ডাব-নারকেলের মেয়াদ অল্প, সে রসের মেয়াদ; ঝুনো নারকেলের মেয়াদ বেশি; সে শাঁসের মেয়াদ। কবিরা হল ক্ষণজীবী, ফিলজফরের বয়সের গাছপাথর নেই” লিখেছিলেন রবি ঠাকুর তাঁর ‘শেষের কবিতা’-য়। আর লিখবেন না-ই বা কেন? ছোটবেলা থেকেই নারকেল গাছ তাঁর সঙ্গী। “পুবদিকের পাঁচিল ঘেঁষে এক সার নারকেল গাছ। সেই নারকেল গাছের কম্পমান পাতায় আলো পড়বে, শিশিরবিন্দু ঝলমল করে উঠবে, পাছে আমার এই দৈনিক দেখার ব্যাঘাত হয় এইজন্য আমার ছিল এমন তাড়া।” খাবারের মধ্যেও তাঁর সবচেয়ে পছন্দের ছিল— চিতল মাছ, চালতা দিয়ে মুগের ডাল এবং নারকেল চিংড়ি। বাঙালির পাতে নারকেলের কদরই আলাদা। গরম মশলা-ঘি-তেজপাতা-নারকেল দিয়ে ছোলার ডাল, নারকেল দিয়ে কচু বাটা, মুড়ির সঙ্গে ধানি লঙ্কা, ঝুনো নারকেল কোরা আর নারকেল নাড়ুর যে কী অপূর্ব স্বাদ, তা বাঙালিমাত্রেই জানেন। কেরলের খিচুড়িতে থাকবেই ভাত, মুগ ডাল, নারকেল আর বাদাম। আমরা যারা ঘনাদার ‘পোকা’ গল্পটি পড়েছি তারা জানি, সে গল্প শুরুই হত না যদি না ঘনাদার ঘরে একটা বড় মাপের নারকুলে পোকা বা রাইনোসেরাস বিটল ঢুকত। শুধু রবি ঠাকুর কেন, গোটা ভারত বা এশিয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে যে ফল, তা নারকেল। বেন্থাম সাহেব তাঁর বিখ্যাত ট্রিজ় অব ক্যালকাটা অ্যান্ড নেবারহুড বইতে বলেছেন, খাস কলকাতায় বিশ শতকের প্রথম দশক অবধি আর যে গাছ থাকুক না কেন, নারকেল গাছের কমতি ছিল না। এই গাছ শকুনদের বড় প্রিয়। তারা এই গাছের ডালে সারি বেঁধে বসে থাকে।
জিশু খ্রিস্টের জন্মের আগেও নিশ্চয়ই এ দেশে এই ফল ছিল। কারণ, উল্লেখ রয়েছে রামায়ণে। কসমস ইনডিকোপ্লিউস্টেস নামে এক গ্রিক ব্যবসায়ী ৫৪৫ অব্দে ভারতের এই ফলের দারুণ সুখ্যাতি করে একে ‘গ্রেট নাট অব ইন্ডিয়া’ বলেছেন। আরব্য রজনীর গল্পেও সিন্দবাদকে নারকেল বিক্রি করতে দেখা যায়। মোট কথা, এক দিকে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া ও পাপুয়া নিউ গিনি, এবং অন্য দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে উৎপন্ন হয়ে নারকেল গোটা এশিয়া আর আমেরিকার সমুদ্রতটে ছড়িয়ে পড়ে। আজ থেকে ২৩০ লক্ষ বছর আগে কোকোস জ়াইলেনিকা নামে ছোট্ট বাদামের মতো মাত্র ৩.৫ সেন্টিমিটার লম্বা এক ফল ছিল। বিজ্ঞানীরা তার ফসিল থেকে প্রমাণ করেছেন, এটিই নাকি নারকেলের পূর্বপুরুষ। কোকোস নামটা অবশ্য এসেছে অনেক পরে। ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা অন্য অনেক কিছুর মতো এই নামটাও দিয়েছিলেন। কোকোস মানে মড়ার খুলি। নারকেলের মাথায় তিনটে কালো বিন্দু দেখলে খুলির কথাই মনে আসা স্বাভাবিক। তবে পশ্চিমে এই ফলকে ‘নাক্স ইন্ডিকা’ বা ‘ইন্ডিয়ান নাট’ নামে ডাকা হত। এই দুইয়ে মিলে আজকের কোকোনাট নামের জন্ম।
তবে ভারতে নয়, সবচেয়ে বেশি নারকেল হয় মায়ানমার আর ইন্দোনেশিয়ায়। মলদ্বীপের কোট অব আর্মস-এ শোভা পাচ্ছে এই গাছ। সে দেশের মানুষ অবশ্য এই গাছকে বলেন গন-বিন বা লোক ঠকানোর গাছ। কেন? তা নিয়ে রয়েছে এক উপকথা। এক বার সে কালের বর্মায় এক ভেলা চেপে তিন জন উপস্থিত। এক চোর, এক ডাইনি আর এক প্রতারক। তিন জনকেই রাজার কাছে আনা হল। রাজা বললেন চোর বা ডাইনি অভাবী। তাঁদের পয়সাকড়ি দিয়ে বিদায় করো। আর প্রতারকের গলা কাটো। প্রতারকের গলা তো কাটা হল। কিন্তু যখনই কেউ সেই বধ্যভূমির পাশ দিয়ে যায়, কাটা মাথা চিৎকার করে রাজাকে গালাগাল করে। রাজা দেখলেন, এ মহা জ্বালা। তিনি মাথাটা মাটির গভীরে পুঁতে দিলেন আর সেই থেকে গজিয়ে উঠল এই গন-বিন গাছ। তার মাথা ধরে নাড়া দিলে এখনও সে গলগল করে রাজার নামে গাল পাড়ে।
কী থাকে একটা সুপুষ্ট নারকেলে? থাকে ৪০০ গ্রাম শাঁস, ১৫০ মিলিলিটার জল আর প্রচুর মিনারেল, ভিটামিন, ক্যালোরি। কিন্তু নারকেলের আসল আদর তার তেলের জন্য। শাঁসে থাকে লরিক অ্যাসিড। এই স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তে হাই ডেনসিটি কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়িয়ে রক্তনালীতে ক্ষতিকর লো ডেনসিটি কোলেস্টেরল জমতে দেয় না। আর ডাবের জলে কী-ই না থাকে! গ্লুকোজ়, উৎসেচক (পলিমারেজ়, ফসফাটেজ়, ক্যাটালেজ় ইত্যাদি) সাইটোকাইনিন আর বিভিন্ন খনিজ পদার্থ (জিঙ্কলসিয়াম, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ়)। সাধে কী আর পুজো থেকে পরীক্ষা— সব কাজে ডাবের জল অপরিহার্য! শাঁসেও রয়েছে নানা ভিটামিন আর খনিজের সম্ভার। নারকেল থেকে তৈরি হয় নানা ভেষজ ওষুধ। এখানেই শেষ না, এই গাছের সমস্ত অংশ, তা পাতাই হোক বা ফলের খোল, ছিবড়েই হোক বা মূল গাছ— প্রতিটি অংশই বিভিন্ন ভাবে আমরা ব্যবহার করি। পুজোতে ডাবের জল ছাড়া চলে না। পুরীতে জগন্নাথের রথ তৈরি হয় নারকেল কাঠ দিয়ে। পুরাণে তাই এই গাছকে ‘কল্পবৃক্ষ’ নাম দেওয়া হয়েছে।
২০০৯ সালে গঠিত হয়েছিল এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক কোকোনাট কমিউনিটি (এপিসিসি)। উদ্দেশ্য, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এঁর ১৮টি সদস্য দেশের মধ্যে দারিদ্র দূরীকরণে নারকেলের গুরুত্ব বোঝানো আর নারকেলের ব্যবহার বাড়ানো। এপিসিসি-র প্রধান দফতর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়। তাদের পক্ষ থেকে প্রতি বছর আজকের দিনে পালিত হয় বিশ্ব নারকেল দিবস। ভারতে এই দিনটি পালন করা ছাড়াও ২৬ জুন কোকোনাট ডেভলপমেন্ট বোর্ড জাতীয় নারকেল দিবস পালন করে। যে হেতু গাছের ফল থেকে কাঠ, সমস্তটাই কাজে লাগে, তাই অর্থনীতিতে নারকেলের ভূমিকা যে অসীম, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। শুধু নারকেলকে অবলম্বন করেই বেঁচে থাকতে পারে মানুষ। গড়ে উঠতে পারে জীবিকা। এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়াই এর লক্ষ্য।
মৃত্তিকাবিজ্ঞানী, ধান্য গবেষণাকেন্দ্র, চুঁচুড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy