টোকিয়ো প্যারালিম্পিক্সে সোনা জয়ের পর অবনী লেখারা। —ফাইল চিত্র।
সাল ২০০৮। বেজিং অলিম্পিক্সে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল ইভেন্টে সোনা জিতেছিলেন অভিনব বিন্দ্রা। ভারতীয় ক্রীড়া জগতে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। অলিম্পিক্সে ব্যক্তিগত ইভেন্টে ভারতের প্রথম সোনা। তৈরি হল ইতিহাস।
সাল ২০১১। মুক্তি পেল অভিনব বিন্দ্রার আত্মজীবনী ‘এ শট অ্যাট হিস্ট্রি’। পদক জয়ের খিদে, লড়াই এবং সাফল্য তুলে ধরলেন ভারতীয় শুটার। সেই বইয়ে তিনি অস্বীকার করলেন শুধুমাত্র সেরা প্রশিক্ষণ বা কোচেরাই সাফল্য এনে দেওয়ার রাস্তা তৈরি করে দিতে পারে। তাঁর লড়াইয়ের সেই কাহিনি অনুপ্রেরণা দিল গোটা দেশকে, অবনী লেখারাকেও।
মাত্র ১৯ বছর বয়সে টোকিয়ো প্যারালিম্পিক্সে সোনা জিতেছিলেন। অলিম্পিক্সে কোনও ভারতীয় মহিলার সোনার পদক নেই। প্যারালিম্পিক্সে সেই কীর্তি গড়েছিলেন অবনী। এ বারে সেই আরও এক কীর্তি। পর পর দু’টি অলিম্পিক্সে সোনা জিতলেন অবনী। ২০১২ সাল থেকে হুইলচেয়ারে বসে থাকা অবনী বুঝিয়ে দিলেন ইচ্ছে থাকলে কোনও বাধাই কঠিন নয়।
খেলাধুলার সঙ্গে পড়াশোনাতেও প্রথম স্থানেই থাকতেন অবনী। টোকিয়োয় সোনা জয়ের পর এক সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমার মনের মধ্যে কী চলছে সেটা বলে বোঝাতে পারব না। মনে হচ্ছে আমি অনেক উঁচুতে বসে আছি। ব্যাখ্যা করতে পারব না এই মুহূর্তটা।” জয়ের পর উত্তেজিত থাকা অবনী খেলার সময় কী ভাবে শান্ত রেখেছিলেন নিজেকে? তিনি বলেছিলেন, “নিজেকে বার বার বলছিলাম একটা করে শট নিয়ে ভাবব। একেকটা শট ধরে এগোচ্ছিলাম। কত স্কোর হল, পদক পাব কি না, এসব চিন্তাই করিনি তখন। আমার লক্ষ্য ছিল যে শটটা মারছি সেটা ঠিক মারা।” সোনা জয়ের সেই অভিজ্ঞতা এ বারের প্যারালিম্পিক্সে অবশ্যই সাহায্য করেছে অবনীকে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার উনরি লি-র থেকে প্রায় ৩ পয়েন্ট বেশি পেয়ে সোনা জিতেছেন অবনী।
ন’বছর আগে প্রথম রাইফেল হাতে নেন অবনী। তাঁর বয়স তখন ১৩ বছর। অবনী বলেন, “রাইফেল হাতে নিলে মনে হয় যেন একটা ঘরের মধ্যে রয়েছি। বুঝতে পারি কিছু একটা যোগ রয়েছে আমার সঙ্গে রাইফেলের। লক্ষ্য ঠিক রেখে ধারাবাহিক ভাবে শুট করে যেতে হয়, এটাই করতে ভাল লাগে আমার।”
২০১২ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় শরীরের নীচের অংশ অকেজো হয়ে গিয়েছিল অবনীর। সেই সময় তাঁর বয়স মাত্র ১১ বছর। ওখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত তাঁর জীবন। কিন্তু অবনীর বাবা সেটা হতে দেননি। মেয়েকে উদ্বুদ্ধ করেন খেলার জন্য। ভর্তি করে দেন তিরন্দাজিতে। তবে তির-ধনুক নয়, বন্দুক হাতেই নিজেকে খুঁজে পান অবনী। রাজস্থানের কলেজে আইন নিয়ে পড়াশোনা করা মেয়েটি সেই বন্দুক হাতেই ভারতকে প্রথমে সম্মান এনে দিয়েছিলেন টোকিয়োতে। এ বার সোনা প্যারিসে।
২০১৭ সাল থেকে পদক জয় শুরু করেছিলেন অবনী। যুব বিশ্বকাপে রুপো জিতেছিলেন। সেই বছর বিশ্বকাপে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে ক্রোয়েশিয়াতে রুপো জিতেছিলেন। একই ফল ২০২১ সালেও। সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে টোকিয়ো প্যারালিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন অবনী। ২০২২ সালে ফ্রান্সে সোনা জিতেছিলেন বিশ্বকাপে। ১০ মিটার এয়ার রাইফেল এবং ৫০ মিটার রাইফেল থ্রি পজিশনে সোনা জিতেছিলেন তিনি। সেই বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় বিশ্বকাপে রুপো জিতেছিলেন অবনী। এশিয়ান প্যারা গেমসেও সোনা জিতেছিলেন তিনি।
সরকারের তরফেও সাহায্য পেয়েছিলেন। ২০১৭ সাল থেকে তাঁকে যুক্ত করা হয় টার্গেট অলিম্পিক পোডিয়াম স্কিমে (টপস)। ১২টি আন্তর্জাতিক বিভাগে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন অবনী। তাঁর বাড়িতে অনুশীলনের জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বসাতেও আর্থিক সাহায্য করেছিল সরকার।
একের পর এক পদক যতটা সহজে জিতেছেন, অবনীর জীবন ততটা সহজ নয়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “শিরদাঁড়ায় অসুবিধা রয়েছে আমার। কোমরের নীচের অংশ অবশ। এখনও রোজ পায়ের ব্যায়াম করতে হয়। একজন ফিজিয়ো রোজ আসেন। করোনার সময় উনি আসতে পারেননি। আমার মা, বাবাই সাহায্য করেছেন পায়ের ব্যায়াম করতে। যতটা পেরেছে করেছে তারা। আমার ফিজিয়ো জয়পুর থেকে আসতেন। অনেকটা রাস্তা। তাই তিনি আসতে পারেননি সেই সময়। শুটিং অনুশীলনেও ব্যাঘাত ঘটে। বন্দুকে গুলি ভরে শুট করার অনুমতি নেই বাড়িতে। নিয়ম মেনে যতটা অনুশীলন করা সম্ভব, ততটাই করেছি।”
সাল ২০২১। টোকিয়ো প্যারালিম্পিক্সে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল ইভেন্টে সোনা জিতে অবনী পেয়েছিলেন বিন্দ্রার শুভেচ্ছা। ২০০৮ সালের সোনা জয়ী সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, ‘সোনা এল। শুটিংয়ে ভারতকে প্যারালিম্পিক্সে প্রথম সোনা এনে দিল অবনী। আমি গর্বিত। ইতিহাস তৈরি করা তোমার শটের জন্য শুভেচ্ছা।’
সাল ২০২৪। প্যারিস প্যারালিম্পিক্সে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল ইভেন্টে আরও এক বার সোনা জিতলেন অবনী। শুভেচ্ছা জানিয়ে সমাজমাধ্যমে লিখলেন, “প্যারালিম্পিক্সে পদক জয়ের অভিনন্দন। তোমার পরিশ্রম, দায়বদ্ধতা এবং মানসিক দৃঢ়তা দেশকে গর্বিত করেছে। শুধু পদক নয়, হৃদয় জিতে নিয়েছ। তুমি আগামী প্রজন্মের অনুপ্রেরণা।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy