চাঁদে মানবসভ্যতার গড়া শিল্পাঞ্চলের নকশা।
সিঙ্গুরে শিল্প আসেনি। আসছে আসবে করে গত কয়েক দশকে তেমন বড় শিল্প আসেনি পশ্চিমবঙ্গেও। কিন্তু, খুব বেশি হলে আর ৩০টা বছর। বড় শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠতে চলেছে চাঁদে।
চাঁদ-ই তো বাঁচাবে আমাদের। চাঁদ-ই হয়ে উঠবে আমাদের এক ও একমাত্র পরিত্রাতা। পৃথিবীতে শক্তির যাবতীয় চাহিদা মেটাবে চাঁদ-ই। গতিতে ছুটতে চাঁদ ছাড়া আমাদের আর কোনও গতিই থাকবে না!
শক্তির প্রয়োজন মেটাতে তখন আর কয়লা পোড়ানোর দরকার হবে না আমাদের। লাগবে না প্রাকৃতিক গ্যাসও। যে জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা, যার জন্য হু হু করে বেড়ে চলেছে পৃথিবীর গায়ের জ্বর, উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে উষ্ণায়নের বিপদ, তার আর দরকারই হবে না আমাদের। জীবাশ্ম জ্বালানির ভাঁড়ারও তো ধরিত্রীতে ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। খুব দ্রুত।
তাই আর ৩০ বছরের মধ্যেই হইহই করে শিল্পোৎপাদন শুরু করে দিতেই হবে চাঁদে। পৃথিবীর শক্তির যাবতীয় চাহিদা মেটাতে।
চাঁদে মানবসভ্যতার কলোনির ক্যাপসুলগুলির নকশা। ছবি সৌজন্যে: নাসা
চাঁদের হিলিয়াম-৩ মৌল মেটাতে পারে পৃথিবীর ১০ হাজার বছরের শক্তির চাহিদা!
আর সেটা মাত্র কয়েকটা বছর বা কয়েকটা দশকের জন্য নয়। চাঁদে রয়েছে যে বিপুল পরিমাণ ‘হিলিয়াম-৩’ (হিলিয়াম মৌলের একটি বিশেষ আইসোটোপ), তা পৃথিবীতে শক্তির যাবতীয় চাহিদা মেটাতে পারে অন্তত ১০ হাজার বছরের জন্য। যা চাঁদে সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ (হিউম্যান কলোনি) চালাতেও কাজে লাগবে।
আরও পড়ুন- গলদ ‘ও’ রিংয়েই, ফুলে ফেঁপে ওঠেনি বলেই গভীর রাতে থমকে গেল চন্দ্রযান-২ অভিযান
আমাদের গ্রহে ৫ হাজার কিলোগ্রাম ওজনের কয়লা পোড়ালে যতটা শক্তি উৎপাদন হয়, চাঁদের মাত্র ৪০ গ্রাম হিলিয়াম-৩ মৌল থেকে তৈরি হয় ততটাই শক্তি! ভাবুন, কত পরিমাণে ওই মৌলের প্রয়োজন হচ্ছে,ওই বিপুল পরিমাণে শক্তি তৈরি করতে!
পৃথিবীতে কেন নেই হিলিয়াম-৩?
হিলিয়াম মৌলের এই বিশেষ আইসোটোপটি আমাদের গ্রহে খুবই দুর্লভ। সূর্যের করোনা বা বায়ুমণ্ডল থেকে প্রচুর পরিমাণে বেরিয়ে আসে এই বিশেষ আইসোটোপের মৌলটি। কিন্তু পৃথিবীর পুরু বায়ুমণ্ডল রয়েছে। সেই বায়ুমণ্ডলের কণাদের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে সূর্যের করোনা থেকে বেরিয়ে আসা হিলিয়াম-৩ আইসোটোপের মৌল অন্য মৌলে বদলে যায়। ফলে, পৃথিবী আর হিলিয়াম-৩ মৌলটিকে পায় না।
কিন্তু চাঁদের কোনও বায়ুমণ্ডলই নেই। তাই সূর্যের করোনা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা হিলিয়াম-৩ মৌল সরাসরি এসে আছড়ে পড়ে চাঁদের পিঠে। তারা চাঁদের পিঠে (লুনার সারফেস) বালিকণার মধ্যেই মিশে থাকে। বায়ুমণ্ডল নেই বলে সূর্য থেকে চাঁদে আসা হিলিয়াম-৩ মৌল অবিকৃতই থেকে যায়। অন্য কোনও মৌলে বদলে যায় না বলে চাঁদে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে এই বিশেষ আইসোটোপের হিলিয়াম মৌল।
চাঁদে কেমন দেখতে হবে মানবসভ্যতার কলোনি? দেখুন ভিডিয়ো
কেন আর্মস্ট্রংরা গিয়েছিলেন চাঁদে?
জীবাশ্ম জ্বালানি যে ফুরিয়ে যাবে এক দিন সেই ভাবনাটা অনেক দিন ধরেই আমাদের মাথায় ছিল। এটাও আমরা অনেক দিন ধরেই জানতাম, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির জন্যই বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাসগুলির পরিমাণ বাড়ছে ভয়াবহ হারে। ওই ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’গুলির নির্গমন বেড়ে যাওয়ার ফলে, অস্বাভাবিক ভাবে তেতেপুড়ে উঠছে ধরিত্রীর গা। উষ্ণায়নের বিপদ বাড়ছে উত্তরোত্তর। যার জেরে ঘটছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঘটনা। বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে দুই মেরু ও পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য পর্বতমালাগুলির। বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর উদ্বেগজনক ভাবে।
সেই জন্যই সৌরশক্তি, বায়ুশক্তির মতো অপ্রচলিত শক্তির উৎসগুলির সম্পর্কে আমাদের উৎসাহ বাড়তে শুরু করে। প্রচুর পরিমাণে শক্তি উৎপাদনের জন্য আমরা নির্ভর করতে শুরু করি পরমাণু বিদ্যুতের উপর। সেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পরমাণু চুল্লিটা (নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর) এখনও পর্যন্ত যে প্রক্রিয়ায় আমরা চালাই, তাকে বলা হয়, ‘নিউক্লিয়ার ফিশন’। যার মানে, কোনও মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াসটা ভেঙে সেই শক্তির জন্ম হয়। বিভাজনের মাধ্যমে।
কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্সের অধিকর্তা, বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী
এই পদ্ধতিতে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য লাগে প্রচুর পরিমাণে থোরিয়াম, প্লুটোনিয়াম ও ইউরেনিয়ামের মতো অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় মৌলগুলির। চাঁদে আমেরিকা যতগুলি ‘অ্যাপোলো’ মিশন পাঠিয়েছে, তাদের সকলেরই লক্ষ্য ছিল, আমাদের উপগ্রহে ওই তেজস্ক্রিয় মৌলগুলির সন্ধান ও সেগুলি কী পরিমাণে রয়েছে, তার খোঁজতল্লাশ করা। একই কারণে তখন রাশিয়াও (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) চাঁদে একের পর এক অভিযান চালিয়েছে।
কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে আমরা পরমাণু বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারি, যদি পরমাণু চুল্লিটাকে চালানো যায় ‘নিউক্লিয়ার ফিউশন’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যার অর্থ, দু’টি মৌলের পরমাণুর নিউক্সিয়াসের সংযোজন ঘটিয়ে। যে ভাবে তারাদের শরীরে শক্তির জন্ম হচ্ছে বিপুল পরিমাণে। যে ভাবে আমাদের সূর্যের অন্দরে বিপুল পরিমাণে শক্তির জন্ম হয়ে চলেছে প্রতি মুহূর্তে। এত বিপুল পরিমাণে শক্তির জন্ম হচ্ছে বলেই সূর্যের মতো তারার অত উজ্জ্বল হয়। বহু কোটি মাইল দূর থেকে দেখলেও তাদের উজ্জ্বলতা চোখ ধাঁধিয়ে দেয় আমাদের।
চাঁদে মানবসভ্যতার কলোনির দ্বিতীয় নকশা। ছবি সৌজন্যে: নাসা
কেন চাঁদে যাচ্ছে ভারত, চিন?
আর সেটা সম্ভব ওই হিলিয়াম-৩ মৌলটি দিয়েই। যা দিয়ে অপ্রচলিত উপায়ে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে তেজস্ক্রিয়তার বিপদ এড়ানো যাবে পুরোপুরি। তা হবে অনেক বেশি নিরাপদ। পরিমাণে অনেক গুণ বেশি তো বটেই।
এই ধারণাটার ভিত যতই মজবুত হচ্ছে উত্তরোত্তর, ততই ভারত ও চিনের মতো দেশগুলিও এখন ছুটতে শুরু করেছে চাঁদে। যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে ছোট ছোট উন্নয়নশীল দেশগুলিও। কারণ, তারা বুঝে গিয়েছে, অপ্রচলিত উপায়ে শক্তি উৎপাদনের সেরা হাতিয়ারটি রয়েছে চাঁদেই। হিলিয়াম-৩ মৌল।
হিলিয়াম-৩ কী ভাবে কাজে লাগবে পৃথিবীতে শক্তি উৎপাদনে?
আমাদের এই গ্রহের তিন ভাগই জল। বাকি এক ভাগ স্থল। পৃথিবী কার্যত ভরে রয়েছে সাগর, মহাসাগরে। সেই জলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ডয়টেরিয়াম অক্সাইড (D2O)। এই ডয়টেরিয়াম অক্সাইডের সঙ্গে পরমাণু চুল্লিতে হিলিয়াম-৩ মৌলের বিক্রিয়া ঘটালেই জন্ম হতে পারে বিপুল পরিমাণ শক্তির।
চাঁদে মানবসভ্যতার কলোনির তৃতীয় নকশা। ছবি সৌজন্যে: নাসা
আরও পড়ুন- চার বছরের মধ্যেই চাঁদের পাড়ায় ‘বাড়ি’ বানাচ্ছে নাসা!
এখন যেটা ভাবা হচ্ছে, তা হল, তেজস্ক্রিয় বিকিরণহীন পরমাণু বিদ্যুৎ প্রচুর পরিমাণে উৎপাদনের জন্য চাঁদের বালিকণা ও ধুলোবালি (রেগোলিথ) থেকে ওই হিলিয়াম-৩ মৌলটিকে নিষ্কাশন করে সেটাকেই ক্যাপসুলে ভরে পৃথিবীতে নিয়ে আসা হবে এবং কিছুটা দিয়ে চাঁদেই পরমাণু চুল্লিতে ব্যবহার করা হবে। তার জন্যই শিল্পাঞ্চল ও গড়ে উঠবে চাঁদে।
আর ৩০ বছরের মধ্যে চাঁদে যে কলোনি বানাতে চলেছে মানবসভ্যতা, এই হিলিয়াম-৩ মৌলটি তারও শক্তির চাহিদা মেটাবে।
চাঁদে মানবসভ্যতার কলোনির চতুর্থ নকশা। ছবি সৌজন্যে: নাসা
চাঁদে মানুষের কলোনিতে কী কী লাগবে?
চাঁদে তো জলও খুব কম নেই। বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন, চাঁদের উত্তর মেরুতে যতটা বরফ জমে রয়েছে তার ওজন প্রায় ৬০ হাজার কোটি কিলোগ্রাম। মানে, সেই বরফকে গলিয়ে জল করা গেলে তা ১০ কিলোমিটার লম্বা, ১০ কিলোমিটার চওড়া এবং ১০ মিটার গভীরতার একটি হ্রদকে পুরোপুরি ভরিয়ে দিতে পারে। অনুমান, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতেও রয়েছে প্রায় একই ওজনের বরফ।
আর ৩০ বছর পরে চাঁদের দুই মেরুতে যখন মানবসভ্যতা কলোনি গড়ে তুলবে, তখন সেই বরফ গলানো জল যেমন কাজে লাগবে কলোনির বাসিন্দাদের, তেমনই সেই জলকে তড়িৎ বিশ্লেষণ করে যে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পাওয়া যাবে, তাদের রকেটের জ্বালানি হিসাবেও কাজে লাগানো যাবে। সেই জ্বালানি ভরেই চাঁদ থেকে মহাকাশযানে চাপিয়ে পৃথিবীতে নিয়ে আসা যাবে হিলিয়াম-৩ মৌল। পৃথিবীতে শক্তির চাহিদা মেটাতে অন্য পদ্ধতিতে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনে।
চাঁদে মানবসভ্যতার কলোনিকে যাঁরা এখন ‘দিবাস্বপ্ন’ বলে মনে করছেন, তাঁরা আদতে জানেন না, বিজ্ঞানটা এগিয়ে গিয়েছে কতটা দূরে। চাঁদে কলোনি বানানোর প্রস্তুতিটা কোথায় পৌঁছেছে। গামা রে-সহ নানা রকমের বিষাক্ত বিকিরণের হাত থেকে বাঁচতে সেই কলোনি বানানো হবে চাঁদের পিঠ থেকে দেড় মিটার গভীরে। রোজ সূর্যের আলো পাবে বলে, আর জলের প্রাচুর্য সেখানেই বেশি থাকবে বলে সেই কলোনি চাঁদের দুই মেরুতেই গড়ে উঠবে। যেখানে সৌরশক্তি টানার জন্য সোলার সেলগুলিকে বসানো থাকবে উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়ায়। যেখানে সূর্য়ের আলো থাকে বছরের সব সময়েই।
টেলিফোন সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন: সুজয় চক্রবর্তী
ছবি সৌজন্যে: নাসা।
ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ বা ‘এসা’)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy