দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুনে তখন ছারখার হচ্ছে পৃথিবী। কয়েক বছর ‘নিরপেক্ষ’ থাকার পর, সবে সেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছে আমেরিকা। এই মহাযুদ্ধক্ষণে জন্মেছিলেন ক্যাসিয়াস ক্লে জুনিয়র। আমেরিকার আর পাঁচটা ব্ল্যাক ফ্যামিলির মতো এই পরিবারটির কাছেও সেই বাইরের যুদ্ধের থেকে অনেক বেশি ভয়ের ছিল দেশের ভিতরের যুদ্ধটা। কালো মানুষ হিসেবে আমেরিকায় বেঁচে থাকার যুদ্ধ সেটা। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নাম তখন আমেরিকার কালো মানুষরাও ভাল করে শোনেননি। তেমনই এক সময়ে, ১৭ জানুয়ারি ১৯৪২, কেন্টাকির দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে জন্মালেন ক্যাসিয়াস ক্লে জুনিয়র। পরে যিনি মহম্মদ আলি হবেন। হাতের বক্সিং গ্লাভস নিষ্ঠুরের মতো আছড়ে পড়বে প্রতিপক্ষের চোয়ালে। আর যিনি চোয়াল শক্ত করে বলবেন, ‘জেলে যেতে হয় যাবো, কিন্তু সাদা চামড়ার শাসকদের কথামতো যুদ্ধে যেতে পারব না। কোনও ভিয়েতকং কখনও আমায় নিগার বলে ডাকেনি’।
দ্য বাইসাইকেল থিফ
ক্যাসিয়াস ক্লে জুনিয়রের বয়স তখন ১২। জন্মদিনে একটা বাইসাইকেল কিনে দিয়েছিলেন বাবা ক্যাসিয়ায় ক্লে সিনিয়র। সেই সাইকেল কি না হয়ে গেল চুরি! আর যায় কোথায়। রেগে আগুন ছেলে। সোজা হাজির থানায়। চুরির অভিযোগ জানিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি সে। চোর ব্যাটাকে পেলে কেমন উত্তমমধ্যম দেবে তাও জানিয়ে দিল পুলিশ অফিসারকে। কিন্তু সে দিনের সেই পুলিশ অফিসারটি যদি জো মার্টিন না হয়ে অন্য কেউ হতেন, কে বলতে পারে মহম্মদ আলিকে আমরা পেতাম কি না! জো মার্টিন ছিলেন একজন বক্সিং প্রশিক্ষকও। জো ক্লেকে বোঝালেন চোরকে ধরে মারতে গেলে আগে শিখতে হবে কী করে মারতে হয়। ব্যস্, শুরু হয়ে গেল ক্লের প্রশিক্ষণ। পরে যিনি বিশ্ব জয় করবেন তাঁর প্রথম মাস্টারমশাই হয়ে গেলেন জো মার্টিন। সেটা ১৯৫৪ সাল। সে বছরই অপেশাদার বক্সিং-এ নেমে পড়েন ক্লে।
অলিম্পিকের সোনা
১৯৬০ রোম অলিম্পিকে সোনা জেতেন ক্যাসিয়াস। সেই মেডেল নাকি তিনি রাগের মাথায় ছুড়ে ফেলে দেন ওহায়ো নদীতে। ঘটনাটা রোম থেকে ফেরার কিছু দিনের মধ্যেই। বন্ধুকে নিয়ে এক রেস্তোরাঁয় ঢুকতে গিয়ে বাধা পান। ব্যাপার কী? না এই রেস্তোরাঁয় শ্বেতাঙ্গ ছাড়া অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ। গর্জে ওঠেন ক্লে। এ সবের মানে কী! কিন্তু কে শোনে কার কথা। তর্ক বিতর্ক চলতে চলতে এক দল শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে মারপিটও বেঁধে যায়। এ কেমন দেশ! এ কেমন আইন! এ কেমন নীতি! মনের আক্রোশে রোম থেকে জিতে আনা অলিম্পিকের সোনা তিনি নাকি নদীতে ছুড়ে ফেলে দেন। এই বছরই, অর্থাত্ ১৯৬০ সালেই, পেশাদার বক্সিং-এ আসেন ক্লে। তার আগে অপেশাদার রিং-এ লড়েছেন ১০৫টা ম্যাচ। জিতেছেন ১০০টায়।
ক্যাসিয়াস ক্লে থেকে মহম্মদ আলি
১৯৬০ সালের ২৯ অক্টোবর পেশাদার বক্সিং-এ নামেন ক্লে। ১৯৬৩ পর্যন্ত ১৯টা ম্যাচে ১৯টাতেই জয়। তার মধ্যে ১৫টা নক আউট করে। তাক লাগানোর মতো রেকর্ড। যোগ্যতা অর্জন করে ফেললেন বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন সনি লিস্টনের মুখোমুখি হওয়ার। অবশেষে সেই দিন! ১৯৬৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। মিয়ামির রিং-এ নামার আগে বিশ্ব আর এক ক্লেকে দেখল। যার আস্ফালন বিপক্ষকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। ক্লে হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘সনি একটা বিশাল, কুত্সিত ভালুক। বিশ্রি গন্ধ। ওকে হারানোর পর চিড়িয়াখানায় রেখে আসব’। তাঁর আস্ফালন অক্ষম প্রমাণিত হয়নি। সনিকে হারিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সেই তিনি বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন। এই বছরই মুসলিম ধর্ম নেন ক্লে। নাম বদলে মহম্মদ আলি। এই নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। কম কথা শুনতে হয়নি। কিন্তু নড়ানো যায়নি আলিকে।
যাবো না যুদ্ধে, যা খুশি করো
বক্সিং রিং-ই তাঁকে বিশ্ব জুড়ে খ্যাতি দিয়েছে। দিনের পর দিন লড়াই করেছেন নিজেকে সেরা করে তোলার জন্য, নিজেকে সেরা জায়গাটায় টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু আত্মসম্মানের যুদ্ধে তিনি হেলায় ছেড়ে আসতে পেরেছেন এ সব কিছু। এখানেই আরও অনেক অনেক ক্রীড়াবিদের থেকে মহম্মদ আলি স্বতন্ত্র। ভিয়েতনামে বোমা ফেলছে আমেরিকা। ডাক এল মহম্মদ আলিরও। যেতে হবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে। বাধ্যতামূলক। রুখে দাঁড়ালেন আলি। না, যাবো না। এবং গেলেন না। কী বললেন? বললেন, ‘‘ওরা কেন আমাকে গায়ে ইউনিফর্ম চাপিয়ে বাড়ি থেকে ১০ হাজার মাইল দূরে গিয়ে ভিয়েতনামের বাদামী চামড়ার মানুষদের উপর বোমা ফেলে আসতে বলছে, যখন লুইভিলের (মার্কিন শহর) তথাকথিত নিগ্রো মানুষদের সঙ্গে কুকুরের মতো ব্যবহার করা হয় এবং ন্যূনতম মানবাধিকার দিতেও অস্বীকার করা হয়! না, আমি বাড়ি থেকে ১০ হাজার মাইল গিয়ে হত্যায় মদত দিতে পারব না। পারব না বিশ্ব জুড়ে কালো মানুষের উপর আধিপত্য চালানো শ্বেতাঙ্গ দাসপ্রভুদের স্বার্থে আর একটা গরিব দেশকে পুড়িয়ে আসতে। ...আমার বক্তব্যের জন্য যদি আমাকে জেলেও যেতে হয় যাবো! এ আর নতুন কী! গত ৪০০ বছর ধরে তো আমরা জেলখানাতেই আছি।’’
জেলে হয়ত যাননি। কিন্তু এর জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছিল মহম্মদ আলিকে। যে বক্সিং তাঁর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতো সেই বক্সিং রিং থেকে নির্বাসিত হলেন। ১৯৬৭র মার্চ থেকে ২৫ বছরের আলিকে আর রিং-এ নামতে দেওয়া হল না। সেই নিষেধাজ্ঞা উঠল মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর। সেটা ১৯৭১ সাল।
প্রত্যাবর্তন
নিষেধাজ্ঞা যখন উঠল ২৯ বছর বয়স হয়ে গেছে মহম্মদ আলির। চার বছর রিং-এর বাইরে। ইতিমধ্যেই বক্সিং সার্কিটে এসে গেছেন তরুণ প্রজন্মের বক্সাররা। বয়স কম। ক্ষিপ্রতা বেশি। কিন্তু এ সব তোয়াক্কা করেননি আলি। তিনি যে মহম্মদ আলি। আর কেউ তখনও জানুক না জানুক, তিনি তো জানেন, কী করতে হবে তাঁকে! আবার শুরু হল লড়াই। একের পর এক প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করছেন। এর মধ্যেই জো ফ্রেজিয়ারের সঙ্গে সেই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ, যে ম্যাচ বক্সিং-এর ইতিহাসে কিংবদন্তী হয়ে আছে। শেষ পর্যন্ত মুখোমুখি হলেন হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন জর্জ ফোরম্যানের। ৩০ অক্টোবর ১৯৭৪ খেতাব পুনরুদ্ধার করলেন আলি। ৩২ বছর বয়সে ২৫ বছর বয়সী ফোরম্যানকে হারিয়ে। ইতিহাস গড়লেন।
১৯৮১ সালে অবসর নেওয়া পর্যন্ত পেশাদার রিং-এ নেমেছেন ৬১ বার। ৫৬ বার জিতেছেন। আর জীবনের লড়াইয়ে? সম্মানের লড়াইয়ে? সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের প্রথম অশ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রপতিকে দেখে নিশ্চয় তাঁর মনে পড়েছিল সেই সব পুরোন দিনের কথা। আর বারাক ওবামা রাষ্ট্রপতি হয়েই স্মরণ করেছিলেন মহম্মদ আলিকে। ওবামার জীবনের অন্যতম অনুপ্রেরণা যে তিনি। কেন তিনি বহু বহু মানুষের অনুপ্রেরণা? ওই যে হারিয়ে যেতে যেতে আবার ফিরে আসা, বাধা সরিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জ, বুক ভরা সাহস, তীক্ষ্ণ আত্মসম্মানবোধ আর মানুষকে ভালবাসা- এই সব দিয়েই তো একটা মহম্মদ আলি তৈরি হয়। ৭৪ বছর বয়সে এই মানুষটাই সারা পৃথিবীকে ভারাক্রান্ত করে চলে গেলেন। এই মৃত্যু শুধু ক্রীড়াজগতে নয়, মানুষের সার্বিক ইতিহাসেই পাথরের মতো ভারী!
আরও পড়ুন:
আলির জীবনের সেরা দশ ফাইট
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy