গ্র্যাজুয়েট হতে পারেননি। তার কারণ, ওই সময় বিজ্ঞান বিভাগেও সংস্কৃত আর দর্শনশাস্ত্র ছিল। ওই দু’টি বিষয়েই তিনি পাশ করতে পারেননি। তবে অঙ্কে ১৫০-র মধ্যে পেয়েছিলেন ৮৫।
এটা জানলে তো এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে, রামানুজনের মতো অঙ্কের এক বিস্ময়কর প্রতিভা কেন ১৫০-র মধ্যে ৮৫ নম্বর পেয়েই থেমে গিয়েছিলনে? তাঁর তো ১৫০-য় ১৫০ পাওয়ার কথা!
সেই ‘ধাঁধা’র আসল উত্তরটা হল, রামানুজন প্রশ্নপত্রের শুধু চ্যালেঞ্জিং অঙ্কগুলিই কষেছিলেন, পরীক্ষার হলে। মানে, যে অঙ্কগুলি কষতে বেশির ভাগ পরীক্ষার্থীরই সাহসে কুলোয়নি! যেগুলো তেমন চ্যালেঞ্জিং নয়, সেগুলো কষার তিনি চেষ্টাও করেননি। আসলে ওই চ্যালেঞ্জিং অঙ্কগুলো কষতেই তাঁর সময় ফুরিয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত, রামানুজন নিজেও বুঝে গিয়েছিলেন, পরীক্ষায় পাওয়া নম্বর দিয়ে কখনওই ঠিকঠাক ভাবে মেধার বিচার হয় না।
আরও পড়ুন- অঙ্ক নিয়ে খেলতে খেলতে যিনি ‘কম অঙ্কেই’ চলে গেলেন!
গ্র্যাজুয়েট হতে না পেরে লাইব্রেরিতে বইয়ের সমুদ্রেই ডুবে গিয়েছিলেন রামানুজন। সেই সময়েই লাইব্রেরিতে হঠাৎ পেয়ে যান অঙ্কের একটি বই- ‘আ সিনপ্সিস অফ এলিমেন্টারি রেজাল্টস ইন পিওর অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিক্স’। ওই বইটিই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। যদিও বইটি কোনও টেক্সট বুক নয়। তা ছিল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসার জন্য প্রস্তুতির বই। যাতে শুধুই বিবৃত করা ছিল প্রচুর উপপাদ্য। কিন্তু কোনওটিই প্রমাণ করা ছিল না। রামানুজন ওই বইয়ের প্রতিটি উপপাদ্যই নিজে প্রমাণ করেছিলেন। আর তা করেছিলেন একেবারেই তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে। পরে অনেক গণিতবিদ যে সমাধানগুলো দেখে চমকে গিয়ে বলেছিলেন, এত সহজে ওই উপপাদ্যগুলোকে প্রমাণ করা যায়? ওই সময়েই রামানুজন নিজেই অনেক নতুন উপপাদ্য ও তাদের ফলাফল আবিষ্কার করেছিলেন।
কিন্তু গরীব পরিবারের ছেলে। খাওয়ার ভাতই জুটত না তেমন ভাবে, পড়ার খরচ জোগাড় করবেন কোথা থেকে!
তাই রামানুজন তখন একটা ‘ফেলোশিপ’ বা বৃত্তি পাওয়ার জন্য একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। রামানুজনের সেই দুঃসময়ে এস রাও, রামস্বামী আইয়ারের মতো দাক্ষিণাত্যের সেই সময়কার জনাকয়েক বিশিষ্ট গণিতবিদ চিনতে পেরেছিলেন রামানুজনের গণিত প্রতিভাকে। কিন্তু কোনও প্রথাগত ডিগ্রি ছিল না রামানুজনের। তাই তাঁর পক্ষে এ দেশে কোনও ‘ফেলোশিপ’ পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
রাও, আইয়ারের মতো গণিতবিদরাই তখন রামানুজনকে পরামর্শ দেন, তাঁর প্রয়োজনের কথা জানিয়ে বিদেশি গণিতবিদদের চিঠি লিখতে। তাঁরা যদি কেউ তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান! সেই পরামর্শ শুনে রামানুজন তিন জন বিশিষ্ট বিদেশি গণিতবিদকে চিঠি দেন। প্রথম দু’জন তার কোনও জবাব দেননি। তৃতীয় জন ছিলেন বিশিষ্ট ব্রিটিশ গণিতবিদ জি এইচ হার্ডি। তাঁকে ১০ পাতার চিঠি পাঠান রামানুজন। সেখানে তাঁর কষা প্রায় ২০০ উপপাদ্য তিনি পাঠিয়েছিলেন হার্ডিকে।
হার্ডি সেটা পেয়ে খুব অবাক হয়ে যান। এত সহজে এত উপপাদ্যের সমাধান করা যায়? বিস্ময় নিয়ে হার্ডি ছুটে যান আরেক বিশিষ্ট গণিতবিদ লিটলউডের কাছে। লিটলউডও বলেন, ‘‘এ তো ভাই একটা অসাধারণ প্রতিভা!’’ এর পর হার্ডি রামানুজনকে লম্বা একটা প্রশংসা পত্র পাঠান। আর তাঁকে ইংল্যান্ডে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান।
কিন্তু রামানুজন ছিলেন অত্যন্ত গোঁড়া ও রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের ছেলে। নিজেও ছিলেন আদ্যোপান্ত গোঁড়া। ‘কালা পানি’ পেরতে হবে বলে রামানুজন প্রথমে ইংল্যান্ডে যেতে রাজি হননি। কিন্তু হার্ডির মতো এক জন গণিতবিদের প্রশংসা পত্র তখন তাঁর পকেটে চলে এসেছে বলে রামানুজন সেই সময় একটি ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলোশিপ’ পেয়ে যান। কিন্তু তখন হার্ডি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, রামানুজনকে তড়িঘড়ি ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে। এর পর হার্ডি অনেককে দিয়েই রামানুজনকে বলতে থাকেন, ‘‘চলে এস ইংল্যান্ডে।’’
শেষমেশ রাজি হয়ে যান রামানুজন। ৫ বছর ছিলেন ইংল্যান্ডে। সেই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। হার্ডির সঙ্গে মিলে বেশ কিছু নতুন উপপাদ্য আবিষ্কার করেছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল- ‘বার্নোলিজ নাম্বার’। বৃত্তের পরিধি আর ব্যাসের অনুপাত সব সময়েই একটি ধ্রুবক বা কনস্ট্যান্ট। যাকে বলে- ‘পাই’। রামানুজন ওই ‘পাই’য়েরই একটি অসীম শ্রেণি বা ‘ইনফিনিট সিরিজ’ আবিষ্কার করেছিলেন। যা হার্ডিকে চমকে দিয়েছিল। তাঁর গবেষণার ফলাফলগুলো পরে ফলিত গণিত ও আধুনিক পদার্থবিদ্যাতেও দারুণ ভাবে কাজে লেগেছে।
তাঁর কাজের মূল ক্ষেত্রগুলো ছিল ‘নাম্বার থিওরি’, ‘কন্টিনিউড ফ্র্যাকশান’, অসীম শ্রেণি ইত্যাদি। ৫ বছর ইংল্যান্ডে থাকার সময়ে বেশ কিছু ‘কনজেকচার’ও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। যুগান্তকারী সেই ‘কনজেকচার’গুলো এখনও যথেষ্টই প্রাসঙ্গিক।
হার্ডি এক সময় রামানুজন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘যে কোনও ধনাত্মক অখণ্ড সংখ্যাই রামানুজনের কাছে ভগবান!’’
কেন বলেছিলেন কথাটা?
তার কারণ, যত বড় সংখ্যাই হোক না কেন, তাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে সেই সংখ্যার একটা অদ্ভুত গাণিতিক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করে ফেলতেন।
পাঁচ বছর ইংল্যান্ডে থাকার শেষ দিকে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন রামানুজন। কারণ, প্রচণ্ড গোঁড়া হওয়ার জন্য ওই সময় তিনি নিজে রান্না করে খেতেন। নিরামিষ খেতেন। খুব ভোরে কনকনে ঠান্ডা জলে চান করতেন। কিছু দিন পরেই তাঁর যক্ষা হয়। তখন হাসপাতালে ভর্তি হন।
এক দিন হার্ডি ট্যাক্সি নিয়ে হাসপাতালে রামানুজনকে দেখতে যান। সেই ট্যাক্সির নাম্বার ছিল ‘১৭২৯’।
হার্ডি সেই নাম্বারের কোনও বৈশিষ্ট্যই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। হাসপাতালে গিয়ে হার্ডি রামানুজনকে বলেন, ‘‘সংখ্যাটা খুব বোরিং।’’ রামানুজন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন, ‘‘কে বলল? এটা অত্যন্ত ইন্টারেন্টিং সংখ্যা। কারণ, এটি হল সবচেয়ে ছোট ধনাত্মক, অখণ্ড সংখ্যা, যাকে দু’টি ধনাত্মক অখণ্ড সংখ্যার ত্রিধাতের (টু দ্য পাওয়ার থ্রি বা কিউব বলা যায়) সমষ্টি হিসেবে প্রকাশ করা যায়।
পরে এই ধরনের সংখ্যাগুলোকেই ‘Taxicab’ নাম্বার বলা হয়। কারণ, রামানুজন আর হার্ডি সেই ট্যাক্সি থেকেই ওই সংখ্যাটা পেয়েছিলেন। হঠাৎই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy