Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
পাত্রী ইন্দিরা নেহরু, পাত্র ফিরোজ় গান্ধী। হিন্দু মেয়ের সঙ্গে পার্সি যুবকের পরিণয় নিয়ে উত্তাল দেশ। বিবাহ সমর্থন করলেন গান্ধীজি। ঠিক আট দশক আগের সেই দিনটিও ছিল আজকের মতো রামনবমী।
Indira Gandhi

বাবার কাটা সুতোয় তৈরি শাড়ি পরে বিয়ে

১৯৪২ সালের ৬ মার্চ ঘোষণা হল ইন্দিরা-ফিরোজ়ের বিয়ে হবে আনন্দভবনে।

বরবধূ: বিয়ের দিন ফিরোজ় গান্ধীর সঙ্গে ইন্দিরা নেহরু

বরবধূ: বিয়ের দিন ফিরোজ় গান্ধীর সঙ্গে ইন্দিরা নেহরু

সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২২ ০৯:০৭
Share: Save:

১৯৪২ সালের ৬ মার্চ ঘোষণা হল ইন্দিরা-ফিরোজ়ের বিয়ে হবে আনন্দভবনে। তারিখটি ২৬ মার্চ। রামনবমীর দিন। এর দু’সপ্তাহ আগে ‘দ্য লিডার’ কাগজে ইন্দিরা নেহরুর এনগেজমেন্ট-এর খবর বেরিয়েছিল প্রথম পাতায়। হিন্দু ব্রাহ্মণ কন্যার সঙ্গে পার্সি যুবকের বিয়ে। ফলে এই বিয়ের বিরোধিতা করে, রীতিমতো শাসিয়েও তখন বেশ কিছু চিঠি এসে পৌঁছয় গান্ধীজি এবং জওহরলাল নেহরুর কাছে।

ওই পরিস্থিতিতে নেহরু অনুভব করেন, এই বিষয়ে প্রেস বিবৃতি দেওয়া প্রয়োজন। তিনি বিবৃতি দিয়ে বলেন, “আমার কন্যা ইন্দিরার সঙ্গে ফিরোজ গান্ধীর এনগেজমেন্ট-এর কথা একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এই ব্যাপারে আমার কাছে বহু লোক জানতে চাওয়ায়, ওই রিপোর্টটি ঠিক বলেই জানাচ্ছি। বিয়েটা ব্যক্তিগত এবং ঘরোয়া ব্যাপার, যা মূলত দু’জনের এবং আংশিক ভাবে তাদের পরিবারের চিন্তার বিষয়। তবুও জনগণের সঙ্গে আমার যোগাযোগের কথা ভেবে আমার উচিত বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী এবং সাধারণ ভাবে আমার উপর যাঁরা আস্থা রাখেন সেই জনগণকেও এটা জানানো।” একই সঙ্গে নেহরু বলেছিলেন, “মহাত্মা গান্ধী, যাঁর মতকে জনগণের ব্যাপারেই শুধুমাত্র নয়, আমার নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারেও গুরুত্ব দিই, তিনি এই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছেন। আমার পরিবারের সদস্য এবং আমার স্ত্রীর পরিবারের সদস্যরাও সম্মতি দিয়েছেন।” গান্ধীজি নেহরুকে জানিয়েছিলেন, সেবাগ্রামে এই বিয়ের আয়োজন করা যেতে পারে, তা হলে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করবেন। তবে পরিবারের সদস্যরা চাওয়ায় শেষে এলাহাবাদের বাড়ি থেকেই বিয়ে ঠিক হয়।

এই ঘটনার বছরখানেক আগে ইন্দিরা এক দিন কারাবন্দি নেহরুর সঙ্গে দেখা করে ফিরোজ়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথা বলেছিলেন। মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে খুব খুশি হননি নেহরু। পরিচিত হলেও জামাই হিসেবে মেনে নিতে পারছিলেন না ফিরোজ়কে, অথচ একমাত্র মেয়েকে কষ্টও দিতে চাননি। পরে মেয়েকে চিঠিতে লিখলেন, “যদি তুমি ফিরোজ়কে বিয়ে করতে চাও, করো। কেউ তোমাকে বাধা দেবে না।” যদিও তিনি মেয়েকে বাস্তব সম্পর্কে সতর্ক করতে চেয়েছিলেন। বোঝাতে চাইলেন, সে যে নতুন জীবনে যেতে চাইছে তা কেমন তা সে জানে না। পণ্ডিতজি ফিরোজ়ের পরিবারের অন্য কাউকে চেনেন না বলেও জানিয়েছিলেন তাঁর মেয়েকে। তা ছাড়া ইন্দিরার স্বাস্থ্যের কথা ভেবে তিনি সতর্ক করেছিলেন, ডাক্তারের মত অনুসারে, এ রকম স্বাস্থ্যের অবস্থায় সন্তানধারণ ঠিক নয়।

এ ব্যাপারে জওহরলাল ইন্দিরাকে গান্ধীজির পরামর্শও নিতে বলেছিলেন। গান্ধীজির আস্থা অর্জন করার প্রশ্নে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন ইন্দিরা। গান্ধীজিও বুঝেছিলেন, এই মেয়ে বিয়ের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর, তাই তিনিও মত দেন। এর কিছু দিন বাদে জেল থেকে প্যারোলে ছাড়া পান নেহরু। তার ঠিক পরেই এক দিন বারাণসীতে উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেস কমিটির বৈঠক সেরে রাতের ট্রেনে এলাহাবাদ ফিরছিলেন ইন্দিরা, ফিরোজ় এবং জওহরলাল। তারা তিন জন একই কম্পার্টমেন্টে বেশ কিছু ক্ষণ ছিলেন। সেই ট্রেন যাত্রাপথেই ফিরোজ়-ইন্দিরার বিয়ের ব্যাপারে নেহরুর কাছ থেকে সম্মতি মিলেছিল।

এই বিয়ের বিরোধিতা করা চিঠিগুলির জবাব মহাত্মা গান্ধীও দিয়েছিলেন ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ‘হরিজন’ পত্রিকার মাধ্যমে। গান্ধীজি লিখেছিলেন, “আমি বেশ কিছু খারাপ ভাষায় লেখা চিঠি পেয়েছি এবং তাতে খোলাখুলি ভাবেই ফিরোজ়ের সঙ্গে ইন্দিরার এনগেজমেন্ট-এর কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু একটা চিঠিতেও ফিরোজ় গান্ধীকে খারাপ লোক বলা হয়নি। তার শুধুমাত্র অপরাধ সে পার্সি। আমি এখনও আগের মতোই বিয়ের কারণে কারও ধর্ম পরিবর্তনের চরম বিরোধী। ধর্ম পোশাকের মতো ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করা যায় না। এই ক্ষেত্রে কোনও রকম ধর্ম পরিবর্তনের প্রশ্নই উঠছে না। ফিরোজ় গান্ধী দীর্ঘ দিন ধরে নেহরু পরিবারের ঘনিষ্ঠ। সে অসুস্থ কমলা নেহরুর সেবা-শুশ্রূষা করেছে। সে তাঁর সন্তানের মতো।”

ফিরোজ় এবং ইন্দিরার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে গান্ধীজি জানিয়েছিলেন, বন্ধুত্বকে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েই তাঁদের মধ্যে স্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। কোনও পক্ষই জওহরলাল নেহরুর আশীর্বাদ এবং সম্মতি ছাড়া বিয়ে করার কথা ভাবেননি। তিনি সম্মতি দিয়েছেন, যখন বুঝেছেন এঁদের আকর্ষণের একটা শক্ত ভিত রয়েছে। জনগণ জানে তাঁর সঙ্গে নেহরুর সম্পর্ক। তিনি দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাপুর মনে হয়েছিল, ওঁদের এনগেজমেন্ট-এ সম্মতি না দেওয়াটা নিষ্ঠুরতা। সময় যত এগোবে এমন বন্ধনে সমাজের মঙ্গল হবে বহুগুণ। এই মুহূর্তে দেশবাসী সেই পারস্পরিক সহনশীলতার স্তরে পৌঁছতে পারেননি। কিন্তু পারস্পরিক ধর্মীয় শ্রদ্ধার মাধ্যমে সেই সহনশীলতা যদি বৃদ্ধি পায়, তা হলে এমন বন্ধনকে স্বাগত জানাতে হবে।

ইন্দিরা-ফিরোজ়ের পরিণয়‌ এ দেশের বিয়ের ক্ষেত্রে একটা নবযূগের সূচনা। এই বিয়ের পরেও ধর্মের দিক থেকে তাঁরা দুজনেই আগের মতোই রইলেন। যা বিরল যুগান্তকারী ঘটনা এবং পরবর্তী কালে এই বিয়ে আইন সংস্কারের‌ ক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে ওঠে। গান্ধীজির সঙ্গে নেহরু আলোচনা করেছিলেন বিয়ের আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। কারণ নেহরু বুঝেছিলেন, গান্ধীজির অনুগামী লক্ষ্মীধর শাস্ত্রী, যিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক ছিলেন, বিয়ের দিনটিকে জাতীয়তাবাদী অনুষ্ঠান হিসেবে তুলে ধরতে একেবারে আলো-বাজির রোশনাই করে উৎসবের আকার দিতে চাইছেন। নেহরু বা গান্ধীজি কারও উৎসাহ ছিল না জাঁকজমকে। তাঁরা লক্ষ্মীধরকে নিবৃত্ত করেন৷

এই বিয়েতে অভিনবত্ব ছিল। ইন্দিরার হাতে একটি তরবারি তুলে দিয়ে শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। শপথে পাঠে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, “বিশ্বের কোনও দিক থেকে যদি কেউ চলে আসে আমাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করতে, আমি তরবারি হাতে তাদের শেষ পর্যন্ত বাধা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। আমি প্রার্থনা করি এই স্বাধীনতার আলো ছড়িয়ে পড়ুক, যা সব দিক থেকে আমাদের আলোকিত করবে।” হিন্দু অথবা পার্সি কোনও পক্ষেরই গোঁড়া কোনও আচার-অনুষ্ঠান সেখানে স্থান পায়নি। উভয় সম্প্রদায়ই অগ্নিকে মান্য করে, তাই বিবাহ অনুষ্ঠান হয়েছিল অগ্নিকে সাক্ষী রেখে। বিয়ের অনুষ্ঠান ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছিল।

বিয়ের দিন ওই বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছাড়াই বেশ কয়েকশো মানুষ ঢুকে পড়েন। ভাল করে বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে বাড়ির সংলগ্ন গাছেও উঠে পড়েছিলেন অনেকে। ফিরোজ় গান্ধী বরের বেশে সেখানে প্রবেশ করলে নিমন্ত্রিত মানুষজন রীতিমতো করতালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানায়। বিয়ের জন্য নির্দিষ্ট মঞ্চের উপর অগ্নিকুণ্ড, তার পাশেই বসেছিলেন ফিরোজ়। জওহরলাল কন্যা ইন্দিরাকে নিয়ে সেখানে আসেন। সেখানে একটি গদি দেওয়া শূন্য আসন সংরক্ষিত রাখা ছিল কমলা নেহরুর জন্য। ইন্দিরার পরনে ছিল গোলাপি রঙের খাদির শাড়ি, যেটা তৈরি হয়েছিল তাঁর বাবা জওহরলালের চরকায় কাটা সুতো থেকে। শাড়ির পাড়ে রুপোর সুতোয় এমব্রয়ডারি করা হয়েছিল। তিনি বাবার পাশে বসেছিলেন যত ক্ষণ না কন্যাদান হয়। ফিরোজ়ের পরনে ছিল খাদি শেরওয়ানি, হাঁটু পর্যন্ত দীর্ঘ‌ কোট এবং চুড়িদার বা টাইট ফিটিং পাজামা।

লক্ষ্মীধর শাস্ত্রীর নেতৃত্বে দু’জন পুরোহিত মিলে আচার-অনুষ্ঠানের কাজ সেরেছিলেন। পার্সি সমাজের বেশ কিছু লোক ওই দিন বিয়ের অনুষ্ঠান দেখছিলেন, যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ওই বিয়ের বিরোধিতা করে আগে আনন্দ ভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত শান্তিতেই বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান মিটেছিল। অপ্রীতিকর চিঠির বদলে আনন্দ ভবনে তার পর পোস্টম্যান নিয়ে আসে বেশ কিছু উপহার। আনন্দ ভবনের বাইরে থাকা লোকগুলি এই অনুষ্ঠানে শত্রুতার বদলে শেষে আন্তরিকতা দেখান।

তবে বিয়ের দিন মহাত্মা গান্ধী গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক এক্সপ্রেস করে দিল্লি রওনা হয়েছিলেন স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের সঙ্গে দেখা করতে। ফলে গান্ধীজির এই বিয়েতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও তিনি বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। তবে মহাত্মা গান্ধী উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন খাদির জিনিস। এই বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই বাপু ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে ডাক দিলেন। সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেনি নবদম্পতি। এর জেরেই কারাবাস করতে হয়েছিল নবদম্পতিকে। দেশের জন্য হাসিমুখে সব মেনে নিয়েছিলেন তাঁরা।

তথ্যঋণ: ১. ফিরোজ় দ্য ফরগট্ন গান্ধী— বার্তিল ফক; ২. দ্য সঞ্জয় স্টোরি— বিনোদ মেহতা; ৩. ফিরোজ় গান্ধী: আ ক্রুসেডার ইন পার্লামেন্ট— তরুণকুমার মুখোপাধ্যায়

অন্য বিষয়গুলি:

Indira Gandhi Rajeev Gandhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy