ছবি: রৌদ্র মিত্র।
পণ্ডিতপ্রবর সার্বভৌম ভট্টাচার্যকে নীলাচলের মানুষ এক ডাকে চেনে। তাঁর মতো পণ্ডিত শাস্ত্রজ্ঞ মানুষকে শ্রদ্ধা করে সকলে। মহারাজেরও বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র তিনি।
নিজ বাটীর দাওয়ায় বসে, মৃৎ-প্রদীপের আলোয় একখানি শাস্ত্র-পুস্তকের পাতায় তিনি মগ্ন হয়ে ছিলেন। নৃসিংহ এসে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালে তিনি মাথা তুলে তাকালেন। প্রথমটায় যেন আধো অন্ধকারে ভাল ঠাহর করতে পারেননি, পরে সম্যক উপলব্ধি করলে তাঁর মুখমণ্ডল মৃদু হাসিতে ভরে উঠল। স্মিত মুখে বললেন, “তা বণিকপুত্র, এই ভর-সন্ধ্যাবেলায়? কী মনে করে?”
কথাটা শেষ করে তাঁর মুখের হাসি আরও চওড়া হল। তাঁর নিজের কথার ভিতরে যে মৃদু রসিকতা ছিল, তাতেই তিনি যেন মজা পেলেন।
আসলে নৃসিংহের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন যোদ্ধা। রাজকর্মচারী হিসেবে তাঁরা বংশপরম্পরায় রাজ্যের সেবা করে এসেছেন। কিন্তু নৃসিংহের পিতা অস্ত্র ছেড়ে জাহাজ নিয়ে পাড়ি দিলেন সমুদ্রে। বাণিজ্য করে অর্জন করলেন প্রভূত অর্থ। নৃসিংহও পিতার পথ অনুসরণ করলেন। কিন্তু রাজ-পরিবারের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল না। বরং বণিকরূপে তাঁদের মর্যাদা বেড়েছে বই কমেনি।
পণ্ডিত চূড়ামণি সে কারণেই বণিকপুত্র বলে ডেকে একটু মজা করলেন।
তবে সে রসিকতায় আমল দেওয়ার মতো মনের অবস্থা নৃসিংহের ছিল না। তিনি বুঝলেন, পণ্ডিতপ্রবর এখনও আসন্ন বিপদের আভাস পাননি।
সামনে রাখা একটি ছোট চৌকি টেনে নিয়ে, তাতে উপবেশন করে নৃসিংহ বললেন, “শিরোমণি মশায়, আপনার কাছে একটি বিষয়ের ব্যাখ্যা জানতে এলাম।”
তিনি তেমনই স্মিতমুখে বললেন, “কী বিষয়ে বণিক-পুত্র?”
“কয়েক দিন ধরেই আমি একটা স্বপ্ন দেখছি।”
“বলো, কী স্বপ্ন?”
“একটি বড় সাপ। অনবরত আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। একটা ভয়ঙ্কর কালো সাপ...” তার গলার স্বর ভীষণ গম্ভীর হয়ে এল।
পণ্ডিত মশাইয়ের মুখ থেকে হাসি মুছে গিয়েছিল। এখন তাঁর মুখের বলিরেখায় ভ্রুকুটি কুঞ্চন। তিনি বললেন, “আর্যপুত্র, তুমি একটু অপেক্ষা করো।”
শিরোমণি মশাই নৃসিংহকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অন্দরমহলে চলে গেলেন।
নৃসিংহের মন যেন বুঝতে পারছিল, একটা ঝড় আসছে। এই স্বপ্ন যেন সেই রকমই অশুভ ইঙ্গিত করছে ক্রমাগত। কিন্তু সে ঝড় তো শুধু তাঁর উপরে নয়, সমগ্র রাজ্যের উপরে ধেয়ে আসতে চলেছে। এই ঝড় থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী! এখান থেকে তাঁকে এক বার প্রধান সেনাপতি গোবিন্দ বিদ্যাধরের কাছে যেতে হবে। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি আবার ভাবলেন, তিনি কেন এত আশঙ্কিত হচ্ছেন! তিনি তো রাজকর্মচারী নন। মহারাজ আর প্রদেশপাল রায় রামানন্দের অনুপস্থিতিতে গোবিন্দ বিদ্যাধরই এখন রাজ্যের প্রধান পরিচালক। তিনি যথেষ্ট কূটকৌশলী ও রাজকার্যে নিপুণ ব্যক্তি। তিনিও নিশ্চয়ই আসন্ন বিপদের সংবাদ পেয়ে গিয়েছেন। সুতরাং নৃসিংহের এ বিষয়ে এত উতলা না হলেও চলবে। কিন্তু স্বপ্নের ভিতরে সেই ভয়াল সর্প তাঁকে ক্রমাগত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তাঁর সারাদিনের কাজের ইচ্ছাকে লুপ্ত করে দিয়ে একটা গভীর আশঙ্কার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাই তিনি উপযাচক হয়েই মাধব মিশ্রের কাছে নিজের এক বিশ্বস্ত অনুচরকে পাঠিয়েছিলেন। মাধব তাঁর চঞ্চলতা বুঝে নিজেই ছুটে এসেছিলেন। মনের মধ্যে এই সব চিন্তায় নৃসিংহ এতটাই নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, পণ্ডিত মশাইয়ের ডাক তাঁর কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি।
দ্বিতীয় ডাকে নৃসিংহ মুখে তুলে তাকালেন।
শিরোমণি মশাই বসতে বসতে বললেন, “তোমার পিতা তোমার কোষ্ঠী বিচার করতে দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেটা আর ফেরত নেওয়ার অবকাশ পাননি,” বলে তিনি শুভ্র বস্ত্রে মোড়া জন্মকুণ্ডলীটি নৃসিংহের হাতে দিলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন, “ভয় পাওয়ার কারণ থাকলেও, অন্তে হানিকর কিছুর আশঙ্কা নেই। বরং তুমি বিপদকে জয় করবে, এমনটাই আমি দেখতে পাচ্ছি।”
নৃসিংহ আরও কিছু বিস্তারিত শোনার আশায় পণ্ডিত মশাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কিন্তু আচার্য তার চেয়ে বেশি ভেঙে আর কিছু বললেন না। শুধু রহস্য করে বললেন, “বিপদ আগত ঠিকই, কিন্তু শ্রীজগন্নাথদেব আছেন। তিনি বিশ্বের রক্ষাকর্তা। তিনি ঠিকই পথ দেখাবেন তোমায়।”
২
অন্ধকার তখনও পুরোপুরি কাটেনি, পঙ্গপালের মতো ইসমাইল গাজীর সৈন্যরা ওড়িশার গ্রামে ঢুকে পড়ল। দস্যুর বেশে দামাল নিষ্ঠুর সেনা ঝাঁপিয়ে পড়ল হিংস্র শ্বাপদের মতো। তখনও ঘুম ভেঙে জেগে ওঠেনি গ্রামের চরাচর। উষার আলো ফুটে ওঠার আগেই, ওড়িশার সীমান্তবর্তী গ্রামের আকাশ লাল হয়ে উঠল। নিষ্ঠুর সেনার দল ঘুমন্ত দরিদ্র ঘরগুলিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। সেই লেলিহান আগুনে ভোর হওয়ার আগেই আকাশ রক্তিম। চার পাশে কোথাও কোনও পাখির কূজন নেই, শুধু মানুষের হাহাকার, ঘোড়ার খুরের প্রমত্ত দাপাদাপি, যোদ্ধাদের হুঙ্কার আকাশ-বাতাস মুখর করে তুলেছে। লুট-তরাজ, প্রহার-হত্যা কিছুই বাদ যাচ্ছে না।
ও দিকে এক জন অশ্বারোহী তীব্র বেগে মাঠ-ঘাট-বন পেরিয়ে ছুটে চলেছে। কালো ঘোড়ার পিঠে বসা যুবকটির আপাদমস্তক কালো বস্ত্রে আচ্ছাদিত। কিন্তু ঘোড়সওয়ার একা নয়, তার পিছনে পিছনে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আরও এক ঘোড়সওয়ার তাকে অনুসরণ করছে। দ্বিতীয় জনেরও আপাদমস্তক কালো পোশাকে আচ্ছাদিত। তার কোমর থেকে ঝুলে আছে দীর্ঘ এক তলোয়ার। কাঁধে ধনুক, পিঠ তিরপূর্ণ তূণ।
প্রথম জন মেঠো পায়ে-চলা রাস্তা ছেড়ে ঝোপঝাড় জঙ্গলের পথ ধরল। অনুসরণকারীকে কোনও ক্রমে এড়িয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো তার উদ্দেশ্য। তার সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র তেমন কিছু নেই। শুধু একটি ছোট ধারালো খঞ্জর কোমরের কাছে গুঁজে রাখা। অন্ধকারে ভাল করে কিছু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। তবু তার ইন্দ্রিয় তাকে বার বার সজাগ করে দিচ্ছে, শ্বাপদের মতো পিছনের অশ্বারোহী প্রায় তার ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছে। সহসা তার মনে হল, একটা তির তার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে দিয়ে সামনের একটা গাছে বিদ্ধ হল। সে আরও সজাগ হয়ে, ডান দিকের নিবিড়তর গাছগাছালির পথ ধরল। তার বুকের ভিতরে ভয় দানা বাঁধছে। মরতে সে ভয় পায় না। যোদ্ধার কাছে বীরের মৃত্যু গৌরবের। কিন্তু, তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছতেই হবে, না হলে ঘোর সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী। অন্যথায় সে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে বুক চিতিয়ে পিছনের ঘোড়সওয়ারের মুখোমুখি হতে পারত। কিন্তু হঠকারিতায় যদি তার প্রাণনাশ হয়, তা হলে অসীম অনিষ্ট ঘটে যাবে। ফলে তাকে সব কিছু এড়িয়ে দৌড়তে হচ্ছে।
কিন্তু এ ভাবে কত ক্ষণে সে কাফি খাঁর মতো ধূর্ত আর নিষ্ঠুর যোদ্ধাকে এড়াতে পারবে! সেই কারণেই যখন সাপের ছোবলের মতো তিরের ফলা থেকে সে অল্পের জন্য বেঁচে গেল, তখন সে বুঝতে পারল, এই ভাবে সে কাফি খাঁকে এড়াতে পারবে না। তাকে এ বার একটু ঝুঁকি নিতেই হবে। কিন্তু ব্যর্থ হলে সে ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে না— এই সংশয়ের দোলাচলে যখন সে ভুগছে, তখনই আরও একটা শর তার কানের কাছে মৃত্যুর শ্বাস ফেলে চলে গেল। সে সচকিত হয়ে উঠল।
রাতের আঁধার সবে তরল হতে শুরু করেছে। সেই আলো-ছায়ায় সে সামনের একটি বৃহৎ গাছের আড়ালে ঘোড়া দাঁড় করাল। তার পরে সটান সে ঘোড়ার পিঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার হাতের নাগালে গাছের একটি ঝুলন্ত ঝুরি।
কাফি খাঁর ঘোড়াও সেই গাছের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। হঠাৎ বনের স্তব্ধতা ভেঙে খানখান করে তীব্র একটা জান্তব শব্দ অনুরণিত হতে থাকল। কাফি খাঁ চমকে উঠল। কিন্তু চমক ভেঙে সতর্ক হওয়ার আগেই কে যেন অতর্কিতে তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলেল। অসম্ভব বলিষ্ঠ দু’টি হাত তার গলা চেপে ধরেছে তীব্র আক্রোশে। কাফি খাঁও পুরুষসিংহ। অচিরেই হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে উঠে সে পাল্টা আক্রমণ করল। এ বার কাফি খাঁ ঝটকা দিয়ে আক্রমণকারীকে মাটিতে ফেলে তার বুকের উপর চেপে বসেছে। ভীষণ বলশালী হাতে গলা চেপে ধরে সেই যুবকের।
তত ক্ষণে ভূপতিত যুবকের মুখ থেকে ঢাকা সরে গিয়েছে। ঝাপসা অন্ধকারেও কাফি খাঁ তাকে চিনতে পেরে অবাক হয়ে যায়, “এ কী, জয়চন্দ্র!”
কাফি খাঁর হাতের ফাঁস আরও তীব্র হয়। জয়চন্দ্রর দুই চোখের মণি যেন অক্ষিকোটর ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। শ্বাসবায়ু শেষ হয়ে আসছে তার। তবু কাফি খাঁর কথায় তার মুখের পেশিতে হাসির আভাস ফুটে ওঠে। তার দুটো অসহায় হাত কিছু একটা খোঁজার আগ্রহে ব্যর্থ সঞ্চালিত হচ্ছে মাটির উপরে। কিছু না পেয়ে সেই হাত অকারণে ভূমি কর্ষণ করে চলে শুধু। তবু চেতনার শেষ অন্তরীপে পৌঁছবার মুহূর্তে তার হাত কোমরের কাছে গোপনে গোঁজা খঞ্জরটি খুঁজে পায়। দুর্বল হাতে সেই খঞ্জর তুলে কাফি খাঁর পেটের কাছে আঘাত করে। অপ্রত্যাশিত আঘাতে কাফি খাঁ-র হাত সামান্য শিথিল হতেই জয়চন্দ্র তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
নিজেকে সামলে কাফি খাঁও বিদ্যুদ্বেগে তার কোমর থেকে একটি তীক্ষ্ণ শলাকা বার করে জয়চন্দ্রর হাতে বিঁধিয়ে দিয়েছে। তীব্র বেদনা সয়েও জয়চন্দ্র তার সমস্ত শক্তি দিয়ে কাফি খাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার বুকে আমূল বসিয়ে দিল তার খঞ্জরটি। দারুণ যন্ত্রণায় কাতর আর্তনাদ করে কাফি খাঁ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
জয়চন্দ্র আর দাঁড়ায় না। ডান হাতে অন্য হাতের ক্ষত চেপে ধরে সে ঘোড়ার কাছে দৌড়য়। ঘড়ঘড় শব্দে কাফি খাঁ কী বলল, সে শুনেও শুনল না। এখন তার এক মাত্র উদ্দেশ্য ভোরের আগেই গন্তব্যে পৌঁছনো। সে তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
কাফি খাঁর শলাকায় বিষ ছিল। সেই বিষের দহন ক্রমশ ক্ষতস্থান থেকে রক্তবাহিত হয়ে জয়চন্দ্রর সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ছে। তার সারা শরীরে নেমে আসছে অসীম অবসাদ। সে বিপুল মনের জোরে চৈতন্য ধরে রাখার চেষ্টা করে চলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy