মঙ্গলগ্রহ একাদশকে খেলার জন্য এখুনি ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে যদি একটা টিম বাছতে হয়, ফরোয়ার্ড লাইন তৈরিতে সবচেয়ে কম সময় যাবে।
লিওনেল মেসি।
নেইমার দ্য সিলভা।
লুই সুয়ারেজ।
আর ম্যাচটা মঙ্গলগ্রহে হলেই একমাত্র খেলতে পারতেন সুয়ারেজ। কেননা এই গ্রহের সর্বত্র আগামী চার মাসের জন্য তিনি ফুটবল থেকে নির্বাসিত। সরকারি ভাবে সাজা হল বিশ্বকাপে উরুগুয়ে আর যত দিন টিকে থাকবে, তা সমেত ন’টা আন্তর্জাতিক ম্যাচের। এমনকী ফিফার শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি তাঁর দাঁতের কামড় নিয়ে এতটাই উত্তেজিত যে তারা এই ক’মাসের মধ্যে সুয়ারেজের কোনও ফুটবল স্টেডিয়ামে ঢোকাও নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। নাটালে দ্বিতীয় রাউন্ডে কলম্বিয়ার সঙ্গে নিজের দেশের খেলা তিনি রিজার্ভ বেঞ্চ বা গ্যালারি কোথাও বসে দেখতে পারবেন না।
শোনা যাচ্ছে, উনিশ সদস্যের ফিফা শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি সর্বসম্মত ভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুয়ারেজের আইনজীবী দাবি করেছিলেন, ইংল্যান্ড আর ইতালি তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু ফিফা শৃঙ্খলারক্ষা কমিটিতে যাঁরা এককাট্টা হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, তার প্রধান সুইৎজারল্যান্ডের। সহ-প্রধান সিঙ্গাপুরের। এমনকী পাকিস্তান বা কলম্বিয়ারও সদস্য রয়েছেন। এঁদের মনে হয়েছে, ফুটবলের ভাবমূর্তি রক্ষায় এ রকম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরই প্রয়োজন ছিল।
সোজা কথা লুই সুয়ারেজকে ঘাড়ধাক্কাটুকু দিতে বাকি রেখে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে! খুব দ্রুতই তাঁর মন্টেভিডিও-গামী বিমানে ক্লিষ্ট মুখে ওঠার ছবি চলে আসা উচিত! উরুগুয়ে সরকার যতই উত্তেজনা দেখাক। ফুটবল ফেডারেশন যতই আবেদন করুক। সুয়ারেজের বিশ্বকাপটা অন্তত গেল। আর জিওর্জিও চিয়েলিনিকে কামড়ে দেওয়ার জন্য তিনি যা সাজা পেলেন, এত বড় সাজা বিশ্বকাপ ইতিহাসে নেই। চুরানব্বইয়ে স্পেন ফুটবলার লুই এনরিকের নাক ভেঙে দেওয়ার জন্য আট ম্যাচ সাসপেন্ড করা হয়েছিল ইতালিয়ান মিডফিল্ডারকে মার্কো তাসোত্তিকে। সুয়ারেজকে যে ন’ম্যাচ বাইরে বসিয়ে দেওয়া হবে সেটা ফুটবলমহল স্বপ্নেও ভাবেনি। ফিফার দেশগুলো যতই একমত হোক, ফুটবলাররা অনেকে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন তাঁর মাঠে খেলা দেখতে আসার অধিকারটাও কেড়ে নেওয়া হল দেখে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট বা টিভি চ্যানেলে অনেকেই বলছেন, ও কি অপরাধী নাকি? ও কি কাউকে খুন করেছে? কিন্তু এ সব বলায় কিছু আসে যায় না। শাস্তির সিলমোহরের উপর সই হয়েই গিয়েছে।
বিষ্যুদবার পোর্তো আলেগ্রে থেকে দু’বার ফ্লাইট বদলে বেলো হরাইজন্তে নামার সময় পারিপার্শ্বিক দেখে বারবার মনে হচ্ছিল, সুয়ারেজের অন্ধকারের মধ্যে নির্বাসিত হয়ে যাওয়াটা কী অদ্ভুত বৈপরীত্য। গোটা ব্রাজিল এখন হাসছে। নাচছে। কাপ নিয়ে তুমুল আলোচনা করে যাচ্ছে। যেখানে যান, ফুটবল থেকে নিস্তার নেই। পোর্তো বিমানবন্দরে বিশাল বিশাল সব দেশের পতাকা। বেলোয় প্রত্যেকটা দেশের জার্সির পাশে ফুল স্তুপীকৃত করে রাখা। শহরের মধ্যে একটু পরপর পোস্টার বেম ভিন্দে। আপনাকে স্বাগত। পাবে বসে লোকে রেডিও চালিয়ে পাগলের মতো পর্তুগাল-ঘানা ম্যাচের কমেন্ট্রি শুনছে। যে পাবে টিভি আছে তার বাইরে তো মেট্রো সিনেমার সামনেটার মতো গিজগিজে ভিড়। প্লেনের মধ্যেও সারাক্ষণ টিভিতে মেসি-নেইমারদের গোল দেখাচ্ছে। দেখাচ্ছে স্কোলারি-সাবেয়াদের প্রেস কনফারেন্স পর্যন্ত।
মনেই হচ্ছে না এই দেশেই মাত্র দিন সতেরো আগে কত গঞ্জনা শুনেছি বিশ্বকাপ সম্পর্কে। বিশ্বকাপের মুখ বলে লোকে পেলে-রোনাল্ডোকেও প্রকাশ্যে গালাগাল করতে ছাড়েনি। এ দিন পোর্তো থেকে রোনাল্ডোদের বেসক্যাম্প যেখানে সেই ক্যাম্পিনাস আসার সময় ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন উদ্বিগ্ন ভাবে বলছিলেন, “ব্রাজিলীয় ডিফেন্সকে আমার বিশ্বাস নেই। একটা অঘটন যদি হয়ে যায় আবার কিন্তু দেশে বিশ্বকাপ বিরোধিতা ফিরে আসবে।”
কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ প্রবক্তার সংখ্যা আর কত? ব্রাজিল যে বরাবরের চার্বাক দর্শনে বিশ্বাসী। এখন ইন্দ্রিয়সুখ কীসে— না নেইমার-মেসির যুগলবন্দিতে।
দু’জনেই চারটে করে গোল করে ফেলে গোল্ডেন বুটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, এটাই একমাত্র মিল নয়। দু’জনেই যেন নিজের নিজের টিমের হয়ে এক ঘোড়ার গাড়ি টানছেন। এঁদের চোট হলে কী হবে, ভাবনায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কোচেরা পুরো সময় মাঠে অবধি রাখতে পারছেন না। বিশ্বে এত সব প্রান্তের মানুষ এ দেশে এসে ব্রাজিল-বাসীর সঙ্গে খুশিতে মাতোয়ারা। বিয়েবাড়ির অদৃশ্য একটা প্যান্ডেল তো তৈরি আছেই যাবতীয় ডেকরেশন সমেত। তার পর বুটের কারুকার্যে যেন হাজার-হাজার ওয়াট আলোর সব ঝাড়লণ্ঠন লাগিয়ে দিয়েছেন মেসি-নেইমার। ওঁদের দুই দেশ ফাইনাল যাক বা না যাক, ব্রাজিল বিশ্বকাপের এই পর্যন্ত লাইটিংয়ের দায়িত্বে এঁরা দু’জন। বার্সার দুই সতীর্থ।
আর সেই ঝাড়লণ্ঠনের পাশে মূর্তিমান অন্ধকার যেন সুয়ারেজ। বিশ্বকাপের চুরাশি বছরের ইতিহাসে এমন কলঙ্কিত প্রস্থান সেই মার্কিন বিশ্বকাপে মারাদোনা ছাড়া কারও ভাগ্যে জোটেনি। উরুগুয়ে সাংবাদিকেরাও কেউ কেউ তাঁদের ক্যাপ্টেনের মতোই বলছেন, ইতালির জাঁদরেল ডিফেন্ডার যে এত অপুরুষোচিত মনোভাব দেখাতে পারেন তা তাঁরা ভাবতেই পারেননি। কেউ কেউ বলছেন, রেফারি যদি ক্রমাগত সুয়ারেজকে লাথি মারার জন্য ইতালি স্টপারদের আগেই সতর্ক করতেন, এই ঘটনা হত না। প্ররোচনা পুরোটাই ইতালি থেকে এসেছে।
কিন্তু ডিফেন্ডার লাথি মারলেই যদি তাকে কামড়ে দিতে হয়, তা হলে তো নেইমার-মেসির বত্রিশ পাটির প্রতি ম্যাচে ব্যবহার হওয়া উচিত। বন্যতার শাস্তি দিয়েছে ফিফা এবং আবিষ্কার করেছে, মোটামুটি বাকি ফুটবল-বিশ্ব পাশে রয়েছে।
তা বলে সুয়ারেজও এই বিশ্বকাপের একতরফা অন্ধকার নন। আলো তো তিনিও বয়েই এনেছিলেন প্রথম ম্যাচেই দু’গোল করে! দেশের হয়েও নেইমার-মেসির চেয়ে অনেক সফল তিনি।
নির্বাসনের দিন সুয়ারেজের নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে, গোল্ডেন বুটের দাবিদার আমিও তো হতে পারতাম। দুটো ম্যাচে দুটো গোল করেছি। বুফোঁ ওই শটটা দারুণ না বাঁচালে তিনটে হত। ইংল্যান্ড ম্যাচে জয়সূচক গোলের পর হাউহাউ করে কেঁদেই ফেলেছিলাম এক মাসের আগের জীবনটা মনে করে। যখন আমি হুইলচেয়ারে ঘুরছিলাম। বিশ্বকাপ খেলতে পারব কি না জানতাম না। সেই বিশ্বকাপে এলাম। এসেও নিয়তি আবার বাড়ি পাঠিয়ে দিল!
হুইলচেয়ারের অন্ধকার থেকে নিজ-কৃতিত্বে আলোয় ফিরে আবার সেই আলোটাকেই বিসর্জন দিয়ে দিলেন উরুগুয়ান। যত দিন বিশ্বকাপ থাকবে তত দিন সর্বকালের ট্র্যাজিক নায়কের নমিনেশনে তাঁর নামটাও থাকবে! অন্যদের হয়তো যন্ত্রণার বহর আরও বেশি। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকেও তো নকআউট পর্বের আগেই চলে যেতে হল। কিন্তু তাঁর একটা সান্ত্বনা আছে, এই নিষ্ক্রমণ নিছক ফুটবল স্কিলের ব্যর্থতায়। গায়ের জোরে এমন ভরা বিয়েবাড়ি থেকে আর কাউকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy