ত্রাতা: সেঞ্চুরির পথে পূজারা। শুক্রবার সাউদাম্পটনে। ছবি: এএফপি।
চেতেশ্বর পূজারাকে পুজো-প্রার্থনা করা শিখিয়েছিলেন তাঁর মা রিনা পূজারা। লক্ষ্য ছিল, ছেলের মনকে শান্ত রাখা। মাঝেমধ্যে মা এমনও বলতেন যে, পুজো করলে তবেই ক্রিকেট খেলতে যেতে দেব।
রিনা পূজারা আর এই পৃথিবীতে নেই। ক্যানসারের সঙ্গে তাঁর লড়াই যখন শেষ হয়, ছেলের বয়স ১৭। তার ঠিক পাঁচ দিন পরে সৌরাষ্ট্রের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ ম্যাচ খেলার কথা তাঁর। মাকে হারিয়ে সেই ম্যাচ তো দূরের কথা, ক্রিকেট মাঠেই আর যাওয়ার মতো মনের অবস্থা নেই। সদ্য স্ত্রীকে হারানো অরবিন্দ পূজারা জোর করে ছেলেকে খেলতে পাঠান। তার পর থেকে বাবা-মার দ্বৈত ভূমিকা সামলে গিয়েছেন তিনি।
সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট তৈরি করে মায়ের মতো খাইয়ে দিয়ে স্কুলে পাঠাতেন ছেলেকে। তার পর স্কুল থেকে দুপুরে ফিরলে তাঁকে নিয়ে চলে গিয়েছেন ক্রিকেট কোচিং সেন্টারে। দিনের পর দিন বল ছুড়ে ছুড়ে ব্যাটিং প্র্যাক্টিস করিয়ে গিয়েছেন। আর সেই প্র্যাক্টিসে কপিবুক ব্যাটিং ছাড়া অন্য কোনও এলোপাথাড়ি শট কখনও মারতে দেননি। কড়া অনুশাসনে বিশ্বাসী অরবিন্দ পূজারা ছেলের ক্রিকেটকে তৈরি করেছেন শৃঙ্খলা আর অধ্যবসায়ের মন্ত্রে। ছেলেকে বড় ক্রিকেটার তৈরি করবেন বলে মুম্বইয়ে নিয়ে গিয়েছেন। অল্প টাকার ঘর ভাড়া করে থেকে সেখানে খেলিয়েছেন।
বাবা-মায়ের শিক্ষারই যেন প্রতিফলন দেখা গেল হ্যাম্পশায়ারের মাঠে পূজারার ব্যাটিংয়ে। এক দিকে মায়ের শেখানো পুজো-প্রার্থনার ধৈর্য এবং মনঃসংযোগ। দু’বার হেলেমেটে ঘটাং করে লাগার পরেও যা টোল খায় না। প্রথম বার বেন স্টোকসের বাউন্সার যেটা লাগল, অনেকেই আঁতকে উঠেছিলেন। ফিল হিউজের মৃত্যুর পরে মাথায় বল লাগা মানেই এখন আতঙ্ক তৈরি হয়ে যাওয়া। এমনকি, বোলার স্টোকসও এসে পূজারার কাঁধে হাত রেখে খোঁজ নিলেন, ঠিক আছেন কি না। অধিনায়ক জো রুট এসে কথা বলে গেলেন। ড্রেসিংরুম থেকে দৌড়ে এলেন ভারতীয় দলের ফিজিয়ো। প্রায় দশ মিনিট ধরে শুশ্রূষা চলল। প্রেস বক্সের টিভি-তে দেখা গেল কপালের উপরটা ফুলে উঠেছে। পূজারা তবু মাঠ ছেড়ে গেলেন না। এবং সেই যে জল-টল খেয়ে, হেলমেট পাল্টে নিয়ে ফের দাঁড়িয়ে পড়লেন ব্যাট হাতে, থেকে গেলেন শেষ পর্যন্ত।
যত সময় গেল, মায়ের শিক্ষার পাশাপাশি বাবার শেখানো শৃঙ্খলা আর অধ্যবসায়ও ফুটে উঠতে থাকল। প্রথমে বিরাট কোহালির সঙ্গে চতুর্থ উইকেটে ৯২ রানের পার্টনারশিপ। ৫০ রানের মধ্যে দুই ওপেনারকে হারানোর পরে প্রতিরোধ গড়ার কাজ শুরু। এই প্রজন্মে কোহালির সঙ্গে ব্যাট করা মানে সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে ব্যাট করার মতো। রাহুল দ্রাবিড় এক বার বলেছিলেন, ‘‘সচিনের সঙ্গে ব্যাট করতে গিয়ে প্রথমে মাথায় রাখতে হত, ওকে যেন রান আউট না করে দিই। সারা দিন ধরে গ্যালারির বিদ্রুপ শুনতে হবে। তার পর সারাক্ষণ তুলনার ঝক্কি তো আছেই।’’
একই কথা নিশ্চয়ই পূজারার মাথাতেও ঘোরে। তাঁর নিজের যা রান আউট হওয়ার ইতিহাস! তার উপর ক্রিজে দাঁড়িয়ে যদি দেখতে হয় দলের অধিনায়ক ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে ব্যাট করতে আসছেন, সঙ্গে বডিগার্ড নিয়ে। এমন মহাতারকার সঙ্গে ব্যাট করার ঝক্কি!
পূজারা আধুনিক কালের শক্তিশালী ব্যাটসম্যানদের মতোও নন যে, স্ট্রোকের ফুলঝুরিতে মন জিতে নেবেন। বরং প্রাচীন মতবাদের ছাপ আছে যে, একটা-একটা করে ইট সাজিয়ে পাকাপোক্ত বাড়ি বানিয়ে তুলব। হ্যাম্পশায়ারের মাঠে সেই পুরনো টেস্ট ব্যাটিং মতবাদেরই জয় হল। কখনওসখনও যে হেরে যায় খরগোশের গতি আর জেতে কচ্ছপের একাগ্রতা এবং অদম্য মনোভাব!
একটা সময় ১৪২-২ ছিল ভারত। কোহালি আর পূজারা তখন ম্যাচের রাশ হাতে তুলে নিয়েছেন। কোহালি টেস্টে ছয় হাজার রান পূরণ করে ফেললেন। একমাত্র সুনীল গাওস্কর তাঁর আগে ছয় হাজারের স্টেশনে পৌঁছেছেন। দুর্ধর্ষ সব স্ট্রোক খেলছিলেন। একটা অনড্রাইভ মারলেন স্টুয়ার্ট ব্রডকে। শুধু ব্যাটটা রাখলেন বলের উপরে। এত সুন্দর টাইমিং যে, তৎক্ষণাৎ তীব্র গতিতে বল গিয়ে আছড়ে পড়ল বাউন্ডারিতে। ধারাভাষ্যকারেরা কেউ কেউ বলে উঠলেন, সচিন তেন্ডুলকরকে এ রকম ‘জ্যাব’ করে চার মারতে দেখা যেত।
স্যাম কারেন ব্যাট হাতে ভারতের অশান্তি বাড়িয়েছিলেন। বল হাতে তুলে নিলেন দুষ্প্রাপ্য শিকার। কোহালিকে স্লিপে ক্যাচ দিতে বাধ্য করালেন বাঁ হাতি মিডিয়াম পেসার। কোহালি গেলেন ৭১ বলে ৪৬ করে। আর তার পরেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে শুরু করল ভারতীয় ব্যাটিং। ১৪২-৩ থেকে মুহূর্তে হয়ে গেল ১৯৫-৮। এক-এক জনের কী সব আউটের ভঙ্গি! কেউ রিভার্স সুইপ মারতে গিয়ে উইকেট ছুড়ে দিয়ে গেলেন তো কেউ ক্যাচ প্র্যাক্টিস দিলেন! ঋষভ পন্থের ব্যাটিং কিছু বোঝা গেল না। ২৯ বলে ০! অথচ তিনি নাকি আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান!
সেখান থেকে শেষ দুই ব্যাটসম্যান ইশান্ত শর্মা এবং যশপ্রীত বুমরাকে নিয়ে ৭৮ রান যোগ করলেন পূজারা। নবম উইকেটে ইশান্তকে নিয়ে তুললেন ৩২। শেষ উইকেটে বুমরার সঙ্গে এক ঘণ্টারও উপরে খেলে যোগ করলেন ৪৬ রান। বুমরা স্লিপে ক্যাচ দিয়ে আউট হওয়ায় ভারতের ইনিংস যখন শেষ হল, পূজারার লড়াই তাঁদের এগিয়ে দিয়েছে ২৭ রানে। ৩৫৫ মিনিট ক্রিজে কাটিয়ে ১৩২ নট আউট পূজারা ফিরছেন, ড্রেসিংরুমের বারান্দায় উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন অধিনায়ক কোহালি, কোচ রবি শাস্ত্রী-সহ দলের সকলে। এজবাস্টন টেস্টে তাঁকে বাদ দিয়ে তিন ওপেনার খেলানো হয়েছিল মাথায় রাখলে দিনের গভীরতম দৃশ্য!
চার বছর আগে এখানে ছয় উইকেট নিয়ে ধোনির ভারতকে ভেঙেছিলেন মইন আলি। কোহালির ভারতও পুড়ল তাঁর অফস্পিনে। এ দিন নিলেন পাঁচ উইকেট। একটা সময়ে হ্যাটট্রিকের মুখেও ছিলেন। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে কোহালি প্রথম ওভারই তুলে দিলেন অশ্বিনের হাতে। তিন ওভার ব্যাট করে কুকরা বিনা উইকেটে ৬। এখনও ২১ রানে পিছিয়ে। সিরিজ ওভাল পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার অক্সিজেন সিলিন্ডার এগিয়ে দিয়েছেন পূজারা। এ বার দরকার বুমরার বাউন্স আর অশ্বিনের দুরন্ত ঘূর্ণির কড়া অ্যান্টিবায়োটিক!
স্কোরকার্ড
ইংল্যান্ড ২৪৬ ও ৬-০
ভারত ২৭৩
ভারত (প্রথম ইনিংস)
শিখর ধওয়ন ক বাটলার বো ব্রড ২৩
কে এল রাহুল এলবিডব্লিউ বো ব্রড ১৯
চেতেশ্বর পূজারা ন আ ১৩২
বিরাট কোহালি ক কুক বো কারেন ৪৬
রাহানে এলবিডব্লিউ বো স্টোকস ১১
ঋষভ পন্থ এলবিডব্লিউ বো মইন ০
হার্দিক পাণ্ড্য ক রুট বো মইন ৪
আর অশ্বিন বো মইন ১
মহম্মদ শামি বো মইন ০
ইশান্ত শর্মা ক কুক বো মইন ১৪
যশপ্রীত বুমরা ক কুক বো ব্রড ৬
অতিরিক্ত ১৭
মোট ২৭৩
পতন: ১-৩৭(রাহুল, ৭.২), ২-৫০ (ধওয়ন, ১৭.৫) ৩-১৪২ (বিরাট ৪১.১), ৪-১৬১ (রাহানে, ৪৬.৫), ৫-১৮১ (পন্থ, ৫৬.৩), ৬-১৮৯ (হার্দিক, ৫৮.৩), ৭-১৯৫ (অশ্বিন, ৬০.৫), ৮-১৯৫( শামি, ৬০.৬), ৯-২২৭ (ইশান্ত, ৭০.৬), ১০-২৭৩ (বুমরা, ৮৪.৫)।
বোলিং: জেমস অ্যান্ডারসন ১৮-২-৫০-০, স্টুয়ার্ট ব্রড ১৮.৫-৫-৬৩-৩, স্যাম কারেন ১৬-৪-৪১-১, কিটন জেনিংস ২-০-৪-০, আদিল রশিদ ৭-০-১৯-০, মইন আলি ১৬-১-৬৩-৫, বেন স্টোকস ৭-১-২৩-১।
ইংল্যান্ড (দ্বিতীয় ইনিংস)
অ্যালেস্টেয়ার কুক নআ ২
কিটন জেনিংস ন আ ৪
মোট ৬-০
বোলিং: আর অশ্বিন ২-১-১-০, যশপ্রীত বুমরা ২-০-৫-০।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy