দিন্দা-অমিত। দু’জনে মিলে দশ উইকেট।
প্রত্যেক ক্রিকেটারের নিজের সাফল্য উদযাপনের স্বতঃস্ফূর্ত একটা ভঙ্গিমা থাকে। কেউ উইকেট নিয়ে এরোপ্লেনের মতো হাত ছড়িয়ে সতীর্থের দিকে প্রাণপণ ছুটতে থাকে, কেউ আবার সেঞ্চুরির পর সোজা স্যালুট করে গ্যালারিকে। বাংলার অশোক দিন্দারও এ সব করার একটু-আধটু অভ্যেস আছে। বঙ্গ পেসার একটা সময় উইকেট নিলে ক্রমাগত ফিস্ট পাম্প করতেন। মাঝে আবার তাঁকে দেখা যেত ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর অনুকরণে আকাশ ছুঁয়ে মাটিতে নেমে আসতে। বঙ্গ পেসারদের মধ্যে উইকেটসংখ্যায় সর্বকালের সেরা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার দিনে অশোক দিন্দা যে এমন সব উল্লাস তীব্রতা সহ তুলে আনবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? আজ তো তাঁরই দিন। আজ তো তাঁর নতুন ইতিহাস সৃষ্টির স্বর্ণমূহূর্ত।
আশ্চর্যের হল, অশোক দিন্দা শনিবার বিলাসপুরে এ সব কিছুই করেননি! রেকর্ডের উইকেটটা নিয়ে আকাশের দিকে একবার আঙুল তুলেছেন, পিচে চুম্বন করেছেন একটা, ব্যস! কেন এমন ব্যতিক্রম? বাংলা পেসারদের মধ্যে এত দিন যে তাজ ছিল রণদেব বসুর, আজ থেকে তো সেটা তাঁর হয়ে গেল। এত দিন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বঙ্গ পেসারদের মধ্যে সর্বাধিক উইকেট ছিল রণদেবের। ৩১৭-টা উইকেট ছিল বর্তমান বাংলা বোলিং কোচের। শনিবারের পর যা কি না দ্বিতীয় সর্বাধিক। প্রথম দিন্দা— ৩২০। তা হলে? ‘‘আরে, আমি রেকর্ড করেছি তো কী হয়েছে? রণদা লেজেন্ড। মাঠে নিজেকে বলছিলাম যে, তুমি রণদেব বসুর রেকর্ড ভাঙতে পারো। কিন্তু তীব্র লম্ফঝম্ফ করে বাংলা ক্রিকেটে তার অবদানকে অসম্মান করতে পারো না,’’ বিলাসপুর থেকে ফোনে দিন্দার কথাগুলো শুনলে বঙ্গ পেসার সম্পর্কে শ্রদ্ধা বেড়ে যেতে পারে।
উচিতও। শুধু দিন্দা নয়, সমগ্র বঙ্গ পেস ব্যাটারির প্রতিই বোধহয় বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীদের এ দিন সশ্রদ্ধ হওয়া উচিত। পঞ্জাব কেমন টিম, বোঝাতে একটা নামই যথেষ্ট। যুবরাজ সিংহ! আর তাঁর টিমকে কি না যন্ত্রণার শরশয্যা দিয়ে গেলেন দুই বাঙালি পেসার! পাঁচ-পাঁচ করে উইকেট নিয়ে, পঞ্জাব ইনিংসের দশটা উইকেট দু’জন সমান ভাগ করে।
একজন পুরাতন। একজন নতুন।
অশোক দিন্দা এবং অমিত কুইলা।
রঞ্জি অভিষেককারী অমিতের সঙ্গে শনিবার কথা বললে, দু’টো জিনিস মনে হতে পারে। অমিত কুইলা হয় স্বভাব-বিনয়ী। অথবা স্বপ্নের অভিষেক ঘটিয়ে বিবশ। ডেল স্টেইনের অন্ধ ভক্ত বলছিলেন, ‘‘মোটামুটি ভালই ডেবিউ হল। এর পর নিয়মিত যদি খেলি, তা হলে আমার টার্গেট থাকবে আরও ভাল বল করা। আরও ভাল পারফর্ম করা।’’ ঘটনা হল, দিন্দা বুঝতে পারছেন, নিজের রেকর্ডের দিনেও তাঁকে নড়িয়ে দিচ্ছে অমিত-বিক্রম। দুই পেসারের নিরঙ্কুশ দাপট। ‘‘মনে তো পড়ে না আমি থাকতে শেষ কোন পেসার পাঁচ উইকেট নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। রণদা যখন খেলত, হত। তার পর বোধহয় আর হয়নি,’’ বলছিলেন দিন্দা। বাংলার নবাগতকে নিয়ে যাঁর গলা আপ্লুত শোনায়। দিন্দা বলে চলেন, ‘‘অমিতের সবচেয়ে বড় গুণ, ওর খাটনি। অক্লান্ত খাটতে পারে ছেলেটা। আর একটা হল, জানার আগ্রহ। এ দিনও বল করার আগে জানতে চাইছিল, কী করা উচিত।’’
রণদেব বসু— তাঁর জীবনে শনিবার ব্যতিক্রমী একটা দিন বটে। একই দিনে নিজের উইকেটসংখ্যাকে সতীর্থের টপকে যাওয়া দেখলেন, দেখলেন নিজের ছাত্রের উত্থান। ‘‘অমিতের উইকেটগুলোকে নিজেরই মনে হচ্ছে! ওর গতি আছে। অসম্ভব নিখুঁত থাকতে পারে। লম্বা বলে বাড়তিও বাউন্স পায়। তবে সবচেয়ে ভাল লাগে দেখে যে, প্র্যাকটিস হোক বা ম্যাচ— বল পিছু দু’শো শতাংশ দেয়।’’ একটু থেমে রণদেব ফের বলেন, ‘‘আর দিন্দা? ও যে আমার রেকর্ড ভেঙেছে তাতে খুশি আমি। আমরা ছেড়ে দেওয়ার পর পেস বোলিংকে টেনেছে। দিন্দার এটা প্রাপ্য।’’
শনিবারের প্রেক্ষিতে প্রচারের রোশনাইও বোধহয় দিন্দার বেশি প্রাপ্য। নবাগত অমিত একই সংখ্যক উইকেট পেলেও। দিন্দা তো দেখিয়ে গেলেন, বত্রিশেও তাঁর আগুন জীবিত। দেখিয়ে দিলেন, দিন পাল্টায়। পেসার-সতীর্থ পাল্টায়। কিন্তু তাঁর খিদে পাল্টায় না।
রেকর্ড করে মার্জিত উৎসব করলেও দিন্দার একটা কথা মনে পড়ছিল। নিজের অতীতের কথা। ‘‘ভাবছিলাম, কোন অবস্থা থেকে শুরু করেছিলাম আমি। আমি গ্রাম থেকে উঠে আসা ছেলে। জীবনে ভাল যেমন দেখেছি, খারাপও দেখেছি। খারাপ সময়ে নিজেকে বলতাম, এটা আর এমন কী? এর চেয়েও কষ্ট অতীতে করেছি তো,’’ বলে চলেন দিন্দা। জুড়ে দেন, ‘‘এখনও দাপটে চালিয়ে যাওয়ার দু’টো কারণ খুঁজে পাই আমি। খিদে আর ফিটনেস। নিজেকে বলতে থাকি, তুমিই সেরা। তোমাকে রোজ পারফর্ম করতে হবে। কারণ সেটাই তোমার কাজ।’’ ‘বেঙ্গল এক্সপ্রেস’ বেছে দেন, আজ পর্যন্ত নিজের সেরা বোলিং পার্টনারকে। ‘‘শামির সঙ্গে খুব বেশি খেলিনি আমি। রণদার সঙ্গেই আমার সেরা পার্টনারশিপ। রণদা বুঝতে পারত, আমি কী করতে চাইছি। আমি বুঝতাম, রণদা কী চাইছে।’’ অশোক দিন্দা বরং ইতিহাস সৃষ্টির পর দু’টো অপূর্ণ ইচ্ছেয় হাত রাখতে চান। একটা টেস্ট ক্যাপ। একটা রঞ্জি ট্রফি। হাসতে-হাসতে বলে দেন, ‘‘আদতে তিনটে ছিল। আজ একটা হয়ে গেল। তবে ডেভিডদার রেকর্ডটা (উৎপল চট্টোপাধ্যায়, ৫০৪ উইকেট) হবে না।’’ কিন্তু টেস্ট ক্যাপ— সেটাও আর হবে কি? উত্তর আসে, ‘‘যত দিন খেলব, আশাটা নিয়ে বাঁচব। ইচ্ছে আরও একটা আছে। রিটায়ার করব যে দিন, পাঁচ উইকেট নিয়ে করব!’’
এবং সব দেখলে-শুনলে পুরাতন ও নতুনের জীবন-ক্যানভাসে কোথাও গিয়ে যেন যোগসূত্রের খোঁজও পাওয়া যায়। একজন স্বপ্ন দেখছেন, ক্রিকেট কিটব্যাগে তালাচাবি ঝোলাচ্ছেন পাঁচ উইকেট নিয়ে। আর একজন রঞ্জিতে ক্রিকেটকিট খুললেনই পাঁচ উইকেট নিয়ে। জীবনের শুরুটাও তো দু’জনের এক। দিন্দার মতো অমিতও দারিদ্র দেখেছেন, সহ্য করেছেন প্রতিকুলতা। অমিত এ দিনও বললেন যে, ছোটবেলার কোচ সুশীল শিকারিয়া তাঁকে খাওয়াতেন-পরাতেন। সুশীল-স্যর এবং রণদেব বসু না থাকলে তাঁর এই জায়গায় আসা সম্ভবই হত না। রণদেব দেখা গেল, কৃতিত্ব নিতে চান না। বরং তিনি নিশ্চিত বাংলার ভাবী পেস-প্রজন্ম নিয়ে। তিনি থাকুন বা না থাকুন, যাঁরা আগামী দশ বছর সার্ভিস দেবে বলে তাঁর বিশ্বাস।
দিক। হোক। অশোক দিন্দার রেকর্ড অক্ষত থেকে গেলে বঙ্গ ক্রিকেটের আর কী লাভ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy