পৃথিবীর মায়া কাটানোর পর থেকেই বিজ্ঞানীরা ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলেন তাকে। প্রায় তিনশো দিন পরে আজ সেই ঘুম ভাঙল। নড়েচড়ে উঠল সে!
বেঙ্গালুরুর ইসরোর কন্ট্রোল রুমে দর্শকাসনে বসে উত্তেজনায় ফুটছিলেন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার প্রধান কে রাধাকৃষ্ণন। উৎকণ্ঠায় বার বার হাত চলে যাচ্ছিল মুখে। অবশেষে হাসি ফুটল। বললেন, “একদম ফিট রয়েছে ল্যাম। খুব চিন্তায় ছিলাম।”
বুধবার মঙ্গলযানকে ঠিকমতো কক্ষপথে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব এখন এই ল্যাম অর্থাৎ ‘লিকুইড অ্যাপোজি মোটর’-এর কাঁধেই। অভিযানের শেষ ধাপে সে-ই নায়ক। মঙ্গলের একেবারে কাছে পৌঁছে যেতেই ফায়ারিং করা হবে ইঞ্জিনটিকে। বেঙ্গালুরুর কন্ট্রোল রুম থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হবে গোটা বিষয়টিকে। ৪৪০ নিউটন (শক্তির মাপকাঠিতে) ফায়ারিংয়ের পাল্টা ধাক্কায় মঙ্গলযান পৌঁছে যাবে লালগ্রহের কক্ষপথে। কিন্তু পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে বেরোনোর পর থেকেই সুপ্ত অবস্থায় ছিল ল্যাম। তাই ইসরোর দুশ্চিন্তা কাটছিল না। আজ পরীক্ষামূলক ভাবে ঘুম ভাঙানো হয় ল্যামের। আর প্রথম চেষ্টাতেই সফল। ৪ সেকেন্ডের জন্য চালু হয়েছিল ইঞ্জিনটি। তবে ল্যাম যে জেগেছে, তা জানতে আরও ১২ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল ইসরোর বিজ্ঞানীদের। দূরত্বটা যে অনেক! মঙ্গলের রাজত্ব থেকে পৃথিবীর মাটি, ২২ কোটি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে খবর আসতে সময় লেগে গিয়েছিল ১২ মিনিট।
ইসরোর এক বিজ্ঞানী বললেন, “এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে...। ইঞ্জিনটা একদম ঠিক আছে। বুধবারের জন্য প্রস্তুত।” তাঁর কথায়, “দীর্ঘদিন কাজ না করে পড়ে ছিল। সবাই তাই খুব চিন্তায় ছিল, যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট না হয়ে যায়।” তবে বিকল্প ব্যবস্থার কথাও মাথায় রেখেছিল ইসরো। কিন্তু তাতে আর যা-ই হোক, ল্যামের মতো সুনিপুণ ভাবে কাজ করতে পারত না সে। খামতি থেকেই যেত, জানালেন বিজ্ঞানীরা।
২৪ সেপ্টেম্বর সকালে মঙ্গলের কক্ষপথে ঢোকার সময় চালু করা হবে ল্যামকে। ইসরোর বিজ্ঞানীদের কথায়, “অভিযানের সব চেয়ে কঠিন ধাপ ওটাই। চিন্তা তাই থেকেই যাচ্ছে।” গোটা বিষয়টা কন্ট্রোল রুম থেকে নিয়ন্ত্রণ করবেন ২৫০ জন বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ারের একটি দল। গত ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর বেঙ্গালুরুর কন্ট্রোল রুমে একপ্রস্ত মহড়াও দিয়েছেন তাঁরা। ইসরোর সদর দফতর, অন্তরীক্ষ ভবনের বক্তব্য, চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছিয়ে সামান্য ভুলচুকও নস্যাৎ করে দিতে পারে পুরো অভিযান। তাই বারেবারে মহড়া দিয়ে শেষ ধাপের সাফল্য নিয়ে ১০০ শতাংশেরও বেশি নিশ্চিন্ত হতে চাইছে তারা। আজ মঙ্গলযানের গতি পথে সামান্য বাঁক আনা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের ভাষায় একে বলে ‘ট্রাজেকটরি কারেকশন’। অগস্ট মাসেই এই সংশোধন করার কথা ছিল। তার পর ঠিক হয় ১৪ সেপ্টেম্বর তা করা হবে। কিন্তু তখনও প্রয়োজন পড়েনি। শেষমেশ যাত্রাপথের অন্তিম লগ্নে সংশোধনটা করতেই হল আজ।
এ দিন সকাল ৮ নাগাদ (ভারতীয় সময়) নাসার মঙ্গলযান ‘মাভেন’ গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছয়। সে খবর আসতেই ইসরোয় উত্তেজনার পারদ আরও চড়ে। কলোরাডোর লকহেড মার্টিন মিশন সাপোর্ট এরিয়ার কন্ট্রোল রুম তখন উল্লাসে ফেটে পড়েছে। মিস কৌতূহলের পর তাদের লালগ্রহের নয়া ‘বিশেষজ্ঞ’-ও সফল। মঙ্গল অভিযানে এই বাজিও মাত করল নাসা।
দু’টো দিন পরে ঠিক এই দৃশ্যটাই নিজেদের কন্ট্রোল রুমে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চায় ইসরো। কয়েক দিনের ব্যবধানে মঙ্গল পাড়ি দিয়েছিল মাভেন ও মঙ্গলযান। মঙ্গলের ঘরে ঢুকে পড়েছে এক জন। আর এক জন পা ফেলার অপেক্ষায়। গত বছর ৫ নভেম্বর পিএসএলভি রকেটে চেপে রওনা দিয়েছিল ভারতীয় কৃত্রিম উপগ্রহটি। আর তার সপ্তাহ দুয়েক পরেই ১৮ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে মাভেন। কথাই ছিল, নাসার মহাকাশযানটি লালগ্রহের কক্ষপথে পৌঁছনোর দু’দিন পরেই কক্ষপথে পা ফেলবে ভারতীয় যান।
মঙ্গলের মাটিতে ইতিমধ্যেই গবেষণা চালাচ্ছে নাসার ‘মিস কৌতূহল’ কিউরিওসিটি। লালগ্রহের মাটিতে জলের অস্তিত্ব কোনও দিন ছিল কি না, তা পরীক্ষা করে দেখাই এর কাজ। ভারতের মঙ্গলযান ও নাসার মাভেন এ বার মঙ্গলের কক্ষপথ থেকে সেই অনুসন্ধান চালাবে। উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে কখনও মঙ্গলের কাছে আসবে তারা। কখনও দূরে যাবে। আর সে ভাবেই গ্রহের বায়ুস্তরের উপরিভাগ ও নীচের দিকে গবেষণা চালাবে। খতিয়ে দেখবে মঙ্গলের হাওয়া। সে সঙ্গে গ্রহের ভূপ্রাকৃতিক গঠনের ছবিও তুলে পাঠাবে মঙ্গলযান।
এক জন তো পৌঁছেই গিয়েছে। আর এক জন লালগ্রহের দরজায় কড়া নাড়ছে। অপেক্ষা আর মাত্র দু’টো দিন। তবে মাভেন যতই পরে রওনা দিয়ে আগে পৌঁছে যাক না কেন, ইসরো যদি বুধবার সফল হয়, আসল বাজি মারবে কিন্তু সে-ই। এক সঙ্গে তিন-তিনটে বাজি...। এক, প্রথম চেষ্টাতেই সাফল্য। গোটা বিশ্বে এ সম্মান ভারতই প্রথম ঝুলিতে পুরবে। দুই, এশিয়ায় ভারতই প্রথম মঙ্গলের কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠাবে। আর তিন, মাভেনকে পাঠাতে আমেরিকার এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ৪৮ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার।
আর ভারতের... ৭ কোটি ৪০ লক্ষ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy