যশস্বী জয়সওয়াল এবং পৃথ্বী শ। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
শেষ বার দেখা হয়েছিল ৯ নভেম্বর, ২০১৭। তারিখটা এখনও মনে আছে কোচ জ্বলা সিংহের। ওই দিন পৃথ্বী শ-এর জন্মদিন ছিল। তার কিছু দিন পরেই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক হিসাবে চলে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপ খেলতে। জিতে ফেরার পর থেকে আর কোচের সঙ্গে দেখা করেননি। সে ভাবে কথাও হয়নি। খারাপ লেগেছিল জ্বলার। তবে সেই আঘাতে মলম লাগিয়েছেন তাঁর অন্য ছাত্র যশস্বী জয়সওয়াল। জ্বলার আক্ষেপ মিটিয়ে দিয়েছেন বাঁহাতি ওপেনার।
পৃথ্বী এবং যশস্বীর বয়সের ফারাক দু’বছরের। ২৫ বছরের পৃথ্বী ভারতীয় দল থেকে অনেক দূরে। আইপিএলের নিলামে দল পাননি। মুম্বইয়ের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে দল থেকে বাদ পড়তে হয়েছে। সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে সুযোগ পেলেও রান পাচ্ছেন না। সেখানে ২৩ বছরের যশস্বী অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ১৬১ রানের ইনিংস খেলে দলকে জেতাচ্ছেন। রান করার জমি তৈরি করে দিচ্ছেন বিরাট কোহলির মতো ক্রিকেটারকে। দুই ওপেনারকেই খুব কাছ থেকে দেখেছেন কোচ জ্বলা। প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। তাই বুঝতে পারছেন ফারাকটা কোথায়।
এক সময় পৃথ্বীর তুলনা করা হত সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে। ভারতের হয়ে টেস্ট অভিষেকে শতরান করেছিলেন মুম্বইয়ের ওপেনার। কিন্তু মাত্র পাঁচটি ম্যাচ খেলেই থমকে গিয়েছে তাঁর টেস্ট কেরিয়ার। সাদা বলের ক্রিকেটেও দেশের হয়ে শেষ খেলেছেন ২০২১ সালে। শেষ তিন বছরে পৃথ্বীর ক্রিকেট কেরিয়ারের গ্রাফ শুধুই নিম্নমুখী। তবে খবরের শিরোনাম থেকে সরেননি। দামি গাড়ি, নৈশপার্টিতে বার বার ডুব দিয়েছেন পৃথ্বী। ফিটনেসকে সে ভাবে গুরুত্ব দেননি। তাঁর ব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
২০২০ সালে অসত্য কথা বলে ধরা পড়েছিলেন অজিঙ্ক রাহানের কাছে। তখন তিনি ভারতীয় দলে। চোট লেগেছে বলে ফিল্ডিং করছিলেন না পৃথ্বী। অথচ তাঁর কোনও চোটই লাগেনি। অনুশীলনে ফিল্ডিং করবেন না বলে চোট লাগার অভিনয় করেছিলেন। এটা ধরে ফেলেছিলেন রাহানে। এই ঘটনার পর ভারতীয় দল পৃথ্বীর উপর থেকে আশ্বাস হারায়। সেই সঙ্গে ইয়ো-ইয়ো পরীক্ষায়ও (এটি এক ধরনের ফিটনেস পরীক্ষা। ভারতীয় ক্রিকেটারদের এই পরীক্ষায় অন্তত ১৬.১ নম্বর পেতে হয় পাশ করার জন্য।) উত্তীর্ণ হতে পারেননি তিনি। ফলে দল থেকে বাদ পড়তে হয়েছিল। মাঠের বাইরের জীবনে এতটাই মেতে উঠেছিলেন পৃথ্বী যে, ফিটনেস ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। তাঁর ওজন যে বাড়ছিল তা ছবিতে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে। গত বছর ইডেনে বাংলার বিরুদ্ধে রঞ্জি ম্যাচে খেলেছিল মুম্বই। সেই ম্যাচে পৃথ্বী যখন মুম্বইয়ের হয়ে নেমেছিলেন, তখন সাংবাদিককুল প্রথমে তাঁকে চিনতেই পারেননি। সাংবাদিকদের দোষ ছিল না। প্রায় ফুটবলের মতো চেহারা হয়ে যাওয়া পৃথ্বীকে দেখে আর যা-ই হোক, খেলোয়াড় বলে মনে হচ্ছিল না।
২০২১ সালে পৃথ্বীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন রিকি পন্টিং। দিল্লি ক্যাপিটালসের কোচ ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। সেই দলের ওপেনার ছিলেন পৃথ্বী। অনুশীলনে ভারতীয় ব্যাটারকে নেটে বাড়তি সময় কাটাতে বলেছিলেন পন্টিং। কিন্তু ফর্মে না-থাকা পৃথ্বী তা মানেননি। তাঁর আচরণ পন্টিংকে খুশি করতে পারেনি। এ বারের আইপিএলের নিলামে পৃথ্বীকে কোনও দলই কেনেনি। জাতীয় দলের পর আইপিএল থেকেও দূরে চলে গেলেন তিনি।
২০২৩ সালে পৃথ্বীর নাম জড়িয়ে গিয়েছিল প্রভাবী স্বপ্না গিলের সঙ্গে। তাঁর বুকে এবং হাতে নাকি মেরেছিলেন পৃথ্বী। এমন অভিযোগই করেছিলেন স্বপ্না। টাকা দিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ করেছিলেন তরুণী। যদিও পৃথ্বীর অভিযোগ ছিল নিজস্বী তুলতে না-চাওয়ায় স্বপ্না তাঁকে মেরেছিলেন। আদালত পর্যন্ত গড়ায় সেই মামলা।
ছোটবেলায় পৃথ্বী এমন ছিলেন না। কোচ জ্বলা জানিয়েছেন, ক্রিকেট অন্তপ্রাণ ছিল তাঁর ছাত্র। পৃথ্বীর বাবাও ছেলেকে তৈরি করার দিকে বিশেষ নজর রাখতেন। কিন্তু ২০১৮ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ের পরেই সব কিছু কেমন বদলে গিয়েছিল। মাথা ঘুরে গিয়েছিল পৃথ্বীর। আনন্দবাজার অনলাইনকে জ্বলা বললেন, “২০১৫ সালে পৃথ্বী আমার কাছে প্রথম এসেছিল। প্রতি দিন বিকেল ৪টে নাগাদ ওর বাবা ফোন করতেন। জানতে চাইতেন ছেলেকে আমার কাছে পাঠাবেন কি না। আমিও ডেকে নিতাম। প্রতিভা ছিল ছেলেটার মধ্যে। তৈরি করছিলাম নিজের মতো করে। ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে জায়গা পেয়েছিল আমার প্রশিক্ষণে থাকার সময়ই। মুম্বই দলেও জায়গা পেয়েছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে ওর জন্মদিনের পর আর দেখা হয়নি।”
২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছিল অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ। ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন পৃথ্বী। প্রথম ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৯৪ রান করেছিলেন। ৬ ম্যাচে ২৬১ রান করেছিলেন। গড় ছিল ৬৫.২৫। তাঁর মধ্যে আগামী দিনের তারকা হওয়ার সব রকম সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল। বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক হিসাবে দেশে ফিরতেই জায়গা পেয়ে গিয়েছিলেন আইপিএলে। দিল্লি ক্যাপিটালস তাঁকে দলে নিয়েছিল। সাত বছরে আইপিএলে ৭৯ ম্যাচে করেছেন ১৮৯২ রান। শেষ তিন বছর নিয়মিত দলে জায়গা পাননি। জ্বলা বললেন, “অনেক সুযোগ পেয়েছে পৃথ্বী। কিন্তু নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী খেলতে পারেনি। আমার ছাত্রেরা আমার সন্তানের মতো। পৃথ্বী খারাপ খেললে আমার খারাপ লাগে। কিন্তু ওর মনে হয় ক্রিকেট থেকে মন সরে গিয়েছে। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতে ফেরার পর থেকে আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি। দেখা করা তো দূর, ফোনও করেনি। আমি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সে ভাবে উত্তর পাইনি। আমার কাছে আর প্রশিক্ষণ নিতে আসেনি। এখন ও মানসিক ভাবে কোন জায়গায় আছে তা বলতে পারব না। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে ও পিছিয়ে পড়ছে। পৃথ্বীর সঙ্গে খেলা শুভমন গিল, অভিষেক শর্মা বা ওর থেকে ছোট যশস্বীরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে।”
পৃথ্বীর মন ক্রিকেটের বাইরে বেশি বলেই মনে করছেন তাঁর কোচ। একমত পৃথ্বীর ছোটবেলার কোচ সন্তোষ পিঙ্গুতকরও। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ের পর টাকা এবং খ্যাতি বাড়তে থাকে পৃথ্বীর। এটাই ক্রিকেট থেকে তাঁর মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয় বলে মত কোচদের।
যশস্বীকে ছোটবেলা থেকে তৈরি করেছেন জ্বলা। পৃথ্বী ১৬ বছর বয়সে তাঁর কাছে এসেছিলেন। যশস্বী আরও অনেক কম বয়স থেকে জ্বলার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। জ্বলার বাড়িতেই থাকতেন বাঁহাতি ওপেনার। জ্বলা বললেন, “যশস্বী ক্রিকেট নিয়েই থাকে। বড় রান করতে ভালবাসে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্রিজ়ে সময় কাটানোর দিকে মন দেয়। শতরান করে ভাবে দেড়শো করার কথা, দ্বিশতরান করার কথা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করে যায়। খাওয়াদাওয়ার দিকে নজর দেয়। রান না পেলে নেটে বেশি ক্ষণ সময় কাটায়। ওর মনঃসংযোগ, একাগ্রতা, খেলার ইচ্ছা শেখার মতো।” পৃথ্বীর মধ্যে যে জিনিসগুলোর অভাব দেখেন জ্বলা, সেগুলিই দেখছেন যশস্বীর মধ্যে। আগামী দিনে বড় তারকা হওয়ার ক্ষেত্রে যশস্বীর উপর বাজি ধরছেন জ্বলা।
২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জ্বলার প্রশিক্ষণে অনুশীলন করেছেন পৃথ্বী। তিন বছরে বহু শনিবার বাড়ি নিয়ে গিয়ে তরুণ ব্যাটারকে চাইনিজ় খাইয়েছেন তাঁর কোচ। সেই সময় ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকা ছাত্রকে আবার ফিরে পেতে চান জ্বলা। বললেন, “পৃথ্বীর মধ্যে প্রতিভা রয়েছে। অভাব শুধু মনোযোগ আর ভাল খেলার ইচ্ছার। ও যদি সেগুলো ফিরিয়ে আনতে পারে, তা হলে আবার ফিরবে। মাত্র ২৫ বছর বয়স ওর। এখনও মুম্বই দলে খেলার সুযোগ পাচ্ছে। রান করতে হবে। তা হলেই নির্বাচকদের নজরে পড়বে। সকলে ওকে চেনে। জানে ও কতটা ভাল খেলতে পারে। ধারাবাহিক ভাবে রান করলে এবং নিজের স্বভাব বদলে ফেললে পৃথ্বী আবার ভারতীয় দলে ফিরতে পারে। তবে লড়াইটা বেড়ে গিয়েছে। শুভমন, যশস্বীরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। ওদের ধরতে গেলে অনেকটা পথ দৌড়তে হবে পৃথ্বীকে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy