ইন্দ্রজাল: ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯। বঙ্গোপসাগরে নামানো হচ্ছে বাক্সবন্দি পি সি সরকার জুনিয়রকে।
লন্ডনের উড গ্রিন এম্পায়ার থিয়েটারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে এক মার্কিন জাদুকর। নাম উইলিয়াম এল্সওয়ার্থ রবিনসন। আসল নামে অবশ্য তিনি পরিচিত নন। তাঁর বিশ্বাস, জাদুর সঙ্গে কিঞ্চিৎ অচেনা এশীয় রোমাঞ্চ মিশিয়ে দিতে পারলে মানুষের ঘোর লাগে বেশি। মার্কিন জাদুকর তাই বেশির ভাগ সময় চৈনিক সেজে থাকেন। হাতে গোনা ক’জন ছাড়া সবাই তাঁকে চেনে চাং লিং সু নামে। মেকআপ করে চোখ দু’টো ছোট ছোট করে রাখেন। মুখে, গায়ে বাদামি-হলদে রঙ লাগান। চুল চিনেদের মতো টেনে পিছনে লম্বা বেণি বাঁধা।
একটা খেলা দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন সু। খেলার নাম ‘কনডেমড টু ডেথ বাই দ্য বক্সার।’ স্টেজে তাঁর সহকারী তাঁর দিকে বন্দুক তাক করে গুলি ছুড়বেন, গুলি গায়ে লাগার আগেই লুফে নিয়ে মুঠোবন্দি করবেন সু! ১৯১৮ সালের ২৩ মার্চ, লন্ডনের ভরা প্রেক্ষাগৃহে শুরু হয়েছে রোমহর্ষক সেই খেলা।
বক্সারের পোশাক পরা সহকারী জ্যাক গ্রসম্যান বন্দুক তাক করলেন। গুড়ুম! মঞ্চে লুটিয়ে পড়লেন জাদুকর! চিনে ছদ্মবেশ নিয়ে থাকা সু পারতপক্ষে সবার সামনে ইংরেজি বলতেন না। কিন্তু সে দিন, স্টেজে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল ‘ওহ মাই গড! সামথিং হ্যাজ় হ্যাপেন্ড। লোয়ার দ্য কার্টন।’ রক্তাক্ত সু-কে নিয়ে যাওয়া হল পাসমোর এডওয়ার্ড কটেজ হাসপাতালে। সেখানেই পর দিন সকালে মারা গেলেন তিনি। হ্যাঁ, জ্যাকের ছোড়া বুলেট সোজা লেগেছিল বুকে।
এ কি দুর্ঘটনা না চক্রান্ত? বহু গবেষক, জাদুকর একাধিকবার এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বুলেট লোফার খেলা সাধারণত দেখানো হত দুই ব্যারেলযুক্ত গাদা বন্দুকে। একটা ব্যারেলে শুধু বারুদ ভরা থাকত। লুকনো অন্য ব্যারেলে চলে যেত গুলি। ট্রিগার টিপে ফায়ার করলে, যে ব্যারেলে বারুদ রয়েছে সেখানে ফাঁকা শব্দ হত। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যারেল থেকে গুলি বেরত না। খেলার আগে জাদুকর যে গুলিটি সর্বসমক্ষে তুলে দেখাতেন, সেটা তিন হাতের তালুর মধ্যেই লুকিয়ে রাখতেন। বন্ধুকের আওয়াজের পরে সেটিই তুলে দেখাতেন সবাইকে।
এই ম্যাজিক বিপজ্জনক। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে বন্দুক নিয়মিত পরিষ্কার করা ছিল বাধ্যতামূলক। কিন্তু সু ছিলেন অলস প্রকৃতির মানুষ। বুলেট বার করে ব্যারেল ঠিকঠাক সাফ করা তাঁর ধাতে ছিল না। ফলে তাঁর বন্দুকের ভিতরে বিভিন্ন জায়গায় বারুদ জমা হয়েছিল। সে দিন ফায়ার করা মাত্র বন্দুকের ভিতর জমে থাকা বারুদ ছিটকে অন্য ব্যারেলে থাকা গুলিতে গিয়ে ধাক্কা মারে। গুলি এফোঁড় ওঁফোড় করে দেয় সুকে।
সু একা নয়, এমন ঘটনার আরও নজির আছে ইতিহাসে। সামান্য ভুলের জন্য খেলা দেখাতে গিয়ে প্রাণ গিয়েছে জাদুকরের। ঠিক যেমনটা হয়েছে গত মাসে হুগলি নদীতে। ‘জাদুকর ম্যানড্রেক’ ওরফে চঞ্চল লাহিড়ীকে তাঁর অনুমতিক্রমেই হাতে-পায়ে দড়ি বেঁধে হুডিনির কায়দায় খাঁচার ভিতর বন্ধ করে নদীর জলে ফেলা হল। কিন্তু সময় মতো তিনি হাত-পায়ের শেকল খুলতে পারেননি।
৫০ বছর আগে, ১৯৬৯ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর, নুরপুরের কাছে বঙ্গোপসাগরে ‘ডেথ-ডিফায়িং এসকেপ ফিট আন্ডার দ্য সি’ খেলা দেখিয়েছিলেন পি সি সরকার জুনিয়র। তাঁকে একটি পোস্টাল ব্যাগে ভরে, সিল করে দেওয়া হয়। তার পর সেই ব্যাগ কাঠের বাক্সে ভরে দু’টি তালা লাগিয়ে ওয়েল্ডিং করে দেওয়া হয়েছিল। লঞ্চ থেকে কপিকলের মাধ্যমে সেই বাক্স নামানো হয়েছিল সমুদ্রে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিজেকে মুক্ত করে সমুদ্রে ভেসে উঠে রেকর্ড করেছিলেন। পুরনো স্মৃতি হাতড়ে জাদুকর বললেন, ‘‘এ খেলা পুরোটাই হাতসাফাই অভ্যেস, দক্ষতা, ক্যালকুলেশন, মনের জোর, ক্ষিপ্রতা, সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করে। আমাকে যখন পোস্টাল ব্যাগে ভরে বাক্সে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তত ক্ষণে আমার ব্যাগ খোলা হয়ে গিয়েছে, আর যখন সমুদ্রে নামাচ্ছে, তত ক্ষণে আমি বাক্স খুলে ফেলেছি। কোনও একটা পদক্ষেপে দেরি হওয়া মানেই মৃত্যু। দুর্ভাগ্যবশত যা চঞ্চলের ক্ষেত্রে হয়েছে।’’
ভাগ্য সহায় হয়নি মাদাম ডেলিনস্কিকেরও। পোল্যান্ডের এক জাদুকরের স্ত্রী ও সহকারী ছিলেন তিনি। ‘বুলেট ক্যাচিং’ এর খেলায় ছ’জন বন্দুকবাজের উদ্যত বন্দুকের সামনে দাঁড়াতেন তিনি। এখানেও দর্শকের চোখে ধুলো দিয়ে ফাঁকা কার্তুজ ফায়ার করাটাই ছিল নিয়ম। ১৮২০ সালে জার্মানিতে রাজদরবারে খেলা দেখানো হচ্ছে। ছ’জন সেনাকে আগে থেকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অল্পবয়সি এক সৈন্য রাজার সামনে ঘাবড়ে গিয়ে অভ্যাসবশত আসল বুলেট লোড করে ফেলল রাইফেলে। ফায়ার করতেই লুটিয়ে পড়লেন মাদাম। তিনি তখন অন্তঃসত্ত্বা! শোকে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর জাদুকর স্বামী।
জাদুকর আর্নল্ড বাকের মৃত্যু ডেকে এনেছিলেন এক দর্শক। ১৮৪০-এ এক দর্শককে ডেকে ফাঁকা কার্তুজ বন্দুকে লোড করিয়েছিলেন আর্নল্ড। কিন্তু দর্শকটি আর এক কাঠি উপরে। ফাঁকা কার্তুজের সঙ্গে তিনি কিছু লোহার পেরেকও বন্দুকে ভরে চালিয়ে দেন। ফায়ার করা মাত্র পেরেকগুলো সোজা বিঁধে যায় আর্নল্ডের বুকে। মৃত্যু হয় তাঁর। ১৮৬৯ সালে জাদুকর অ্যাডাম এপস্টেন এক শোয়ের আগে নিজের জাদুদণ্ড দিয়ে বন্দুকের ব্যারেলে বারুদ ঠেসে নিয়েছিলেন। অসাবধানে দণ্ডের একাংশ ভেঙে ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল, খেয়াল করেননি। চাবি টিপতেই সেই ভাঙা অংশ নল থেকে বেরিয়ে বিঁধে যায় তাঁর কপালে। মঞ্চেই মৃত্যু।
অদ্ভুতভাবে মৃত্যু হয়েছিল ওয়াশিংটন আরভিং বিশপেরও। মাঝেমাঝে তিনি কিছু ক্ষণের জন্য মূর্তির মতো স্থির হয়ে যেতেন। মৃত বলে ভুল হতে পারে। তাই সবসময় পকেটে একটা কাগজে লিখে রাখতেন, এমন হলে ৪৮ ঘণ্টা না পেরনো পর্যন্ত যেন তাঁর পোস্টমর্টেম না হয় বা তাঁকে কবর দেওয়া না হয়। ১৮৮৯-এর মে মাসে নিউ ইয়র্কের এক ক্লাবে শো দেখানোর সময় মূর্ছা যান তিনি। তিন জন চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানান, তিনি মৃত। পোস্টমর্টেম হয়। কিন্তু তাঁর স্ত্রী মানতে নারাজ। স্ত্রী ডাক্তারদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনেন। যদিও সে অভিযোগ ধোপে টেকেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy