মেলালেন তিনি মেলালেন...। ইনসেটে, আইনস্টাইন।
‘ঈশ্বর’-এর আর এক নাম কি আইনস্টাইন?
না-ও যদি হয়, অঙ্কটা কিন্তু একেবারেই নির্ভুল কষেছিলেন আইনস্টাইন। ১০৬ বছর আগে। যেন ঈশ্বরই! অঙ্ক কষে তিনি তো নির্ভুলটাই সবচেয়ে আগে বলে দেবেন। ব্রহ্মাণ্ডের অনেক নিয়মকানুনই যিনি অঙ্কের জাদুমন্ত্রে ধরে ফেলেছিলেন সকলের চেয়ে অনেক আগেই।
১০৬ বছর আগে আইনস্টাইনের কষে দেওয়া অঙ্ক যে একেবারেই নির্ভুল ছিল, আড়াই হাজার বছর আগেকার দু’টি তারা সে কথা দ্ব্যর্থহীন ভাবেই জানিয়ে দিল। ফের প্রমাণিত হল আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের সত্যতা।
পৃথিবী থেকে দু’হাজার ৪০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা ওই দু’টি তারার উপর একটানা ১৬ বছর ধরে নজর রেখেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাদের বলা হয়— ‘বাইনারি পালসার’। যার বৈজ্ঞানিক নাম— ‘PSR J0737−3039A/B’।
সেই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে লেখা গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘ফিজিক্যাল রিভিউ এক্স’-এ।
মেলালেন তিনি মেলালেন…
গবেষকরা দেখেছেন, ১০৬ বছর আগে তাঁর আপেক্ষিকতাবাদে আইনস্টাইন অঙ্ক কষে ঠিক যেমনটা জানিয়েছিলেন সেই ভাবেই জোড় বেঁধে থাকা দু’টি তারা (বাইনারি) একে অন্যের উপর যে টান (যাকে অভিকর্ষ বল বলা হয়) দেয় তা তাদের মধ্যেকার স্থান (‘স্পেস’) ও কাল (‘টাইম’)-কে আরও বেশি দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে দেয়। তার ফলে, একটি তারার বিকিরণের আলো অন্য তারাটিতে পৌঁছনোর সময়ে হেরফের ঘটে। আলোর কণা ফোটনের গতিবেগ (সেকেন্ডে এক লক্ষ ৮৬ হাজার কিলোমিটার) ধ্রুবক (কনস্ট্যান্ট) হলেও এক তারা থেকে তার জোড় বাঁধা অন্য তারটিতে আলো পৌঁছতে কখনও দেরি হয়ে যায়।
১০৬ বছর পর ঠিক সেই ঘটনাটাই প্রথম চাক্ষুষ করলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
তারার অন্তিম দশায় যা যা হয়
কোনও তারা অন্তিম দশায় পৌঁছলে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হয়। তাকে বলা হয় ‘সুপারনোভা’। তার পর যে কোনও তারারই কপালে থাকে সাধারণত দুধরনের ভবিষ্যত। হয় সেটি ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর হয়ে যায়। যার নাগপাশ এড়িয়ে কোনও বস্তু, এমনকি আলোও বেরিয়ে আসতে পারে না। আর ব্ল্যাক হোল না হলে সুপারনোভার পর কোনও তারা নিউট্রন নক্ষত্র হয়ে যায়। কোনও তারার অন্তরে থাকা ভারী মৌলগুলি তখন প্রচণ্ড অভিকর্ষ বলের টানে একেবারে তারার কেন্দ্রস্থলে এসে খুব কম জায়গায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে। তার ফলে, নিউট্রন নক্ষত্রগুলির ঘনত্ব হয় প্রচণ্ড বেশি। সেগুলি আকারে ছোট হয়ে যায় এতটাই যে সাধারণত তাদের ব্যাস হয় ২০ কিলোমিটার বা ১২ মাইল। কলকাতা শহরে হুগলি নদীর পশ্চিম প্রান্ত থেকে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের পূর্ব প্রান্তের দূরত্ব যতটা (৯/১০ কিলোমিটার), তার প্রায় দ্বিগুণ।
আকারে এত ছোট হলে হবে কি, নিউট্রন নক্ষত্রের ভর হয় সূর্যের ভরের প্রায় আড়াই গুণ।
পালসার মহাকাশে লাইটহাউস!
পালসার এক ধরনের নিউট্রন নক্ষত্রই। তাদের এমন নামকরণের কারণ, নির্দিষ্ট সময় অন্তর তাদের থেকে বেরিয়ে আসে বিকিরণ। রেডিয়ো তরঙ্গে। যা আলোক বর্ণালীর একটি প্রান্তে রয়েছে। বর্ণালীতে দৃশ্যমান আলোর এলাকা থেকে অনেকটা দূরে। তাই এই রেডিয়ো তরঙ্গ কখনও খালি চোখে দেখা যায় না। এই রেডিয়ো তরঙ্গ বেরিয়ে আসে কোনও পালসারের মেরু অঞ্চল থেকে। পালসারগুলি সব সময় ঘোরে বলে এই বিকিরণের ফলে সেগুলিকে মহাকাশে মনে হয়— ‘লাইটহাউস’। এই বিকিরণ হয় একেবারে ঘড়ি ধরে। সময়ের হিসাবে তার কোনও ভুলচুক হয় না।
পালসারের রেডিয়ো তরঙ্গের বিকিরণ দেখা সম্ভব হয় শুধুই রেডিয়ো টেলিস্কোপে। জার্মানির ‘ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর রেডিয়ো অ্যাস্ট্রোনমি’-র জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা রেডিয়ো টেলিস্কোপেই ১৬ বছর ধরে নজর রেখে চলেছিলেন এই যুগ্ম তারা— ‘PSR J0737−3039A/B’-র উপর।
গবেষকরা কী দেখেছেন?
তাঁরা দেখেছেন, নির্দিষ্ট সময় অন্তর একটি পালসারের মেরু থেকে বেরিয়ে আসা রেডিয়ো তরঙ্গ অন্য পালসারে পৌঁছতে কিছুটা দেরি হচ্ছে। যেন আলোর কণার গতিতে কেউ লাগাম পরাচ্ছে। দু’টি তারার একে অন্যকে টানই সেই আলোর গতিতে লাগাম পরাচ্ছে।
এটা যে অনিবার্যই সে কথা তাঁর আপেক্ষিকতাবাদে বলেছিলেন আইনস্টাইন। ১০৬ বছর আগে।
তা যে একেবারেই ভুল ছিল না এই প্রথম সেটা জানিয়ে দিল আড়াই হাজার বছর আগেকার দু’টি যুগ্ম তারা। পালসার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy