এডস ভাইরাস।
এডস ভাইরাসকে এখন জিনে ধরেছে!
জিন দেখলেই পালাচ্ছে এইচআইভি। এই জিন কোনও ভূত নয়। বরং ভূত তাড়ানোর ওঝা!
আমাদের শরীরে সদ্যোজাত ওই জিন ওঝার মতো ঝাড়ফুঁক করলে, ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রব ওঠে এডস ভাইরাসের! শরীরে এই জিন থাকলে আমাদের কোষ, কলার ত্রিসীমানায় আসার সাহস পায় না এইচআইভি।
এই নজরকাড়া তথ্যটি দিয়েছে সাম্প্রতিক একটি জিন-গবেষণার ফলাফল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফিউচার অফ হিউম্যানিটি ইনস্টিটিউটে’র অধিকর্তা, জিন-তাত্ত্বিক ও বিবর্তন তত্ত্ববিদ নিক বোস্ট্রমের ওই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’ জার্নালে। গত সপ্তাহে তা ছাপা হয়েছে ‘এভোলিউশান’ জার্নালেও।
গবেষণা জানাচ্ছে, আমাদের শরীরেই গড়ে উঠতে শুরু করেছে এডস-প্রতিরোধী জিন। তা উত্তরোত্তর বেড়ে উঠছে। ইতিমধ্যেই সেই জিন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে আফ্রিকার একাংশে। একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে। চট করে এডসের ওষুধ বা প্রতিষেধকের আবিষ্কার না হলে, হয়তো আর ২০/২৫ বছরের মধ্যেই ওই এডস-প্রতিরোধী জিন গোটা আফ্রিকা মহাদেশে বেশির ভাগ মানুষের শরীরেই গড়ে উঠবে। কালে-কালে সেই জিনের বিকাশ ও বিস্তার ঘটতে পারে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ায়। ‘সিসিএলআর-৫’ নামে আমাদের শরীরে সদ্য গড়ে ওঠা ওই জিনই মারণ রোগ এডস রোখার প্রথম প্রাকৃতিক ওষুধ। যা, বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে আমাদের শরীরে গড়ে ও বেড়ে উঠতে শুরু করেছে।
‘সিসিএলআর-৫’ জিন। সবুজ রঙে দেখানো হয়েছে।
তাঁর গবেষণাপত্রে বোস্ট্রম দেখিয়েছেন, প্রযুক্তি ও পরিবেশ কী ভাবে আমাদের শরীরের জিনকে প্রভাবিত করে। আর, তার দৌলতে আমরা, ‘হোমো সাপিয়েন্স’রা কী ভাবে দ্রুত বদলে গিয়েছি দশ হাজার বছর ধরে। তাতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের জিনের মধ্যেই ধীরে ধীরে ম্যালেরিয়া-প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। এমনকী, আফ্রিকার একাংশে এডস-প্রতিরোধী নতুন একটি জিনও আমাদের শরীরে গড়ে ও বেড়ে উঠতে শুরু করেছে।
ওই গবেষকদলের অন্যতম সদস্য, নেদারল্যান্ডসের ‘রাবাউন্ড ইউনিভার্সিটি নিমেজেনে’র জিনতত্ত্ববিদ উর্মিমালা মিশ্র ই মেলে জানাচ্ছেন, ‘‘চট করে এডসের ওষুধ বা, প্রতিষেধকের আবিষ্কার না হলে, ‘সিসিএলআর-৫’-এর মতো এডস-প্রতিরোধী জিন গোটা আফ্রিকার একটি বড় অংশের মানুষের শরীরে গড়ে উঠতে বড়জোর আড়াই-তিন দশক লাগবে। আর, সেটা হলে এডস-আক্রান্তের সংখ্যায় যে মহাদেশটি এখন এক নম্বরে (‘হু’র রিপোর্ট অনুযায়ী), সেই আফ্রিকায় ৩০ বছর পর এডস হয়তো বিরল বা, ব্যাতিক্রমী রোগ হয়ে উঠবে।’’
জিন-তাত্ত্বিক ও বিবর্তন তত্ত্ববিদ নিক বোস্ট্রম।
এডস-প্রতিরোধী জিন কী ভাবে গড়ে উঠছে আমাদের শরীরে?
উর্মিমালা জানাচ্ছেন, ‘‘বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে এটা হচ্ছে। বোস্ট্রমের গবেষণা দেখিয়েছে, প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে ও দুরারোগ্য রোগের সঙ্গে যুঝতে গিয়ে, বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে আমাদের শরীরে জিনের বিকাশ ও রূপান্তর ঘটেছে দশ হাজার বছরে। এমনকী, নতুন জিনও শরীরে গড়ে উঠেছে। ‘সিসিএলআর-৫’ তেমনই একটি জিন। যা, আদতে একটি প্রোটিন। এটি শরীরে থাকলে এডসের ‘এইচআইভি’ কিছুতেই কোষের প্রাচীর ফুঁড়ে ঢুকতে দেয় না। ওই প্রোটিনের সংস্পর্শে এলে ‘এইচআইভি’ মরে যায়। ফলে, ওই জিন যত বেশি করে মানুষের শরীরে গড়ে উঠবে, তত দ্রুত হারে ‘এইচআইভি’-রও বংশ-নাশ হবে। এডস ভাইরাস অত দ্রুত হারে ছড়াতে পারবে না।’’
বিবর্তনের নিয়মে কি অন্য কোনও জিন আমাদের শরীরে গড়ে উঠেছে দশ হাজার বছরে?
জিন-তাত্ত্বিক বোস্ট্রমের সহযোগী গবেষক উর্মিমালা জানাচ্ছেন, ‘‘অবশ্যই নতুন জিন গড়ে উঠেছে। না হলে আমরা দুধ খেয়ে হজম করতে পারতাম না। এক দিন শুধুই পশু-পাখি শিকার করে তাদের মাংস আর ফলমূল খেয়ে দিন কাটত মানুষের। দুধ খাওয়া জানত না। কৃষি সভ্যতার বিকাশ ও গো-পালন প্রথা চালুর পর মানুষ দুধ খেতে শিখল। মহাভারতে আমরা দুধ নিয়ে পাণ্ডব ও কৌরবদের কাড়াকাড়ির গল্প পড়েছি। মানে, তখন মানুষ দুধ খেত। আবার দুধ খেয়ে ভীমের বমি করে ফেলার গল্পও পড়েছি। এর অর্থ, দুধ খেয়ে কেউ কেউ তখন হজম করতে পারত না। দুধ হজম করার জন্য কালে কালে আমাদের শরীরে ল্যাকটোজ হজম করার ক্ষমতাসম্পন্ন জিন গড়ে উঠেছিল। আজও অনেককে দুধ খেয়ে বমি করতে দেখা যায়। কারণ, তাঁদের শরীরে ওই জিন এখনও গড়ে ওঠেনি। বিবর্তনের নিয়ম এ ভাবেই আমাদের ‘হোমো সাপিয়েন্স’দের বদলে দিয়েছে দশ হাজার বছরে। জিনের বিকাশ বা নতুন জিনের জন্ম সে ক্ষেত্রে আসলে একটি প্রাকৃতিক ওষুধ। আমরা কৃত্রিম ভাবে ওষুধ বা প্রতিষেধক বানালে যে প্রক্রিয়াটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, বিবর্তনের নিয়ম সমস্যা আর সঙ্ঘাত কাটিয়ে জয়ী হওয়ার জন্য জীবনকে শক্তি জোগায়। এটাই ‘ন্যাচারাল সিলেকশান’ বা প্রাকৃতিক নির্বাচন। যে পারে না, সে হারিয়ে যায়। যে পারে, সে-ই ‘ফিটেস্ট’- যোগ্যতম। তার ‘সারভাইভ্যাল’ হয়। সে-ই থাকে। ওষুধ বা প্রতিষেধকের আবিষ্কার হলে এডস ভাইরাসের সঙ্গে আর লড়তে হবে না আমাদের। ওষুধই লড়াই করবে। ফলে, এইচআইভি ভাইরাসের সঙ্গে লড়ার জন্য আমাদের শরীরকে ‘সশস্ত্র’ করে তোলার আর প্রয়োজন বোধ করবে না প্রকৃতি ও পরিবেশ। তাই এডসের শত্রু জিনটির আর বাড়-বৃদ্ধি হবে না আমাদের শরীরে।’’
গবেষণা জানাচ্ছে, এডস রোখার ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ আমাদের শরীরে এসে গিয়েছে। সেই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ রয়েছে সদ্যোজাত ‘সিসিএলআর-৫’ জিনের হাতেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy