হিউমের গোলেও আটকাল না পুণের উচ্ছ্বাস। রবিবার। ছবি: আইএসএল
পুণে- ২ (এডুয়ার্ডো, অ্যানিবল-পেনাল্টি) : এটিকে-১ (হিউম)
কালো প্যান্ট-সাদা শার্টের পুরোদস্তুর ফর্ম্যাল আউটফিট নিমেষের মধ্যে বদলে গেল পাতি ক্যাজুয়াল আউটফিটে! দু’হাত আকাশে তুলে শূন্যে একটা বিশাল লাফ। প্যান্টের থেকে শার্ট-ফার্ট বাইরে বেরিয়ে এসেছে! তবু মুখে চওড়া হাসি। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিলেন তিনি।
আইএসএল তিন বছরে পা দিয়েছে। কিন্তু আন্তোনিও লোপেজ হাবাসকে এতটা বাধভাঙা উচ্ছ্বসিত-প্রাণবন্ত বোধহয় উদ্বোধনী বছরে আটলেটিকো কলকাতাকে চ্যাম্পিয়ন করার পরেও দেখা যায়নি। যতটা রবিবার বালেওয়াড়ি স্টেডিয়ামে পুণে সিটি এফসি-র প্রথম গোলের পরে দেখা গেল!
কিন্তু অভিব্যক্তিটা খুব আশ্চর্যের কি? কোচিং জীবনের অন্যতম কঠিন সময়ের মধ্যে যদি এ দিনের মতো ‘ডাবল ধামাল’ হয়ে যায়, তা হলে যে কোনও কোচকেই হয়তো হাবাসের মতোই বাঁধন-ছাড়া দেখাবে। দু’-দু’বছর এটিকে কোচ থাকার সময় যে অমৃত-স্বাদ উপভোগ করতে পারেননি, সেটা রবিবারই পুণের কোচ হিসেবে করে দেখালেন। বালেওয়াড়ির মাঠ থেকে প্রথম বার মাথা উঁচু করে বেরোলেন। সেটাও আবার পুরনো দলের বিরুদ্ধে আত্মসম্মানের মহালড়াই জিতে।
আইএসএলের সব ভেনুতে মস্তানি করলেও পুণে হাবাসকে সব সময় খালি হাতে ফিরিয়েছে। কিন্তু কথায় আছে না— উপরওয়ালা যব দেতা হ্যায়, ছপ্পড় ফাড় কে দেতা হ্যায়। রবিবারের বালেওয়াড়ি হাবাসকে সিংহাসন আর এটিকের সামনে ফের ‘ট্রাই এগেন’-র সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দিল।
হাবাসের উত্তরসূরি মলিনাও পারলেন না কলকাতার পুণে-অভিশাপ কাটাতে। সেই মাঠটার অদ্ভুত জ্যামিতিতে আটকে গেলেন এটিকের আর এক স্প্যানিশ কোচও। মাঠের ছোট আকারের ঠেলায় না পারলেন উইং ব্যবহার করতে, না পারলেন খেলাটাকে ছড়াতে। তার মধ্যে ৪-৪-১-১ ছক বুমেরাং হয়ে ফিরল কলকাতার দিকেই। হাবাসের ৩-৫-২ ছকের জাতাকলে পড়ে মাঝমাঠ থেকে আক্রমণে বল সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেল এটিকের। আর উইং— সেখান দিয়ে তো ভাল করে দৌড়নোরই উপায় নেই, গোল উপযোগী সেন্টার করা তো দূরের কথা। পুণের এই মাঠে জিততে হলে মাঝমাঠে লোক বাড়িয়ে অ্যাটাকে যেতে হবে। এত দিন হাবাসের পুণেও যেটা করছিল না। কিন্তু এ দিন ছেড়ে আসা শহরের বিরুদ্ধে ৪-২-৩-১ থেকে নিজের নতুন টিমকে ৩-৫-২ খেলাতেই ‘ব্লকবাস্টার হিট’ ইন্ডিয়ান সুপার লিগের বিখ্যাত সাদা শার্ট।
তবে আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে হাবাস যাঁকে নিজের যোগ্য উত্তরসূরি বেছেছেন, তিনিও বা সর্বহারা হন কী করে? দ্বিতীয়ার্ধে একটা সময় ০-২ পিছিয়ে পড়েও এটিকে কোচ জোসে মলিনা হাল ছাড়েননি। অ্যানাবলের পেনাল্টি গোল দেবজিৎ হাতে লাগিয়েও বাঁচাতে না পারার পরে মাঝমাঠে পিয়ারসনকে উঠিয়ে জাভি লারাকে নামাতেই হাতেনাতে রেজাল্ট। পাল্টা পেনাল্টির পরে ‘রিবাউন্ডে’ হিউমের গোল। ব্যবধান কমিয়ে কলকাতার ম্যাচে ফেরত আসা। আক্রমণে লোক বাড়িয়ে এটিকে তখন ৪-৩-৩। কিন্তু যে মুহূর্তে মলিনা তাঁর নতুন স্ট্র্যাটেজি আমদানি করলেন, তখন তাঁর হাতে সময় কম। দ্যুতিরা সমতায় ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা চালালেও শেষমেশ লাভ হয়নি। ম্যাচ শেষে মলিনাও স্বীকার করে গেলেন, ‘‘পরিস্থিতিটা বুঝতে একটু দেরি করে ফেললাম। না হলে শেষের দিকে ম্যাচটা তো ধরেই নিয়েছিলাম। দ্বিতীয় গোলটা এল না এই যা!’’
‘পরিস্থিতি বুঝতে’ দেরি তো করলেনই, এটিকে কোচ দেরি করলেন ফুটবলার বদলাতেও। এ রকম মাঠে জাভি লারার মতো ইউটিলিটি ফুটবলারের প্রয়োজন। যিনি অ্যাটাকিং থার্ডে সাহায্য করতে পারবেন। আবার দরকারে নীচে নেমে ডিফেন্ডারদের ভরসা দেবেন। কিন্তু মলিনা তাঁকে নামালেন এমন সময় যখন ম্যাচ প্রায় হাতের নাগালের বাইরে। আরও একটা ‘ব্যাকফায়ার’ হয়েছে— হেল্ডার পস্টিগা। গোটা ম্যাচে কলকাতার মার্কিকে এক বারের জন্যেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাঠে এমন ভাবে নড়াচড়া করছিলেন, যেন ফুটবল খেলতে নামেননি, কোনও বাগানে ঘুরতে এসেছেন। পস্টিগার ‘সৌজন্যে’ এটিকের লড়াই কার্যত হয়ে দাঁড়ায় দশ বনাম এগারো।
হাবাসের মতো ধুরন্ধর কোচ সেটা ধরতে দেরি করেননি। দেরি করেননি চেনাতে, কে গুরু আর কে শিষ্য! হয়তো এই ম্যাচের হারে শেষ পর্যন্ত মলিনার দলের সেমিফাইনালে ওঠা আটকাবে না। তবে হাবাসের কাছে এই ম্যাচটা সেমিফাইনালের টিকিটের চেয়েও যে বেশি জরুরি ছিল, সেটা বুঝিয়ে দিলেন প্রাক্তন কলকাতা কোচ। আর পুণে ফুটবলাররাও তাঁদের কোচের সেই আবেগকে যথাযথ সম্মান জানালেন।
এডুয়ার্ডো তো প্রথম গোলটা করলেন তার একটু আগে ফুটবলারদের ভিড়ের মধ্যে সংঘর্ষে মিনিট কয়েক ‘ব্ল্যাক আউট’ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও! অন্য সময় হলে হয়তো মাঠ ছাড়তেন, কিন্তু আজ যে হাবাস বনাম কলকাতা! ডান চোখের নীচে ব্যান্ডেজ নিয়ে হাবাসের দলকে প্রথমার্ধে এগিয়ে দেন এডুয়ার্ডো-ই! যাঁকে হাফটাইমে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতের খবর ভাল আছেন এডুয়ার্ডো। আর ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজতেই দেখা গেল সবার আগে পুণের ডাগ আউটের দিকে দৌড়চ্ছেন তাদের এ দিনের আর এক গোলদাতা অ্যানিবল। পিছনে বেটে, নারায়ণ দাসেরা। কোনও দিকে না তাকিয়ে সবাই মিলে জড়িয়ে ধরলেন তাঁদের প্রিয় কোচকে। সাদা-শার্টের সামান্য কিছু অংশ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না তখন সেই উৎসবের ভিড়ে। পরে হাবাস বলছিলেন, ‘‘বলেছিলাম না সেমিফাইনালের পথ চলা এই ম্যাচ থেকেই শুরু করব। করলাম। আর টুর্নামেন্টের সবচেয়ে শক্তিশালী দলকে হারিয়ে করলাম।’’ কণ্ঠস্বর দিয়ে যেন আগুন ঝরছে হাবাসের।
একটু দূরের ছবিটা অবশ্যই একেবারে উল্টো। রংহীন। হতাশায় মোড়া। এটিকে শিবির যেন মানতেই পারছে না রেজাল্টটা। আসলে ম্যাচটা তো শুধু দু’টো টিমের মধ্যে ছিল না। ছিল দু’টো শহরের। যার একটা ছেড়ে অন্যটার দায়িত্ব নিয়েছেন এক একরোখা, জেদি কোচ। তাই মলিনা যতই বলুন না কেন, ‘‘ফুটবলে সব ম্যাচ জেতা যায় না। হারলেও আমরা এখনও সেমিফাইনালের লড়াইয়ে আছি,’’ হাবাসের কাছে হেরে কলকাতা কোচের ভেতরটা যে ফেটে যাচ্ছে, সেটা তাঁর শরীরী ভাষাতেই স্পষ্ট। এ বারের আইএসএল শুরু ইস্তক যে মানুষটার সঙ্গে মলিনার ছায়াযুদ্ধ চলেছে, তাঁর কাছেই প্রথম যুদ্ধেই হেরে গেলেন যে!
আপাতত তাই আসল স্কোরলাইন হাবাস-১ : মলিনা-০। তবে ফিরতি লড়াই রয়েছে রবীন্দ্র সরোবরে।
কলকাতা অপেক্ষায় থাকল!
আটলেটিকো: দেবজিৎ, অর্ণব, প্রীতম, সেরেনো, রবার্ট, ডিকা (বিদ্যানন্দ), পিয়ারসন (লারা), বোরহা, দ্যুতি, হিউম (বেলেনকোসো), পস্টিগা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy