৫৫ বলে ১১৫*। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
বেঙ্গালুরু ফাইনাল শুরু হওয়ার আগে বাংলা ক্রিকেটারদের রোববার সান্ধ্যকালীন আড্ডায় টিমের অঙ্গসংবাহক হঠাৎই বলতে থাকেন, আজ ঋদ্ধিমান সেঞ্চুরি করবে।
বিকাশ কুণ্ডু নামের এই অঙ্গসংবাহক ক্রিকেট নিয়ে যে সব পূর্বাভাস করেন, তার কিছু কিছু মিলে যায় বলে টিমমেটদের তাঁর জ্যোতিষচর্চায় মৃদু প্রশ্রয়ও আছে। ঋদ্ধি এই মরসুমে দারুণ ব্যাটও করছেন। তা বলে আইপিএল ফাইনালে সেঞ্চুরি! হাঁ হাঁ করে ওঠেন লক্ষ্মী-সৌরাশিসরা। হাতের কাছে থাকা সহ খেলোয়াড়রাই বিশ্বাস করতে চায়নি তো ভারতবর্ষ কোন ছার! সাত বছরের আইপিএলে প্রথম ফাইনালে সেঞ্চুরি হবে। আর তা-ও করবে কিনা এক বাঙালি! আর তার নাম হবে ঋদ্ধিমান সাহা! এই মর্মে খেলার আগে বাজি ধরা হলে ফাটকার দর কত হত ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছি না। ১০,০০০-১? নাকি তার চেয়েও বেশি?
আইপিএলে বাঙালির প্রথম রোমাঞ্চকর সেঞ্চুরি এটা যদি বিস্ময়ের ডিগ্রিতে প্রচুর ওপরে হয়, তার চেয়েও বড় বিস্ময়, আধুনিক মিডিয়া অধ্যুষিত সময়ে ভারতের দ্বিতীয় উইকেটকিপারের এমন বিনম্র উপস্থিতি। শিলিগুড়ির ছেলে বহু দিনই কলকাতার বাসিন্দা। কিন্তু বরাবর নিজের উপস্থিতি এমন রেখে দিয়েছেন যেন ভিড়ে ঠাসা বাসের এক যাত্রী। যার পৃথক কোনও মুখ নেই। বিশেষ কোনও অস্তিত্ব থেকেও নেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন সাড়ে চার বছর অথচ কলকাতায় ক্রিকেট মহলের নিরানব্বই শতাংশ লোক তাঁর বাড়ি চেনে না।
ঋদ্ধি কোথায় থাকেন জিজ্ঞেস করলে খুব সামান্য অংশ উত্তর দিতে পারবেন, ওই রাজারহাটের ও দিকে।
রাজারহাট এত বড় জায়গা সেখানে কোথায়? উত্তর কেউ প্রায় দিতেই পারবে না। কেউ কেউ বলবে ইউনিটেক বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি। কেউ বলবে ওই একটা কোনও উঁচু বাড়িতে।
শুধু এই সূত্রের ওপর ভিত্তি করে কী করে খুঁজে পাওয়া যাবে কারও বাড়ি? পাওয়া যায় যদি তার খ্যাতির কোনও সাড়াশব্দ থাকে। হাওড়া গিয়ে লক্ষ্মীরতন বা মনোজের বাড়ি পাওয়াটা মোটেও কঠিন নয়। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে জিজ্ঞেস করতে করতে এখনও উৎপল চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ঋদ্ধিকে খুঁজে পাবেন কী করে? পাড়ার ইস্ত্রিওয়ালাও তাঁর বাড়ি চিনবে এমন ভরসা কারও নেই।
স্থানীয় ক্রিকেটারদের ঘরোয়া আড্ডায় ঋদ্ধি সম্পর্কে বরাবরই অপর্যাপ্ত প্রশংসা। এই বছর টি-টোয়েন্টিতে এত ভাল খেলার রহস্য কী বিস্ময় প্রকাশ করলে তাঁর সহ খেলোয়াড়দের কেউ কেউ বলবেন, ‘ওকে খালি গায়ে কখনও দেখেছেন? ঠিক ব্রুস লি।’
সমস্যা হল, সেটা শুনেও কেউ বিশ্বাস করতে চায়নি। ভারতের সবচেয়ে নিখুঁত উইকেটকিপার এই পর্যন্ত গিয়েও লোকে হ্যাঁচকা ব্রেক মেরেছে, দুর! ব্যাটিংটা নেই। কেউ আরও বিরক্ত হয়ে বলেছে, কোনও বাহার নেই। এই মানচিত্রে থেকে, সবার চোখের সামনে থেকেও অজ্ঞাত থাকার জন্য যিনি যথাসাধ্য করেছেন, তিনি অবশ্যই ঋদ্ধিমান সাহা।
কেকেআরে যে তিন বছর ছিলেন ম্যাকালাম আর বিসলার দুনিয়ায় তাঁর উপস্থিতি কেউ গ্রাহ্যই করেনি। এর পর তিন বছর কাটল ধোনির সংসারে। আলো থেকে ছায়ায় চলে আসাটা এইখানে নিশ্চিত হয়ে গেল। ধোনির ছায়া হয়ে গেলেন ঋদ্ধি। যাঁর ভূমিকাটা খুব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় কখনওই ইন-চার্জ হবে না। মাঝে মাঝে অ্যাক্টিং ইন-চার্জ হতে পারো। আর তুমি থাকবেই শুধু, কখনও ব্র্যান্ড হবে না। টাকা ভাল পাবে। কিন্তু পরিচিতি পাবে না। এই সময় ঋদ্ধিকে অনেকেই বলেছেন, তুই ধোনির ছায়া হয়ে পড়ে আছিস কেন? সিএসকে ছেড়ে দে। ঋদ্ধি শুনেছেন, কান দেননি। টুইটার অ্যাকাউন্ট খোলা ছাড়া নিজস্বতা দেখানোর ন্যূনতম চেষ্টা করেননি। তা টুইটারেও ক’জনেরই বা আগ্রহ থাকবে তাঁকে নিয়ে। তারকা ক্রিকেটারদের যেখানে গড়ে সত্তর-আশি হাজার ফলোয়ার থাকে, সেখানে ঋদ্ধির মাত্র দু’হাজার। ধোনির কারাগারই তাঁর নিয়তি এই স্থির বিশ্বাসের জগৎ থেকে রোববার মুক্ত আকাশে উত্তরণ ঘটল ঋদ্ধিমান সাহার। আর ছায়া নন তিনি। কারও ডামি না। নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ। আর বাঙালির প্রথম আইপিএল সেঞ্চুরি এল এমন প্রভাবশালী ম্যাচে যা সৌরভ পরবর্তী সময়ে বাঙলা ক্রিকেটের সেরা বিজ্ঞাপন হয়ে থাকল।
এর পর রাজারহাটে বাড়িটা খুঁজতে আর সমস্যা হওয়া উচিত নয়। পানওয়ালা বা ইস্ত্রিওয়ালা, যারই সাহায্য নেওয়া যাক। ঋদ্ধি যে এখন গারদের বাইরে এক মুক্ত মানুষ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy