সেই ভুতুড়ে গ্যালাক্সি ‘ড্রাগনফ্লাই ৪৪’।
চেহারায় আমাদের মিল্কি ওয়ের মতো হলেও, একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভরা একটা ভুতুড়ে গ্যালাক্সির খোঁজ মিলল। এই প্রথম। যে গ্যালাক্সিতে তারার সংখ্যা খুবই সামান্য। ফলে, আমাদের আকাশগঙ্গার মতো তার কোণায় কোণায় আলো জ্বলে না। আর সেই ভুতুড়ে গ্যালাক্সির প্রায় গোটা শরীরটাই (৯৯.৯৯ শতাংশ) ভরা রয়েছে অজানা, অচেনা পদার্থে। যার নাম ডার্ক ম্যাটার। তাই গোটা গ্যালাক্সি জুড়েই যেন ‘বিদিশার নিশা’! জমাট বাঁধা ভুতুড়ে অন্ধকার ফুঁড়ে ওই গ্যালাক্সির কিছু কিছু তারার আলো গ্যালাক্সির চার পাশে যেন তৈরি করেছে একটা জ্যোতি! সেই ‘জ্যোতি’ ছিল ভাগ্যিস। সেই আলোতেই টেলিস্কোপের লেন্সে ধরা দিয়েছে সেই ‘কৃষ্ণকলি’ ভুতুড়ে গ্যালাক্সি। যার নাম ‘ড্রাগনফ্লাই-৪৪’।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার ভন ডোক্কুমের নেতৃত্বে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটি আন্তর্জাতিক দল এই ভুতুড়ে গ্যালাক্সিটির হদিশ পেয়েছে সম্প্রতি। গবেষণাপত্রটি ছাপা হয়েছে বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল লেটার্স জার্নাল’-এ। এই ‘কৃষ্ণকলি’ গ্যালাক্সিটি রয়েছে এই ব্রহ্মাণ্ডের ‘কোমা’ নক্ষত্রপুঞ্জে। তার খোঁজ পেয়েছে হাওয়াই দ্বীপের ডব্লিউ এম কেক অবজারভেটরি ও জেমিনি নর্থ টেলিস্কোপ। জল বেশি থাকার জন্য গভীর সমুদ্রে যেমন জাহাজের গতি বেড়ে যায়, সমুদ্রোপকূলের চেয়ে, তেমনই কোন গ্যালাক্সিতে কত জোরে ছুটছে তারাগুলি, তার ওপর নির্ভর করে সেই গ্যালাক্সি কতটা ভারী। গ্যালাক্সির ভর কতটা। তারাগুলি যত জোরে ছোটে, গ্যালাক্সির ভরও হয় ততটাই বেশি।
কিন্তু ওই ভুতুড়ে গ্যালাক্সিতে তারাগুলি যতটা জোরে ছোটে বলে ধারণা ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের, দেখা গিয়েছে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি জোরে ছোটে তারাগুলি।
তখনই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, এটা কী ভাবে সম্ভব হচ্ছে?
রাস্তায় গাড়িঘোড়া বেশি থাকলে তো ট্রাফিক জ্যাম হবেই আর তাতে রাস্তায় গাড়িঘোড়ার গতি কমে যাবে। ওই গ্যালাক্সিতেও যদি তারার সংখ্যা খুব বেশি হোত, তা হলে তারাগুলি অত জোরে ছুটতে পারতো না সেখানে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, ওই গ্যালাক্সিতে তারার সংখ্যা যৎসামান্যই। গ্যালাক্সির মধ্যে প্রচুর ফাঁকা জায়গা রয়েছে। আর সেই জায়গাগুলি একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভরা।
ওই ফাঁকা জায়গাগুলিতে অত অন্ধকার কেন?
যেন ‘বিদিশার নিশা’! ঘুটঘুটে কালো ‘ড্রাগনফ্লাই-৪৪’ গ্যালাক্সি
সেই জায়গায় যদি কোনও চেনা, জানা পদার্থ থাকতো, তা হলে তার ওপর আলো পড়লে তা প্রতিফলিত বা বিচ্ছুরিত হতো। আর সেই আলোয় আমরা ফাঁকা জায়গাগুলি দেখতে পেতাম। সেগুলি ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা থাকতো না। তা হলে, নিশ্চয়ই সেই জায়গাগুলি ভরা রয়েছে এমন সব পদার্থ দিয়ে, যাদের সঙ্গে দৃশ্যমান আলো বা কোনও তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের কোনও বনিবনাই (ইন্টার-অ্যাকশন) হয় না। নেই বিন্দুমাত্র ভাবসাব। এর থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, ওই ফাঁকা জায়গাগুলি ভরা রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অজানা অচেনা ডার্ক ম্যাটার দিয়ে।
কিন্তু ওই ফাঁকা জায়গাগুলি শুধুই ডার্ক ম্যাটার দিয়ে ভরা, এ ব্যাপারে কী ভাবে নিশ্চিত হলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা?
গবেষকরা জানিয়েছেন, অত বিশাল এলাকা জুড়ে থাকা ফাঁকা জায়গাগুলি যদি একেবারেই শূন্য থাকতো বা আমাদের চেনা পদার্থ দিয়ে ভর্তি থাকতো, তা হলে ওই গ্যালাক্সির ভর অতটা বেশি হতো না। আমাদের সূর্যের ভরের এক লক্ষ কোটি গুণ ভর ওই ভুতুড়ে গ্যালাক্সির। আর এইখানেই আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির সঙ্গে তার মিল। আমাদের আকাশগঙ্গারও ভর তেমনটাই। অমিলটা হোল, সেই ভরের এক শতাংশের ১০০ ভাগের মাত্র এক ভাগ হয়েছে তার তারাদের জন্য। বা, অন্যান্য চেনা, জানা পদার্থের জন্য।
এই ঘুটঘুটে অন্ধকারেই মিলবে ‘আলো’র দেখা? মিলবে ডার্ক ম্যাটার?
তা হলে অত ভর হল কী ভাবে ওই গ্যালাক্সির?
নিশ্চয়ই সেখানে রয়েছে এমন কিছু, যাদের আমরা চিনি না, জানি না। এরাই সেই ডার্ক ম্যাটার।
শরীরের ভেতর ডার্ক ম্যাটার রয়েছে, এমন গ্যালাক্সির আবিষ্কার অবশ্য এই প্রথম নয়। এর আগেও এমন গ্যালাক্সির খোঁজ মিলেছে। সেগুলির নাম ‘আলট্রা-ফেন্ট ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি’। তবে সেই গ্যালাক্সিগুলি ছোট ছোট। অত ভারীও নয় সেগুলি। ‘ড্রাগনফ্লাই-৪৪’ গ্যালাক্সির ভরের ১০ হাজার ভাগের মাত্র এক ভাগ ওই ছোট ছোট গ্যালাক্সিগুলির ভর।
তার মানে, এটা বলাই যায়, মহাকাশে ডার্ক ম্যাটারের এত বড় ‘খনি’র হদিশ মেলেনি এর আগে। ফলে, আগামী দিনে ডার্ক ম্যাটারের তল্লাশে বড় ল্যাবরেটরি হতে চলেছে এই ‘কৃষ্ণকলি’ ড্রাগনফ্লাই-৪৪’!
আরও পড়ুন- কেন প্রাণের আশা উস্কে দিল ভিন গ্রহ প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy