-ফাইল ছবি।
ভারতের বিজ্ঞান গবেষণায় ইতিহাসে কি এটা ‘কালো অধ্যায়’ নয়?
গবেষণাপত্রে দেওয়া ছবি ও তথ্যাদিতে জালিয়াতির অভিযোগ উঠল এ বার ভারতীয় বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে। সেই গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখক আরতি রমেশ দেশের জীববিজ্ঞান গবেষণার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্স' (এনসিবিএস)-এর অধ্যাপক। তাঁর নিজস্ব গবেষণাগারও রয়েছে এনসিবিএস-এ। জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিশ্বের ন্যতম প্রধান বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকাগোষ্ঠী ‘নেচার গ্রুপ’ প্রকাশের আট মাস পর গবেষণাপত্রটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অভিযুক্ত গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখকদের মধ্যে রয়েছেন দুই বঙ্গসন্তানও। শিলাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুস্মিতনারায়ণ চৌধু্রী।
ঘটনাটি নিয়ে এখন চরম আলোড়ন দেশের বিজ্ঞানীমহলে। মঙ্গলবার এনসিবিএস-এর তরফে দেওয়া একটি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ঘটনার তদন্ত করা হয়েছে। তাতে জালিয়াতির অভিযোগ স্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “গবেষণাপত্রে দেওয়া ছবি ও তথ্যাদি জালিয়াতির ক্ষেত্রে কোনও এক গবেষকের ভূমিকা রয়েছে বলে জানা গিয়েছে।” তবে কেন এনসিবিএস-এর অধিকর্তার দেওয়া সেই বিবৃতিতে স্পষ্ট ভাবে সেই গবেষকের নামোল্লেখ করা হয়নি, তা নিয়ে তোলপাড় এখন দেশের বিজ্ঞানীমহল। তাঁদের বক্তব্য, “ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে এমন ঘটনা সম্ভবত এর আগে ঘটেনি। প্রকাশিত হওয়ার কয়েক মাস পর জালিয়াতির অভিযোগে কোনও গবেষণাপত্র এই ভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি কোনও বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকাগোষ্ঠীর তরফে। এই ঘটনা ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার ঐতিহ্যকে কালিমালিপ্ত করল।”
কী বলছেন আরতি?
তাঁর মন্তব্য, “আমি খুবই শোকাহত। গবেষণাপত্রের করেসপন্ডিং অথর হিসাবে আমারও কিছু দায় থাকে। আমার তথ্যাদি খতিয়ে দেখা উচিত ছিল।”
আরও পড়ুন
রাজ্যে নতুন আক্রান্ত এক ধাক্কায় ন’শোর নীচে, মৃত্যু ১৮, সক্রিয় রোগী ১৮ হাজারের কম
আরও পড়ুন
মহারাষ্ট্রে মহারাজনীতি, শিবসেনার চালে কি আপাতত ‘নিরাপদ’ উদ্ধব সরকার
অভিযোগের কাঠগড়ায় ওঠা গবেষণাপত্রটি ২০২০-র ৬ অক্টোবরে প্রকাশিত হয় নেচার গ্রুপের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার কেমিক্যাল বায়োলজি’-তে। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম ‘ডিসকভারি অব আয়রন সেন্সিং ব্যাক্টিরিয়াল রাইবোসুইচেস’। গবেষণাপত্রটির করেসপন্ডিং অথর এনসিবিএস-এর অধ্যাপক আরতি রমেশ। তাঁর সহযোগী গবেষকদের মধ্যে রয়েছেন শিলাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সুস্মিতনারায়ণ চৌধু্রী এবং ডলি মেহতা।
সেই গবেষণার পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের দাবি ছিল, ব্যাক্টিরিয়ার মধ্যে এমন এক ধরনের রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (আরএনএ)-এর অণুর এই প্রথম হদিশ মিলেছে, যা লোহাকে আলাদা ভাবে চিনতে পারে। লোহাকে অনুভব করতে (‘সেন্স’) পারে। গবেষকরা সেই আরএনএ অণুটির নাম দেন ‘সেন্সি’।
গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার দেড় মাস আগেই (২১ অগস্ট, ২০২০) এনসিবিএস-এর তরফে করা একটি টুইটে আরতি ও তাঁর সহযোগীদের আবিষ্কারকে ‘পথিকৃৎ কাজ’ বলে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। তার পর ‘ইনস্টিটিউট অব বায়োইনফরমেটিক্স অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড বায়োটেকনোলজি’-র সেমিনারেও আরতিকে আমন্ত্রিত বক্তা মনোনীত করা হয় গত সেপ্টেম্বরে তাঁদের আবিষ্কার নিয়ে বলার জন্য।
কিন্তু গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার দিন কয়েকের মধ্যেই সেখানে দেওয়া ছবি ও তথ্যাদির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে ‘পাবপিয়ার’ নামে একটি সংস্থা। যারা দীর্ঘ দিন ধরেই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকাগুলিতে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের ছবি ও তথ্যাদির সত্যতা নিয়ে অনুসন্ধানমূলক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের অভিযোগ ছিল, “পরীক্ষালব্ধ ফলাফল বলে দাবি করা বিষয়গুলিকে প্রমাণ করার জন্য গবেষণাপত্রে ইচ্ছাকৃত ভাবে ডিজিটাল ফোটোশপ পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়েছে। সেই ভাবেই ছবি তৈরি করা হয়েছে। যা গবেষণাপত্রের রিভিউয়ারদেরও ধোঁকা দিতে পেরেছে নিখুঁত ভাবে।”
গবেষণাপত্রটির সত্যতাকে চ্যালেঞ্জ করে পাবপিয়ার-এর তরফে এক বিজ্ঞানীর মতামত অনলাইনে আসার পরেও গত জানুয়ারিতে গবেষণাপত্রটির ভূয়সী প্রশংসা করা হয় এনসিবিএস-এর তরফে।
যদিও অনলাইনে বিরূপ মতামতের বন্যা দেখে নেচার কেমিক্যাল বায়োলজি-র তরফে সম্পাদকের দফতর থেকে গত ১১ ডিসেম্বর গবেষণাপত্রটির নীচে একটি অংশ জুড়ে দেওয়া হয়। তাতে লেখা হয়, “এই গবেষণাপত্রে দেওয়া তথ্যাদি সম্পর্কে পাঠকদের সতর্ক করা হচ্ছে। কারণ, ওই সব তথ্যের সত্যতা নিয়ে জোরালো প্রশ্ন উঠেছে। ঘটনার তদন্তের পর এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এনসিবিএস-এর এক বিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, এর পরেই গত ফেব্রুয়ারি থেকে আরতি নিজেই গোপনে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন গবেষণাপত্রটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য। তিনি চিঠি দেন 'নেচার কেমিক্যাল বায়োলজি' পত্রিকার সম্পাদককে। জানান, তাঁর সহযোগী গবেষকরা পরীক্ষায় যে সব তথ্য সরবরাহ করেছিলেন তা নিয়ে তিনি নিঃসংশয় নন। তাই ওই গবেষণাপত্রটি তিনি প্রত্যাহার করে নিতে চাইছেন। এর পর গত ৩০ জুন 'নেচার কেমিক্যাল বায়োলজি' পত্রিকার তরফে গবেষণাপত্রটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।
আরতির অধীনে গবেষণা করা অনেকেই (নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক) কিন্তু বলছেন, “ওঁর সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতাও খুব তিক্ত। আমাদের অনেকের গবেষণালব্ধ ফলাফলই তিনি এর আগেও নিজের করা বলে চালিয়েছেন। প্রচারও করেছেন। ওঁর ক্ষমতা রয়েছে বলে আমরা কিছু বলার সাহস পাইনি। তাতে আমাদের পড়াশোনা, গবেষণার বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে ভেবে।”
ঘটনা নিয়ে 'আনন্দবাজার অনলাইন'-এর তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল এনসিবিএস-এর অধিকর্তা সত্যজিৎ মেয়রের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, “আমরা প্রশাসনিক তদন্ত করেছি। তাতে দেখা গিয়েছে, অধ্যাপক আরতি রমেশের এ ব্যাপারে কোনও দায় নেই। গোটা ঘটনাই ঘটিয়েছেন অন্য এক জন। তাঁকে চিহ্নিতও করা হয়েছে।”
তবে তাঁর নামটি কী, জানতে চাইলে জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন এনসিবিএস-এর অধিকর্তা। বলেছেন, “তদন্তের স্বার্থেই তা জানানো সম্ভব নয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy