Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

পিঠের গন্ধে ঘুম ভাঙতে হেঁশেলে ছুট

রোদে শুকোচ্ছে মাটির সরার ছাঁচ। গোকুলপিঠে, ভাপা, চসি, দুধপুলি আর রসবড়া তো সময়ের অপেক্ষা। কিংবা মাটির উনুনেই লোহার থালায় বানানো কেক। মা-ঠাকুমার আটপৌরে রান্নাঘরে ভালবাসার শিল্পকর্ম। ঋজু বসুরোদে শুকোচ্ছে মাটির সরার ছাঁচ। গোকুলপিঠে, ভাপা, চসি, দুধপুলি আর রসবড়া তো সময়ের অপেক্ষা। কিংবা মাটির উনুনেই লোহার থালায় বানানো কেক। মা-ঠাকুমার আটপৌরে রান্নাঘরে ভালবাসার শিল্পকর্ম। ঋজু বসু

ছবি: শুভেন্দু চাকী  সৌজন্য: বিপাশা ফ্লোরেন্স রোজারিও

ছবি: শুভেন্দু চাকী সৌজন্য: বিপাশা ফ্লোরেন্স রোজারিও

শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

পুরু বরফে যখন বাচ্চাদের খেলার পার্ক, আউটহাউস, গ্যারাজ, মেপ্‌ল গাছের ডালপালা অবধি ধবধবে হয়ে যায়, তখন গোকুলপিঠে ভাজতে মন চায় মেখলার। যেমন মা ভাজত দেশের মিঠে শীতে।

আর ওটিজি-তে চিজকেক বেক করতে গিয়ে সুজি ওরফে সুজাতার মনে পড়ে, সত্যিই কত বুদ্ধি ধরত মা। প্রেশারকুকারে মামুলি সব সরঞ্জামেও কেকে কী চমৎকার স্বাদ খুলত মায়ের হাতে।

স্টারের আদলের কুকি কাটারে পিঠে কাটার দরুন সাত সাগর পারের গোকুলপিঠে দেখতে হয়, ছোট ছোট তারার মতো। ঠিক যেন বারান্দায় চিকচিক করা রুপোলি বরফের ছোপ। গরম-গরম ভেজে রসালো পিঠেয় কামড় দিলে বা ঘন পায়েসে ডুবিয়ে চাখলে মায়ের কথা মনে পড়ে। প্রবাসের ধূসর কনকনে ঠান্ডা খানিক ক্ষণের জন্য মোলায়েম মনে হয়।

পিঠে করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে তাজা নারকোলের জন্য মন খারাপ হয় সুজাতা চাটুজ্জের। তবু প্যাকেটের ডেসিকেটেড নারকোলে, নারকোল কুরনোর ঝক্কির থেকে রেহাই। পায়েসের খোঁজে বাংলাদেশি দোকানের পাটালিতেও মাটির গন্ধ, মায়ের গন্ধ ভুরভুর করে।

বস্টন বা সানফ্রান্সিসকো নয়, এই কলকাতার কালিকাপুরকেও সময়ে-সময়ে ঘোর বিদেশ বলে মনে হয় বিপাশা ফ্লোরেন্স রোজারিওর। ক্রিসমাসের সময় থেকেই ছেলেমেয়েরা আবদার জুড়ত, ‘দিদাকে বলো না মা, ঢাকা থেকে ‘বল পিঠে’টা পাঠাতে।’ চালগুঁড়ির খোলে গুড়-নারকোলের পুরভরা গোলাকার পিঠে তো, তাই ওরা বলে ‘বল পিঠে’!

নদিয়ায় এর নামই ধুবি পিঠে। কেউ বলে, বাহা পিঠে বা ভাপা পিঠে। থাক-থাক চালগুঁড়ির উপরে কুরনো নারকোল, তার উপরে পাটালির টুকরোও বসবে থাকে থাকে। উপরে ফের চালের গুঁড়ি লেপতে হবে। এই ভাবে তিন তলা পিঠার কাই রেডি।

বড়দিন-নিউ ইয়ারের কেক, কেকের জায়গায় থাকুক! বাঙালি খেশ্চানঘরে এই ভাপা পিঠেও কম আদরের নয়। পরিষ্কার নতুন কাপড়ে মুড়ে ভাপানোর সময়ে কেকের মতোই দেখতে লাগে তাকে। ঢাকা-নবাবগঞ্জে বিপাশার মা-দিদিমার আলাদা পেতলের বাটিই থাকত এই ভাপা পিঠের জন্য।

মা নেই আজ তিন বছর। ছেলেমেয়েরাও দু্দ্দাড় বড় হয়ে যাচ্ছে। এই নতুন বছরে টুকরো-টাকরা কেক খেলেও পিঠে মুখে রোচেনি তাঁর।

শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রবীণ গিন্নি নন্দিনী দেববউরানির পৌষালি স্মৃতি আবার কেকের সুঘ্রাণে ম-ম। সুকিয়া স্ট্রিট বা তেলেঙ্গাবাগানে বাপের বাড়ির রান্নাঘরে কর্তাদের নিরন্তর চায়ের জোগান দিত যে ছোট মাটির উনুনটা, শীতে তার অন্য উপযোগিতা। কানা-উঁচু বড় বড় লোহার বগি-থালায় বালির ঢিবিতে মুখ লুকোত ক্রাউন-মার্কা অ্যালুমিনিয়াম কন্টেনার। তাতে ভরা কেকের খামির। ঢিমে আঁচ জ্বলত সারা ক্ষণ। কলাইয়ের ঢাকনি সরিয়ে মা-কাকিরা উল বোনার কাঁটা নেড়ে বার বার দেখত, সব ঠিকঠাক হচ্ছে তো! শীতের দুপুরগুলো কাটত এ ভাবেই। উনুনে বা উনুনের পাশের তেতে থাকা মাটির তাক জুড়ে জমজমাট কেক-কাণ্ড।

পশ্চিমে হাওয়া-বদলে গেলেও হগ মার্কেট থেকে কেনা মেওয়া, আখরোট, কিসমিস, কাজু সঙ্গে যেত। পলসনের মাখনের গন্ধ ভরা সেই অসাধারণ কেকের স্বাদ এখন আর কোথাও খুঁজে পান না নন্দিনী।

কসবার ৯০ বছরের মায়া গুহ বিশ্বাসের চসির পায়েস আর দুধপুলি খেয়ে এই পৌষেও বাক্‌রুদ্ধ ভাইঝি পৃথা রায় বর্ধন। যে-সে চালবাটা পছন্দ নয় পিসিমার। তাঁর প্রবীণ আঙুলে পিঠের গোলা যেন জলতরঙ্গের মতো বেজে ওঠে। নুড্‌লসের মতো ঝরঝরে তুলতুলে চসি আর দুধপুলির পুলি এই বয়সে টিপে টিপে গড়েছেন নিজের হাতেই।

সে-কালের পৌষ সংক্রান্তির কাউন্টডাউন শুরু হত দিন ৭-৮ আগেই। খিদিরপুরের ইয়ংবেঙ্গল হোটেলের বাড়ির মেয়ে পৃথার মনে পড়ে, কালীঘাটে বা হেস্টিংসের বাড়িতে মাটির সরার ছাঁচ নিজের হাতে গড়ে রোদে শুকোতে দিচ্ছেন ঠাকুমা-দিদিমারা। মা কমল বসুরায়ও পিঠে বিশারদ। সাত-সকালে উনুনে আঁশ-কাঁটার ছোঁয়া লাগার আগে শুরু হত মহা-যজ্ঞি। পিঠের গন্ধে ঘুম ভাঙতেই ভাইবোনদের বাসিমুখে হেঁশেল ঘেরাও!

অধুনা মন্ট্রিয়লবাসী পূর্ণা চৌধুরীদের মুদিয়ালির বাড়িতেও মা মিনতিদেবীর দম ফেলবার ফুরসত নেই দিনভর। নেত্রকোনায় দেশের বাড়ির নিয়ম মেনে গরিব-দুঃখীকে পিঠে বিলি-পর্ব। গোকুলপিঠে, রসবড়া, দুধপুলি, মুগশামলি! অন্তত দু’গামলা নতুনগুড়ের পায়েস! সব মিটতে বিকেল গড়িয়ে যেত।

চালবাটায় পিঠের গোলার নিখুঁত আঁটোসাঁটো ভাবটি থেকে শুরু করে পুরের পরিশীলিত স্বাদ, সবেতেই গৃহিণীর হাতযশই শেষ কথা। পাথুরেঘাটার এক গিন্নির পাতপুলি চাখতে চাখতে কানে এসেছে, কী ভাবে যেন নিপুণ হাতে নারকোলের শাঁসটুকু ছুলে মিহি ভাবে পিষতে হবে। কতটা ছানা ও ক্ষীর নারকোলে মিশবে, আগুনে তাতানো ঈষৎ নরম কলাপাতার আদরে পাক দিয়ে জন্ম নেবে সূক্ষ্মতম স্বাদের আভিজাত্য— বলতে বলতে ময়ূর-ময়ূর ভঙ্গিতে কলার তুলেছেন বড়বাড়ির গিন্নি।

মোদ্দা কথা, পুরুষকে যদি গোঁফ দিয়ে চেনা যায়, মেয়েদের চিনতে হবে পিঠের গুণে। ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’র কাঞ্চনমালা-কাঁকনমালার গল্পই যেমন। কাঞ্চনমালা রানি। কিন্তু কপালের ফেরে দাসী হয়েছিলেন। তাঁকে ঠকিয়ে তাঁর কাপড়, গয়না পরে রানি হলেন কাঁকনমালা! কিন্তু পিঠে করতে গিয়েই জারিজুরি ফাঁস।

পিঠা কুড়ালির ব্রত! রাজ্যে সে-দিন ‘পিঠা বিলাইতে হয়’। দেখা গেল, দাসীরূপী কাঞ্চনমালা করেছেন চন্দ্রপুরী, মোহনবাঁশী, ক্ষীরমুরলি, চন্দনপাতা, এই সব। আর নকল রানির দৌড়, আস্কে পিটা, চাস্কে পিটা আর ঘাস্কে পিটা! হাতে-নাতে প্রমাণ! ‘মানুষ বুঝিল কে রানি, কে দাসী’।

বরিশাইল্যা তপন রায়চৌধুরীর চোখে কিন্তু এই আস্কে পিঠেরই আলাদা কদর। সাহেবদের যেমন বিফ স্টেক, তেমনই না কি বাঙালির আস্কে পিঠে। বাঙালদেশে যার নাম চিতই। পাটালি-গোলা ঘন দুধে ডোবানো বাসি চিতইয়ের স্বাদ যে পেয়েছে, সে বছরভর শীতের অপেক্ষায় থাকবে। ঠিক যেমন, বচ্ছরকার পার্বণী কেকের টানে মোরব্বা, বাদাম, কিশমিশ মাসের পর মাস রামে মজিয়ে গাঢ় হয় প্রতীক্ষা।

সংসদের অভিধানে সাহেবি প্যানকেক বা গ্রিড্‌লকেককেও আস্কে পিঠে বলা হয়েছে। চালের আস্কে পিঠে মাটির সরায় ভাপানো, প্যানকেক তাওয়ায় ভাজা ডিম-ময়দার গোলা। বিশ শতকের বাঙালি শৈশব জুড়ে মস্ত ছায়া ফেলা রুশদেশের উপকথার গল্পে, প্যানকেক আবার সরুচাকলি হয়েছে।

সরুচাকলি নিয়ে রুশ-কাহিনির বুড়োবুড়ির হ্যাংলামিটুকুই সার। ঘটিদের এই লুচি পরোটার দেশে তার দেখা সহজে মিলবে না। কলকাতার রেস্তোরাঁয় অন্ধ্র বা কেরলের ঝাল-ঝাল গরগরে মাংসের সঙ্গে দক্ষিণী চালের রুটি আপ্পাম বছরভর দৌড়য়, তার বাঙালি বোন সরুচাকলির দেখা নেই। আস্কের সঙ্গে অবশ্য আপ্পাম নয়, ইডলির মিলই বেশি। সংক্রান্তির আগের দিন ঘটির দেশও মাটির সরায় ঢাকা আস্কে পিঠে লক্ষ্মীকে নিবেদন করবে।

শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে নতুন ধানের শীষ-আমপাতায় রাশি-রাশি বাউনি বাঁধা হবে। আর শোনা যাবে, গিন্নিরা লক্ষ্মীঠাকরুনকে বলছেন, ‘আউনি বাউনি কোথাও না-যাও, ঘরে বসে পিঠে ভাত খাও!’

আস্কের আসলি স্বাদ টের পেতে যেতে হবে হাওড়ার মন্দিরতলায় সামরান হুদা-সুমেরু মুখুজ্জেদের গোলটেবিলে। মাটির খোলা বা সরা সব সময়ে মেলে না সেখানে। শহুরে ফ্ল্যাটে কাঠের উনুন ঘিরে সদ্যোজাত চিতইয়ের অপেক্ষায় ঘরভরা লোলুপ কুচোদের ভিড়ও নেই। তবু এখানেই উঠে আসে, এক টুকরো কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। গাঁ-ঘরের বিলে ধরাপড়া বক কি হাঁসের ভর্তা নেই। শুঁটকি বা সর্ষের ভর্তাও কদাচ মিলবে। মুরগির ভুনা কি কাতলা মাছের ঠান্ডা বাসি থকথকে লাউ ঝোল বিরানের সঙ্গতেই গরম চিতই মহিয়ান।

চালগুঁড়ির গোলায় ডিম-মেশানো ‘তারা রুটি’ বা ফিনফিনে রুমালের মতো ভাঁজ করা ছিটা পিঠারও দেখা মেলে। শিকড়চ্যুত শহুরে গ্লোবাল বাঙালি তক্কো করি এ পিঠের কতটা বিলিতি প্যানকেক, আর কতটা ম্যাঙ্গালোরের নির দোসার সঙ্গে মিলবে। কষা-কষা আলুর দমের সঙ্গী ছিটা রুটির আর একটা নামও শুনেছিলাম বটে এক সুন্দরবন গিন্নির মুখে। চালগুঁড়ির গোলা দোসার মতো হাত দিয়ে তাওয়ায় ছুড়ে দেওয়া হয় বলে, নাম হাতছোড়া পিঠা। লীলা মজুমদারের গপ্পেও তো গ্রামপ্রধানের ঘরে ভাল বিস্কুটের মতো ফুরফুরে নরম মোটা চালের রুটি খাওয়া হয়েছিল। সঙ্গে ছিল বনের মধু।

আবার বালিগঞ্জের পোড়ো বাড়িতে গা-ছমছমে ভূতের গল্পের গৌরচন্দ্রিকাটুকু এই লীলাই ভরে দিয়েছেন, চায়ের সঙ্গে অপরূপ গোলাপি কেকের রঙে। লীলুপিসির লেখা বা জীবন জুড়েই রংবেরঙের ভোজ-বিলাসের ফিরিস্তি। পাঁচ মুখে তা সরস লেখনীতে তুলে ধরেছেন শিখা রায়, যিনি আবার লীলার কৃতী ভাইপো প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব প্রসাদরঞ্জন রায়ের স্ত্রী।

‘মা এমনিতে সাহেবি রান্নাটাই বেশি ভালবাসতেন। বাড়িতে নিজে পিঠেপুলি করার থেকে কেক-বিস্কুট-পাই-প্যাটির দিকে ঝোঁকটাই বেশি!’— বললেন লীলার কন্যা কমলা চট্টোপাধ্যায়। মায়ের বিখ্যাত ‘রান্নার বই’য়ের তিনি সহ-সূপকারও বটে।

শিলং বা কলকাতায় লীলার বালিকাবেলা জুড়ে রকমারি বিজাতীয় স্বাদ-চর্চা। কয়লার উনুনে লোহার পাত ফেলে বাক্স তন্দুর চাপিয়ে কারিকুরি। মিসেস ডিনের কুক-বুক ঘেঁটে মা সুরমাদেবী বুদ্ধি করে দেশি বিকল্প উপকরণ খুঁজতেন বা সহজসাধ্য কৌশল ভাঁজতেন। রচিত হত কেক, বিস্কুট, পুডিং, মুরগির স্ক্যাল্পের রোমাঞ্চকর ও স্বর্গীয় আস্বাদ। সাহেবি কসরতের ছোঁয়ায় লীলার মায়ের হাতের কেক দোকানের থেকেও উৎকৃষ্ট হত।

মা-ঠাকুমাদের আটপৌরে স্টুডিয়োয় এ সব শিল্পকর্মের মূলে কি নিছকই ভালবাসা বা বঙ্গললনার বিখ্যাত স্নেহবৃত্তি? প্রশ্ন তুলেছিলেন আর এক ভোজন-রসিক লেখক বুদ্ধদেব বসু। এবং নিজেই তা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন। অর্থবল ছাড়া নিতান্ত মামুলি সরঞ্জামে এই ‘গাধাখাটুনি’র সঙ্গে বরং যন্ত্রযুগের ঢের আগে দাসদের পিরামিড তৈরির প্রাণান্তকর শ্রমের তুলনা টেনেছেন বুদ্ধদেব।

লীলা অবিশ্যি আপশোস আঁকড়ে থাকতে রাজি নন। যে কোনও দক্ষ গৃহিণী কাম হেঁশেলের এগজিকিউটিভ শেফের মতোই তাঁর দর্শন, নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অব ইনভেনশন। দরকারে সেকেলে নিয়ম পালটাতে হবে। মেয়েরা অনন্তকাল রান্নাঘরে পড়ে থাকবে, সেটি হবে না। কোনও রান্না বাতিল করা তাঁর না-পসন্দ। লীলার বেশিরভাগ কেক-পিঠেই সহজ নিয়মে সারা।

‘রান্নার বই’য়ের মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘ভাল জিনিস উপভোগ করতে না-পারার মতো খারাপ কিছুই নেই। আমরা যদি মাছের শুক্তো, মোচার ঘণ্ট, পিঠেপুলি করতে ভুলি তার থেকে মূঢ়তা আর কিছু হতে পারে না।’

কে না জানে, পাটিসাপটা, গোকুলপিঠে, নারকোল নাড়ু, দুধপুলির টানে ‘জিভকাটা ভূতে’রাও ফিরে ফিরে আসে। কোনও এক পৌষপার্বণে গোলমাল করার অপরাধে গয়লার ঘরের দুষ্টু ছেলেদের জিভ কেটে নিয়েছিল জমিদার। লীলার গল্পময় সেই পিঠেপাগল ভূতেদের দস্যিপনাও।

কেক-প্যাটি বাঙালির মনে বরাবরই দখিন-খোলা জানলার রোম্যান্স। আর পিঠেপুলি ঘরে ফেরার গান। দুটিকে ঘিরেই বয়ে চলে আদরের নৌকো। এ শহরে এখনও কারও কারও চোখে লেগে, দেশগাঁয়ে গাইলে পাড় দিয়ে চাল কোটার দৃশ্য। চালের গুঁড়ির বল পাকিয়ে ফুটন্ত কড়াইয়ে সেদ্ধ করার জন্য ছুড়ে দিতে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত কচিকাঁচাদের। পাকন বা পোয়া পিঠে কড়ায় ছাড়ার একটা সুযোগ পেতে বা চিনির সিরায় ডোবাতে মুখিয়ে থাকত খুদে-বাহিনি। ঠিক যেন সামাজিক বা পারিবারিক কেক মিক্সিং-এর আসর। মাকে সঙ্গত করতে যেখানে নেমে পড়তেন লীলা ও তাঁর দিদি।

এ সময়ে বিপাশার শাশুড়ি আহ্লাদীদেবীও স্মৃতির ঘরে আটকা পড়েন। তাঁর ছেলে সাইমন্ডস, প্রতুল, জেমস, প্রদীপেরা তখন গেঁড়ি বয়সের। শ্বশুরমশাই মার্টিন রোজারিও কেক বানানোর সময়ে তাঁকে ঘিরে সব ক’টা! এমন রাজসূয় যজ্ঞে কে না হাত লাগাতে চায়! ঠাকুরদা হাসতে হাসতে সবাইকে খুশি করতেন। সাইমন্ডসের পেট টিপে, ‘যা তুই ডিমটা ঢাল!’ কিংবা ‘ওরে প্রদীপ তুই একটু চিনি দে তো!’ রানাঘাটের ক্রিশ্চান কলোনি বা এন্টালির পুরনো বাড়ি ম্যাজিক রিয়্যালিজমের মতো মিশে থাকে কলকাতার শরীরে।

নকশি পিঠা বিহীন এই শহরে সামরানের চোখেও মূর্ত হয়ে ওঠে কবেকার পৌষ। যখন সদ্য মালিশ দেওয়া পিঠার কাইয়ে খেজুর কাঁটায় নিজের নাম লেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠত ছোটরা। এও যেন কেকের আইসিংয়ের আল্পনা। গাঁঘরের সেই অখ্যাত পিসি-চাচি-ফুফুরা অবলীলায় পিঠার গায়ে ফুটিয়ে তুলতেন শাপলা, পদ্ম, কুলো, পাখি, মাছ। তাছাড়া, পিঠে বেলে পাট করার কায়দায় কোনও ছাঁচ ছাড়াই ফুটে ওঠে নিটোল হার্ট, ঝিনুকের খোল বা আস্ত গোলাপ। গোলপার্কের মেয়ে নয়না সেনগুপ্ত, অধুনা ঢাকার গিন্নি নয়না আফরোজ এই গোলাপ পিঠার আর্ট রপ্ত করেছেন।

কেকের গায়ে চিনির পাতের মিহি গোলাপফুলটির জন্যও কিন্তু ছাঁচ মেলে না। একেলে তুখড় গিন্নি-কাম-হোম শেফের দল, তা গড়েন হাতে-হাতেই। সঙ্গে তাক লাগানো আরও বহু মডেল, যার সঙ্গে সেকালিনীদের শিল্পকর্মের তুলনা চলবে।

ডোনাট থেকে দুধপুলি, ব্রাউনি থেকে বিবিখানা পিঠে— যে কোনও কিছুই হাতেকলমে শেখার অঢেল সুবিধে ইন্টারনেটের জমানায়। চালগুঁড়ি, ময়দা, ডিম, গুড়, নারকোলের মিশেলে এই বিবিখানা আদতে পিঠে হয়েও এক ধরনের কেক! পৌষপার্বণে মা-বাবা বেঙ্গালুরুর বাড়িতে এলে, নলেনগুড়-নারকোলের পুর ভরে স্পেশাল কেক করবেন ঠিক করে রেখেছেন ঋদ্ধি বসু বন্দ্যোপাধ্যায়। কেক হয়েও তার প্রতিটা কামড়ে মিশে পিঠের আবেশ!

শীত-সকালে গরম পিঠে বা চায়ের সঙ্গে মোক্ষম কেকের মেজাজ আসলে নিছকই কেক-পিঠের ঘেরাটোপে বন্দি নয়। তার মধ্যে লুকিয়ে হারানো সময়ে পাড়ি দেওয়ার চাবিকাঠি। এ প্রসঙ্গে ফরাসি লেখক প্রুস্তসাহেবকে এক বারটি স্মরণ করলে দোষ হবে না। কোনও এক ক্নান্ত দিনশেষে মায়ের দেওয়া ফুলো-ফুলো মাদেলিন কেক চায়ে ডুবিয়ে খেয়েই তাঁর মনের ঘরে আলো জ্বলে উঠেছিল।

ওই চা-কেকের অনুষঙ্গে জড়িয়ে ছেলেবেলার ভুলে যাওয়া সুখস্মৃতি। সেটাই না কি বহুচর্চিত প্রুস্তিয়ান মোমেন্ট। যার সংঘাতে রোজকার একঘেয়ে যাপনটা মনে হয় ঘোর মিথ্যে। কেকই হোক বা পিঠে— এই পৌষে তার পরতে পরতে মিশে কত কালের আনন্দ-বিষাদ। ভাঙাচোরা জীবন ভুলে থাকতে অব্যর্থ স্বাদসেতুর টান।

অন্য বিষয়গুলি:

Pitha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE