Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
কা গে র ছা ব গে র ছা

ভালবাসাবাসি যেন দুজনেরই বাঁশি

বউ পালিয়ে গেলে পুরুষমানুষদের মান-ইজ্জত থাকে না, যদিও পুরুষরাই অহরহ পালিয়ে যায়। এলার বর চলে যায় বেলার কাছে, বেলার বর পাশের বাড়ির মুক্তির সঙ্গে চলে যায় দিঘা। আর ফিরে আসে না। বাবার বন্ধু ডক্টর মণ্ডল ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন মানুষ, তবু কী করে যেন তাঁর ঠাকুরদার মেহগনি আলমারিটা এক দিন উইপোকায় ভরে গেল।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

বউ পালিয়ে গেলে পুরুষমানুষদের মান-ইজ্জত থাকে না, যদিও পুরুষরাই অহরহ পালিয়ে যায়। এলার বর চলে যায় বেলার কাছে, বেলার বর পাশের বাড়ির মুক্তির সঙ্গে চলে যায় দিঘা। আর ফিরে আসে না। বাবার বন্ধু ডক্টর মণ্ডল ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন মানুষ, তবু কী করে যেন তাঁর ঠাকুরদার মেহগনি আলমারিটা এক দিন উইপোকায় ভরে গেল। পোকারা খেয়ে ফেলতে লাগল কাঠ, হজম করে দিল ডক্টর মণ্ডলের প্যান্টশার্ট, ওঁর স্ত্রীর ব্লাউজ, পেটিকোট। বাড়ির উলটো দিকেই ছিল একটা কাঠের দোকান। তারা এসে দেখেটেখে বলল, আলমারির পাল্লা বদলাতে হবে, দু’পাশের কাঠ, মাঝখানের তাক, এমনকী পেছনটাও পালটে ফেলতে হবে। ডক্টর মণ্ডল তাতেই রাজি হয়ে গেলেন, শত হলেও ঠাকুরদার আলমারি। পর দিন সকালে থলির মধ্যে যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির হল মাঝবয়সি উদাস চোখের এক কাঠমিস্ত্রি। বছর দু’তিন আগেই ডক্টর মণ্ডলের ছেলের বিয়ে হয়েছে, টকটকে বউ এসেছে ঘরে, তার এক বছর পর টুকটুকে নাতি। আমি তখন ক্লাস টেন-এ পড়ি। এক দিন ঘুম থেকে উঠে দেখি বাবার মুখ থমথম করছে, মা’র মুখ আরও থমথমে... ডক্টর মণ্ডলের ছেলের বউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, উধাও সেই কাঠমিস্ত্রিও, পড়ে আছে শুধু তার চটের ব্যাগ, ব্যাগের ভেতর পড়ে আছে র‌্যাঁদা, হাতুড়ি, পেরেক, করাত। আর খাটের ওপর পড়ে আছে ডক্টর মণ্ডলের ছোট্ট নাতি।

ছ্যা-ছ্যা পড়ে গেল সারা পাড়া জুড়ে। চেম্বারে তালা ঝুলিয়ে, কাউকে না জানিয়ে ডক্টর মণ্ডল ছেলে, বউ, নাতি নিয়ে চলে গেলেন তাঁর দেশের বাড়ি গোবরডাঙায়। আর ফিরে এলেন না। তার পর অনেক অনেক বছর চলে গেল। এক দিন কোত্থেকে যেন ফিরছি, কলকাতা থেকে অনেক দূরে হেজে পচে যাওয়া ছোট্ট একটা মফস্‌সল শহরে গাড়ি থামল। চা খেতেই হবে। খুঁজেপেতে একটা ছোটখাটো চায়ের দোকান পাওয়া গেল। চা আর চারটে লেড়ো বিস্কুট অর্ডার দিতে গিয়ে, চা করছেন যে মহিলা তাঁর দিকে নজর পড়ল, আর আমি চমকে উঠলাম। পেছনে এক বুড়ো একমনে বাঁশি বাজিয়ে চলেছেন। আমাকে চা আর বিস্কুট দিয়ে আবার স্টোভে জল ফোটাতে শুরু করলেন সেই মহিলা, মানে ডক্টর মণ্ডলের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া ছেলের বউ। এ বয়সেও রূপ তাঁকে ছেড়ে যায়নি, কারণ বোধহয় এই বাঁশি বাজানো বুড়ো, আদতে সেই কাঠমিস্ত্রি। আবার চা বললাম, তার পর আবার চা, তার পর আবার চা। তার পর নিজের পরিচয় দিলাম। বললাম, জানেন, সবাই খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল, অনেক চেষ্টা করেও কেউ বুঝতে পারেনি কেন সব কিছু ছেড়েছুড়ে এঁর সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন আপনি!

মহিলা আস্তে আস্তে বললেন, আলমারির কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে ও বাঁশি বের করে বাজাত। ছোটবেলা থেকেই আমার বাঁশি বাজানোর শখ, কিন্তু বাড়ি থেকে শিখতে দেয়নি, মেয়েমানুষে আবার বাঁশি বাজাবে কী! বিয়ের পর আমার স্বামীকেও অনেক সাধাসাধি করেছিলাম আমাকে বাঁশি শিখতে দিতে। চড় মেরেছিল। তার পর থেকে আর বাঁশির নাম করিনি। ও আমাকে বাঁশি শিখিয়েছে। ও এখনও আমাকে বাজাতে পারে। কী হবে পাকা বাড়ি আর পেট ভরানোর নানান খাবার খেয়ে? মনটা তো আমার ফাঁকাই ছিল। সন্ধের পর আমরা দুজনে দোকানে বসে বাঁশি বাজাই, অনেকে শুনতে আসে।

প্যারিস থেকে ট্রেনে প্রায় চার ঘণ্টা লাগে ভেসুল যেতে। ভেসুলে একটা খুব ভাল আন্তর্জাতিক মানের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়, যেটি চালায় মার্টিন আর ওর স্বামী জাঁ-মার্ক। ভেসুলে থাকলেও, কেউ কাউকে চিনত না ব্যাংককে প্রথম দেখার আগে। পাটায়ার সমুদ্রধারে বসে ছিল মার্টিন একা, সামান্য দূরে একাই বসে ছিল জাঁ-মার্ক। তার পর কী করে যেন বিধাতার ইচ্ছেয় আলাপ হল। কাকে যে বিয়ে করা যায় তা ভাবতে ভাবতেই অনেকটা সময় চলে গেছে দুজনেরই। কথা বলতে বলতে দুজনেই আবিষ্কার করল, ওরা পাগলের মতো ভালবাসে সিনেমাকে। দুজনেই স্কুলে পড়ায়। মাইনেপত্র যা পায় তাতে ওই চলে যায়, কিন্তু তার বেশি নয়। ভেসুলে ফিরে এসে বিয়ে করল ওরা, সিনেমাকে সাক্ষী রেখে। তার পর শুরু হল একটা স্বপ্ন দেখা। সহায় নেই, সম্বল নেই, বড়লোক বন্ধুবান্ধব নেই, যোগাযোগ নেই, শুধু আছে ওই স্বপ্ন— একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল শুরু করতেই হবে ভেসুলে। কী করে যেন ওরা শেষমেশ শুরুও করে দিল। অসম্ভব কষ্ট, অপমানের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে দাঁড় করিয়ে ফেলল ফেস্টিভ্যালটাকে।

ওদের বাড়িতেই ছিল ফেস্টিভ্যাল অফিস। এক দিন ওখানে বসে ইন্টারনেটে কাজ করছি, হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকল মার্টিন, ওর পেছনে মার্ক। তার চোখেও জল, কিন্তু অবিরাম সান্ত্বনা দিয়ে চলেছে মার্টিনকে। কী ব্যাপার? জাঁ-লুক গদার-এর ‘নথ্রে মিউসিক’-এর শো শুরু হওয়ার কথা ছিল পাঁচটায়। সাড়ে ছ’টা বেজে গেছে, প্যারিস থেকে প্রিন্ট এখনও এসে পৌঁছয়নি। দুজনের চোখের জল আর বাঁধ মানতেই চায় না। আমি আস্তে আস্তে উঠে বাইরে বেরিয়ে এলাম, বুঝলাম কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে পারবে না কোনও দিন, সিনেমা ওদের এক অদ্ভুত শেকলে বেঁধে রেখেছে।

প্রায় তিরিশ বছর আগে আমার সঙ্গে হনলুলুতে আলাপ হয়েছিল জেনেট প্যলসন-এর। জেনেট তখন ছিল এয়ারহোস্টেস, কিন্তু প্লেনে উঠলেই ওর কান্না পেত। ভয় নয়, যা করতে চেয়েছিল তা করতে পারছিল না বলে। ও ভালবেসেছিল নাটক আর সিনেমাকে। ওর বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম, ঘর ভর্তি নাটক, কবিতা, সিনেমার বই ও পোস্টার। কিছু দিন পর শুনলাম, এয়ারহোস্টেসের চাকরি ছেড়ে, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে, সিনেমা নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে জেনেট। জেনেটের স্বামী ছিল, মেয়ে ছিল, কিন্তু কী যেন একটা ছিল না। আর ভিলি ছিল ফিজি আইল্যান্ড-এর ছেলে, ওখান থেকে নাটক নিয়ে পড়তে এসেছিল হনলুলুতে। হনলুলু ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম আমিও, যেতেই হয়েছিল বার ছয়-সাত। তত দিনে জেনেট ফেস্টিভ্যালের ডিরেক্টর। বয়স বেড়েছে আমাদের দুজনেরই। জেনেট জানাল, ও বিয়ে করছে ভিলিকে। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে আগেই। ভিলি জেনেটের থেকে ছাব্বিশ বছরের, আর জেনেটের মেয়ের থেকে দু’বছরের ছোট। ভিলি তখন সবে পড়াতে ঢুকেছে ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে, তৈরি করেছে নাটকের দল।

শেষ যে বার হনলুলু গিয়েছিলাম, কয়েকটা দিন ওদের বাড়িতেই ছিলাম। ভিলি পড়াতে চলে গেলে জেনেট আমাকে ওর ভয়ের কথা বলত। ভিলি এত ছোট, এখনও তরতাজা যুবক, যদি অন্য কোনও মেয়ে এসে ওকে নিয়ে চলে যায়! জেনেটের তো বয়স হয়ে গেছে... এক বিকেলে আমি আর ভিলি বেরোলাম ঘুরতে। অনেক দূর এসে একটা গাছ দেখিয়ে ভিলি বলল, জানো, এখানেই আমাদের বিয়ে হয়েছিল, আর এই গাছের তলায় আমরা প্রথম আমাদের নাটক করেছিলাম। এই কয়েক দিন আগে জেনেট ই-মেলে জানাল, একটা সম্পূর্ণ এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করছে ওরা দুজন, যাতে একক অভিব্যক্তির সঙ্গে মিলেমিশে আছে সিনেমার দৃশ্য, শব্দ আর ওদের জীবনের সত্যি কিছু ঘটনা। জেনেটের এখন আর ভয় নেই। স্টেজ ওদের অদ্ভুত এক মায়া আর ভালবাসায় জড়িয়ে রেখেছে, যেখানে বয়স বা অন্য কিছুই কোনও ব্যাপার নয়।

ভালবাসাকে ছুঁয়ে থাকে স্বপ্ন আর স্বপ্নকে ছুঁয়ে থাকে ভালবাসা। যে ভালবাসা, ভালবাসার কাজ ঘিরে দানা বাঁধে, সে সম্পর্কে বিস্ময় থেকে যায় চির কাল। রূপ, সমাজ, শরীর বা অন্য কিছুরই আর দরকার লাগে না।

ভুল বললাম?

অন্য বিষয়গুলি:

Buddhabev Dasgupta Rabibashariya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE