প্রতিবাদী: সিরিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে ভারত। তবু কি বন্ধ হয়েছে রক্তস্রোত?
হাসাকেহ প্রদেশটার রাজধানীর নামও হাসাকেহ। সিরিয়ার এই শহর ঘিরে ছোট ছোট অনুন্নত গ্রাম। তেমনই এক গ্রাম, নাসওয়েহ্। ইউফ্রেটিস-এর শীর্ণ শাখা, খাবুর তিরতির করে বয়ে চলেছে এক কোণ দিয়ে। অযত্নের ছাপ গ্রামের সর্বাঙ্গে। বেআইনি বসতি, বাড়ি তৈরির ভাঙাচোরা সরঞ্জাম, গমখেত ভর্তি আবর্জনা... তা হোক, এই গ্রামের আনাচে-কানাচেই তো ছড়িয়ে ছিল জ়াহরা-র ছোটবেলাটা।
ক্যাথারিন জোয়েফ-এর ‘এক্সেলেন্ট ডটারস’ বইয়ের সেই জ়াহরা আল আজ্জো-র পরিবার এক সময় ছিল রীতিমতো সচ্ছল। আরবি ঘোড়া পুষত তারা। কিন্তু পরের দিকে আর্থিক অবস্থা তলানিতে ঠেকে। জ়াহরার ভাইয়েরা সবজি, সিগারেট বেচে সংসার টানতে থাকে। মদ খাওয়া বেড়ে যায় জ়াহরার বাবার, শোনা যায় অন্য এক মহিলার সঙ্গে সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। বাবার জীবনের এই গোপন কথা জ়াহরা জানতে পেরেছিল বাবারই এক বন্ধু তাইসিরের কাছ থেকে। জ়াহরা-কে তাইসির ভয় দেখায়, তার বাবার গোপন সম্পর্কের কথা ফাঁস করে দেবে সে, গোষ্ঠীর সম্মান বাঁচাতে খুনও করবে দুজনকে, যদি জ়াহরা অন্তত এক দিনের জন্য তার সঙ্গে বেরিয়ে না আসে। ভয় পেয়েছিল জ়াহরা। বাবাকে বাঁচাতে তাইসিরের সঙ্গে বেরোয়। বেরনো মাত্র অপহরণ। তাইসির তাকে নিয়ে আসে দামাস্কাসে। সেখানে ধর্ষিত হয় জ়াহরা। তখন তার বয়স মোটে পনেরো।
ঘাসালত আল আর। সিরিয়ার মাটিতে কান পাতলে হামেশাই শোনা যায় এই শব্দগুলো। মানে, লজ্জাকে মুছে ফেলা। পরিবারের গা থেকে, পৃথিবী থেকেও। কোথাও যেন এতটুকু চিহ্ন পড়ে না থাকে। সিরিয়ার মতো দেশে ‘লজ্জা’র এই ধারণা সব সময়ই কোনও না কোনও মেয়ের নামের সঙ্গে আটকে থাকে। কখনও সেই মেয়ের চালচলন পরিবারের প্রতিটি পুরুষ সদস্যের গায়ে বিরাট কালো দাগ হয়ে ফুটে উঠলে, সেই দাগ ধুয়ে ফেলতে মেরে ফেলতেই হয় তাকে। যার পোশাকি নাম, ‘অনার কিলিং’, সম্মান রক্ষার্থে খুন। যার ছায়া দেখি ভারতেও— হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহারে। কিন্তু আরব দুনিয়ায়, বিশেষ করে সিরিয়ায়, সম্মান রক্ষার্থে খুন নিয়ে চা-দোকানে চর্চা হয় না, মোমবাতি মিছিল বেরোয় না, সংসদও উত্তাল হয় না। সেখানে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা, পরিবারে পুরুষদের পবিত্র কর্তব্য। তাই মেয়েটির খুনের পর সদম্ভে অপরাধের কথা স্বীকার করে খুনি, লজ্জা মোছার আনন্দে পার্টি দেয় পরিবার।
আর আইন? সিরিয়ার আইনে সম্মান রক্ষার্থে খুন ‘খুন’ নয়, হত্যাকারীও ‘খুনি’ নয়। অপরাধী যদি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে স্বীকার করে, সে পরিবারের সম্মান বাঁচাতে মেয়েটিকে মেরেছে, বেকসুর রেহাই। কর্তৃপক্ষ শুধু দামাস্কাসের বাব মুসালা-র মতো কিছু মেয়েদের কারাগার বানিয়েই ক্ষান্ত থাকে। জ়াহরার মতো কুমারীত্ব হারানো মেয়েরা আঠেরো অবধি সেখানে নিরাপদ। কোরান প়়ড়ে, সেলাই শেখে। এ যেন জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে কিছুটা সময় কিনে নেওয়া। কারণ, আঠেরো পেরোলেই শেষ হবে বন্দিজীবন, শুরু হবে বেঁচে থাকার অসম লড়াই। কোনও কোনও পরিবার ঠিক খুঁজে বার করে তাদের মেয়েটিকে। তাকে খুন করে ‘শুদ্ধ’ করে নিজেদের। পরে বেমালুম ভুলে যায় তার নামটাই। এই মর্মান্তিক বাস্তবকে কিছুতেই বুঝতে চায় না বন্দি মেয়েগুলো। যাদের কোলে এই সে দিনও উঠেছে, তাদেরই হাতে অস্ত্র উঠে আসে কী করে? তাই কারাগার থেকে পালাতে চায় তারা। ফিরতে চায় সেই পরিবারেরই আশ্রয়ে, তারই অজান্তে যেখানে হয়তো তৈরি হচ্ছে খুনের নীল নকশা।
সে যাত্রায় জ়াহরা-কে বাঁচিয়েছিলেন তার মাসি। বাব মুসালায় বন্দি মেয়েটাকে প্রথম দর্শনেই ভাল লেগে গিয়েছিল উম ফাওয়াজের। কিশোরী মেয়েটা কিনা জেলে বন্দিজীবন কাটাচ্ছে! বুক মুচড়ে উঠেছিল তাঁর। সম্পর্কে মেয়েটা তো তাঁরই বোনঝি। কিন্তু দূর শহরে থাকা জ়াহরার পরিবারের সঙ্গে বহু দিন যোগাযোগ নেই তাঁর। জ়াহরার পরিবার হঠাৎই এক দিন উম ফাওয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানায় জ়াহরার অপহরণের কথা। জানায়, পুলিশ তাকে উদ্ধার করে মেয়েদের কারাগারে আটকে রেখেছে। তাই তাদের অনুরোধ, উম ফাওয়াজের ছেলে ফাওয়াজ জ়াহরাকে বিয়ে করে তাদের পরিবারকে এই অসম্মানের হাত থেকে বাঁচাক, জ়াহরাকে বার করে আনুক জেল থেকে।
বিষম অনুরোধ! সিরিয়ার মতো দেশে একটি অপহৃত এবং জেল-খাটা মেয়েকে নিজের স্ত্রী’র মর্যাদা দেওয়া! কিন্তু উম ফাওয়াজের পরিবার গোঁড়া ছিল না। তাঁদের বিশ্বাস, জ়াহরার কাণ্ডটা যে কোনও পরিবারের পক্ষেই অমর্যাদাকর ঠিকই, কিন্তু মেয়েটি নিজে তো কোনও অন্যায় করেনি। জ়াহরার সঙ্গে ফাওয়াজের বিয়ে দেন তাঁরা। জ়াহরার পরিবারের সম্মান বাঁচাতে নয়, মেয়েটির প্রাণ বাঁচাতে। কারণ, জ়াহরার বাবা-দাদার হাবেভাবে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল, তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য মেয়েটাকে মেরে পরিবারের কলঙ্ক ধুয়ে ফেলা।
বিয়ে হল জ়াহরার। নতুন তোশক-বালিশ-কম্বল, প্রচুর উপহার আর এক লক্ষ সিরীয় লিরা বরপণ-সমেত নতুন জীবন। আর পেল জীবনসঙ্গী, যার কাছে পবিত্রতম কর্তব্য— জ়াহরাকে তার আগের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া। সে কখনও তার কাদামাখা অতীত ঘেঁটে দেখতে যায়নি। বরং সুন্দর এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল তাকে।
জ়াহরা কিন্তু বাঁচেনি। তার গল্পে ভরা দিন আর স্বপ্নে ভরা রাতগুলো থমকে গিয়েছিল ২১ জানুয়ারি ২০০৭-এর সকালে। ঘুমন্ত জ়াহরার মাথায় পাঁচ বার কোদাল চালিয়েছিল তার দাদা। পরে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ওই দিন জ়াহরার বাড়িতে পার্টিও হয়েছিল। নেমন্তন্ন পেয়েছিল গোটা গ্রাম।
কিন্তু আর পাঁচ জন খুন হয়ে যাওয়া সিরীয় মেয়ের মতো জ়াহরা আল আজ্জো মুছে যায়নি। তার নিজের গ্রামের কেউ তার পরিচয় স্বীকার করেনি। কিন্তু দামাস্কাসের প্রতি সচেতন নাগরিকই তার জীবনের খুঁটিনাটি মনে রেখেছিল বহু বছর পরেও। আশ্চর্য! ওই সময় সিরিয়ায় প্রতি বছর সম্মান রক্ষার নামে খুন হত তিনশো থেকে চারশো মেয়ে। তাদের অনেকেই জ়াহরার মতোই সদ্য কৈশোরে পা রাখা এবং নিষ্পাপ। এই খুনগুলো নিয়ে সমাজের অন্দরে ফিসফিসানি হত ঠিকই, কিন্তু আলোড়ন কখনও না।
জ়াহরার মৃত্যুতে কিন্তু সেই চিরচেনা ছবি দেখা গেল না। সাধারণ মানুষ তো বটেই, ঐতিহ্য আঁক়ড়ে বসে থাকা গোঁড়ারাও জোরদার এক ধাক্কা খেলেন। হয়তো জ়াহরার বয়স, তার ‘দোষ না থাকা’ ভাবমূর্তি, অথবা বিয়ের পরও তার মর্মান্তিক পরিণতিই ছিল আসল কারণ। কিন্তু কারণ যা-ই হোক, পরের কয়েক মাস এই একটি ঘটনাই বিতর্কের চুড়োয় বসে রইল। সে বিতর্ক এমনই জোরদার যে, আইনি বিশেষজ্ঞ, ইসলামীয় পণ্ডিত, এমনকী সিরিয়ার পার্লামেন্টও প্রচলিত আইন পালটানোর পক্ষে সায় দেয়। প্রথা ভেঙে তোলপাড় চলে মিডিয়ায়। তবে, সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপটি করেছিলেন জ়াহরার স্বামী। তাঁর গোষ্ঠী এবং ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে গিয়ে জ়াহরার দাদার বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করেন তিনি।
গৃহযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সিরিয়ায় জ়াহরা ছিল এক ঝড়ের নাম। যে ঝড় অনেক কিছু পালটে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। সিরিয়ায় তখন ‘এনজিও’ শব্দটাই অপরিচিত। যে ক’টি ছিল, কড়া নজরদারি আর হেনস্থার মধ্যে থাকত হত তাদের। অথচ জ়াহরার মৃত্যুর পর কয়েক জন সমমনস্ক নারীপুরুষ তৈরি করেন এক সংগঠন। মেয়েদের অধিকারগুলো নিয়ে তাঁরা আইনি লড়াইয়ের জন্য নীরবে প্রস্তুত হতে থাকেন এমন এক দেশে, যেখানে বাক্স্বাধীনতার কোনও নামগন্ধ নেই। জ়াহরা তাই এক লড়াইয়েরও নাম। সরকারি সম্মতিতে অনার কিলিং-এর মতো জঘন্য প্রথার অবসানের লড়াই, এবং বৃহত্তর অর্থে ‘সম্মান’-এর সংজ্ঞাটার দিকে আরও এক বার ফিরে তাকানোর লড়াই। জেহাদিদের হাতে চলে যাওয়ার আগের দিনগুলোয় সেই স্বপ্নই ডানা মেলেছিল সিরিয়ার আরও অসংখ্য জ়াহরার মনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy