গণ-পদত্যাগের পর দিন। মোহনবাগান তাঁবুতে সদস্য-সমর্থকদের সঙ্গে সুব্রত ভট্টাচার্য। সোমবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
ভাস্কোর মোহনবাগান হোটেলে নাকি ঘুম ছুটেছে ফুটবলারদের। সনি নর্ডি থেকে শিল্টন পাল। বোয়া থেকে লালকমল ভৌমিক সবাই অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ নিয়ে দুশ্চিন্তায়। ক্লাবের ডামাডোলে সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় প্লেয়াররাই।
গোয়ায় যখন ফুটবলারদের মধ্যে নিজেদের বকেয়া টাকা, আসন্ন আই লিগ নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন কলকাতায় বাগান তাঁবুতে অদ্ভুত পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট, সচিবের পথ ধরে তাঁদের অনুগামী ফুটবল সচিব, কোষাধ্যক্ষ-সহ দশ জন কর্মসমিতি সদস্যও পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের যেন হিড়িক পড়েছে। বিকেলে ক্লাব তাঁবুতে আরও বড় নাটক। ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট, রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় হঠাত্-ই কর্মসমিতির সভা ডেকে দিলেন কালই। কলকাতায় ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী থেকে শহরের মেয়র, মেয়র পারিষদ প্রায় সবাই। যাঁদের অনেককেই বহুদিন দেখা যায়নি ক্লাব চত্বরে। যে যাঁর মতো করে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিতে শুরু করেছেন। শ’দেড়েক কট্টর বাগান সমর্থক ভিড় করেছেন ক্লাবে। উদ্বিগ্ন ভাবে ক্লাবের বর্তমান হাল জানতে।
কর্মসমিতির বৈঠক ডেকে কী হবে কেউ জানে না। ক্লাবের নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। ছয় জনের কমিটি কাজও শুরু করেছে। ফেব্রয়ারির শেষ নাগাদ নির্বাচন করার ইচ্ছে কমিটির। প্রশ্ন হল, প্লেয়ারদের বকেয়া টাকা দেবে কে? ফুটবল টিমে সবার মিলে পেমেন্ট বাকি প্রায় দেড় কোটি টাকা। কো-স্পনসর না থাকায় সেই টাকা আসবে কোথা থেকে? স্পনসর যে টাকা দেয় তার চেয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা ইতিমধ্যেই বেশি খরচ হয়ে গিয়েছে এ মরসুমের টিম তৈরিতে।
প্রতিবারই টিম গড়তে দুই থেকে তিন কোটি টাকা দিতেন পদত্যাগী প্রেসিডেন্ট টুটু বসু। সারদা-কাণ্ডের জেরে তাঁর পুত্র ক্লাব সহ-সচিব সৃঞ্জয় বসু এখনও হাজতে। টুটুবাবু এতটাই মানসিক ভাবে ভেঙে রয়েছেন যে, বাগান নিয়ে এখন তাঁর ভাবার সময়ই নেই। অথচ তাঁকে ঘিরেই গত আড়াই দশক চলেছে বাগানের শাসকগোষ্ঠী। সূত্রের খবর, সামনের মরসুমে আরও বড় সমস্যায় পড়তে পারে মোহনবাগান।
পরেরবার স্পনসরশিপ তুলে নিতে পারে ম্যাকডাওয়েল। হঠাত্-ই এরকম সম্ভবনা তৈরি হয়েছে। বিজয় মাল্য তাঁর ইউনাইটেড স্পিরিট লিমিটেডের অর্ধেকেরও বেশি শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন যে কোম্পানিকে সেই আন্তর্জাতিক পানীয় সংস্থাটি খেলায় স্পনসরশিপের বাজেট কমিয়ে দিতে চাইছে। নভেম্বরেই বোর্ড মিটিংয়ে প্রথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিজয় মাল্য যে খেলাগুলোয় স্পনসর করতেন তার মধ্যে ফমুর্লা ওয়ান এবং মোহনবাগানকে আর টাকা দেওয়া হবে না। তাদের এই সিদ্ধান্তের পিছনে কারণ শোনা যাচ্ছে, বাগানে টাকা ঢেলে কোম্পানি কোনও বাড়তি মাইলেজ পাচ্ছে না। বাগানে দীর্ঘদিন ট্রফি নেই। এএফসি কাপেও বহুদিন খেলছে না ক্লাব। পদত্যাগী ক্লাব সচিব অঞ্জন মিত্র অবশ্য এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাইছেন না। “এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনও খবর নেই। আমি ম্যাকডাওয়েল-মোহনবাগান কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করেছি।” তবে বোঝা যাচ্ছে, নির্বাচনে যে গোষ্ঠীই আসুক, বিশাল দেনা তাদের মেটাতে হবে।
হঠাত্ নাটকীয় পদত্যাগ করে টুটু-অঞ্জন-দেবাশিসরা ক্লাবের এই আর্থিক শূন্যতাই হয়তো দেখাতে চাইছেন সবুজ-মেরুনের অসংখ্য সদস্য-সমর্থকদের। নিজেরা দেখতে চাইছেন সুব্রত ভট্টাচার্যের মতো যাঁরা নিয়মিত শাসক গোষ্ঠী বিরোধী কথা বলে আসছেন এত দিন, তাঁরা কী করেন এ বার? বাগানের ঘরের ছেলে সুব্রত এ দিন বিকেলে এসেছিলেন ক্লাব তাঁবুতে। ক্লাবের প্রশাসনে আসবেন কি না প্রশ্ন করা হলে বলেন, “ক্লাব প্রশাসনে আসব কি না এখনই তা নিয়ে ভাবছি না। পরে পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেব।” তাঁকে ঘিরে ধরে একদল সমর্থক অবশ্য দাবি তোলেন, “বাবলুদা আপনি ক্লাবের হাল ধরুন।” এক বছর আগে আই লিগ থেকে দ্বিতীয় ডিভিসনের নেমে যাওয়ার আশঙ্কায় বাগান তাঁবুতে মোমবাতি মিছিল থেকে পোস্টার আবেগের বিস্ফোরণ ঘটেছিল হাজার হাজার সমর্থকের। এ দিন অবশ্য তা দেখা যায়নি। বরং অনেক থমথমে ছিল তাঁবু। রাজনৈতিক নেতাদের দাপাদাপি সত্ত্বেও এসেছিলেন বড় জোর শ’দেড়েক সদস্য-সমর্থক। আসলে সবাই ধরে নিয়েছেন একটা নাটক চলছে। কিছু হবে না ধরে নিয়ে হতাশাও গ্রাস করেছে হয়তো।
ক্লাবের বিরোধী গোষ্ঠী বলে সে রকম কেউ নেই এখন। বিরোধী আছে, তবে তা বহু বিভক্ত। কোনও জোটও নেই। বলরাম চৌধুরীদের মতো যাঁরা আছেন তাঁরা বলা যায় জল মাপছেন। বিশাল দেনা থাকলে তাঁরা আর নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাবেন না বলেই খবর। “কে আনবে এত টাকা, কোথা থেকে আসবে টাকা, বাজার যা খারাপ। নির্বাচনে নামার আগে দেখতে হবে কত টাকা দেনা রেখে যাচ্ছে ওরা,” বলে দিয়েছেন ব্যবসায়ী বলরাম।
সোজা কথা, ক্লাবের আর্থিক দূরবস্থায় কেউ এসে বাঁচাবে ক্লাব, এই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে পদত্যাগ করে এখন যেন মজা দেখছেন অঞ্জন-দেবাশিসরা। টিমের ব্যর্থতা একটা অজুহাত মাত্র। প্রায় আড়াই দশক কুর্সিতে থাকা শাসকগোষ্ঠীর কর্তারা জানেন, ক্লাবের যা আর্থিক অবস্থা কেউ কিছুই করতে পারবে না। সহানুভূতির ভোট তাঁদের দিকে যেতেই পারে। সে জন্যই নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করতে চাইছেন তাঁরা। ঠিক হয়েছে, আজ কর্মসমিতির সভায় ভাইস প্রেসিডেন্টদের কোনও একজনকে কমিটির মাথায় বসিয়ে তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। টুটু-অঞ্জনরা হয়তো কিছু দিন এ নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। অঞ্জন অবশ্য এ দিনও হতাশ ভঙ্গিতে ফের বলেছেন, “এত চেষ্টা করলাম। তবু ট্রফি এল না। খারাপ লাগছে।” নির্বাচন কমিটিতে প্রাক্তন বিচারপতি-সহ ছ’জন রয়েছেন। সচিব এবং পদাধিকার বলে রয়েছেন অঞ্জন। তিনি কি নির্বাচন কমিটিতে থাকবেন? “এখনও ভাবিনি। ভাবার মতো মানসিক অবস্থা নেই।” বলে দিয়েছেন তিনি।
এই তীব্র অনিশ্চিত আবহে ফেড কাপে আজ নিয়মরক্ষার ম্যাচ খেলতে নামছেন সঞ্জয় সেনের ছেলেরা। শিলং লাজংয়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই ম্যাচে সান্ত্বনা জয় পেতেও মন দেবেন কী, কাতসুমি-প্রীতমদের সকলের চিন্তা বকেয়া পেমেন্ট নিয়ে। মধ্য জানুয়ারিতে শুরু হতে চলা আই লিগে বাগান খেলবে কি না তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত কেউ কেউ। সিনিয়র ফুটবলার দেখলেই ক্লাব নিয়ে প্রশ্ন করছেন দলের নতুন ফুটবলাররা। বাগানের এক সিনিয়র ফুটবলার বলছিলেন, “কী আর বলব! সবাইকে বলছি, আগেও সমস্যা হয়েছে। মিটেও গেছে। এ বারও যাবে।”
ক্লাবের নাটকীয় পরিস্থিতিতে এটাই আপাতত সান্ত্বনা সনি-শিল্টনদের। মিটে হয়তো যাবে, কিন্তু কী ভাবে কেউ জানে না বাগানে! কবে তা-ও কেউ বলতে পারছেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy