ওড়ার ইচ্ছেটা ছিল বরাবরের। প্রতিবন্ধকতা শব্দটা নিজের অভিধানে কখনও খুঁজে পাননি তিনি। বাধা ছিল, বিপত্তিও ছিল একশো’টা। কিন্তু দমে যাওয়া কাকে বলে শেখেননি কোনও দিন। কর্কট রোগ নামটা শুনলে যেখানে লোকে ধরেই নেয় আর ক’দিনের মধ্যেই শেষ হবে জীবন, ঠিক সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইটা শুরু করেছিলেন ইনি। ‘জেট সেট গো’ বলে উড়লেন নীল আকাশে। কণিকা তেকরিওয়াল। এই মুহূর্তে ভারতের অন্যতম কনিষ্ঠ শিল্পপতিদের এক জন। এবং ভারতের প্রথম প্রাইভেট জেট ভাড়া দেওয়ার কোম্পানি ‘জেট সেট গো’-এর মালকিন।
নিজের স্বপ্নউড়ানের সঙ্গে
ভোপালের মারওয়ারি পরিবারে বড় হয়ে ওঠা। ব্যবসা তাঁর রক্তে। ছোট থেকেই ইচ্ছে ছিল নিজে কিছু করার। আর ভালবাসা ছিল উড়োজাহাজের সঙ্গে। ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিন্যান্সে এমবিএ করে কখনও ‘বুলস এভিয়েশন’, কখনও ‘এরোস্পেস রিসোর্স’— উড়োজাহাজকে ছাড়তে পারননি কোনও দিনই।কিন্তু ঠিক যখন নিজের কিছু একটা শুরুর পরিকল্পনা মাথায় ঘুরছে, তখনই মারণ রোগের কামড়। বয়সটা তখন মাত্র ২২। কণিকা বললেন, ‘‘লুকিয়ে রাখিনি কখনও। ক্যানসার নিয়ে কথা বলতাম, চর্চা করতাম। এতেই মনোবল ফিরে পেয়েছিলাম অনেকটা। আমার চিকিৎসক বলেছিলেন, খুব কম সময় রয়েছে হাতে। সে দিনই ওই ডাক্তারকে গুড বাই বলেছিলাম। অন্য ডাক্তারের কাছে গেলাম। ন’মাস ধরে কেমো চলেছিল। যন্ত্রণায় সোজা হতে পারতাম না। কিন্তু লড়াই ছাড়িনি’’
কণিকার মতে, ক্যানসারের জন্য একটা জিনিস অন্তত ভাল হয়েছিল। নিজের ব্যবসা শুরুর আগে নাকি এই ‘ব্রেক’টা তাঁর কাছে খুব জরুরি ছিল। ‘জেট সেট গো’-র জন্য অনেক নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে মাঠে নামতে পেরেছিলেন কণিকা।
ক্যানসারকে হারিয়ে সেই পথ চলা শুরু। ছোটবেলার নেশা পেশায় পরিণত হল ‘জেট সেট গো’-র ডানায় ভর করে। ভারতের প্রথম ‘আকাশ ট্যাক্সি’ বলা যেতে পারে একে। প্রাইভেট জেট। ট্যাক্সি, ওলা বা উবরের মতোই ভাড়া করা যায় এই জেট প্লেন। গ্যাঁটের কড়ি খরচা করলেই আকাশপথে উড়িয়ে আপনার গন্তব্যে পৌঁছে দেবে এই জেট বিমানগুলি। শুধু দেশের মধ্যে মুম্বই, বেঙ্গালুরু, দিল্লিই নয়, দুবাই, নিউ ইয়র্কেও আপনাকে নিয়ে পাড়ি দিতে তৈরি ‘জেট সেট গো’।
ফোর্বসের অনূর্ধ্ব ৩০-এর তালিকায় নাম তুলেছেন ২৭ বছরের কণিকা
কিন্তু যেখানে জেট কোম্পানিগুলোর মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরুষতন্ত্র রাজত্ব করে সেখানে কণিকার মাথা গলানোটা কতটা সহজ ছিল? ‘‘একেবারেই ছিল না’’— বলছেন কণিকা নিজেই। ‘‘কেউ আমাকে সিরিয়াসলি নিতেই চাইত না। আমি বরাবরই কাজের ব্যাপারে একটু জেদি। সমাজের কাছে আমার কাছে এই জেদটা ছিল অহঙ্কার। অথচ অন্য পুরুষ সহকর্মীদের বেলায় সেটাই ছিল প্যাশন। এগুলো শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।’’
নিন্দুকদের পাশেই সরিয়ে রেখেছেন চিরকাল। সেই নিন্দুকদের মুখে ছাই দিয়েই ২০১৩ সালে নতুন করে শুরু হল ‘জেট সেট গো’। ট্যাক্সি সার্ভিসের পাশাপাশি শুরু হল হেলিকপ্টার সার্ভিসও। কাস্টমারদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে শুরু হল ‘জেট সেট ওয়েড’। ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ে অন্য মাত্রা যোগ করল এই নতুন ব্যবস্থা। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হল ‘জেট সেট রেসকিউ’। কোনও সঙ্কটকালীন অবস্থায় উদ্ধারকার্যে অংশ নিতে পারে এই জেট বিমানগুলি। উন্নত লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের পাশাপাশি এতে রয়েছে এমারজেন্সি মেডিক্যাল পরিষেবাও। পাশাপাশি ‘জেট সেট গো’-তে রয়েছে ‘জেট সেট যাত্রা’। বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি এই জেট বিমানগুলি।
‘জেট সেট গো’-র কপ্টারে কণিকা
কী ভাবে একা হাতে এতকিছু সামলান কণিকা? উত্তর দিলেন নিজেই। ‘‘আমার মনে পড়ে না সাম্প্রতিক অতীতে কাজ ছাড়া আমি অন্য কিছু করছে বলে। টেকনোলজি, ফিন্যান্স, মার্কেটিং সবটাই আমার ভীষণ পছন্দের। তবে হ্যাঁ, আঁকতে আর বই পড়তেও আমি খুবই ভালবাসি। আসলে কোনও একটা দিনও আমি এক রকম ভাবে কাটাই না। রোজই নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করি।’’
গত বছরই ফোর্বসের অনূর্ধ্ব ৩০-এর তালিকায় নাম তুলেছেন ২৭ বছরের কণিকা। বিবিসি-র উদ্যমী মহিলাদের তালিকার সাত নম্বরে ছিলেন কণিকা। শুধু তাই নয়, ‘ন্যাশনাল এন্ট্রিপ্রিনিউয়ারশিপ অ্যাওয়ার্ড’-টিও পুরেছেন নিজের পকেটে।
‘‘জীবনের প্রত্যেকটা ‘না’ আসলে ‘হ্যাঁ’-এর পথ প্রশস্ত করে। ‘না’ গুলোকে ‘হ্যাঁ’ করতে করতেই একটা সফল জীবনের পথে এগিয়ে চলি আমরা’’, ক্যানসারকে হার মানিয়ে দৃপ্ত কন্ঠে বললেন এই মুহূর্তে সাত কোটি ডলারের মালকিন কণিকা তেকরিওয়াল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy