ফাইল চিত্র।
নীল আকাশটা একটু ফ্যাকাশে রং নিয়েছে। পশ্চিমের আকাশে মাথাভাঙা মেঘগুলোর শরীরে ফাটা দাগ। এই মেঘের নাম ‘কাস্তেদাগা’ মেঘ। সাদা ফ্যাকাশে মেঘের রংটা একটু ‘চিমনে ধুলোট’ হলেই বৃষ্টি ঝরে মেঘের শরীর থেকে। কাঠের জাল দেওয়া ধোঁয়ার সঙ্গে একটু ধুলো মেশালে যে রং আসে, সেটাই ঐ বৃষ্টি ঝরা মেঘের রং।
এমন মেঘ দেখলেই তিন মাথা বা তেমাথা-রা বলতেন ভাদুই ধান কেটে ঘরে তুলতে। বৃদ্ধ মানুষদের বসে থাকার সময় পিঠ বেঁকে মাথাটা পৌঁছে যেত দুটো হাঁটুর কাছে। মনে হত তিনটে মাথা এক সঙ্গে। প্রকৃতির পাঠশালায় পাঠ নেওয়া অভিজ্ঞ মানুষটিকে গ্রাম বাংলার মানুষেরা বলত তেমাথা। এই মেঘ যে দিন আকাশে দেখা যায়, তার ঠিক দিন কুড়ির মধ্যে বর্ষা আসে। কালো মেঘের জল ঠোঁট দিয়ে ছোঁয় মাটির বুক। তার পর সেই জল গোল্লাছুটের মতো গড়াতে গড়াতে নামে নদীতে। সেই জলের নাম তখন ‘গড়ান জল’। ওই জলের স্পর্শে প্রাণ জাগে নদীর। কানায় কানায় ভরে সে। তার পর বন্যা আসে। জন্মাষ্টমীর পর গঙ্গার বুকে আস্তে আস্তে চর জেগে উঠত। দেখা যেত দুধের সরের মতো নতুন পলি চরের ওপর বিছিয়ে দিয়ে গেছে বন্যার জল।
২২ ভাদ্র থেকে শুরু হত কলাই বোনা। শেষ হত ৮ আশ্বিন। তিন কেজি কলাই ছড়ালে এক কুইন্টাল কলাই হত। প্রতি বিঘেয়। কলাইয়ের পর তারা বুনত তরমুজ, পটল। গঙ্গার পেটের মধ্যে তৈরি হওয়া এক চর ভূতনি দিয়ারা। আজ থেকে চোদ্দো বছর আগে চরের মাটির ওপর খেজুর পাতার পাটিতে বসে এই সব কথা শুনিয়েছিলেন রোহিণী সরকার। তখন তাঁর বয়স ছিল চুরাশি। কিন্তু শরীরে তেজ ছিল। কথার ধার ছিল।
মৌসুমি জলবায়ু এই দেশটার প্রতি উদার। বৃষ্টি নামাতে তার অকৃপণ ভালবাসা এই ধরাতলে বড় বিরল। কখন বৃষ্টি নামবে, বা কেমন ভাবে নামবে— এই দেশের মানুষ তা জানত। অসমের সেউজিয়াপাথার, ছাওয়ারিয়া, চাকলাদোলোনি, বরদোলইপা গ্রামের নিত্যসঙ্গী বন্যা। পাড়া-গাঁয়ের পড়শির মতো তার আসা আর যাওয়া। ব্রহ্মপুত্র কারও কথা শোনে না। বড় তেজি নদ। হঠাৎ করে বন্যা আনা তার খামখেয়ালি স্বভাব। গ্রামের মানুষেরা তা জানে। তাই তারা রাগ করে না। জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময় গ্রামবাসীরা নজর রাখে আশপাশে। কালো পেটকি পিঁপড়ে, মুখে ডিম নিয়ে রেলগাড়ির মতো ছোটে উঁচু কোনও জায়গায়। তার মানে বন্যা হবে। এই ঘটনা দেখা গেলেই বৃষ্টি নামে। পনেরো থেকে সতেরো দিনের মধ্যে। সেই বৃষ্টিতে ‘লাহেলাহে বানপানি’ আসে। নদীর জল ধীরে ধীরে বাড়ে। বন্যা আনে।
মেলং পাখি খুব বেশি ডাকে। ঘুঘু পাখির ডাকে থাকে কান্নার আওয়াজ। যদি চাতক পাখি আর ব্যাং একই সঙ্গে ডাকে, তা হলে নাকি হঠাৎ করে বন্যা আসে। স্থানীয় মানুষেরা বলতেন ‘উথপথপ বানপানি’। বন্যার জল থেকে মাছপুকুরগুলোকে বাঁচাতে তার পাড় উঁচু করে বাঁধিয়ে রাখা হত। আর মাটি ধুয়ে যেন পুকুর না বুজে যায়, তার জন্য পুকুরের চারপাশ দিয়ে লাগানো হত মাটিকে কামড় দিয়ে ধরে রাখে এমন সব গাছ।
বন্যার সময় খাবার জন্যও তাদের ভাবতে হয় না। তাদের ঘরে মজুত থাকত কোমল চাল। আধঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রাখলেই চাল থেকে ভাত হয়ে যেত। কোনও জ্বালানির দরকার হত না। বন্যার পরে চলত তাদের মাছ ধরার পরব।
বন্যাকে ভালবেসে বাঁচার যে যাপনকথা, তা পাওয়া যায় বিহারের মানুষের মধ্যেও। বিহারের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই ‘সোনবর্ষা’ নামে গ্রাম পাওয়া যায়। বর্ষার প্রতিটি বিন্দুকে তারা সোনার সঙ্গে তুলনা করে। বৃষ্টির জলের বিন্দুতে লুকিয়ে থাকে সৃষ্টি। গাছের-মাটির-জীবনের প্রাণের স্পন্দন। ‘বর্ষা আগতছে’ ব্রত পালন করা হয়। এই ব্রত প্রথম দিনের বৃষ্টি ধরা আর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার ব্রত। প্রথম দিনের বৃষ্টির জলকে, মাটিতে পড়তে দেওয়ার আগে একটা পাত্রের মধ্যে ধরা হয়। আর বৃষ্টির ফোঁটা যখন প্রথম মাটি স্পর্শ করে, তখন গ্রামের প্রবীণ মানুষ, মেঘের দেওয়া জলের ফোঁটার শরীরের বৈশিষ্ট্য বোঝার চেষ্টা করে। জলের ফোঁটাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমটি ‘বড়ি’ বা বড়, দ্বিতীয়টি ‘মঝলে’ বা মাঝারি, আর তৃতীয়টি ‘ছোটি’ বা ছোট।
প্রথম দিনের বৃষ্টির রাতটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে দিন যদি শুক্লপক্ষের রাতে চাঁদকে ঘিরে ‘চন্দ্রসভা’ বসে, তা হলে সে বছর ভাল বৃষ্টি হবে। রামধনুর মতো সাত রঙের বলয় যখন চাঁদকে ঘিরে তৈরি হয়, তার নাম তখন ‘চন্দ্রসভা’। চাঁদের কাছে সভা বসলে জোর কদমের বর্ষা আসে দেরিতে। আর দূরে বসলে ভারী বর্ষা আসে তিন সপ্তাহের মধ্যে। তবে যদি শনি কিংবা মঙ্গলবারে প্রথম বৃষ্টির ছোট ফোঁটা পড়ে, আর কৃষ্ণপক্ষের রাত হয়, তবে বন্যা আসবে। এক মাস সাত থেকে দশ দিনের মাথায়।
এমন হলে, তারা মাঠের ফসল কেটে রাখত। খাবার সঞ্চয় করে রাখত। পুকুরগুলো পরিষ্কার করে রাখত। যাতে বন্যার জল সেখানে এসে বিশ্রাম নিতে পারে। প্রতিটা পুকুর গভীর করে কাটা থাকত। আর পুকুরের মাঝে থাকত একটা গভীর কুয়ো। যা দিয়ে বন্যার জল পৃথিবীর পেটে ঢুকত।
দক্ষিণ বিহারের মানুষ বন্যা নিয়ে বাঁচার ধারণা ও পদ্ধতি জানতেন বংশপরম্পরাগত ভাবে। যেমন ‘দোসদ’ বা ‘দুসাদ’ জনজাতির মানুষরা। প্রথমে একটা ‘নহর’ বা নালা বেছে নেওয়া হত। তার বুকের ওপর পাথর ও মাটি দিয়ে তৈরি করা হত আড়াআড়ি বাঁধ, সামান্য উঁচু করে। তার পর স্তরে স্তরে মাটি কেটে তৈরি করা হত কড়াইয়ের মতো একটা ‘তালাও’ বা পুকুর। একেই বলা হত ‘আহার’। একটা ছোট্ট খাল কেটে বাঁধের উজান থেকে জল আনা হত আহারে। আর আহার থেকে বড় ছোট অনেক খাল যেত গ্রামে গ্রামে। জল পৌঁছে দিতে। খালগুলোকে বলা হত ‘পায়েন’। নানা নাম দিয়ে চিহ্নিত করা হত পায়েনগুলোকে। যেমন গাঁও পায়েন, বড়কী পায়েন ইত্যাদি।
তার পর বন্যা আসত। কানায় কানায় ভরে উঠত আহার। বন্যার জল পলিও বয়ে আনত। তাই সেই পলিতে আহারের বুক ভরে যেত, জল বুকে আগল দেওয়ার ক্ষমতা কমত। সেচের কাজে এই জল ব্যবহার হত। আহারে যখন একেবারে জল শুকিয়ে যেত, তখন আহারের পেটটা ব্যবহার হত চাষের কাজে। উর্বর পলিমাটির নরম শরীরে বোনা হত ছোলা। আর ছোলা ওঠার পর শুরু হত আহার সংস্কারের কাজ। আহারের জল যে সমস্ত গ্রামের মানুষরা ব্যবহার করে, তারা এক সঙ্গে দল বেঁধে শুরু করত কাজ। মাটি কাটার। তখন তাদের অন্য নাম। তারা নিজেদের পরিচয় দিত ‘গোমাম’ নামে। জাতকের গল্পেও আহারের উল্লেখ আছে। বোঝা যায়, এই পদ্ধতির ইতিহাস বহু প্রাচীন।
ধীরে ধীরে আহারের শরীর সুন্দর চেহারা নিত। আহারের বুক থেকে মাটি তুলে মাটি ফেলা হত আশপাশের নিচু জমিতে। আর তাতে প্লাবনভূমি উর্বর হত, আরও উঁচু হত। এ ভাবেই তৈরি হয়ে উঠত
আহার, আগামী বছরের বন্যার আবাহনের জন্য।
নেপালের কাঠমান্ডু উপত্যকা। পাহাড় থেকে জন্ম নিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসে বিহারের ভেতর। তার পর মুজফ্ফরপুরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা এই নদীটার নাম বাগমতী। এখানকার মানুষেরা আজ যে ভাবে নদীকে দেখে ভয় পাচ্ছে, আগে তা পেত না। বন্যা আসা তাদের কাছে ছিল উৎসব, যাকে বলা হয় ‘শুনবাগী তেহার’। এই উৎসবটিতে বাগমতী পাড়ের এক গ্রামের প্রবীণ মানুষেরা অন্য গ্রামে গিয়ে উৎসব পালন করত। এক গ্রামের মানুষ অন্য গ্রামের ভাল চাইত। নদীর কাছে গিয়ে নদীর কানে কানে তারা দাবি করত বন্যা আনার। বাগমতীতে বন্যা হলে নেপাল হিমালয় থেকে সে বয়ে আনে খাঁটি উর্বর পলি, যেখানে কোনও সার ও কীটনাশক ছাড়াই ফসল ফলত।
বাগমতীর একেবারে পাড়ে একটা বড় ও লম্বা বাঁশ পোতা হত। যাকে ‘খুঁটা’ বলা হত। খুঁটার মাথায় বাঁধা থাকত ‘নিশান’। অনেকটা পতাকার মতো। নিশানের দিকে তাকিয়ে গ্রামের মানুষেরা বুঝত বাতাসের গতি। খুঁটার দিকে তাকিয়ে বসে থাকত গ্রামের এক বা দুজন প্রবীণ মানুষ। যারা চোখের আন্দাজে খুঁটা দেখে নদীর জল মাপত। জল বাড়তে শুরু করলে প্রবীণ মানুষেরা জানাত ‘বানসিপাহি’-দের। এরা ছিল এক দল যুবক, যারা বন্যার সময় গ্রামের মানুষদের দেখাশোনা করত। নদীতে জল বাড়ার খবর শুনলেই বানসিপাহিরা একযোগে ‘হল্লা’ করত। এই হল্লা ছিল গ্রামবাসীদের প্রতি জল বাড়ার সতর্কবার্তা।
মানুষের সঙ্গে নদীর ভালবাসায় ছেদ পড়ল, যখন থেকে মানুষ নদীকে শাসন করতে চাইল। বন্যার সঙ্গে সহ-বাস করতে চাইল না। বন্যা আটকাতে পাড়ে বাঁধ দিল। আর তাতেই নদীবক্ষে পলি জমল। প্লাবনভূমি থেকে নদীর খাত উঠে গেল অনেক উঁচুতে। উইলিয়াম উইলকক্স সাহেব পাড় বাঁধগুলোকে বলেছিলেন ‘শয়তানের শৃঙ্খল’। আর বাঙালি প্রকৌশলী সতীশচন্দ্র মজুমদার বললেন, নদীর পাশে বাঁধগুলো তৈরি করে আসলে যা হল, তা ‘আগামী প্রজন্মকে বন্ধক রেখে এই প্রজন্মের স্বার্থ রক্ষা করা।’
এর পর হঠাৎ, আঁজলা বাতাস এল। এক টুকরো কালো গুমোট মেঘ সেই বাতাসের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দাঁড়িয়ে গেল বেহালার চৌরাস্তার মাথার ওপর। ও পাশের কামিন বস্তি থেকে বেরিয়ে এল এক মাঝবয়সি মানুষ। আকাশের দিকে চাইল। তার পর মেঘদূতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আহাম্মক!’ আসলে পথের ধারে ঘরবাঁধা ওই মানুষটার ঘরে, বর্ষা মানে এক হাঁটু নোংরা জল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy