Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

দেশপ্রেমের মলম

দিয়ে বঞ্চনার জ্বালাপোড়া কি কখনও কমিয়ে আনা যায়? সেই চেষ্টাই দেখা গেল অরুণাচল প্রদেশে ঘুরতে গিয়ে। লিখছেন সীমান্ত গুহঠাকুরতাজায়গাটার নাম হল ভালুকপং। অসম-অরুণাচল সীমান্ত। সেখানে পৌঁছতেই দুটো ব্যাপার ঘটল। (এক) আন্তঃরাজ্য চেকপোস্টে দেখাতে হল ‘ইনার লাইন পারমিট’। অন্য রাজ্য থেকে আসা টুরিস্টদের জন্য যা ইস্যু করা হয়। ছবিটবি সহ অনেকটা পাসপোর্টের (বা ভিসার) মতোই ব্যাপার। আপনি কেন এসেছেন আর কত দিনের জন্য অরুণাচল প্রদেশে থাকবেন, কোথায় কোথায় যাবেন সবই সেখানে লেখা। নিজের দেশের মধ্যেই একটা জায়গায় ঢোকার জন্য স্পেশাল পারমিট দেখাতে গিয়ে একটু খচখচ করছিল মনটা। এবং (দুই) মোবাইলের টাওয়ার নিরুদ্দেশ হল।

যুদ্ধের চশমা। অরুণাচল প্রদেশের পরিত্যক্ত বাংকার থেকে দেখা যাচ্ছে চিনের বর্ডার। ছবি: সীমান্ত গুহঠাকুরতা

যুদ্ধের চশমা। অরুণাচল প্রদেশের পরিত্যক্ত বাংকার থেকে দেখা যাচ্ছে চিনের বর্ডার। ছবি: সীমান্ত গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

জায়গাটার নাম হল ভালুকপং। অসম-অরুণাচল সীমান্ত। সেখানে পৌঁছতেই দুটো ব্যাপার ঘটল। (এক) আন্তঃরাজ্য চেকপোস্টে দেখাতে হল ‘ইনার লাইন পারমিট’। অন্য রাজ্য থেকে আসা টুরিস্টদের জন্য যা ইস্যু করা হয়। ছবিটবি সহ অনেকটা পাসপোর্টের (বা ভিসার) মতোই ব্যাপার। আপনি কেন এসেছেন আর কত দিনের জন্য অরুণাচল প্রদেশে থাকবেন, কোথায় কোথায় যাবেন সবই সেখানে লেখা। নিজের দেশের মধ্যেই একটা জায়গায় ঢোকার জন্য স্পেশাল পারমিট দেখাতে গিয়ে একটু খচখচ করছিল মনটা। এবং (দুই) মোবাইলের টাওয়ার নিরুদ্দেশ হল।

পরের সাত দিন অরুণাচলের পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর সময় পদে পদে ওই পারমিট দেখাতে হল। জায়গায় জায়গায় মিলিটারি-চেকপোস্ট। প্রতিটা গাড়ির ড্রাইভারকে ভোটার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, টুরিস্ট-গাড়ির বিশেষ পারমিট সব সময় রেডি রাখতে হয়। আর সব টুরিস্টকেও অনুমতিপত্রটা হাতের কাছে রাখতে হয়। এবং মোবাইলের সেই হারিয়ে যাওয়া টাওয়ারও আর ফিরে এল না। গোটা অরুণাচল প্রদেশে একমাত্র বিএসএনএল ছাড়া অন্য কোনও কোম্পানির সার্ভিস চালু নেই। সংস্থাগুলোকে ওখানে ব্যবসার অনুমতিই দেওয়া হয়নি। আর বিএসএনএল-এর পরিষেবার অবস্থা কহতব্য নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর কথা ছেড়েই দিলাম, মোটামুটি বড় শহরগুলোতেও এক দাগ বা দু’দাগের বেশি টাওয়ার মেলে না।

এ রকমটা তো কাশ্মীরে হয় শুনেছিলাম। সেটা তো সন্ত্রাস-কবলিত, ‘উপদ্রুত’ এলাকা। সেখানে বাড়তি রাষ্ট্রীয় সতর্কতা থাকবে, ধরেই নেওয়া যায়। কিন্তু অরুণাচল প্রদেশ কেন? ‘এটাও তো এক রকম উপদ্রুত এলাকাই বটে’, বলছিলেন চেকপোস্টে কর্মরত উর্দিধারী বাঙালি জওয়ান। আমি বাঙালি, জেনে যিনি সামান্য আবেগপ্রবণ হয়ে মুখ খুলেছিলেন। ‘জানেন কি, চিনের সরকারি ম্যাপে তিব্বতের মতো এই অরুণাচল প্রদেশটাকেও ওদের এলাকা বলে দেখানো আছে? তার ওপর এটা আবার অক্টোবর মাস।’

ঘটনা। ১৯৬২-র এই অক্টোবর মাসেই তো ভারত-চিন যুদ্ধ বেধেছিল। পশ্চিম সীমান্তে লাদাখ লাগোয়া আকসাই চিন আর পূর্ব সীমান্তে এই অরুণাচল প্রদেশই ছিল সেই কুরুক্ষেত্রের প্রান্তর। এবং এটাও ঘটনা, মাসখানেক ধরে চলা সেই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় ভারত একেবারে গো-হারা হেরেছিল। ‘খেলা’ বলছি, কারণ, অন্তত চিনের তরফে সেই যুদ্ধটা নিছক নিজের ক্ষমতার একটা ‘ডেমো’ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

অরুণাচল প্রদেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ঢুকে রাজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জমি দখল করে নিয়ে অসমের সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিল চিনের সেনা। কিন্তু মাত্র এক মাস পর, চিনের তরফে একতরফা ভাবেই যুদ্ধ-বিরতি ঘোষণা করে দেওয়া হয়। তাদের সৈন্যবাহিনীও পিছিয়ে যায় ম্যাকমোহন লাইনের ও-পারে, পূর্বের সীমানায়। খুব সোজা ভাবে বললে, চিন ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে একটুখানি চু-কিত-কিত খেলে, ভারতীয় সামরিক ব্যবস্থার করুণ দশাটাকে বেআব্রু করে দিয়ে, মুচকি হেসে আবার নিজের এলাকায় ফিরে গিয়েছিল।

কিন্তু এ সবই তো সেই ৫২ বছর আগেকার ইতিহাস। সেই সদ্য-স্বাধীন ভারতের তুলনায় আজকের ভারত তো অনেক বেশি শক্তিশালী। নয়াদিল্লি থেকে সরাসরি বেজিংয়ে পাল্লা টানতে পারে এমন ক্ষেপণাস্ত্রও তার হাতে মজুত। তা ছাড়া, গত ৫২ বছরে তো এক বারও এই এলাকায় চিনা ড্রাগনের কোনও আগুনে-শ্বাস পড়েনি। সীমান্তের ও-পার থেকে ‘সন্ত্রাস ঢুকিয়ে দেবার’ কোনও বড় রকম অভিযোগও চিনের বিরুদ্ধে তোলার সুযোগ পাননি দিল্লির কর্তারা। কিছু খিচখিচানি দু’দেশের মধ্যে লেগে আছে বটে, সেটা অনেকটা ‘আপনার গাছের ফুল আমার পাঁচিলে ঝুঁকে পড়েছে, তাই পেড়েছি বেশ করেছি’ গোছের। তবে এতটা বজ্র-আঁটুনি কেন?

অরুণাচল প্রদেশের টিলাগুলো কয়লা, চুনাপাথর, মার্বেল, ডলোমাইট, অভ্রে বোঝাই। রয়েছে প্রচুর নদী, পাহাড়ি ঝরনা, হ্রদ। যথেষ্ট বৃষ্টিও হয়। কাজেই জলেরও কোনও অভাব নেই। কিন্তু কিছু ফল-প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র আর কাঠ-চেরাই কল ছাড়া শিল্প বলতে কিচ্ছু গড়ে ওঠেনি সেখানে। প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পর্যটন ব্যবসাতেও তেমন কোনও লাভজনক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বলিউডের পরিচালক রাকেশ রোশন তাঁর ‘কোয়লা’ ছবিতে অরুণাচলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনেকটা ব্যবহার করেছিলেন। তবু অরুণাচল আজও নর্থ-ইস্টের অন্যান্য পাহাড়ি রাজ্যগুলোর মতোই অবহেলিত, উপেক্ষিত।

বমডিলা-দিরাং-সে-লা পাস-তাওয়াং— চিন-ভারত যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পশ্চিম অরুণাচলের পার্বত্য পথে ঘুরতে ঘুরতে সরকারি সেই উদাসীনতার ছবি প্রতি মুহূর্তে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাস্তা নেই, বিদ্যুত্‌ নেই, হাসপাতাল নেই, বাজার নেই (বা থাকলেও সেখানে স্থানীয় ঝুম চাষে উত্‌পন্ন ভুট্টা আর স্কোয়াশ ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না), স্কুলগুলো ভাঙাচোরা, সরকারি টুরিস্ট লজগুলোয় পরিষেবার চূড়ান্ত বেহাল দশা... এক কথায়, ‘নেই-রাজ্য’।

তা হলে আছে কী? আছে শুধু জায়গায় জায়গায় জলপাই উর্দিধারীদের অতি-সতর্ক প্রহরা। ভালুকপং থেকে তাওয়াং হয়ে তিব্বত সীমান্তে বুম-লা পর্যন্ত চোখে পড়ল শুধুই সেনাবাহিনীর বিরাট বিরাট জলপাই রঙের ট্রাকের সারি। বোল্ডার-বোঝাই জলকাদায় মাখামাখি এবড়োখেবড়ো রাস্তা ধরে হেলতে দুলতে চলেছে। পথের ধারে বিভিন্ন আর্মি-বেসক্যাম্পে সেগুলো থামছে, সৈন্যদলের ওঠানামা চলছে। দেখলাম অরুণাচলের ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রামগুলোতে এখনও সেনাবাহিনীর ট্যাংকার থেকেই পানীয় জল সরবরাহ করা হয়, রাস্তার ধারে পর্যটকদের জলখাবারের ব্যবস্থাও করে রেখেছে সেই সেনাবাহিনীই। আর্মি-ক্যাম্পের নন-সিএসডি ক্যান্টিনগুলোর চেহারাই যা একটু পরিচ্ছন্ন, অন্যত্র দোকানপাটের চেহারা দেখলে খাওয়ার ইচ্ছে চলে যায়।

আর আছে ছোট-বড় অজস্র ‘ওয়ার মেমোরিয়াল’। ’৬২-র সেই যুদ্ধের স্মৃতিকে স্থানীয় বাসিন্দা এবং টুরিস্টদের মনে দেগে দেওয়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। বৌদ্ধ মঠের আদলে তৈরি এই স্মৃতিস্তম্ভগুলোতে যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের নামের বাঁধানো তালিকা, শহিদ সৈনিকের আবক্ষ মূর্তি, যুদ্ধক্ষেত্রের মডেল, ম্যাপ, যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র থরে থরে সাজানো। সেই যুদ্ধে ভারতীয় সেনার বীরত্বের কাহিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে ধরার জন্য পয়েন্টার হাতে এক জন করে উর্দিধারী সব সময় মজুত, ‘গাইডের ভূমিকায়’। মাঝে মাঝেই আর্মির এক-এক জন খুব উঁচু পোস্টের লোক রক্ষী-পরিবৃত অবস্থায় এসে সামরিক আদবকায়দা সহ পুষ্পস্তবক দিয়ে যান সেই সব স্মৃতিস্তম্ভে। অর্থাত্‌ আর কিছু থাক বা না থাক, দেশপ্রেম প্রদর্শনে ঘাটতি নেই এতটুকু।

এমনই একটা জায়গা, দিরাং থেকে সে-লা পাস যাবার পথে নুরানাং-এর কাছে ‘যশবন্তগড়’। শুধু ‘ওয়ার মেমোরিয়াল’ নয়, আস্ত একটা যুদ্ধক্ষেত্রকেই সেখানে ’৬২ সাল থেকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে একই অবস্থায়। পাহাড়ের খাঁজে পাথরের তৈরি বাংকার, সেখানে সৈন্যদের ব্যবহৃত উর্দি-বিছানাপত্তর, খাবারের বাসনকোসন, লণ্ঠন, ওয়্যারলেস রেডিয়ো সেট সবই রাখা আছে।

তার এক পাশেই কাঁটাতার ঘেরা আন্দাজ কুড়ি ফুট বাই দশ ফুট একটা ঘাসে ঢাকা জমি। ছোট্ট একটা বোর্ডে লেখা ‘গ্রেভইয়ার্ড অব দ্য চাইনিজ সোলজার্স’। জানা গেল, ৩০০ চিনা সৈনিককে পুঁতে রাখা হয়েছে ওখানে। ‘পুঁঁতে রাখা’ শব্দটা ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম, কারণ ওইটুকু জায়গায় ৩০০ কেন, তিন জন মানুষকেও সসম্মানে শোয়ানো যায় না। অথচ দেখলাম, ওই জায়গাটার প্রতি টুরিস্টদের কী বিষম বিদ্বেষ ঝরে পড়ছে। এক জন জোর গলায় বললেন, ‘ব্যাটাদের কবর থেকে তুলে আবার গুলি করে মারতে ইচ্ছে করছে।’ আর এক জন অবাঙালি পর্যটক বেশ ভরসা জাগানো গলায় দু’একটি অপভাষা সহ যা বললেন, মর্মার্থ, ‘চিন্তা নেই, অচ্ছে দিন এসে গেছে, এ বার প্রতিবেশী বদমাশগুলোকে আচ্ছাসে রগড়ানি দেওয়া হবে।’

রাজ্যটাকে ডুবিয়ে দেব অভাবে দারিদ্রে অবহেলায়, আর বিদ্বেষ ও শত্রুতার টনিক খাইয়ে মানুষগুলোকে উসকে রাখার চেষ্টা চালাব এ স্ট্র্যাটেজি নতুন নয়। অরওয়েলের বিখ্যাত উপন্যাস ‘১৯৮৪’-তেও সরকার সারা ক্ষণ কাল্পনিক যুুদ্ধের বিবরণ প্রচার করত, যাতে জনগণ ‘আমি খেতে পাই না কেন’ প্রশ্নটাকে ভুলে ‘শত্রুকে বেশ আমার দেশ বেধড়ক ঠ্যাঙানি দেয়!’ ঘেন্নার চাষ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমার নিজের দেশ এই কাজ করছে দেখে, খুব ভাল লাগল না। চিনেরও কিন্তু আছে জনসংখ্যার ভয়াবহ চাপ এবং দীর্ঘ পরাধীনতার ইতিহাস। তা সত্ত্বেও তারা আমাদের তুলনায় আজ বহু ক্ষেত্রেই অনেকটাই এগিয়ে। বিশ্ববাজারে সে নিজের অর্থনৈতিক খুঁটিও অনেক বেশি মজবুত করে ফেলেছে। আর যাদের বেচার মতো কিছুই নেই, তাদের আজও দিন কাটছে ‘দেশপ্রেম’ বেচেই। ওই একটা জিনিসই তো আছে, যা দিয়ে অন্য সমস্ত ‘না-থাকা’কে দিব্যি ঢেকে দেওয়া যায়।

সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ, অরুণাচল প্রদেশের পশ্চিম প্রান্তের তাওয়াং থেকে পূর্ব-প্রান্তের বিজয়নগর পর্যন্ত ২০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এক সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। তবু এটা সু-রাজনীতির লক্ষণ। প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা হোক, তবে তা হোক উন্নয়নকে কেন্দ্র করেই। ‘হায়দার’ সিনেমায় একটা সংলাপ আছে, ‘ওপরে ঈশ্বর আর নীচে সেনাবাহিনী ছাড়া কাশ্মীরের মানুষের জন্য আর কিছুই নেই।’ কথাটা কি অবশিষ্ট ভারত বা তার পশ্চিম প্রান্তের প্রতিবেশী দেশটি সম্পর্কেও প্রযোজ্য নয়? গত ৬৭ বছর ধরে এই দুই দেশের নেতারা তো অনেক ‘বর্ডার বর্ডার খেলা’ খেললেন। এ বার একটু অন্য কথা ভাবুন!

nachhorbanda@gmail.com

অন্য বিষয়গুলি:

simanta guhathakurata patriot
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE