শাহী চিকেন হালিম
সূর্য তখনও ডোবেনি। কিন্তু একেবারে জমজমাট জ়াকারিয়া স্ট্রিট। শুধু জ়াকারিয়া কেন, খিদিরপুর, চাঁদনি চক, মেটিয়াবুরুজ, পার্ক সার্কাস... নানা চত্বরেই জমে উঠছে ভিড়। সময় হয়ে এসেছে ইফতারের। সূর্য ডোবার পাঁচ থেকে আট মিনিটের মাথায় শুরু হবে ইফতার। রমজান ও মহরম মাসে সারা দিন না খেয়ে উপবাসভঙ্গের নামই ইফতার। তার জন্যই আয়োজন। প্রথম দিকে জলপাই, খেজুর, উটের দুধ, হালিম দিয়ে উপবাসভঙ্গ হত। এখন তার বদলে ফল, তেলেভাজা থাকলেও তালিকায় হালিম অপরিবর্তিত। কাবাব, নিহারি, পায়া, চাঁপ, ফালুদা, বত্তিসা হালুয়া থাকলেও হালিম রাজ করছে নিজের মতোই। এর জন্যই গোটা বছরের অপেক্ষা। রমজান মাস এবং মহরম মাস— বছরের এই দুই সময় ধরে রান্না হয় হালিম।
হালিম না কি হারিস?
‘‘আল্লার নিরানব্বইটি নাম আছে। তার মধ্যে একটি নাম হল হালিম। ‘হালিম’ শব্দটির অর্থ শান্ত, সহিষ্ণু। শুরুর দিকে আগের রাতে গম ভিজিয়ে রাখা হত। পরদিন গমের সঙ্গে মাংস দিয়ে রান্না করা হত,’’ বলছেন অধ্যাপক শামিম আহমেদ।
হালিমের নামেরও পরিবর্তন হয়েছে। আরবিতে একে বলা হয় হারিস। পরে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এসে তার নাম হয় হালিম। হারিসের অর্থ মিশ্রণ। শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ‘কিতাব-আল-তাবিখ’ গ্রন্থে। দশম শতাব্দীতে বইটি লেখেন ইবনে সায়ার আল ওয়ারক।
শাহী মাটন হালিম
আরব থেকে হালিম দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া হয়ে এসে পৌঁছয় ভারতবর্ষে। প্রাচীন কালে সারা রাত ধরে ভিজিয়ে রাখা গম পরদিন মাংস, ভেড়ার চর্বি বা মাখনে নিভু আঁচে ফোটানো হত। পরে তা ছেঁকে অবশিষ্ট মিশ্রণ পিষে ফেলা হত। নুন মিশিয়ে পরিবেশন করা হত দারচিনি, ঘি আর চিনি দিয়ে! আরব ও ইয়েমেন থেকে ভারতে এসেছিলেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের হাত ধরেই ভারতে আগমন হারিসের।
মালয়ালি মুসলমান গোষ্ঠী মোপিলা হালিমকে জনপ্রিয় করে তুললেও আলাদা করে বলতে হয় এক জনের কথা। তিনি সুলতান সইফ নওয়াজ় জং বাহাদুর। ইয়েমেনের হদরামত থেকে আসা নওয়াজ় হায়দরাবাদের নবাব মীর ওসমান আলি খানের রাজসভার সদস্য ছিলেন। নওয়াজ়ের দেওয়া যে কোনও দাওয়াতে হালিম থাকতই। ‘‘হারিস কাশ্মীরেও ভীষণ জনপ্রিয়। সেখানে শীতকালে পাওয়া যায় এই পদ। স্বাদও অন্য রকম,’’ বক্তব্য ব্লগার ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ীর।
বলতে হয় হায়দরাবাদের ছাউ কমিউনিটির কথাও। তাঁরা আজও হারিস খান। হারিস দু’ভাবে পরিবেশন করা হয়। একটি খারি অর্থাৎ নোনতা, অন্যটি মিঠি। অনেকের মতে মিষ্টি হালিম বেশি খোলতাই।
হালিম বনাম খিচুড়ি
আবার হালিমকে খিচুড়ির দূরদূরান্তের আত্মীয় হিসেবেই মনে করেন অনেকে। মাংস দিলে কিছু খিচুড়ির স্বাদ বেড়ে যায়। তবে খিচুড়ির সঙ্গে হালিমের অমিল স্পষ্ট। প্রথমত, খিচুড়ি রান্না করতে এত সময় লাগে না। মশলাপাতির পরিমাণও কম।
ইরানি হালিম
দ্বিতীয়ত, খিচুড়িতে মাংসের টুকরো বা কিমা পড়ে। কিন্তু হালিম তৈরি করার পদ্ধতি একেবারে আলাদা। এ প্রসঙ্গে আসা যাক হালিম তৈরির কথায়।
হালিম রান্না
ঢিমে আঁচে বেশিক্ষণ ধরে রান্না করাই হল হালিম তৈরির ঠিক পদ্ধতি। সাত-আট ঘণ্টা তো বটেই, কখনও তার বেশি সময়ও লাগে। হায়দরাবাদি হালিম রান্না করতে প্রয়োজন বিফ অথবা মাটন। গম, বার্লি, ডাল সারা রাত ভিজিয়ে রেখে দিতে হয়। পরদিন হাঁড়িতে মশলা মাখিয়ে মাংস রান্না করতে হয়। অন্য দিকে বিশাল বড় হাঁড়িতে সিদ্ধ বসানো হয় ভিজিয়ে রাখা ডাল-গম ইত্যাদি। মাংস রান্না হয়ে এলে গ্রেভি মেশানো হয় হাঁড়িতে। থাকে সুবিশাল কাঠের হাতা বা ঘোতনি। তা দিয়ে পিষে তৈরি হয় হালিম। মাংস, ডাল, গম প্রায় মিহি না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে পেষা।
হালিমের রকমফের
ভারতে হালিম তৈরি হয় মূলত বিফ এবং মাটন দিয়েই। তবে মধ্য প্রাচ্যের নানা জায়গায় সহজলভ্য মাংস দিয়েই হালিম তৈরি হয়। তালিকায় আছে ভেড়া, উটের মাংসও। এ দেশে বিফ, মাটন ছাড়া পাওয়া যায় চিকেন হালিম। যদিও খাদ্যপ্রেমীরা সেই পদকে হালিমের মান্যতা দিতে নারাজ। কোথাও কোথাও তৈরি হয় ভেজিটেবিল হালিমও! থাকে হরেক ধরনের সিদ্ধ আনাজ। কেউ কেউ কামিনী চাল, আবার কেউ গোবিন্দভোগ চালও দেন এই রান্নায়।
আফগানি হালিম
কলকাতায় নানা ধরনের হালিম পাওয়া যায়। হায়দরাবাদি হালিম তো আছেই। আর আছে শাহী মাটন বা চিকেন হালিম, ইরানি হালিম, আফগানি হালিম। কলকাতায় তৈরি হায়দরাবাদি হালিমে পেষা মাংস দিয়ে রান্না করা হয়। শাহী হালিমে পড়ে হাড়সমেত মাংসের ছোট ছোট টুকরো। ইরানি হালিম তৈরি হয় বোটি অর্থাৎ হাড় ছাড়া মাংসের টুকরো দিয়ে। তাতে হাড়-সহ মাংসও যোগ করা হয়। হাড়ের রস হালিমের স্বাদ বাড়ায়। অন্য দিকে আফগানি হালিম তৈরির পদ্ধতি একেবারে আলাদা। জিরে, ধনে, লঙ্কা, গরম মশলা, মাংসের কিমা, নুন ও ডিম দিয়ে মেখে ছোট বলের আকার দেওয়া হয়। হলুদ বা কেশর মেশানো দুধে মাংসের বল ফুটিয়ে তৈরি করা হয় কোফতা। সেই কোফতাই পড়ে সাবেক পদ্ধতিতে তৈরি হালিমে।
হায়দরাবাদ বনাম কলকাতা
দেশ-কাল ভেদে যতই বদলে যাক হারিসের স্বাদ, তবুও কাছাকাছি যেতে পারে হায়দরাবাদের হালিমই। কিন্তু কলকাতা? যাঁরা এক বার হায়দরাবাদি হালিমের স্বাদ নিয়েছেন, তাঁরাও কিন্তু কলকাতার হালিমকে ঠিক ‘হালিম’ বলতে নারাজ। তাঁদের মতে, হালিম না বলে পদটিকে বলা যেতে পারে ‘ডাল গোস্ত’। পদটির কোন নাম আসলে যুক্তিযুক্ত, এ প্রসঙ্গে লড়াই অনেক। পক্ষ ও বিপক্ষে বাদানুবাদও প্রচুর। তবে সে সব তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে যাঁরা কলকাতাতেই বসে হালিমে রসনাতৃপ্তি করেন, বিজয়ী তাঁরাই!
ছবি: দেবর্ষি সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy