বিস্ফোরণ এই ভাবে ধরা পড়েছে টেলিস্কোপের চোখে। ছবি- নাসা।
প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটেছে ব্রহ্মাণ্ডে। এত ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ১৪০০ কোটি বছরের ব্রহ্মাণ্ডে এর আগে আমরা আর কখনও ঘটতে দেখিনি। বিগ ব্যাংয়ের পর এত বেশি পরিমাণে শক্তিও বেরিয়ে আসতে দেখিনি কোনও বিস্ফোরণ থেকে।
সেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ধরা পড়েছে চারটি টেলিস্কোপে। তার মধ্যে অন্যতম পুণের ‘জায়ান্ট মিটার রেডিও টেলিস্কোপ (জিএমআরটি)’ ও পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় বসানো ‘মুর্চিসন ওয়াইডফিল্ড অ্যারে (এমডব্লিউএ)-এর মতো দু’টি অত্যন্ত শক্তিশালী রেডিও টেলিস্কোপ। বাকি দু’টি এক্স-রে টেলিস্কোপ। একটি নাসার ‘চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি’। অন্যটি- ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ‘এক্সএমএম-নিউটন’।
সেই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল’-এ। বৃহস্পতিবার।
কোথায় ঘটেছে সেই বিস্ফোরণ?
চারটি টেলিস্কোপ দেখেছে, সেই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণটা হয়েছে আমাদের থেকে ৩৯ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। ‘অফিউচুস’ নামে রয়েছে যে গ্যালাক্সির ঝাঁক (‘গ্যালাক্সি ক্লাস্টার’), তার কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি এলাকায়। একটি দানবাকৃতি ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের (‘সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল’) চার পাশে।
গ্যালাক্সির ভূত! খাঁ খাঁ করছে প্রকাণ্ড গর্ত!
চারটি টেলিস্কোপ দেখেছে, বিস্ফোরণের পর অকল্পনীয় ভাবে উত্তপ্ত গ্যাস বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চার দিকে। সবটুকু কণা আর পদার্থ খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে একেবারে হাড় জিরজিরে হয়ে পড়েছে লক্ষ লক্ষ গ্যালাক্সি। যেন সেগুলি কোনও গ্যালাক্সি নয়, গ্যালাক্সির ভূত! কঙ্কালসার।
সেই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে শুধু তোলপাড়ই হয়নি ব্রহ্মাণ্ড, তৈরি হয়েছে একটা প্রকাণ্ড গর্তের। যে গর্তের মধ্যে নেই কোনও কণা বা পদার্থ। শূন্য। একেবারে মহাশূন্য। খাঁ খাঁ করছে সেই ভয়ঙ্কর গর্তটা।
কতটা বিশাল জানেন সেই গর্তটা?
আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির মতো ১৫টি গ্যালাক্সিকে পাশাপাশি রাখলে যতটা জায়গা জুড়ে থাকে (১৫ লক্ষ আলোকবর্ষ), গর্তের ব্যাস ততটাই। আরও সহজ করে বলতে হলে, ১০০ কোটি সৌরমণ্ডলকে পাশাপাশি রাখলে তা যতটা জায়গা জুড়ে থাকবে, ওই প্রকাণ্ড গর্তের চেহারাটা ততটাই বিশাল। যাকে দানবাকৃতি বললেও যেন কম বলা হয়। সেই গর্তের আয়তন ১০৭০ ঘন সেন্টিমিটার। যার অর্থ, এক-এর পিছনে ৭০টি শূন্য বসালে যে সংখ্যাটা হয়, তত ঘন সেন্টিমিটার।
কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)’-এর অধিকর্তা, ব্ল্যাক হোল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সন্দীপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘এমন প্রকাণ্ড বিস্ফোরণ আমাদের গ্যালাক্সির কাছে-পিঠে হলে শুধু আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিই নয়, কর্পূরের মতো উবে যেত অ্যান্ড্রোমিডা-সহ আশপাশে থাকা আরও ৫/৬টা গ্যালাক্সি।’’
কতটা ভয়ঙ্কর এই বিস্ফোরণ?
বিস্ফোরণে কতটা শক্তি বেরিয়ে এসেছে, জানেন? সেটা বলার আগে বুঝে নেওয়া যাক, ১৪০০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং বা মহা বিস্ফোরণের পর কতটা শক্তি বেরিয়ে এসেছিল? যা এখনও রয়ে গিয়েছে এই ব্রহ্মাণ্ডে, শক্তির বিনাশ হয় না বলে।
বিগ ব্যাংয়ের পর মোট যে পরিমাণ পদার্থের সৃষ্টি হয়েছিল, তার পরিমাণ এক-এর পিছনে ৬০টি শূন্য বসালে যে সংখ্যাটা (১০৬০) হয়, তত গ্রাম। এবং মহা বিস্ফোরণের পর মোট যে শক্তির জন্ম হয়েছিল, তার পরিমাণ, এক-এর পিছনে ৮১টি শূন্য বসালে যে সংখ্যাটা (১০৮১) হয়, তত আর্গ (শক্তির একক)।
১০ কোটি সূর্যকে ধ্বংস করলে যা হয়, ততটা শক্তি!
সন্দীপ জানাচ্ছেন, অফিউচুস গ্যালাক্সির ঝাঁকে যে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণটা ঘটতে দেখা গিয়েছে, তার ফলে তৈরি হয়েছে ১০৬২ আর্গ শক্তি। অর্থাৎ, ১০ কোটি সূর্যকে একেবারে ধ্বংস করে দিলে যে পরিমাণে শক্তির উদ্ভব হবে, ততটা শক্তি। ভাবুন, কতটা প্রলয়ঙ্কর হয়েছে সেই বিস্ফোরণ। তবে বিগ ব্যাং-এর পর যে পরিমাণ শক্তির জন্ম হয়েছিল, তার তুলনায় সামান্যই।
কয়েকশো কোটি বছর আগে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতেও। কিন্তু তার চেয়ে ১০ লক্ষ গুণ বেশি শক্তি বেরিয়ে এসেছে এই বিস্ফোরণ থেকে। আর এখনও পর্যন্ত যত বড় বিস্ফোরণ ব্রহ্মাণ্ডে দেখা গিয়েছে, এটা তার ৫ গুণ।
প্রকাণ্ড শূন্য গর্তটা তৈরি হল কী ভাবে?
সন্দীপের ব্যাখ্যা, কেন্দ্রে থাকা দানবাকৃতি ব্ল্যাক হোলের টানে গ্যালাক্সির ঝাঁক থেকে এসে কণা ও পদার্থগুলি পড়ার সময় এক্স-রে তৈরি হয়। নানা দিক থেকে প্রচুর পরিমাণে পদার্থ এসে পড়ছে বলে। সেই ঠিকরে বেরনো এক্স-রে কণা ও পদার্থগুলিকে ভেঙে টুকরোটুকরো করে আয়নে পরিণত হয়। তৈরি করে ঋণাত্মক আধানের ইলেকট্রন আর ধনাত্মক আধানের প্রোটন। শুধু ভেঙেই থামে না। এক্স-রে বেরিয়ে আসে অসম্ভব গতিতে। তার নজরে যা পড়ে, তাকেই সে তার গতিতে টেনে নিয়ে যায় সঙ্গে। কিন্তু প্রোটনগুলি তুলনায় ছোট চেহারার বলে সেগুলি নজরে আসে না এক্স-রে’র। তাই গ্যালাক্সির ঝাঁক থেকে এক্স-রে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে ইলেকট্রনগুলিকে। কিন্তু সেই ইলেকট্রনের টানেই ধনাত্মক আধানের প্রোটনও বেরিয়ে যায় তাদের পিছু পিছু। এই ভাবেই সব কণা ও পদার্থ ইলেকট্রন আর প্রোটনে ভেঙে গিয়ে গ্যালাক্সির ঝাঁক থেকে বেরিয়ে গিয়ে কঙ্কালসার বানিয়ে দিয়েছে গ্যালাক্সিগুলিকে। আর সেই এলাকায় কোনও কণা বা পদার্থ নেই বলে তৈরি হয়েছে সেই প্রকাণ্ড গর্ত।
সন্দীপ জানাচ্ছেন, ব্রহ্মাণ্ডে এমন ঘটনা ঘটতে দেখা গেল এই প্রথম।
ছবি ও গ্রাফিক সৌজন্যে: নাসা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy