ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলা বৈভব সূর্যবংশী। ছবি: পিটিআই।
রোজ অনুশীলনের সুযোগ হত না। কারণ, বিহারের সমস্তিপুরের বাড়ি থেকে পটনার অ্যাকাডেমির দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। তাই বাবা ছেলেকে অ্যাকাডেমিতে নিয়ে আসতেন এক দিন অন্তর। ছেলেকে ক্রিকেটার তৈরি করার স্বপ্ন দেখা এবং তার জন্য জমি বিক্রি করে দেওয়া বাবা যে দিন নিয়ে আসতেন, সে দিন সেই ছেলে ৫০০ বল না খেলে নেট ছাড়ত না। ১৩ বছরের সেই বৈভব সূর্যবংশী সাধারণ ক্রিকেট অ্যাকাডেমি থেকে রাজস্থান রয়্যালসের নেটে এবং সেখান থেকে ছ’দিনের মধ্যে ঢুকে পড়ল আইপিএলে।
সোমবার আইপিএলের নিলামে রাজস্থান এবং দিল্লি ক্যাপিটালসের মধ্যে লড়াই হল বৈভবকে নিয়ে। দুই দলই তাকে নেওয়ার জন্য ঝাঁপাল। যে কারণে ৩০ লক্ষ থেকে তার দাম পৌঁছে গেল ১ কোটি ১০ লক্ষ টাকায়। শেষ পর্যন্ত রাজস্থানই নিল ১৩ বছর ২৪৩ দিনের বৈভবকে।
বৈভবের বাড়ি বিহারের সমস্তিপুরের তাজপুরে। চার বছর বয়সে বাবার হাত ধরে ক্রিকেট শেখা শুরু তার। সাড়ে সাত বছর বয়সে বৈভবের বাবা সঞ্জীব তাকে নিয়ে যান পটনার এক ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে। সেখানেই কোচ সৌরভ কুমার প্রথম দেখেন বৈভবকে। অবাক হয়ে গিয়েছিলেন এত কম বয়সে তার ব্যাটিং দেখে। নেটে নামার জন্য ছটফট করত বৈভব। আর সেখানে তার বয়সি বোলারেরা প্রায় পাত্তাই পেত না। বড়দের সঙ্গে খেলানো হত বৈভবকে। আনন্দবাজার অনলাইনকে সৌরভ বললেন, “আমরা জানতাম নিলামে রাজস্থান ওর জন্য ঝাঁপাবে। প্রায় সব দলই বৈভবের খেলার ভিডিয়ো চেয়েছিল। দিল্লি আর রাজস্থান ট্রায়ালেও ডাকে। ১৯ নভেম্বর রাজস্থানের ট্রায়ালে গিয়েছিল বৈভব। পাঁচ দিনের মধ্যে ওরাই কিনে নিল ওকে।”
মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে বৈভব। বাবা কৃষক। একটি দোকানও আছে। জমি বিক্রি করে ছেলের ক্রিকেট শেখার খরচ জুগিয়েছেন সঞ্জীব। সমস্তিপুর থেকে ভোর ৪টের সময় বেরোতে হয়। পটনা পৌঁছতে সাড়ে ৭টা বেজে যায়। সেখানে কোচ মণীশ ওঝার কাছে প্রশিক্ষণ নেয় বৈভব। কাকভোরে খাবার বানিয়ে দেন বৈভবের মা। মণীশ বললেন, “সমস্তিপুরে বৈভবের বাড়ি থেকে পটনায় আমার অ্যাকাডেমির দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। প্রতি দিন অনুশীলন করতে আসা সম্ভব ছিল না। এক দিন অন্তর আসত ও। তবে যে দিন আসত অন্তত ৫০০ বল খেলত।”
নিজের সঙ্গে কিছু বোলার নিয়ে আসত বৈভব। বিভিন্ন শট খেলার অনুশীলন চলত সারা দিন ধরে। খেলার এবং শেখার ইচ্ছা এতই প্রবল ছিল যে, সময়ের হিসাব থাকত না। মণীশ বললেন, “আমার কাছে আসা ছেলেদের আমি সাধারণত ১০০-২০০ বল খেলাই। বৈভব খেলত ৫০০ বল। এই বয়সটা ক্রিকেটারদের শেখার সময়। ও এত খেলে বলেই দ্রুত শিখতে পারে। একজন ক্রিকেটার যত বল খেলবে, তত শিখবে। তবে বেশি বল খেললেই সকলে যে শিখবে সেটা নয়। নেওয়ার ক্ষমতা এবং ইচ্ছেটাও প্রয়োজন। সেটা বৈভবের প্রবল।”
নিলামের আগেই আলোচনায় উঠে এসেছিল বিহারের কিশোর ব্যাটারের নাম। নিলামের তালিকায় কনিষ্ঠতম ক্রিকেটার হিসাবে ছিল বৈভবই। তার ন্যূনতম দাম ছিল ৩০ লাখ টাকা। নিলামের সঞ্চালিকা মল্লিকা সাগর বৈভবের নাম ঘোষণা করতেই আগ্রহ দেখান দিল্লি কর্তৃপক্ষ। তাঁদের সঙ্গে টাকার যুদ্ধে নামেন রাজস্থান রয়্যালস কর্তৃপক্ষ। রাজস্থানকে নিলামে নেতৃত্ব দেন কোচ রাহুল দ্রাবিড় নিজে। দিল্লির হাতে সে সময় ছিল ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ১৮ জন ক্রিকেটারকে নেওয়া ছিল তাদের। অন্য দিকে, রাজস্থানের হাতে ছিল ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তাদের কেনা হয়েছিল ১৬ জন ক্রিকেটার। তুলনায় বেশি টাকা হাতে থাকায় সম্ভবত ভবিষ্যতের লগ্নি হিসাবে এগিয়ে যান রাজস্থান কর্তৃপক্ষ। তাঁরা ১ কোটি ১০ লাখ টাকা দাম দিতে লড়াই থেকে সরে যেতে বাধ্য হয় দিল্লি। তাতেই নতুন ইতিহাস তৈরি হল আইপিএলে।
বৈভবের দুই কোচ উচ্ছ্বসিত দ্রাবিড়কে তাঁদের ছাত্র কোচ হিসাবে পাওয়ায়। দ্রাবিড় মানেই তরুণ ক্রিকেটারদের তুলে আনার কাহিনি। জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে থাকার সময় দ্রাবিড়ের হাত ধরেই তৈরি হয়েছিলেন যশস্বী জয়সওয়াল, শুভমন গিলের মতো ক্রিকেটার। ভারতীয় দলের কোচ থাকার সময়ও তরুণ ক্রিকেটারদের সুযোগ দিয়েছেন। রাজস্থান রয়্যালস ইতিমধ্যেই বৈভবকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছে। দ্রাবিড় হয়তো চাইছেন না বৈভবের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটুক। তার যত্ন নেওয়া শুরু করে দিয়েছে রাজস্থান। বৈভবের কোচ সৌরভ বললেন, “দুর্দান্ত সুযোগ। দেশের অন্যতম সেরা কোচ দ্রাবিড়। তার সঙ্গে সাজঘর ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ পাবে বৈভব। অনেক কিছু শিখতে পারবে। এত কম বয়সে দ্রাবিড়ের মতো কোচের সান্নিধ্য পাওয়াটা বিরাট ব্যাপার।” একই মত কোচ মণীশেরও।
১২ বছর ২৮৪ দিন বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় মিডল অর্ডার ব্যাটার বৈভবের। ২১১ দিনের জন্য রেকর্ড গড়া হয়নি তার। ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার নজির রয়েছে রাজপুতানার প্রাক্তন ক্রিকেটার আলিমুদ্দিনের। তার আগে ভারতের অনূর্ধ্ব ১৯ ‘বি’ দলের হয়ে ভাল পারফরম্যান্স করেছিল সে। ভাল খেলেছিল বিনু মাঁকড় ট্রফিতেও। সেই প্রতিযোগিতায় পাঁচ ম্যাচে ৪০০-র বেশি রান করে সে। গত ১ অক্টোবর বেসরকারি টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার অনূর্ধ্ব ১৯ দলের বিরুদ্ধে ৫৮ বলে শতরান করে আলোচনায় উঠে আসে ১৩ বছরের বৈভব। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের লাল বলের ক্রিকেটে ভারতের হয়ে এটাই দ্রুততম শতরান। ইনিংসে ছিল ১৪টি চার ও চারটি ছয়। স্ট্রাইক রেট ১৬৭.৭৪।
এত কম বয়সে বড় বড় কীর্তি গড়ে ফেলা বৈভবকে নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্কও। অনেকের অভিযোগ সে নাকি বয়স ভাঁড়িয়ে খেলছে। কোচ সৌরভ যদিও সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিলেন। তিনি বললেন, “ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড ২০১৯ সালে ওর বয়স পরীক্ষা করেছে। ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ বি দলে খেলেছে। অর্থাৎ, ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ স্তরে বয়সের পরীক্ষা দিয়েছে বৈভব। প্রয়োজনে আবার পরীক্ষা দেবে। ওর বয়সে কোনও ভুল নেই। তবে দিনের শেষে তো ও ভাল ক্রিকেট খেলছে বলে সুযোগ পাচ্ছে। আইপিএলের কোনও দল তো ও কম বয়সের বলে নেয়নি। ভাল খেলতে পারে বলে নিয়েছে। তাই বয়স নিয়ে যাঁরা বলছেন, তাঁদের প্রথমত জেনে কথা বলা উচিত এবং অবশ্যই বৈভবের খেলাটাকে সম্মান করা উচিত।”
বরাবর নিজের বয়সের থেকে বড় বোলারদের বিরুদ্ধে খেলেছে বৈভব। তবে আইপিএলে তার বিপক্ষে থাকবেন মিচেল স্টার্ক, যশপ্রীত বুমরা, যুজবেন্দ্র চহাল, রবিচন্দ্রন অশ্বিনের মতো বোলারেরা। কোচ মণীশ বললেন, “বৈভব ভাবেই না উল্টো দিক থেকে কে বল করছে। বোলার তো বলই করবে। ঘরোয়া ক্রিকেটারদের থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের গতি, সুইং, বাউন্স বেশি থাকতে পারে। দিনের শেষে তাঁরা বল করবেন আর বৈভব ব্যাট করবে। বিপক্ষের পরিকল্পনা বুঝে মোকাবিলা করতে হবে। এটাই তো ক্রিকেটের নিয়ম।”
কোচ জানালেন বৈভবের উচ্চতা প্রায় ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। হাতে নানা ধরনের স্ট্রোক রয়েছে। বয়সের থেকে বড়দের বিরুদ্ধে খেলার সাহস রয়েছে। মণীশ বললেন, “বৈভবের একাগ্রতা, শেখার ইচ্ছা, মনোযোগ এবং ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা প্রবল। খেলাই ওর ধ্যানজ্ঞান। তবে আগামী দিনে সম্পূর্ণ ক্রিকেটার হয়ে ওঠার জন্য কয়েকটা বিষয় শিখতে হবে। ক্রিকেট মানে শুধু চার-ছক্কা নয়, সিঙ্গলসও নিতে হয়। রাজস্থানের ট্রায়ালে ওকে এক ওভারে ১৭ রান করতে বলা হয়েছিল। বৈভব প্রথম তিনটে বলেই ছক্কা মারে। কিন্তু লাল বলের ক্রিকেট খেলতে হলে উল্টো দিকের ক্রিকেটারের সঙ্গে বোঝাপড়া জরুরি, খুচরো রান নেওয়া প্রয়োজন। আগামী দিনে সেগুলো মাথায় রেখে খেলতে হবে বৈভবকে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy