‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলের হ্রদ। ছবি- নাসার সৌজন্যে।
না, উবে যায়নি পুরোপুরি। বরং এখনও প্রচুর পরিমাণে জল রয়েছে ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলে। হয়তো তার অতীতের জলের সঞ্চয়ের ৯৯ শতাংশকেই ধরে রাখতে পেরেছে লাল গ্রহ।
যা রয়েছে মঙ্গলের পিঠের (সারফেস) নীচে। রয়েছে লাল গ্রহের পিঠে ছড়ানো নানা ধরনের খনিজের অন্তরে, অন্দরে।
যার আর এক নাম ‘জীবন’, সেই জলকে এখনও এই ভাবেই ধরে রেখেছে মঙ্গল। কোটি কোটি বছরে তার বায়ুমণ্ডল খুবই পাতলা হয়ে গেলেও জলের ভাণ্ডারকে খোয়াতে দেয়নি লাল গ্রহ। বাঁচিয়ে রেখেছে। বাঁচিয়ে চলেছে। প্রায় ৩০০ কোটি বছর ধরে।
আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সাম্প্রতিক গবেষণা এই আশাজাগানো খবর দিয়েছে। লাল গ্রহের জলের প্রায় সবটুকুই কয়েকশো কোটি বছরে উবে গিয়েছে বলে এত দিন যে বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল, এই গবেষণা তার ভিতটাই টলিয়ে দিল।
অতলান্তিক মহাসাগরের অর্ধেক জল ছিল মঙ্গলে
গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘সায়েন্স’-এ। মঙ্গলের কক্ষপথে প্রদক্ষিণরত মহাকাশযান ও লাল গ্রহের মাটিতে নামা বিভিন্ন ল্যান্ডার ও রোভারের পাঠানো তথ্যাদি খতিয়ে দেখে গবেষকরা জানিয়েছেন, ৪০০ কোটি বছর আগে যে পরিমাণ জলের ধারা বইত মঙ্গলে, তার ৩০ থেকে ৯৯ শতাংশ জল এখনও উবে যায়নি। তার কিছুটা মঙ্গলের পিঠের নীচে অত্যন্ত ঠাণ্ডায় জমে বরফ হয়ে রয়েছে, বাকিটা রয়েছে পিঠে ছড়ানো বিভিন্ন খনিজের অন্দরে।
‘ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি' (ক্যালটেক) ও নাসার ‘জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরি' (জেপিএল)-র যৌথ গবেষণা জানিয়েছে, ৪০০ কোটি বছর আগে তরল অবস্থায় থাকা জলের পরিমাণ যথেষ্টই ছিল মঙ্গলে। সেই পরিমাণ জলে লাল গ্রহ ভাসত ১০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ মিটার গভীর মহাসাগরে। যা পৃথিবীর অতলান্তিক মহাসাগরের এখনকার জলের পরিমাণের প্রায় অর্ধেক। কিন্তু জন্মের ১০০ কোটি বছর পর থেকেই শুকিয়ে যেতে শুরু করে মঙ্গল। ওই সময় মঙ্গলকে চার দিক থেকে ঘিরে থাকা চৌম্বক ক্ষেত্রটি উধাও হয়ে যায়। নিজের অভিকর্ষ বলের টান ততটা জোরালো নয় বলে মঙ্গল দ্রুত তার বায়ুমণ্ডল হারাতে শুরু করে। আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে উবে যেতে শুরু করে লাল গ্রহের জলের ভাণ্ডার।
এত দিন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশেরই ধারণা ছিল, জন্মের ৩০০ কোটি বছর পর থেকে এখনও পর্যন্ত এই ভাবেই মঙ্গলের জলের ভাণ্ডার উবে গিয়েছে পুরোপুরি।
জল ধরে রাখতে পেরেছে লাল গ্রহ
‘‘কিন্তু না। উবে যায়নি। বরং নিজের জলের ভাণ্ডারের ৩০ থেকে ৯৯ শতাংশ এখনও ধরে রাখতে পেরেছে মঙ্গল’’, ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-এর ই-মেলে পাঠানো প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানিয়েছেন অন্যতম গবেষক ক্যালটেক-এর প্ল্যানেটারি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও ‘কেক ইনস্টিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজ’-এর অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর বেথানি এহলম্যান।
বেথানি ও তাঁর ছাত্রী ইভা শেলার ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-কে জানিয়েছেন, নাসার বিভিন্ন মহাকাশযানের পাঠানো তথ্যাদির সঙ্গে মিলছে না মঙ্গলের জলের ভাণ্ডার পুরোপুরি উবে যাওয়ার তত্ত্ব। উল্কাপিণ্ডও জল বয়ে আনে বলে সেই ভাবেও কতটা জল সঞ্চিত হতে পারে লাল গ্রহে সেই তথ্যাদিও খতিয়ে দেখা হয়েছিল। জন্মের পর থেকে লাল গ্রহের বিভিন্ন সময়ে তরল, বরফ ও বাষ্পীভূত অবস্থায় কী পরিমাণে জল ছিল তা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে খতিয়ে দেখা হয়েছে গবেষণায়। মঙ্গলের পিঠ ও বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক উপাদান কী কী আর তার পরিমাণ কী ভাবে বদলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, খতিয়ে দেখা হয়েছে তা-ও।
কী ভাবে জল ধরে রাখতে পারল মঙ্গল?
জল সাধারণত দু’ধরনের হয়। একটি ক্ষেত্রে জলের অণুতে থাকা হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে শুধুই একটি প্রোটন থাকে। এই ধরনের জলই বেশি দেখা যায়।
অন্য ক্ষেত্রে জলের অণুতে থাকা হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকে একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রের জলকে বলা হয় ‘ডিউটেরিয়াম ওয়াটার’। এই ধরনের জলে হাইড্রোজেন পরমাণুতে প্রোটনের সঙ্গে বাড়তি একটি নিউট্রনও থাকে বলে তা তুলনায় ভারী হয়। এই জলের পরিমাণ অনেক কম (মোট জলের ০.০২ শতাংশ)।
বেথানি ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-কে পাঠানো ই-মেল জবাবে লিখেছেন, ‘‘যে ধরনের জলের অণুর হাইড্রোজেন পরমাণুর অন্দরে শুধুই একটি প্রোটন রয়েছে তুলনায় হাল্কা ওজনের সেই জল মঙ্গলের দুর্বল অভিকর্ষ বলের টান উপেক্ষা করে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উবে গিয়েছে। কিন্তু লাল গ্রহে রেখে গিয়েছে ভারী জলকে (ডিউটেরিয়াম ওয়াটার)। যে জলের অণুর একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর অন্দরে একটি প্রোটনের সঙ্গে থাকে একটি নিউট্রনও। আমরা মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে ডিউটেরিয়ামের হদিশ পেয়েছি। এটাই প্রমাণ করছে, লাল গ্রহ তার জল পুরোপুরি খুইয়ে ফেলেনি।’’
বেথানি ও ইভা জানিয়েছেন, তাঁরা মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে ডিউটেরিয়াম ও হাইড্রোজেনের যে অনুপাত পেয়েছেন তা বুঝিয়ে দিচ্ছে উবে যাওয়ার ফলে লাল গ্রহ যেমন তার জলের ভাণ্ডারের কিছুটা কয়েকশো কোটি বছরে খুইয়েছে, তেমনই সেই জলের অনেকটা পিঠের নীচে থাকা বরফ ও পিঠে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থের মধ্যে ধরেও রেখেছে।
পাথর জলে মিশেই মাটি, কাদা তৈরি করে। তৈরি করে নানা ধরনের পদার্থ যাতে অন্যতম উপাদান হিসাবে রয়েছে জল (‘হাইড্রেটেড’)। এই ভাবেই বিভিন্ন খনিজ পদার্থের জন্ম হয়। পৃথিবীতে এই ভাবেই খনিজ পদার্থ তৈরি হয়েছে। হয়েছে মঙ্গলেও।
কপাল মন্দ মঙ্গলের!
‘‘তবে পৃথিবীর সঙ্গে মঙ্গলের এ ক্ষেত্রে কিছুটা ফারাকও রয়েছে’’, বলেছেন জেপিএল-এর সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ও ‘ইউরোপা’ মিশনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য গৌতম চট্টোপাধ্যায়।
গৌতমের কথায়, ‘‘পৃথিবীতে এই প্রক্রিয়াটা উপর থেকে নীচ পর্যন্ত চলেছে। আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে নীচের পদার্থ উপরে উঠে এসেছে। কিন্তু মঙ্গলে কোনও টেকটনিক প্লেট নেই বলে তার পিঠ শুকিয়ে যাওয়ার পর তা আর জলে ভিজে ওঠেনি। তাই মঙ্গলের জলের সঞ্চয়ের একটি বড় অংশ তার পিঠের নীচে বরফে ও পিঠে ছড়িয়ে থাকা খনিজ পদার্থগুলির অন্দরেই আটকা পড়ে গিয়েছে।’’
ছবি সৌজন্যে- নাসা।
গ্রাফিক সৌজন্যে- গবেষণাপত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy