ব্যাঙাচি থেকেই ব্যাঙ হয়—কে না জানে! কিন্তু অনেকেরই অজানা, পেনিসিলিনের প্রভাবে এই রূপান্তর থেমে যায়। ব্যাঙাচি তখন বড় ব্যাঙাচি হয়, কিন্তু ব্যাঙ হয়ে ওঠে না— এই অদ্ভুত আবিষ্কারটি যাঁর কৃতিত্ব, তিনি প্রকৃতিবিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। সেই সময় বিখ্যাত বিজ্ঞানী জুলিয়ান হাক্সলে আসেন কলকাতা। তাঁকে দেখানো হল গবেষণার ফল। তিনি বললেন, ব্যাপারটা খুবই রহস্যজনক। একটা রিপোর্ট ‘নেচার’ পত্রিকায় দেওয়া উচিত। দুর্ভাগ্য, সেটা আর কখনওই করা হয়নি।
গোপালচন্দ্র ছিলেন স্বভাববিজ্ঞানী। আর্থিক কারণে ইন্টারমিডিয়েট অবধিই পড়াশোনা। বাংলার গাছপালা, কীটপতঙ্গ, পশুপাখিদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে তিনি কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, গবেষণা চালিয়ে ফলাফল লিখেছেন। ১৯২১ থেকে ১৯৭১— বসু বিজ্ঞান মন্দিরে তিনি গবেষণা চালিয়েছেন ব্যাঙ, পিঁপড়ে, মৌমাছি আর মাকড়সা নিয়ে। ১৯৩০ সালে বাংলার মাছখেকো মাকড়সা সম্বন্ধে তাঁর বিশদ পর্যবেক্ষণ বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ট্রানজ্যাকশনে বেরোয়। ১৯৩৪-৩৫ সালে পিঁপড়ে অনুকারী মাকড়সা, টিকটিকি-শিকারি মাকড়সা সম্পর্কে চারটি গবেষণাপত্র মুম্বইয়ের ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটি, আমেরিকান সায়েন্টিফিক মান্থলি এবং কলকাতার সায়েন্স অ্যান্ড কালচার-এ প্রকাশিত হয়। স্বয়ং জগদীশচন্দ্রও আশা করেছিলেন, এই আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা নিবন্ধগুলি গোপালচন্দ্রকে বিদেশেও পরিচিতি দেবে। কিন্তু ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন পাল্টাচ্ছে। হিটলারের অভ্যুত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা সেই আশায় জল ঢেলে দেয়।
সামান্য উপকরণ দিয়ে কত অসামান্য মণিমুক্তো যে খুঁজে বের করেছেন তিনি! যেমন, পিঁপড়ের ডিম থেকে রানি, পুরুষ না কর্মী— কোন ধরনের পিঁপড়ের জন্ম হবে, তা বুঝতে টবে রাখা আমগাছে বাসা বানিয়েছিলেন। যেখানে শুধুই থাকবে কর্মী পিঁপড়ে। টবের চার দিকে জল থাকায় সেখানে প্রবেশ নিষেধ অন্য পিঁপড়ের। ছ’ সপ্তাহ পর দেখা গেল, ডিম পাড়া হয়েছে, লার্ভা রয়েছে এবং পিঁপড়ের সংখ্যাও বেড়েছে। স্ত্রী পিঁপড়ের অনুপস্থিতিতে কী করে সম্ভব হল এটা? ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ সাল অবধি খাবার, বাসা এবং পিঁপড়ের প্রকৃতি পাল্টে তিনি বুঝতে চাইলেন ডিম পাড়ার ধরন।
তবে তাঁর সবচেয়ে আশ্চর্য আবিষ্কার বোধ হয় জৈব দ্যুতি। পরিত্যক্ত জায়গায় বৃষ্টির রাতে আগুন জ্বালায় কে? রহস্যভেদ করতে এক বৃষ্টিভেজা রাতে তিনি রওনা দিলেন ‘পাঁচীর মার ভিটা’র দিকে। সে এক জঙ্গুলে, জনমানবহীন জায়গা। দেখলেন, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে জমাট-বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা অস্পষ্ট আলোর রেখা। কাছে যেতেই সেই আলো আরও স্পষ্ট, আরও উজ্জ্বল। হঠাৎই তা দপ করে নিভে গেল। ফের জ্বলে উঠল। আরও খানিক এগিয়ে দেখা গেল যেন বেশ বড় এক অগ্নিকুণ্ড। আগুনের শিখা নেই। কাঠকয়লা পুড়ে যেমন গনগনে আগুন হয়, অনেকটা সেই রকম। সে আলোর তীব্রতা নেই। তিনি লক্ষ করেন, শুষ্ক দিনে জঙ্গলে জল পড়লে রাত্রিবেলায় এই আলো দেখা যায়। অথচ দিনের আলোয় দেখা যায় না। পচা গাছপালার এই আশ্চর্য আলো বিকিরণের ক্ষমতার উপর তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক রচনা প্রকাশিত হয় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়, ১৩২৬ বঙ্গাব্দে।
বসু বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণার সময়ই দেশ-বিদেশের বৈজ্ঞানিক পত্রিকাতে তাঁর নানা নিবন্ধ প্রকাশিত হতে লাগল। গবেষণার প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে গোপালচন্দ্র কীটপতঙ্গ খুঁজে বেড়াতেন। শুধু বিজ্ঞানচর্চাই নয়, অন্ত্যজদের লেখাপড়া শেখানো, জারিগান, কথকতার মাধ্যমে গ্রামের মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করার চেষ্টাও করেছেন তিনি। সত্যেন্দ্রনাথ বসু ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকা সম্পাদনার ভারটি তাঁর হাতেই সমর্পণ করেছিলেন। প্রায় তিন দশক সম্পাদক থাকাকালীন তিনি বিজ্ঞান সাহিত্যে এক নতুন দিক উন্মোচন করেন।
গত ১ অগস্ট পালিত হল গোপালচন্দ্রের ১২৫-তম জন্মদিন। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের অডিটোরিয়ামে। আয়োজক পরিষদ, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য বিজ্ঞান প্রসার সমিতি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রক। প্রধান অতিথি ছিলেন দিল্লির বিজ্ঞান প্রসার-এর অধিকর্তা নকুল পরাশর। উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবাংলায় বিজ্ঞান আন্দোলনের বহু কর্মী। অপরাজিত বসু, সুমিত্রা চৌধুরী এবং রণতোষ চক্রবর্তী বললেন গোপালচন্দ্রের বিচিত্র জীবন এবং গবেষণা নিয়ে। ভবানীশঙ্কর জোয়ারদার তাঁর বক্তৃতায় বললেন, জীববৈচিত্র পর্যবেক্ষণ বিষয়ে। শিলাঞ্জন ভট্টাচার্য তুলে ধরলেন প্রথার বাইরে গোপালচন্দ্রের পর্যবেক্ষণ কর্মকাণ্ড। গোপালচন্দ্রের লেখালিখি নিয়ে বলেন শ্যামল চক্রবর্তী ও মানসপ্রতিম দাস। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গোপালচন্দ্রের নাতনি মালা চক্রবর্তী ভট্টাচার্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy