আক্রমণ: রাজস্থানের জয়পুরে পঙ্গপালের ঝাঁক এ ভাবেই ছেয়ে ফেলেছে আকাশ। ছবি: পিটিআই
উফ! পিছনের পা-টা আবার ঘষা খেল পাশেরটার সঙ্গে। পেটটাও ঘষা খাচ্ছে। ভিড় বড্ড বেড়ে গিয়েছে। যে দিকে তাকাও গিজগিজ করছে সবুজ মাথা। খাবারও কমে এসেছে। যে কোনও মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে ঘাড়ে। তার পর ধড় থেকে মুন্ডু ছিঁড়ে খেতে সময় নেবে না। সজাগ থাকতে হবে। দেখতে হবে সামনের জন কী করছে। ওই তো, এগোচ্ছে গুটি গুটি। পিছু নিতে হবে। প্রাণে বাঁচতে হলে মিছিলে পা মেলানোই রীতি। এ বার বোধহয় উড়বে। পিছনে পিলপিল এগিয়ে আসছে সব। এ বার উড়তে হবেই।
‘ক্যানিবালিজ়ম’। খাদ্যাভাবে বা স্বভাববশে স্বজাতির সদস্যদের খেয়ে ফেলা— বিশেষ ধরনের কয়েকটা ঘাসফড়িং প্রজাতির বৈশিষ্ট্য। কোনও এলাকায় এই ধরনের ঘাসফড়িংয়ের সংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে এরা একে অপরকে খেতে শুরু করে। প্রাণ বাঁচাতে প্রত্যেকেই উড়ে পালাতে চায়। এক জন উড়লে, পিছু নেয় এক জন। তাকে দেখে আর এক জন, আরও। ক্রমে তৈরি হয় ঝাঁক বা ‘সোয়ার্ম’। ‘লোকাস্ট সোয়ার্ম’— পঙ্গপালের ঝাঁক।
২০১৮-র শেষ দিকে দক্ষিণ আরবের মরু অঞ্চলে জন্ম নেওয়া পঙ্গপালের এমন একটা ঝাঁক কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে এগোতে এগোতে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পেরিয়েছে সম্প্রতি। রাজস্থান, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশে খেতের পর খেত উজাড় করে দিচ্ছে। কী এই পঙ্গপাল? কেনই বা এরা এ রকম ঝাঁকে ঝাঁকে ওড়ে? এত ফসল খেয়ে নষ্ট করে?
১৮৭৪ সাল। জুলাইয়ের শেষ দিক। আমেরিকার কানসাসে দুপুর রোদে বাড়ির বাইরে কুয়ো থেকে জল তুলছিল বছর বারোর একটা মেয়ে। হঠাৎ তার মনে হল, সূর্যের তেজ যেন ঝিমিয়ে পড়ল ঝুপ করে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কানে এল ভয়ঙ্কর গুঞ্জন। সে চমকে তাকাল আকাশে। মাটি আর আকাশের মধ্যে তখন ধূসর-সবুজ এক চাদর। বেশি ক্ষণ ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ পায়নি সে। আকাশ থেকে তার গায়ে, হাতে পায়ে, কুয়োয়, তার বাড়ির দেওয়ালে, জানলায়, বাগানের বেড়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হাজার হাজার পঙ্গপাল।
পৃথিবী বহু বার পঙ্গপালের আক্রমণের সাক্ষী থেকেছে। প্রাচীন মিশরে ‘ডেজ়ার্ট লোকাস্ট’-এর প্রমাণ পাওয়া যায় কবরের দেওয়ালে আঁকা ছবি থেকে। গ্রিক মহাকাব্য ‘দ্য ইলিয়াড’-এ হোমার পঙ্গপালের উল্লেখ করেছেন। ১৮৭৫ সালে আমেরিকার নেব্রাস্কায় ১১০ মাইল বিস্তৃত, আধ মাইল পুরু ‘রকি মাউন্টেন লোকাস্ট’-এর পরিযাণ দেখেছিলেন নেব্রাস্কার চিকিৎসক ও আবহাওয়াবিদ অ্যালবার্ট চাইল্ড। পরবর্তী কালে সেই পঙ্গপালের পরিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অ্যালবার্ট সোয়ার্ম’। ভারতেও হানা দিয়েছে তিন ধরনের পঙ্গপাল— ‘ডেজ়ার্ট লোকাস্ট’, ‘মাইগ্রেটরি লোকাস্ট’ ও ‘বম্বে লোকাস্ট’। ‘সহজ পাঠ’-এর দ্বিতীয় ভাগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘‘এবার পঙ্গপাল এসে বড়ো ক্ষতি করেছে। ক্ষিতিবাবুর ক্ষেতে একটি ঘাস নেই। অক্ষয়বাবুর বাগানে কপির পাতাগুলো খেয়ে সাঙ্গ ক’রে দিয়েছে। পঙ্গপাল না তাড়াতে পারলে এবার কাজে ভঙ্গ দিতে হবে।’’ ‘পঙ্গপাল’ শব্দের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় নতুন নয়।
‘সোয়ার্মিং বিহেভিয়ার’ বিশেষ কয়েকটি প্রজাতির ঘাসফড়িংয়ের জিনগত বৈশিষ্ট্য। পতঙ্গ গোষ্ঠীর যে কোনও প্রাণীই অনুকূল পরিবেশে খুব কম সময়ের মধ্যে দ্রুত বংশবিস্তার করে। সেই সংখ্যাধিক্যের ভারসাম্য রক্ষায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কিছু বাহ্যিক ও আচরণগত বৈশিষ্ট্যও বিবর্তিত হয়। সেই বৈশিষ্ট্য জিনগত ভাবে সঞ্চারিত হয় পরবর্তী প্রজন্মে। ভিড় বাড়লে বা খাদ্যসঙ্কট দেখা দিলে ‘ক্যানিবাল’ হয়ে ওঠা তেমন একটা বৈশিষ্ট্য। তা এড়াতে ঝাঁক বেঁধে খাদ্যের সন্ধানে ওড়াটাও।
ঝাঁক বাঁধার পদ্ধতি বুঝতে এই পতঙ্গ সম্পর্কে একটা ধারণা হওয়া দরকার। পঙ্গপাল, ঘাসফড়িং বা গঙ্গাফড়িং— তিনটেই কিন্তু একই ধরনের পতঙ্গের বিভিন্ন নাম। তবে সব ঘাসফড়িং বা গঙ্গাফড়িংকেই পঙ্গপাল বলা যায় না। ওই যেমন ছোটবেলায় পড়েছি, ‘সব ক্ষারই ক্ষারক, কিন্তু সকল ক্ষারক ক্ষার নয়’। পতঙ্গ শ্রেণির ‘অ্যাক্রিডিডি’ ফ্যামিলির ছোট শুঁড়বিশিষ্ট কুড়িটির মতো বিশেষ প্রজাতির ঘাসফড়িং, যারা বিশেষ পরিস্থিতিতে ঝাঁক তৈরি করে, তাদের পঙ্গপাল বলা হয়।
ঝাঁকে ঝাঁকে এসে নিমেষে খেতের ফসল সাবাড় করে দেখে মনে হতে পারে, ঝাঁকে থাকাটাই বোধহয় পঙ্গপালের ধর্ম। কিন্তু তা নয়। এরা প্রকৃতিগত ভাবে লাজুক। একা থাকতেই পছন্দ করে। নিতান্ত জৈবিক প্রয়োজন ছাড়া সমগোত্রীয় ঘাসফড়িংয়ের ধারেকাছেও ঘেঁষে না। গায়ের রং সবুজ, হলুদ, বাদামি মেশানো হওয়ায় গাছের পাতায় বা ডালে দিব্যি লুকিয়ে থাকতে পারে। এতে শিকারির হাত থেকে যেমন বাঁচা যায়, তেমনই ‘ক্যানিবালিজ়ম’ এড়াতে ‘সোশ্যাল ডিসস্ট্যান্সিং’ও বজায় রাখা হয়।
তবে শুধু ‘ক্যানিবাল’ হয়ে ওঠাই এই অপ্রয়োজনীয় সংখ্যাধিক্যের একমাত্র ফলাফল নয়। পতঙ্গের ঘনত্ব ঘাসফড়িংয়ের মধ্যে আরও লক্ষণীয় কিছু পরিবর্তন ঘটায়। যেমন, রং, যা ফ্যাকাসে হলুদ-সবুজ থেকে বাদামি ঘেঁষা হয়ে যায়; আকার, যা বড় হয় এবং দেহ শক্তিশালী হয়; মস্তিষ্ক আকারে বাড়ে, মস্তিষ্কে ‘সেরোটোনিন’-এর ক্ষরণ বাড়ে, যার প্রভাব পড়ে আচরণে। যেখানে এরা পরস্পরের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখত, সেখানে অতিরিক্ত সেরোটোনিন-এর প্রভাবে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে চায়। প্রজননের সম্ভাবনা বাড়ে। যদিও তখন জানা থাকে না, এই ‘কাছাকাছি’ এসে ভিড় বাড়ানোই ভবিষ্যতে ‘ক্যানিবাল’ হওয়ার রাস্তা চওড়া করবে।
যাই হোক, এই পরিবর্তিত দশায় এই ঘাসফড়িংদের ‘মেটাবলিক রেট’ও বেড়ে যায়। ফলে আগের চেয়ে এরা খায় অনেক বেশি। শুধু তা-ই নয়, স্বাদ বা পুষ্টিগুণেরও ধার ধারে না। যা পায় খচমচ করে চিবোতে থাকে। আচরণগত এই ধরনের পরিবর্তন ভিড় বাড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রকাশ পেতে পারে ঘাসফড়িংদের মধ্যে। হঠাৎ করেই এরা শান্ত অবস্থা থেকে অস্থির হয়ে ওঠে।
নির্দিষ্ট কিছু পরিবেশগত অবস্থা, যেমন, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, খাদ্যাভাব, জনঘনত্ব ইত্যাদির নিরিখে কিছু কিছু প্রাণীর মধ্যে একাধিক রূপভেদ তৈরি হয়, যাদের বলা হয় ‘ফেনোটাইপিক ফর্ম’। আমরা অনেক সময় এদের ‘সামার ফর্ম’, ‘উইন্টার ফর্ম’ ইত্যাদি বলে থাকি। প্রাণীদের এই একাধিক রূপভেদ থাকার বৈশিষ্ট্যকে ‘ফেনোটাইপিক প্লাস্টিসিটি’ বলা হয়। যে ধরনের ঘাসফড়িং পঙ্গপাল হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে, তাদের মধ্যে এই ‘ফেনোটাইপিক প্লাস্টিসিটি’ দেখা যায়।
এ বার ধরে নেওয়া যাক ‘ডেজ়ার্ট লোকাস্ট’-এর কথা। ‘ডেজ়ার্ট লোকাস্ট’ বা ‘সিস্টোসার্কা গ্রিগেরিয়া’ দক্ষিণ আরব ভূখণ্ডের মরুপ্রায় অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা। রুক্ষ শুষ্ক এলাকায় এমনিতেই গাছপালা কম। তাই সে সব খেয়ে বেঁচে থাকা ঘাসফড়িংয়ের সংখ্যাও কম। এই অবস্থা অবশ্যই ‘সলিটেরিয়াস ফর্ম’-এ থাকার উপযুক্ত।
কিন্তু কী হবে, যদি অবস্থা আরও গুরুতর হয়ে যায়! অর্থাৎ, পরিবেশ যখন আরও রুক্ষ ও শুষ্ক হয়ে ওঠে। তখন জল কমে, তাপমাত্রা বেড়ে যায়। কমে যায় গাছপালার সংখ্যা। এ রকম পরিস্থিতিতে ঘাসফড়িংদের খাদ্যসঙ্কটের সম্ভাবনা দেখা দেয়। তখন খাবারের চাহিদা মেটাতে বেঁচে থাকা গুটিকতক গাছে এসে জড়ো হয় ওরা। পারস্পরিক দূরত্ব কমে, ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ে। মস্তিষ্কে ক্ষরিত হয় অতিরিক্ত সেরোটোনিন। আর ঠিক এমন শুষ্ক রুক্ষ পরিস্থিতির পরে যদি হঠাৎ করে বৃষ্টি হয়, তা হলে তো কথাই নেই। অনুকূল পরিবেশ পেয়ে তখন ঘাসফড়িং প্রজননে মন দেয়। ডিম ফুটে বেরয় নতুন প্রজন্মের অপরিণত ঘাসফড়িং বা ‘নিম্ফ’। তখন তাদের মধ্যেও ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ে। পাশাপাশি থাকা ঘাসফড়িংয়ের পায়ে পায়ে ঘষা লেগে ‘ট্যাকটাইল সিগন্যাল’ পৌঁছতে থাকে ওদের মস্তিষ্কে। ওরা বুঝে যায়, ভিড় খুব বেড়ে গিয়েছে। এ বার এগোতে হবে।
অপ্রাপ্তবয়স্ক ‘নিম্ফ’-দের ডানা থাকে না। তাই এরা উড়তে পারে না। এ দিকে ভিড় বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যসঙ্কট এবং ক্যানিবালিজ়ম-এর ভয় থাকেই। অতএব, সারি সারি নিম্ফ একত্রে তৈরি করে ‘মার্চিং ব্যান্ড’। হাঁটতে থাকে মাইলের পর মাইল। হাঁটার পথে এরা ঘাস, গাছ, খেতের ফসল, যা পায় খেতে থাকে। কারণ খিদে তো তখন তুঙ্গে। এক সময় এই ‘নিম্ফ’ পূর্ণাঙ্গ ঘাসফড়িংয়ে পরিণত হয়, যোগ দেয় ঝাঁকের সঙ্গে। এগিয়ে যায় উষ্ণ বাতাসের অভিমুখ ধরে খাবারের সন্ধানে।
আরব থেকে ইরান, পাকিস্তান হয়ে যে পঙ্গপালের ঝাঁক ভারতে ঢুকেছে, তার সূত্রপাত কিন্তু ২০১৮ সালের মে মাসে। সেই সময় দক্ষিণ আরবীয় মরু অঞ্চলে ধেয়ে এসেছিল সাইক্লোন ‘মেকুনু’। যার জেরে এই অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। রুক্ষ আবহাওয়ার পরে এই অতিবৃষ্টির জেরে এখানকার ‘ডেজ়ার্ট লোকাস্ট’ অতিরিক্ত বংশবৃদ্ধি করে। তার পরে অক্টোবরে ‘লুবান’ সাইক্লোনের জেরে ফের ভারী বৃষ্টি হলে পঙ্গপালের সংখ্যা প্রায় আট হাজার গুণ বেড়ে যায়।
পঙ্গপালের সংখ্যার এই বিস্ফোরণের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের দাবি, বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে ক্রমাগত বাড়তে থাকা মহাসাগরীয় জলতলের উষ্ণতা একাধিক শক্তিশালী সাইক্লোনের জন্ম দিচ্ছে। এ ছাড়া, তাপমাত্রা আর অসময়ে ভারী বৃষ্টিও পঙ্গপালের সংখ্যাধিক্যের সহায়ক। পঙ্গপালের যাত্রাপথে একাধিক বার ভারী বৃষ্টিপাত হলে তাদের সংখ্যাও উত্তরোত্তর বেড়েছে।
বিপদ নাকি এখনও বাকি। হয়তো কোনও ভাবে পঙ্গপালের মিছিল এ যাত্রা রুখে দেওয়া যাবে। কিন্তু শুধু এ বছর নয়, বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে ভারত মহাসাগরে সাইক্লোন ভবিষ্যতেও তৈরি হবে, এবং এ ভাবেই শুষ্ক রুক্ষ ঋতুর পরে প্রবল বৃষ্টি পঙ্গপালের সংখ্যা ফের হু-হু করে বাড়িয়ে দেবে, যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। ওরা হেঁটে যাবে মাঠের পর মাঠ। উড়ে পেরিয়ে যাবে এক পঞ্চমাংশ পৃথিবী। পিছনে পড়ে থাকবে লুণ্ঠন-পরবর্তী শূন্য শস্যভাণ্ডার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy