বাকি দিনগুলোর মতো সেই দিনও দু’চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঘুম ভেঙেছিল নসিমার। টিটাগড়ের গ্রামের স্কুলের প্রার্থনা, পড়াশোনা, সেলাই সব কিছু নিয়ে ১৭ বছরের তরতাজা মেয়েটার সকালটা তার পর বইতে শুরু করেছিল অন্য দিনগুলোর মতোই। অভাবের সংসারে মা কাজে বেরিয়ে গিয়েছে অনেক সকালে। দুই দাদাও বাড়িতে নেই। উঠোনের কলতলায় জামা কাপড় কাচতে বসেছিল নসিমা। তখনও সে জানতো না এটাই তার জীবনের ‘শেষ দিন’। এর পর বাকিটা ভরে যাবে রাতের চেয়েও গভীর অন্ধকারে।
নসিমার পাড়াতেই থাকতো জাফর। নসিমার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আগ্রাসী তরুণের মাথায় চেপে গিয়েছিল বদলা নেওয়ার জেদ। পুরুষের প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার ধৃষ্টতা যে মেয়ে রাখে তাকে দিতে হবে উচিত শিক্ষা। জাফর জানত সেই সময় বাড়িতে একা রয়েছে নসিমা। মৃত্যু দূতের মতো তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। আচমকা মুখে ছুড়ে মারে ঝাঁঝালো অ্যাসিড…
টানা এক মাস হাসপাতালের খরচ চালাতে দোরে দোরে সাহায্য চেয়ে ফিরেছেন মা, দুই দাদা। আশ্চর্যজনকভাবে গোটা মহল্লাতেও তেমন কেউ বাড়িয়ে দেয়নি সাহায্যের হাত। দু’চোখ অন্ধ হয়ে যায় নসিমার। গ্রামের স্কুলে বিচার সভা বসানোর কথা হলেও আসেননি জাফরের বাবা। ‘সময় নেই, অনেক কাজ আছে’ বলে ছেলের অপরাধের মুখোমুখি দাঁড়ানোটা এড়িয়ে গিয়েছেন বাবা। পুড়ে যাওয়া মুখ আর অন্ধ মেয়েটাকে নিয়ে, ন্যূনতম অর্থ সম্বল করে, চোখের চিকিত্সার জন্য অমৃতসর থেকে মুম্বই ছোটাছুটি করেছিলেন মা। কিন্তু দৃষ্টি ফেরেনি।
এরপর শুরু হয় বাড়িতে বসে গুমরে মরার কঠিন সময়। একটা ঘরের মধ্যেই ১২ বছর বসে থেকেছেন নসিমা। নিজের বাড়ির উঠোনেও পা রাখেননি এক যুগ। সাহস হয়নি। এ দিকে তিন মাস পুলিশ হেফাজতে থাকার পর ছাড়া পেয়ে যায় জাফর। বিয়ে করে সংসার পাতে।
নসিমার গল্প তো এ দেশের অনেক মেয়েরই। তবে কেন তার কথা বলছি? কারণ, এখান থেকেই যে শুরু হচ্ছে গল্পের দ্বিতীয় ভাগ।
উহিনী সদস্য শর্মিষ্ঠা দাসের সঙ্গে নসিমা ও তাঁর মা
তিন বছর আগে হঠাত্ই নসিমার জীবনে আসে উহিনী। থিয়েটার ও সমাজ সেবার কাজে ১৪ বছর ধরে যুক্ত সংগঠন উহিনী টিটাগড়ে পৌঁছেছিল নিজেদের কমিউনিটি বেসড রিহ্যাবিলিটেশন প্রকল্প নিয়ে। আর্থিক ভাবে দুর্বল মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বাড়িতেই সাইকোলজিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, স্পেশাল এডুকেটরদের পরিষেবা পৌঁছে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য। খুঁজতে খুঁজতেই পৌঁছে যান নসিমার বাড়ি। ‘‘প্রকল্পের জন্য নসিমার ছবি চাওয়া হলে আমাদের নসিমার ১৭ বছরের ছবি দেওয়া হয়। নতুন ছবি দিতে সঙ্কোচ বোধ করছিল পরিবার। অবশেষে যখন সেই ছবি দেখি তখন শিউরে উঠেছিলাম। কী বীভত্স!’’ কথাগুলো বলছিলেন উহিনীর মূল উদ্যোক্তা সঞ্জয় দাস।
ভয়ে বাড়ির বাইরে আসতে চাননি নসিমা। নিজের অন্ধকার জগতে সেঁধিয়ে থাকা নসিমা কারও সঙ্গে কথাও বলতে চাননি। কিন্তু হাল ছাড়েনি উহিনী। শুরু হয় নসিমাকে ট্রমা থেকে বের করে আনার কাউন্সেলিং। পুনর্বাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে মোবিলিটি ট্রেনিং-এর অংশ হিসেবে নসিমার হাতে শুধু একটা লাঠি তুলে দেওয়া হয়েছিল। ‘‘প্রথম যখন বাড়ির বাইরে বের হন তখন থরথর করে কাঁপছিলেন নসিমা।’’ চোখের সামনেই যেন সে দিনটা দেখতে পাচ্ছিলেন সঞ্জয়।
নসিমাকে নতুন জীবন দেওয়ার পর উহিনী খুঁজছিল প্রতিবাদের ভাষা। মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে থিয়েটার করা উহিনী এ বার নসিমার গল্প মঞ্চে নিয়ে আসার কথা ভাবতে থাকে। হিন্দিতে লেখা হয়ে যায় আধ ঘণ্টার স্ক্রিপ্ট। প্রথমে অন্য কাউকে দিয়ে অভিনয় করানোর কথা ভাবলেও হঠাত্ই নসিমার কথা মাথায় আসে সঞ্জয়ের। যে নসিমা প্রথমে রাজি হননি, পরে তিনিই শুধুমাত্র এই কাজটা ভাল করে করার জন্য রোজা রাখতে শুরু করেন। গত বছর প্রথম নিজের চরিত্রে মঞ্চে নামেন নসিমা। হলভর্তি দর্শকের সামনে মানুষের ভিতরের পাপকে নষ্ট করার কসম খান।
মঞ্চে উহিনীর গোটা নাট্যদলের সঙ্গে নসিমা
নিজের জীবন কী ভাবে দেখেন তিনি? নসিমা জানালেন, “১৫ বছর আগে আমি খুব ভাল ছিলাম। জীবনে খুশি ছিলাম। কিন্তু জাফর আমার জীবনের সব খুশি কেড়ে নেয়। পড়াশোনা শিখেও আমি কোনও কাজে আসতে পারলাম না। আমার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। বাড়িতে বসে থাকতাম, সারা দিন কাঁদতাম। আর চাইতাম জাফর আমার সঙ্গে যা করেছে, তা যেন আর কোনও মেয়ের সঙ্গে না হয়। আর সেই কারণেই নাটকে অভিনয় করতে রাজি হই আমি। প্রথমে যথন জানতে পারি আমার জীবন নিয়ে ওরা নাটক বানাতে চায় তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, জীবন যেমন চলছে তেমনই চলুক। কিন্তু ধীরে ধীরে সাহস বাড়াতে থাকি নিজের। আল্লাপাক আমার সাহস বাড়ান। যাতে সমাজে এমন কোনও ঘটনা না ঘটে। আর কেউ যেন জাফর না হয়, কেউ যেন নসিমা না হয়, সেই জন্যই মঞ্চে নামি আমি। এখন এই নাটকের মধ্যে থেকেই নিজের জীবনের খুশি খুঁজে পাই। ১২ বছর আমি ঘরে বসে কেঁদেছি। কিন্তু এখন আমি আর কাঁদবো না। আর কোনও মেয়ে যেন না কাঁদে। তাই আমাকে সাহস বাড়াতে হবে। গোটা দুনিয়ার সামনে আমি এখন আমার জীবন কাহিনি তুলে ধরতে চাই। লোকে তো অনেক কিছুই বলবে। কিন্তু আমাকে নিজের সাহস বাড়াতে হবে। আমাকে এই পৃথিবীতে বাঁচতে হবে। কেঁদে নয়, মুখে হাসি নিয়েই বাঁচতে চাই আমি।’’ আর জাফর? শাস্তি দিতে চান না তাকে? ‘‘যদি কেউ কোনও মেয়ের সঙ্গে এমন করে তাহলে তার দু’হাত, দু’পা কেটে দেওয়া উচিত। যাতে আর কেউ এমন কাজ করার সাহস না পায়। বার বার এরা শুধু তিন মাসের জেল খেটে ছাড়া পেয়ে যায়। তাই বার বার জাফর তৈরি হচ্ছে।’’ কথাগুলো বলতে বলতে আজও থরথর করে কাঁপছিলেন নসিমা।
নাসিমা অভিনীত নাসিমারই জীবন কাহিনী নিয়ে তৈরি হিন্দি নাটক ‘শুভারম্ভ’ সম্প্রতি হয়ে গেল ইজেডসিসিতে। আগামী ২৪ অগস্ট আবার শো আছে গিরিশ মঞ্চে। দুই নারীর গল্প নামাঙ্কিত অনুষ্ঠানে ‘রাণীর ঘাটের বৃত্তান্ত’ ও ‘শুভারম্ভ’ নিয়ে আসছে উহিনী।
আরও পড়ুন: শিশুর বুদ্ধি বাড়াতে স্তন্যপান করান ২৮ দিন পর্যন্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy