দু’প্রান্তে: রবিবার কলকাতায় সিএবি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। মেলবোর্নে ভারতকে জিতিয়ে উচ্ছ্বাস কোহলির। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক, টুইটার
বিরাট কোহলির অবিশ্বাস্য ইনিংস দেখে অভিভূত। বলে দিচ্ছেন, কোনও বিশেষণই যথেষ্ট নয়। ভারতের জয়ে আপ্লুত হয়ে সতর্ক। মনে করিয়ে দিতে চান, বিশ্বকাপে প্রত্যেকটা ম্যাচই অগ্নিপরীক্ষা। একই দিনে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সিএবি প্রেসিডেন্ট পদে না দাঁড়ানোর। ইডেনে সারাদিনের ব্যস্ততার পরে বাড়ি ফিরে রাতের দিকে কোহলি এবং ভারতের জয় নিয়ে আনন্দবাজার-কে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: ভারতের এই জয় নিয়ে কী বলবেন?
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়: দুর্দান্ত জয়। দারুণ খেলেছে আমাদের টিম। খুবই কঠিন পরিস্থিতি ছিল। ১৬০ রানের টার্গেট ছিল, ৩১-৪ হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে দারুণ ভাবে ম্যাচে ফিরে এল। বিরাট অসাধারণ, যে ভাবে শেষ পর্যন্ত থেকে জেতাল, অনবদ্য! ভারত-পাকিস্তান এমনিতেই হাইপ্রেশার ম্যাচ। তার উপরে এ দিনেরটা আরও বেশি চাপের হয়ে গিয়েছিল কারণ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিলাম আমরা।
প্র: শুরুতেই ব্লকবাস্টার এবং কী অসাধারণ জয়! বিশ্বকাপ ভারত-পাক ম্যাচ দিয়ে সুপারহিট শুরু, সকলে সেটাই বলছে।
সৌরভ: টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মজা তো সেটাই। কম ওভারের খেলা, উত্তেজনায় ঠাসা। ম্যাচ খুব কঠিন হয়ে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে, হয়তো ধরে নিচ্ছি এই টিমটা জিতবে, তার পরেই দুর্দান্ত খেলে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিচ্ছে কেউ। কেউ ভাবতে পারবে না, এমন পরিস্থিতি থেকে ম্যাচ ঘুরে যাচ্ছে। রবিবার মেলবোর্নে সে রকমই একটা দ্বৈরথ দেখল সকলে। এ রকম ম্যাচ দেখার জন্যই তো লোকে মাঠে আসে, টিভির সামনে থেকে নড়তে পারে না।
প্র: বিরাট কোহলির ইনিংস নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ কী?
সৌরভ: ফ্যানটাস্টিক। এত চাপের মুখে যে রকম ব্যাট করল, তার তুলনা হয় না। কোনও বিশেষণই হয়তো যথেষ্ট হবে না।
প্র: এটাকে কি আপনার দেখা কোহলির সেরা ইনিংস বলবেন?
সৌরভ: আমি এর চেয়েও ভাল খেলতে দেখেছি বিরাটকে। ও এমন মাপের ব্যাটসম্যান যাকে নিয়ে নির্দিষ্ট করে বলা খুব কঠিন যে, এটাই সেরা ইনিংস বা ওটাই সেরা ইনিংস। বিরাটের অনেক ভাল ইনিংসই রয়েছে। অনেক ম্যাচেই অবিশ্বাস্য খেলে জিতিয়েছে। আর ওর রেকর্ড দেখলেই তো সেটা বোঝা যাবে।
প্র: এই মুহূর্তে কোহলির আর কোন স্মরণীয় ইনিংসের কথা মনে পড়ছে?
সৌরভ: অনেকই আছে। কোনও একটা-দু’টোকে বাছা প্রায় অসম্ভব। অ্যাডিলেডে ২০১৫ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে এ রকমই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ ছিল। কোহলি সেঞ্চুরি করেছিল। দারুণ ব্যাট করেছিল। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ, পাকিস্তানকে হারিয়ে ভাল শুরু করেছিল ভারতীয় দল। এই ধরনের সেঞ্চুরির প্রভাব অন্য রকম হয়। ঢাকায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এশিয়া কাপে বড় সেঞ্চুরি ছিল (১৮৩)। বিধ্বংসী ব্যাটিং করেছিল।
প্র: কোহলি কেন অনন্য? কী মনে হয় আপনার?
সৌরভ: এক কথায়, বিশেষ প্রতিভা। আমাদের সময় থেকে কয়েক জন বিশেষ প্রতিভা দেখেছি। সচিন (তেন্ডুলকর), রাহুল (দ্রাবিড়)। কোহলিও সে রকমই বিশেষ প্রতিভাসম্পন্ন। সাদা বলের ক্রিকেটে তো অতুলনীয়। কী সব ইনিংস খেলেছে, কী সব ম্যাচ জিতিয়েছে!
প্র: বিশেষ করে যখন রান তাড়া করার সময়? যে কারণে নামকরণ হয়ে গিয়েছে ‘চেজ়মাস্টার’?
সৌরভ: শুধুই রান তাড়া করার সময় বিরাট সেরা, সেটা আমি মানি না। রান তাড়া করি বা প্রথমে ব্যাট করি, বিরাট অসাধারণ। না হলে এত রান করতে পারে! আজও তেমনই একটা ইনিংস খেলল। চাপের মুখে ওই ইনিংস, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ, সকলের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা ব্যাটিং। অনবদ্য, অনবদ্য!
প্র: হ্যারিস রউফকে ১৯তম ওভারে কোহলির মারা দু’টো ছক্কাই কি আপনার মতে টার্নিং পয়েন্ট?
সৌরভ: হ্যাঁ, যদি কোনও একটা মুহূর্তকে বাছতেই হয় টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে, তা হলে ওই দু’টো ছক্কা। তবে এ রকম ম্যাচে একটা মুহূর্তকে বাছা কঠিন। আমার মতে, শেষ দুই ওভারে প্রত্যেকটা বলই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রত্যেকটা বল, প্রত্যেকটা রান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ ধরনের ক্লোজ় ম্যাচে একটু-ওদিক হলেই তো খেলা ঘুরে যেতে পারে।
প্র: শেষ তিন ওভারে দরকার ছিল ৪৮। শেষ ৮ বলে ২৮, দুই ছক্কায় কোহলি সেটাকে করে দিলেন ছয় বলে ১৬। তার পর শেষ ওভারের ওই নাটক..
সৌরভ: হ্যাঁ, সেই কারণেই ওই দু’টো ছক্কাকে বাছতে হবে। কারণ ওই ১২ রানের পরে সমীকরণটা অনেকটা ঘুরে গিয়েছিল। কিন্তু এটাও ঠিক যে, তার পরেও কাজ শেষ হয়নি। শেষ ওভারেও ১৬ রান তুলতে হয়েছে। সেই কারণেই বলছি, শেষ দু’ওভারের প্রত্যেকটা বল গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
প্র: কী মনে হচ্ছে, এই জয় কি এ বারের বিশ্বকাপে ভাল কিছুর ইঙ্গিত?
সৌরভ: অবশ্যই। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ সব সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাতে একটা সুর তৈরি হয়ে যাওয়ার ব্যাপার থাকে। তার উপরে প্রথম ম্যাচ যদি হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আর এ রকম হাড্ডাহাড্ডি, রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে ম্যাচ জেতা যায় শেষ ওভারে, তা হলে সেই জয় দলের আত্মবিশ্বাস নিশ্চয়ই অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। আমি নিশ্চিত, রোহিতদের ড্রেসিংরুমেও বিশ্বাস অনেক বেড়ে যাবে এইজয়ের পরে।
প্র: ২০১১-র পরে আর বিশ্বকাপ জেতেনি ভারত। আর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপই জিতেছে শুধু প্রথম বার, সেই ২০০৭-এ। এত বছরের বিশ্বকাপ খরা কি এ বার মিটতে পারে?
সৌরভ: হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। ভারতীয় দলে প্রতিভার গভীরতা অনেক বেশি। কী সব ম্যাচউইনার রয়েছে দলটায়! তাই সব সময়ই অন্যতম ফেভারিট। হয়তো টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ দেখেই বলে দেওয়া যায় না, এই টিমটাই চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের ভাল সম্ভাবনা রয়েছে জেতার। ভাল খেলে যেতে হবে। বিশ্বকাপে সফল হতে গেলে ধারাবাহিক ভাবে ভাল খেলে যেতে হয়। ওটাই আসল।
প্র: আজকের এই দুর্দান্ত জয়ের আনন্দ ক্ষণিকের জন্য সরিয়ে রেখে আর এক বার মনে করিয়ে দেওয়া যাক, গত কয়েকটি বিশ্বকাপেও ভাল শুরু করেছে দল। জয় দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। তার পরে কিন্তু স্বপ্নপূরণ নয়, স্বপ্নভঙ্গ হয়ে ফিরেছে। এ বারে কী করতে হবে কাপ জিততে গেলে?
সৌরভ: আশা করব, আমাদের উপরের দিকের ব্যাটসম্যানেরা রান করবে। ৩১-৪ হয়ে যাওয়ার পরে এ দিন বিরাট আর হার্দিক দারুণ ম্যাচে ফিরিয়ে আনে দলকে। ওদের লড়াই ম্যাচটাকে শেষ ওভার পর্যন্ত নিয়ে গেল। হার্দিকও দারুণ খেলল, আইপিএল থেকেই খুব ভাল খেলছে। বিরাট শেষ পর্যন্ত থেকে জিতিয়েছে। তবে বিশ্বকাপ লম্বা টুর্নামেন্ট, সকলকে ভাল খেলতে হয়। আশা করব টপ অর্ডারও দক্ষতা অনুযায়ী খেলবে।
প্র: পাকিস্তান ম্যাচ কোথায় আলাদা? চাপের জন্য? আপনি তো এত পাকিস্তান ম্যাচ খেলেছেন, পাকিস্তানে জিতেছেন অধিনায়ক হিসেবে। এই বিশেষ ম্যাচটায় সফল হতে গেলে কী দরকার হয়?
সৌরভ: মাঠে নেমে দক্ষতার সুবিচার করা। এর মধ্যে কোনও রকেট সায়েন্স নেই। ক্রিকেটের মুখ্য জিনিসগুলো ঠিকঠাক করতে হবে। ব্যাটিং ভাল করো, বোলিং ভাল করো, ফিল্ডিং ভাল করো।
প্র: কিন্তু পাকিস্তান ম্যাচের একটা আলাদা চাপ তো থাকেই, তাই না?
সৌরভ: তা থাকে। কিন্তু খেলতে খেলতে ক্রিকেটারেরা অভ্যস্তও হয়ে যায়।
প্র: সব মিলিয়ে ভারতীয় দলকে প্রথম ম্যাচে দেখে কেমন লাগল?
সৌরভ: প্রথম ম্যাচে তো দারুণ খেলেছে, সন্দেহ নেই। তবে বিশ্বকাপ জিততে গেলে প্রত্যেক ম্যাচে ভাল খেলতে হয়। তাই একটা জয়ে খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ার দরকার নেই। ইয়েস, আমরা পাকিস্তানকে হারিয়েছি, দারুণ শুরু করেছি, দুর্দান্ত জিতেছি। নিশ্চয়ই আনন্দ করব। কিন্তু বিশ্বকাপ জিততে গেলে প্রায় সব ম্যাচই জিততে হয়। জয়ের স্রোতের মধ্যে থাকতে হয়। এখানে দু’টো গ্রুপ থেকে দু’টো করে দল যাবে সেমিফাইনালে। কোনও দলই খারাপ নয়। এশিয়া কাপেও কিন্তু আমরা পাকিস্তানকে হারিয়ে শুরু করেছিলাম। তার পর গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিলাম। তাই আমি বলব, এক-একটা ম্যাচ ধরে এগোও আর মনে রাখো, প্রত্যেকটা ম্যাচই গুরুত্বপূর্ণ। দেখতে হবে যেন আত্মতুষ্টি না চলে আসে। বাইরে যতই সমর্থকরা আনন্দ করুক, টিমকে মনে করতে হবে, আমরা ভাল শুরু করেছি মাত্র। এখনও অনেক কাজ বাকি, অনেক খেলা বাকি।
প্র: অস্ট্রেলিয়ায় এই বিশ্বকাপ জেতার ব্যাপারে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী হতে যাচ্ছে?
সৌরভ: ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং সব কিছুই ভাল করতে হবে। এমন নয় যে, কোনও একটা বিভাগ একটু কম করলাম, তাতেও চলে যাবে। বিশ্বকাপ এমন টুর্নামেন্ট যেখানে টিম হিসেবে ভাল খেলবে হবে, ধারাবাহিক ভাবে ভাল খেলতে হবে। আমাদের দলে প্রতিভার অভাব নেই। আশা করব, উপরের দিকের ব্যাটসম্যানেরা রান করবে। তা হলে আমাদের টিমকে আরও শক্তিশালী দেখাবে।
প্র: ঋষভ পন্থকে কি খেলানো উচিত?
সৌরভ: এটা টিম ঠিক করুক। আমি মন্তব্য করতে চাই না।
প্র: কিন্তু ব্যাটিং অর্ডারে এক জন বাঁ হাতি থাকলে কি ভাল হয়?
সৌরভ: নির্ভর করে সেই বাঁ হাতি কেমন খেলছে তার উপরে। সে যদি ভাল খেলে তা হলে উপকার হতে পারে।
প্র: আপনার মতে এ বারের বিশ্বকাপের ফেভারিট দল কারা?
সৌরভ: কী ফেভারিট বাছব! কেউ ভাবতে পেরেছিল, প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে এ ভাবে উড়িয়ে দেবে নিউজ়িল্যান্ড! আমি পূর্বাভাস, ফেভারিটের মধ্যে নেই। প্রত্যেকটা ম্যাচে দেখতে থাকো কী হয়।
প্র: একটা অন্য প্রশ্ন। সিএবি-তে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে চেয়েও সরে এলেন কেন? সিদ্ধান্ত বদল কেন?
সৌরভ: সিএবি-তে আর নির্বাচনই হচ্ছে না, তাই প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্ন নেই। আমি আগে সিএবি প্রেসিডেন্ট হয়েছি। আর প্রেসিডেন্ট পদে বসতে চাইনি, কারণ মনে হল, অন্যরাও সুযোগ পাক।
প্র: ক্রিকেট প্রশাসনে কি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে ফিরে আসতে দেখা যাবে?
সৌরভ: দেখা যাক কী হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy