ভারতীয় দাবা সংস্থায় বিরাট ডামাডোল ফাইল চিত্র
বিশ্বনাথন আনন্দ বিশ্ব ক্রমতালিকায় ৩২ মাস পর প্রথম দশে যে দিন ফিরলেন, তার পর দিনই ভারতীয় দাবায় ডামাডোল। আদালতের নির্দেশে সর্বভারতীয় দাবা সংস্থার সচিব পদ থেকে সরে গেলেন ভরত সিংহ চৌহান। দিল্লি হাই কোর্ট তার রায়ে বলেছে, বেআইনি ভাবে ওই পদে ছিলেন ভরত। তাই তাঁকে পদ ছাড়তে হবে।
ভরতের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেছিলেন অতনু লাহিড়ি, রবীন্দ্র ডোংরির মতো দাবা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত আধিকারিকরা। আদালতের রায়ের পরে মামলাকারীদের দাবি, এ তো সবে শুরু। ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে ভরতের বিরুদ্ধে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে একের পর এক দুর্নীতি করেছেন তিনি। সব সামনে আসবে। আনবেন তাঁরা।
কী অভিযোগ উঠেছে ভরতের বিরুদ্ধে?
সর্বভারতীয় দাবা সংস্থার নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট না পাওয়ার পরেও সচিব পদে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন তিনি। যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, তাঁদের জোর করে বেআইনি ভাবে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ভরতের বিরুদ্ধে প্রথম দুর্নীতির অভিযোগ করেছিলেন প্রাক্তন কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়ন, তথা সর্বভারতীয় দাবা সংস্থার যুগ্মসচিব অতনু। ভরতের বিরুদ্ধে তাঁর অনেক অভিযোগ ছিল। তার মধ্যে একটি প্রমাণিত। বাকিগুলোও এক এক করে প্রমাণিত হবে বলেই দাবি বাঙালি দাবাড়ুর। আনন্দবাজার অনলাইনকে অতনু বললেন, ‘‘আমার লড়াই শুরু এক বছর আগে। ২০২১ সালের ১০ জুলাই আমি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলাম, কী ভাবে দুর্নীতি করছেন ভরত। ওঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় আমাকে বেআইনি ভাবে সাসপেন্ড করে দেন ভরত। আমি সেটা মানিনি। আদালতে গিয়েছি। আমি প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম যে উনি নিজেই বেআইনি ভাবে পদে রয়েছেন। এত দিনে আদালতও সেটা মেনে নিল।’’
ঠিক কী কী অভিযোগ করেছেন অতনুরা?
ভরতের বিরুদ্ধে অতনুদের অভিযোগের তালিকা বেশ লম্বা। তিনি বললেন, ‘‘২০২১ সালে সর্বভারতীয় দাবা সংস্থার নির্বাচন ছিল। সেখানে দু’টো গোষ্ঠী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিল। একটি ভরতের গোষ্ঠী। অন্যটি দক্ষিণ ভারতের একটি গোষ্ঠী। আমরা দক্ষিণ ভারতের গোষ্ঠীকে সমর্থন করেছিলাম। ভরত ক্রীড়া মন্ত্রকের সঙ্গে যোগসাজশ করে নির্বাচনে জিতেছিলেন। ফলে সচিব পদে বসার অধিকার ওঁর ছিল না। উনি সেটাই করেছিলেন।’’
‘ন্যাশনাল স্পোর্টস কোড’ না মেনে ভরত জোর করে সচিব পদে বসেছিলেন বলে অভিযোগ অতনুর। তিনি বললেন, ‘‘ভারতে জাতীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলিকে ‘ন্যাশনাল স্পোর্টস কোড’ মেনে চলতে হয়। নইলে তারা স্বীকৃতি থেকে শুরু করে সরকারি সুবিধা, কিছুই পায় না। ভরত দিল্লিতে থাকায় ক্রীড়া মন্ত্রকের সবার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভাল। সেটা কাজে লাগিয়ে উনি দুর্নীতি করেছেন। ন্যাশনাল স্পোর্টস কোড অনুযায়ী কোনও ফেডারেশনের সভাপতি, সচিব ও কোষাধ্যক্ষকে দ্বিতীয় বারের জন্য নির্বাচনে জিততে গেলে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেতে হবে। ভরত ৬৪টি ভোটের মধ্যে ৩৫টি পেয়েছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পাননি। তাই সচিব পদে বসার যোগ্যতা ওঁর নেই। আদালতও আমাদের দাবি মেনে নিয়েছে।’’
অতনুদের তরফে আদালতে মামলা করেছিলেন রবীন্দ্র। তিনি ভরতের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ২৯টি ভোট পান। অতনুর দাবি, ভরত দুই-তৃতীয়াংশ ভোট না পাওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী দ্বিতীয় স্থানে থাকা রবীন্দ্রকে সচিব পদে মনোনীত করা উচিত ছিল। সেটা হয়নি। তাই রবীন্দ্রই মামলা করেন। অতনু বললেন, ‘‘হাই কোর্ট স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে ভরত বেআইনি ভাবে পদে ছিলেন। তাই ওঁকে সরে যেতেই হবে। সরকারের কোনও আর্জিই মানেনি আদালত।’’
আদালতের নির্দেশের পরে সর্বভারতীয় দাবা সংস্থার অন্তর্বর্তী সচিব পদে বসানো হয়েছে সংস্থার সহ-সভাপতি বিপনেশ ভরদ্বাজকে। সংস্থার সভাপতি সঞ্জয় কপূর একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, জুলাই মাসে চেন্নাইয়ে দাবা অলিম্পিয়াড আয়োজন করতে যাতে কোনও সমস্যা না হয় তার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ভরতের বিরুদ্ধে দাবাড়ুদের ব্যক্তিগত তথ্য ‘বিক্রি’ করারও অভিযোগ তুলেছেন অতনু। তিনি বললেন, ‘‘এখন দেশের বেশির ভাগ দাবাড়ু নাবালক। কেউ দাবা খেলা শুরু করলে তাদের জোর করে দাবা সংস্থায় রেজিস্ট্রেশন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। সে জন্য তাদের কাছ থেকে টাকাও নেওয়া হচ্ছে। তার পরে দাবাড়ুদের তথ্য অন্য কোনও বেসরকারি সংস্থার কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন ভরত। এতে দাবাড়ুদের ব্যক্তিগত জীবন, এমনকি সুরক্ষা নিয়েও সমস্যা দেখা দিতে পারে। আর্থিক প্রতারণার মুখেও পড়তে পারে তারা।’’ ভরতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও তখন কেউ গুরুত্ব দেয়নি, বললেন অতনু। তাঁর কথায়, ‘‘আমি বার বার ভরতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের সঙ্গে বার বার দেখা করার আবেদন করেছি। কিন্তু উনি এক জন প্রাক্তন কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে দেখা করেননি।’’
অতনুর আরও অভিযোগ, বাংলার দাবারও ক্ষতি করছেন ভরত। কেন্দ্রীয় ক্রীড়া মন্ত্রকের তাতে প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে। রাজ্যও কিছু বলছে না। অতনুর কথায়, ‘‘বাংলার দাবা সংস্থার নির্বাচনে দুটো গোষ্ঠী ছিল। আমরা জিতেছিলাম। কিন্তু আমাদের স্বীকৃতি না দিয়ে যারা হেরেছে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমি এই সব দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছি বলেই ভরতের এত রাগ। আদালতের নির্দেশের পরেও উনি মিথ্যা কথা বলছেন। সব জায়গায় বলছেন, এটা নাকি অন্তর্বর্তী নির্দেশ। পরের শুনানি পর্যন্ত ওঁকে সরতে বলা হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।’’
যাঁর বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, সেই ভরত কী বলছেন? আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে ভরতের সঙ্গে অনেক বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি ফোন কেটে দেন।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy