নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৭ উইকেট নিয়ে উচ্ছ্বসিত মহম্মদ শামি। ছবি: পিটিআই
ওয়াসিম আক্রম বলছেন, ‘‘আমি এত ভাল সিমে বল করতে কাউকে দেখিনি। মহম্মদ শামিকে ঘুম থেকে উঠে বল করালেও বোধ হয় এ ভাবেই বল করবে। এক কথায় অবিশ্বাস্য।’’ এমন এক জন শামিকে নিয়ে এ কথা বলছেন যাঁকে খেলোয়াড় জীবনে বলা হত সুইংয়ের সুলতান। তা হলে কি ব্যাটন বদলে গিয়েছে? ওয়াঘার ও পার থেকে তা চলে এসেছে এ পারে? ব্যাটন বদলে গেলেও তা এক দিনে হয়নি। জীবনের মাঠে প্রতি পদক্ষেপে হোঁচট খেলেও ক্রিকেট মাঠে তার প্রভাব কোনও ভাবেই পড়তে দেননি শামি। অনেক অধ্যবসায়, পরিশ্রম, জেদের ফসল ফলছে ইডেন থেকে ওয়াংখেড়েতে।
সেমিফাইনালে নিউ জ়িল্যান্ডের ড্যারিল মিচেল ও কেন উইলিয়ামসন যখন চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন তখন রোহিত শর্মা শেষ তাস খেললেন। সেই শামির হাতেই বল তুলে দিলেন তিনি। নতুন বলের দুই বোলার যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ সিরাজ থাকলেও শামির উপরেই ভরসা দেখালেন তিনি। কেন? আবার ধার করতে হবে আক্রমের কথা। ‘‘শামির সব থেকে বড় অস্ত্র ও নতুন বলের পাশাপাশি কয়েক ওভারের পুরনো বলেও সুইং করাতে পারে। তার থেকে আর একটু বেশি পুরনো বল পেয়ে গেলে শুরু হয় রিভার্স সুইং। এই ধরনের বোলার যে কোনও অধিনায়কের ভরসার জায়গা।’’ সেটাই করছেন রোহিত। শামি আসছেন, উইকেট নিয়ে দলকে লড়াইয়ে ফেরাচ্ছেন। ঠিক যেমনটা করলেন ওয়াংখেড়েতে। প্রথমে আউট করলেন উইলিয়ামসনকে। সেই ওভারেই ফেরালেন টম লাথামকে। সেখানেই শেষ হয়ে গেল নিউ জ়িল্যান্ডের লড়াই। পরে আরও তিনটি উইকেট নিলেও সেমিফাইনালে শামির প্রথম চার উইকেটই ভারতকে ফাইনালে তুলেছে। সে ভারত প্রথমে ব্যাট করে যতই ৩৯৭ করুক না কেন, শামি না থাকলে ম্যাচ শেষে রোহিত হাসিমুখে ওয়াংখেড়ে ছাড়তে পারতেন কি না তা নিয়ে কিন্তু সন্দেহ রয়েছে।
এই শামির শুরুটা কিন্তু সহজে হয়নি। উত্তরপ্রদেশের সহসপুর নামের একটি গ্রাম থেকে উঠে আসা যুবকের স্বপ্ন ছিল ভারতীয় দলে খেলবেন। কিন্তু জাতীয় দল তো দূর, উত্তরপ্রদেশেই সুযোগ পাচ্ছিলেন না তিনি। চলে আসেন বাংলায়। সুযোগও পান। ঘরোয়া ক্রিকেটে ধীরে ধীরে নিজের নাম তৈরি করতে থাকেন। শামির কাছে আশীর্বাদ হয়ে আসে ২০০৮ সাল। আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্স কেনে তাঁকে। দু’বছর ছিলেন শামি। একটি ম্যাচেও খেলেননি। শুধু নেটে বোলিং করেছেন। কিন্তু এই দু’টি বছর তিনি পেয়ে যান আক্রমকে। কেকেআরের বোলিং কোচের কাছ থেকে একলব্যের মতো শিক্ষা নিয়েছেন। নিজেকে তৈরি করেছেন। অপেক্ষা করেছেন সুযোগের। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে (তৎকালীন ফিরোজ শাহ কোটলা) যখন তাঁর অভিষেক হচ্ছে, তখন শামিকে দেখে বোঝা গিয়েছিল তিনি কতটা আত্মবিশ্বাসী। প্রথম ম্যাচেই মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন। সেই বছরই ক্রিকেটের সব ফরম্যাটে ভারতীয় দলে অভিষেক হয়ে যায় তাঁর।
মাঠের জীবনে শামি যতটা হেসেছেন, মাঠের বাইরের জীবনে ততটাই মুখের হাসি উধাও হয়েছে তাঁর। স্ত্রী হাসিন জাহানের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হয়েছে। মেয়েকে নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছেন হাসিন। করেছেন বধূ নির্যাতনের মামলা। বিবাহবিচ্ছেদ চেয়েছেন। এমনকি শামির বিরুদ্ধে ম্যাচ গড়াপেটারও অভিযোগ তুলেছেন তিনি। সে সব একা হাতে সামলেছেন শামি। প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি। স্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। শুধু মন দিয়ে নিজের খেলাটা খেলে গিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনের জন্য তাঁর ক্রিকেট কোনও দিন খারাপ হয়নি।
তার পরেও ধীরে ধীরে ভারতীয় দলে শুধুই টেস্টের বোলার হয়ে গিয়েছিলেন শামি। সাদা বলের ক্রিকেটে সুযোগ পাচ্ছিলেন না। চলতি বিশ্বকাপে যখন সুযোগ পান তখনও শামিকে নেওয়া নিয়ে সমালোচনা হয়। প্রশ্ন ওঠে, প্রায় এক বছর সাদা বলের ক্রিকেট না খেলা শামিকে কী দেখে নিলেন অজিত আগরকরের নেতৃত্বাধীন নির্বাচক কমিটি। এই সিদ্ধান্ত না দলকে ডোবায়! দলে সুযোগ পাওয়ার পরেও শামি বিশ্বকাপ খেলতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। স্ত্রী হাসিনের করা মামলায় আদালতে গিয়ে আগাম জামিন নিতে হয় শামিকে। তবেই খেলার সুযোগ পান বিশ্বকাপে।
প্রথম চার ম্যাচে বেঞ্চ গরম করেছিলেন শামি। বুমরা ও সিরাজের উপর বেশি ভরসা ছিল রোহিতের। সঙ্গে ছিলেন দুই পেসার অলরাউন্ডার হার্দিক পাণ্ড্য ও শার্দূল ঠাকুর। শামি কিচ্ছু বলেননি। শুধু অপেক্ষা করেছেন। হার্দিকের চোট লাগায় বদলে যায় ছবিটা। দলের ভারসাম্য ঠিক রাখতে পঞ্চম ম্যাচে নেওয়া হয় শামিকে। ধর্মশালায় নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচেই শামি নেন ৫ উইকেট। পরের ম্যাচে ৪। পরের ম্যাচে আবার ৫। ব্যস। মুখে কিছু বলতে হয়নি শামিকে। শুধু নিজের বলের সিম ঠিক জায়গায় রেখেছেন। মাঠে আগুন ছুটিয়েছেন। শাসন করেছেন একের পর এক ব্যাটারকে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ভারতের একমাত্র বোলার হিসাবে ৫০ উইকেট নিয়েছেন। চলতি বিশ্বকাপে মাত্র ৬ ম্যাচেই সর্বাধিক ২৩ উইকেট শামির ঝুলিতে। রেকর্ড করে বলেছেন, ‘‘সুযোগের অপেক্ষা করছিলাম। খুব বেশি সাদা বলের ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাইনি। তবে সুযোগ পেলে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি। লিগ পর্বে নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধেই প্রথম সুযোগ পেয়েছিলাম। অনেকে বোলিংয়ে বৈচিত্রের কথা বলেন। কিন্তু আমার লক্ষ্য থাকে শুধু সঠিক জায়গায় বল ফেলা। আমি বিশ্বাস করি ঠিক জায়গায় বল রাখতে পারলে নতুন বলে উইকেট আসবেই। ম্যাচের যে কোনও সময়ই উইকেট আসতে পারে।’’
আসলে শামি মুখে নয়, কাজে করে দেখাতে ভালবাসেন। বার বার সব অবজ্ঞার জবাব দিয়েছেন। নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। যখনই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে কাদা ছেটানো হয়েছে তখনই তাঁর বল আগুন ঝরিয়েছে। হতে পারে এটা বিরাট কোহলির বিশ্বকাপ। হয়তো অধিনায়ক হিসাবে ইতিহাসে নিজের নাম খোদাই করে নেবেন রোহিত শর্মা। হয়তো ক্রিকেটার হিসাবে না পারলেও কোচ হিসাবে বিশ্বকাপ জিতবেন রাহুল দ্রাবিড়। কিন্তু তাঁদের ঠিক পাশেই জ্বলজ্বল করবেন শামি। কারণ, বিরাট, রোহিতের পাশাপাশি ভারতের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন অনেকটাই নির্ভর করছে তাঁর কাঁধে। আর নিজের কাজটা চুপচাপ করে যাচ্ছেন তিনি। যেমনটা সব সময়ই করে থাকেন।
অপেক্ষা রবিবারের। সে দিনই বিশ্বের সব থেকে বড় মাঠে হাসিমুখে নিজের ক্রিকেট জীবনের সেরা স্পেলটা করার লক্ষ্যে দৌড় শুরু করবেন শামি। বলটা স্টাম্প ভেঙে দিতেই ছুটে এসে তাঁকে কোলে তুলে নেবেন রোহিত। আর শামির প্রতিটি উইকেট গোটা দেশের স্বপ্নকে একটু একটু করে বাস্তবের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এখন থেকেই এই স্বপ্নটা দেখতে শুরু করে দিয়েছেন সুইংয়ের নতুন সুলতান। বিশ্বজয়ের স্বপ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy