ছবি: সুমন চৌধুরী
আজও পৃথিবীর বহু দেশ, বহু অঞ্চল তাঁর পদানত, কিন্তু এ জন্য তাঁকে কোনও তরবারি ব্যবহার করতে হয়নি। এই জয় আইডিয়ার জয়, দর্শনের দিগ্বিজয়। পৃথিবীতে এর আগে বহু দিগ্বিজয় হয়েছে, রামচন্দ্র থেকে পঞ্চপাণ্ডব অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়েছেন। কিন্তু মানুষের দুঃখ দূর করার জন্য কাষায় বস্ত্র পরিহিত, মুণ্ডিতমস্তক শ্রমণদের দিগ্বিজয় এই প্রথম। বোধিজ্ঞান লাভের পর পাঁচ শিষ্যকে গোতম বুদ্ধ তাই বলেছিলেন, ‘যাও, মানুষের দুঃখ দূর করতে এ বার তোমরা চার দিকে ছড়িয়ে পড়ো।’ ঋষিপত্তন, মানে আজকের সারনাথে দাঁড়িয়ে এটাই ছিল শিষ্যদের প্রতি তাঁর প্রথম নির্দেশ। অতঃপর দ্বিতীয়: এক দিকে দুজন যেয়ো না। মানে, প্রতিটি দিকই কভার করতে হবে, কিছু বাকি রাখা চলবে না।
এ ভাবেই ছড়াবে তাঁর আইডিয়ার দিগ্বিজয়। এখন নেপালে জন্মালে, তিন দশকের বেশি সময় ধরে বিহার উত্তরপ্রদেশে ঘুরে বেড়ালে, এই দিগ্বিজয়ীর হাতে হয়তো থাকত কালাশনিকভ। কিন্তু তিনি তো সময়ের হাতে বন্দি নন। নইলে তাঁর কয়েক হাজার বছর পরে জন্মেও ভারতের সংবিধান-প্রণেতা অম্বেডকর কেন আশ্রয় খুঁজবেন বৌদ্ধধর্মে? মায়ানমার থেকে তাইল্যান্ড, চিন, জাপান হয়ে ইংল্যান্ড, আমেরিকাতেই বা কেন তিনি হয়ে উঠবেন মানুষের প্রেরণা! শুধু দেশ নয়, কালও সেই দিগ্বিজয়ীর অধীনে।
এমন সে দিগ্বিজয়ের পরাক্রম, এখন হিন্দুধর্ম বলে আমরা যা জানি, তার অনেকটাই তো বৌদ্ধধর্মের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তৈরি! গীতাকে আজকাল হিন্দুদের ‘জাতীয় গ্রন্থ’ বলে গেলানোর চেষ্টা করা হয়। এমনিতে ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত। সেটি যে বুদ্ধের প্রভাবেই তৈরি, জায়গায় জায়গায় ‘কর্মফলতৃষ্ণা’ জাতীয় শব্দের ছড়াছড়ি, আজকের ক্ষুদ্রমস্তিষ্ক হিন্দুরা খেয়াল করে না। গীতার শুরুতে, ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে অর্জুন হিংসা করতে নারাজ, কৃষ্ণ তাঁকে বলছেন, আরে, তুমি ক্ষত্রিয়, স্বধর্মে থাকার জন্য তোমায় হিংসা করতে হবে। এই বারে ভাবুন, অর্জুন এখানে আর কেউই নয়, অশোক। যে সম্রাট ইচ্ছে করলেই যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারেন, কিন্তু প্রাণিহিংসা না-করার শপথ নিয়েছেন। বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে। আর হিন্দুধর্ম তাঁকে বলছে, ওহে অশোক, হিংসা ত্যাগ করলে, রাজ্য ভেসে যাবে। মানে, বৌদ্ধধর্মের চেয়ে হিন্দুধর্ম শ্রেয়, এটা বোঝাতেই, গুপ্তযুগে গীতা সংকলিত হয়েছিল।
পরে, হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান যাঁর হাতে, সেই শঙ্করাচার্য প্রবল বুদ্ধ-বিরোধী হয়েও, কখনও বুদ্ধের তত্ত্বের বাইরে বেরোতে পারলেন না। বোধিবৃক্ষের নীচে বুদ্ধ আকাঙ্ক্ষা বা তৃষ্ণাকেই দুঃখের কারণ জেনেছিলেন। বহু পরে শঙ্করাচার্য তাঁর গীতাভাষ্যেও বৌদ্ধ তৃষ্ণা শব্দটি নিয়ে আসবেন, ‘কর্মফলতৃষ্ণা’ নিয়ে সবাইকে সাবধান করে দেবেন। আরও পরে, গীতগোবিন্দের কবি জয়দেব বুদ্ধকে দশাবতারে ঢুকিয়ে নিলেন। তারও বহু পরে, শিকাগোয় স্বামী বিবেকানন্দ জানালেন, বৌদ্ধধর্ম হিন্দু ধর্মেরই একটি শাখা। বিদ্রোহী সন্তানের সঙ্গে লড়তে না পেরে, জাঁদরেল হিন্দুধর্ম শেষকালে তাকে মেনে নিতে বাধ্য হল। বুদ্ধ না জন্মালে হিন্দুধর্ম আজকের চেহারায় আসে না।
অন্য ধর্মগুরুদের মতো আচারবিচারের নির্দেশ দিয়েই থামেন না গোতম বুদ্ধ। সেটির পিছনে কার্যকারণের দর্শন খোঁজেন। রাজগৃহের গৃধ্রকূট পর্বতে বহু জৈন তপস্বী খর রোদে দাঁড়িয়ে তপস্যা করতেন। পূর্বজন্মের পাপ কৃচ্ছ্রসাধনে ধবংস করছেন তাঁরা। গোতম জিজ্ঞেস করেছিলেন, পূর্বজন্মে তোমরা কী ছিলে? কেমন পাপ করেছিলে? পাপের কতটা নষ্ট হয়েছে, কতটা বাকি আছে? তাঁরা জবাব দিতে পারেননি। পাপকর্ম আর করবেন না, এটুকুই জানেন। গোতম জানালেন অনন্য এক দার্শনিক সিদ্ধান্ত, ‘কর্মমাত্রেই খারাপ নয়। কর্ম মানে মানসিক উদ্দেশ্য।’ হিংসা, চুরি, ব্যাভিচার যদি কুকর্ম হয়, তার বিপরীতে অবিহিংসা, চুরি না করা, অব্যাভিচারের মতো সুকর্মও আছে। কর্ম মানে মানসিক উদ্দেশ্য— কথাটা এর পর মহাকাব্য থেকে হিন্দু নিয়ম, সবেতে ঢুকে পড়বে। মাংসবিক্রেতা ব্যাধও ঋষিকে ধর্ম শিখিয়ে দেবে। পাণ্ডবেরা যতই রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞ করুন, অনুশাসনপর্বে মহাভারত জানাবে, একশো বছর ধরে ফি মাসে অশ্বমেধ যজ্ঞের যে ফল, মাংসাহার ত্যাগ করলেও সে ফল। মনুসংহিতা বলবে: পরদ্রব্যের অভিলাষ, কুপথ অবলম্বন, অন্যের অনিষ্টচিন্তা— এই তিন রকম মানসিক কর্মই পাপ।
সব ব্যাপারে বুদ্ধ ছিলেন মৌলিক চিন্তার প্রবর্তক। সাধনার প্রথম দিকে, গৃধ্রকূট পাহাড়ে সঙ্গীদের সঙ্গে কঠোর তপস্যা করেছেন গোতম। কখনও কাঁটার শয্যায় ঘুমিয়েছেন, গাছের ছাল পরে রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, শ্যামাক ঘাস, শ্যাওলা এবং গোবর খেয়েছেন। কখনও বা দিনে একটা মাত্র তিলের দানা। কৃশ শরীর, মেরুদণ্ড তখন সুতোর গুটির মতো। পেটের চামড়ায় হাত দিলে তা মেরুদণ্ডে গিয়ে ঠেকে। তার পর তাঁর মনে হল, এই তপস্যায় নিজের মোক্ষ হলেও হতে পারে, কিন্তু দুনিয়ার দুঃখ? তাকে তো এ ভাবে বিনাশ করা যাবে না। শরীর সুস্থ না থাকলে, তাকে মানুষের সেবায় লাগানো যাবে কী করে? নৈরঞ্জনা নদীর ধারে সুজাতা নামে এক নারী তাঁকে এক বাটি পায়েস নিবেদন করেছিলেন। গোতম সেই পায়েস খাওয়ার পর সঙ্গীরা তাঁকে ছেড়ে চলে যান, ‘তুমি ভোগী, ধর্মভ্রষ্ট হয়েছ।’ নির্বাণ লাভ করার পর, তিনি সেই পাঁচ সঙ্গীকেই প্রথম তাঁর ধর্মে দীক্ষিত করেন। জানান, দুঃখের কারণ তিনি খুঁজে পেয়েছেন।
তখন, দুঃখের কারণ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন, আত্মাই দুঃখের কারণ। কেউ বা বলেন, আত্মা নয়, নিয়তি। ঈশ্বরের ইচ্ছা। কিংবা পূর্বজন্মের পাপের ফল। শ্রমণ গোতম সে দিন জানালেন, এ সব কিছু নয়। তোমার তৃষ্ণা বা আকাঙ্ক্ষাই দুঃখের কারণ। ধর্মচক্র প্রবর্তন হল। দুনিয়া জানল চারটি আর্যসত্য: দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখ নিবৃত্তি সম্ভব, তার উপায় আছে।
বহু পরে এক ভিক্ষু তাঁকে আক্ষেপ করে বলেছিল, ‘এত দিন সংঘে থাকলাম, এখনও আপনি স্পষ্ট ভাবে জানালেন না, ঈশ্বর আছেন কি নেই।’ তাঁর উত্তর ছিল, ‘মনে করো, বিষাক্ত তিরে বিদ্ধ হয়েছে এক জন। তুমি তাকে ওষুধ খাওয়াতে গেলে। সে বলল, না, তিরটা কোন দিক থেকে এল, কে মারল, সে মোটা না রোগা, ফরসা না কালো, আগে জানতে হবে। তার পর ওষুধ খাব। লোকটি সে ক্ষেত্রে আর বাঁচবে না। তাই ঈশ্বর আছেন কি নেই, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। দুঃখবিদ্ধ লোকটির যন্ত্রণার উপশমই আমার প্রতিপাদ্য।’ ভিক্ষুর ফের প্রশ্ন, ‘তা হলে আপনার ধর্মমত সম্বন্ধে লোকে প্রশ্ন করলে কী বলব? সবই অনিত্য এবং দুঃখ?’ এ বার হাসলেন তিনি, ‘আমি তোমাদের একটা সেতু দিয়েছি। দুঃখের নদী পার হওয়ার জন্য। নদী পেরিয়ে গেলে সেতুটাকে আর মাথায় নিয়ে বইবার দরকার কী?’ নিজের ধর্মমতকেও তিনি নিছক সেতু মনে করেন। এতটা উদার কোনও ধর্মগুরু আছেন, ‘মামেকং শরণং ব্রজ’-র মানচিত্রে?
বুদ্ধ যখন তাঁর ধর্ম প্রচার করছেন, সেই সময় জৈন, আজীবক— অনেক সম্প্রদায়ই অহিংসার কথা বলে। কিন্তু এক-একটি যজ্ঞে তখন পাঁচ-সাতশো পশুবলি দেওয়া হয়, রাজা ও ক্ষমতাবান ব্রাহ্মণরা যজ্ঞে বসলে চাষিদের গরু, বাছুর টেনে নিয়ে যান। ফলে ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছে বিরোধিতা। চার্বাক তো সাফ বলছেন, ‘যজ্ঞে হত পশু যদি স্বর্গে যায়, যজমান নিজের বাবাকে উৎসর্গ করে না কেন?’ কিন্তু অন্য দার্শনিকেরা যা পারেননি, গোতম সেটাই করেছিলেন। বিরোধিতা নয়, বরং অন্তর্ঘাত। তখন তিনি শ্রাবস্তীতে। এক ব্রাহ্মণ পাঁচশো ষাঁড়, হাজারখানেক বাছুর উৎসর্গ করে যজ্ঞের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বললেন, ‘তথাগত, যজ্ঞের জন্য অগ্নি প্রজ্বলন ও যূপকাষ্ঠ স্থাপন মহাফলদায়ক শুনেছি।’ গোতম বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিও তাই শুনেছি।’ ব্রাহ্মণ নিশ্চিন্ত, ‘তা হলে, আপনার সঙ্গে আমার মত তো মিলে গেল।’ গোতম হাসলেন, ‘যজ্ঞের জন্য আগুন জ্বালা ও যূপকাষ্ঠ তৈরি মানে তিনটি অকুশল কর্ম, ব্রাহ্মণ। যজ্ঞের আয়োজন মানে এতগুলি পশু বধ করতে হবে, এই অকুশল চিত্তের অস্ত্র। যখন পশুবধের নির্দেশ দেওয়া হল, উত্তোলিত হল অকুশল বাগাস্ত্র। পরে খড়্গ তোলা তো অকুশল শারীরিক অস্ত্র।’ আর যূপকাষ্ঠের অগ্নি? ‘কামাগ্নি, দ্বেষাগ্নি ও মোহাগ্নি, এই তিনটি অগ্নি সর্বদা বর্জনীয়। বরং পিতামাতাকে অহবনীয় অগ্নি, স্ত্রী-পুত্র-পরিবারকে গার্হপত্য অগ্নি ও শ্রমণদের দক্ষিণাগ্নি ভেবে পুজো করবে।’ এখানেই অন্যদের সঙ্গে তাঁর তফাত। যজ্ঞবিরোধী হয়েও যজ্ঞ করতে বলেন, কিন্তু মানে বদলে দেন। অগ্নিপুজো বাতিল করেন না, তার অন্য তাৎপর্য তৈরি করেন। ভাষায় অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে অন্য অর্থ নিয়ে এসে ভাবনার জগতে বিপ্লব আনেন।
তাঁর ধর্মে তাই ধূপদীপ জ্বালানো বা যোগসাধনার চেয়ে চিন্তার গুরুত্বই বেশি। যুধিষ্ঠিরের মতো তিনি ধর্ম বলতে নীতির কথা ভাবেন না, ‘যা ধারণ করে তাই ধর্ম।’ ধর্ম নয় শাশ্বত কোনও ধারণী। তিনি যে কোনও চিরন্তনতারই বিরোধী। তিনি বলেন, এক জন মানুষ তো পরমুহূর্তেই অন্য মানুষ। পৃথিবীতে সব কিছুই কোনও কারণে উৎপন্ন হয়, কিছু ক্ষণ থেকেই বিনষ্ট হয়। ধর্মও তা-ই।
জীবনের শেষ রাতে, গায়ে জ্বর, পেটে প্রবল ব্যথা। কুশীনগর অবধিও সে দিন আসতে পারছিলেন না তিনি, হিরণাবতী নদীর তীরে গাছের নীচে বসে পড়েছিল আশি বছরের অশক্ত শরীর। শিষ্য আনন্দ জল নিয়ে আসার পর বললেন, কুশীনারার মল্লদের খবর দাও। রাতে সুগত মহাপরিনির্বাণে যাবেন। কিন্তু কুশীনগরের সামান্য শালবন! সে কি হতে পারে তথাগতর মহাপরিনির্বাণের যোগ্য স্থান? আনন্দ বললেন, রাজগৃহ, কোশাম্বী, শ্রাবস্তীর মতো ছ’টি মহানগর কাছাকাছিই রয়েছে। গোতম বুদ্ধ বললেন, অতীতে শালজঙ্গলের এই কুশীনগর ছিল সমৃদ্ধ এক ধনাঢ্য রাজ্য। এর আগে সাত জন্মে তিনি পরিনির্বাণের জন্য এই জায়গাটি বেছে নিয়েছিলেন। এ বারেও তার ব্যত্যয় হবে না। শিষ্যরা বুঝে গেলেন, আজ যা মহানগর, আগামী কাল তা-ই হতে পারে পরিত্যক্ত জঙ্গল। জগতে কিছুই নয় শাশ্বত সত্য।
তাঁর শেষ উপদেশও এই রকম। আনন্দরা প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার শেষ উপদেশ? তথাগত হেসে বলেছিলেন, ‘সবই জানিয়েছি। আমি কি সেই রকম শিক্ষক আনন্দ, যে অন্যদের তত্ত্ব না জানিয়ে নিজের মুঠোয় লুকিয়ে রাখব?’ রসিকতাবোধে তিনি বরাবরই উজ্জ্বল। দুই তরুণ শ্রমণ এক বার তাঁকে এসে জানাল, ভিক্ষা নিতে যাওয়ার সময় ব্রাহ্মণরা তাদের খুব গালি দিচ্ছে। যে ব্রাহ্মণ ব্রহ্মার মুখ থেকে সৃষ্ট, তারা সেই ব্রাহ্মণবংশে জন্মেও বংশের মুখে কালি দিয়ে শ্রমণ গোতমের সংঘে ঢুকেছে! সব শুনে তথাগতের উত্তর, ‘সে কী! ব্রহ্মার মুখ থেকে? তুমি জানো না, ওরা নারীর গর্ভে জন্মায়! রজস্বলা হয়, গর্ভবতী হয়, সন্তানের জন্ম দেয় এবং অসুস্থ হয় এমন নারী!’
রসিকতায় হেসে উঠেছে সবাই। গুরু তার পরেই বললেন, ‘কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে, আমরা শাক্যপুত্র। তথাগতের মুখ থেকে জন্মেছি, ধম্মে উৎপন্ন হয়েছি, ধম্মের উত্তরসূরি হিসেবে সৃষ্টি হয়েছি।’ রসিকতার মাধ্যমেই দুটি জরুরি কাজ সেরে ফেললেন তিনি। প্রথম, বৈদিক ধর্মে অন্তর্ঘাত। ঋগ্বেদে পুরুষসূক্ত নামে বিখ্যাত একটি সূত্র রয়েছে। সেই বিশাল হিরণ্যপুরুষকে যজ্ঞে বলি দেওয়া হল, তার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য ও পদতল থেকে শূদ্রের জন্ম হল। তথাগত বুঝিয়ে দিলেন, ওই রকম পুরুষ কেউ নেই। ধম্ম বা ধর্মেই উৎপন্ন হয় মানবসন্তান। দ্বিতীয়, সংঘকে বেঁধে ফেললেন এক পরিবারে। সকলেই তাঁর সন্তান: শাক্যপুত্র।
শেষ সন্ধ্যায় প্রায় পাঁচশো শ্রমণ, গৃহস্থ জড়ো হয়েছে। তথাগতের প্রশ্ন: তোমাদের কোনও সংশয়? কোনও জিজ্ঞাস্য? সকলে নীরব। ফের প্রশ্ন: ‘তথাগতকে জিজ্ঞাস্য নেই বুঝলাম। শিক্ষকের কাছেও প্রশ্ন নেই। কিন্তু বন্ধুর কাছেও আর কিছু জানার নেই?’ দুনিয়ার একমাত্র ধর্মপ্রবক্তা, যিনি সেই সন্ধ্যায় গুরুশিষ্য পরম্পরার বাইরে শিষ্যদের স্বীকার করে নিলেন বন্ধু হিসেবে।
এমনকী তাঁর শেষ বাক্যেও থাকল না শিষ্যদের প্রতি সরাসরি কোনও উপদেশ। শুধু বললেন, ‘সংস্কারমাত্রেই অনিত্য। উৎপত্তির পরই ক্ষয় হয় এবং বিনষ্ট হয়।’ এখনও শ্রীলঙ্কায় কোনও ভিক্ষু মারা গেলে তাঁর শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণপত্রে প্রথমেই লেখা থাকে: সংস্কারমাত্রেই অনিত্য।
তাঁর জন্ম, মৃত্যু দুইয়েতেই গণতন্ত্রের আশ্চর্য সমাপতন! ভারতের মানচিত্রে তার আগে ছিল ১৬টি গণরাজ্য। সেখানে প্রবীণ নাগরিকেরাই আলাপ-আলোচনায় নির্ধারণ করতেন, কে হবে রাজা। কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার আগে রাজা সহনাগরিকদের সঙ্গে পরামর্শে বসতেন। তথাকথিত এই গণতন্ত্রের তখন শেষ দশা। প্রজারা মেনে নিচ্ছে রাজতন্ত্রের একাধিপত্য। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে অজাতশত্রুর এক মন্ত্রী গোতমের কাছে হাজির। রাজা বজ্জীদের রাজ্যজয়ে যাবেন, এখন কি সময় প্রশস্ত? সরাসরি উত্তর দিলেন না গোতম। বরং আনন্দকে বললেন, ‘হ্যাঁ গো, বজ্জীরা এখনও নিজেরা মিলিত হয়? নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালায়? মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে না তো? বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করে?’ প্রতিটি উত্তরেই হ্যাঁ। তথাগত জানালেন, বজ্জীরা যত দিন এই সব নিয়ম মানবে, কেউ তাদের পরাস্ত করতে পারবে না। তার পরের সুত্তেই আনন্দকে ডেকে জানালেন, তাঁর মৃত্যুর পর সংঘের নেতা কাউকে স্থির করলেন না। ভিক্ষুরা যেন মাসে নির্দিষ্ট দুটি দিনে জড়ো হয়, কোনও অন্যায় করলে সেখানে সকলের সামনে স্বীকার করে। এই বৌদ্ধ বিনয়েরই নাম পাতিমোক্ষ। গণরাজ্যের নাভিশ্বাসের দিনেও তিনি সংঘে ঢুকিয়ে দেন গণতান্ত্রিক নিয়ম।
এই গণতান্ত্রিক চেতনা থেকেই তিনি ভিক্ষুদের আচারবিচারের নির্দেশ বারংবার বদলে দেন। তাঁরই তৈরি নিয়ম, ১৫ বছর বয়সের আগে কেউ সংঘে আসতে পারবে না। রাজগৃহে এক পরিবার মড়কে উজাড়। পরিচিত ভিক্ষুদের আসতে দেখে ক্ষুধার্ত দুই অনাথ শিশু ছুটে এল। ভিক্ষুরা জানালেন, তোমাদের সংঘে নেওয়া বারণ। তথাগত সব শুনে বললেন, হুশ হুশ করে কাক তাড়াতে পারে? তা হলে সংঘে নিয়ে নাও।
প্রব্রজ্যা নেওয়া দুই শ্রাবক এক রাতে সমকামিতায় লিপ্ত। পরের দিনই তথাগতের নিয়ম, এক জন ভিক্ষু দুই কিশোর শ্রাবককে রাখতে পারবে না। কয়েক বছর পর সারিপুত্তকে এক গরিব পরিবার ধরে পড়ল। তাদের পুত্রটিকে সংঘে নিয়ে ভিক্ষু করা হোক। খেতে-পরতে পাবে, শিক্ষাও পাবে। সারিপুত্তের অধীনে তখন এক কিশোর শ্রাবক... রাহুল! তিনি সমস্যাটা নিবেদন করলেন। তথাগত নিজের নিয়ম বদলে দিলেন, ‘না, ওটি ঠিক হয়নি। এক জন দক্ষ শ্রমণ যত জন শ্রাবককে শিক্ষিত করতে পারে, তত জনকেই নিতে পারে।’
বোধিজ্ঞানের পর ধর্মপ্রচারের শুরুতে তাঁর নিয়ম, সারা বছর ভিক্ষুরা লোককে ধর্ম বোঝাবেন। চাষিরা এসে বললে, বর্ষাকালে তারা সদ্য ধান রোপণ করে। ভিক্ষুদের যাতায়াতের ফলে সেগুলি নষ্ট হয়। সে দিন থেকেই সংঘে শুরু হল ‘বর্ষাবাস’। বর্ষাকালে নয় কোনও ধর্মপ্রচার। শেষ রাতে গোতম বলেছিলেন, ‘আনন্দ, আমার মৃত্যুর পর সংঘ ইচ্ছা করলে কিন্তু ছোটখাটো নিয়মগুলি বদলাতে পারে।’ মানে, আমি প্রবক্তা হই আর যা-ই হই, চূড়ান্ত নিয়ম কিছু হয় না। আজকালকার সমাজতান্ত্রিক সংঘগুরুরাও আদপে ভাবতে পারেন এ সব কথা?
বৈশালী নগরে গণিকা আম্রপালী ভিক্ষুদের আহারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সংঘকে সে দিনই তাঁর উপবনটি দান করবেন তিনি। সঙ্গী শ্রমণরা জিজ্ঞেস করেছিল, এত পুণ্যকর্ম সত্ত্বেও কেন আম্রপালী নগরনটী? সিদ্ধার্থ জানিয়েছিলেন, বহু জন্ম আগে টগরশিখী বুদ্ধকে ধনরত্ন দান করেও মনে মনে বিরক্ত হয়েছিলেন আম্রপালী। এটি সেই অকুশল কর্মের ফল। এ ভাবেই গোতম জন্মান্তরের বিভিন্ন গল্প দিয়ে বোঝান, তিনিই এক এবং একমাত্র বুদ্ধ নন। আগে কখনও এসেছেন টগরশিখী, কখনও দীপঙ্কর বুদ্ধ। আর তিনি সিদ্ধার্থ কখনও জন্মেছেন ক্ষত্রিয়, কখনও বণিক কুলে। কখনও বানর বা হাতি হিসেবেও। কিন্তু প্রতিটি জন্মেই মৈত্রী, করুণা ও বহুবিধ পুণ্যকর্ম চেষ্টা করেছেন। তার ফলেই এই জন্মে বুদ্ধত্ব। জরথ্রুস্ত্র বা শ্রীকৃষ্ণ এক জনই। ঈশ্বরপুত্র যিশুখ্রিস্ট বা পয়গম্বর মহম্মদও এক জন। কিন্তু গোতম গত জন্মের জাতক-কাহিনি বলে ভক্তদের বুঝিয়েছিলেন, দুনিয়ায় মানুষ থেকে গরুঘোড়া, পোকামাকড় সকলেই বুদ্ধত্ব অর্জনের চেষ্টা করতে পারে। বুদ্ধ কোনও নাম নয়, একটি উপাধি মাত্র।
শেষ রাতে, পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। পাবা গ্রামে চুন্দ কর্মকারের বাড়িতে তৃপ্তি সহকারে শুয়োরের মাংস খেয়ে বলেছিলেন, ‘কাউকে দিয়ো না। বাকিটা মাটিতে পুঁতে ফেলো। তথাগতর পরিনির্বাণের কারণস্বরূপ এই মাংস অন্যদের সহ্য হবে না।’ মাংসভক্ষণ নিয়েই সংঘে জ্ঞাতিভাই দেবদত্তের সঙ্গে তাঁর একদা বিরোধ ঘটেছিল। দেবদত্ত বলেছিলেন, আপনি অহিংসার কথা বলেন, অথচ শ্রমণেরা ভিক্ষায় মাংস পেলে গপগপিয়ে খায়। বন্ধ করুন এটি। গোতম বলেছিলেন, করা যাবে না। তাঁর যুক্তি ছিল, অহিংসা নয়, তিনি অবিহিংসার কথা বলেন। হিংসার অভাবাত্মক ভাব। যজ্ঞে পাঁচ-সাতশো গরু ভেড়া উৎসর্গ বন্ধই আসল। বাজারে কে মাংস বেচছে, কে কিনে খাচ্ছে— সেটি নয়।
এখানেই জৈন পার্শ্বনাথ, মহাবীরদের সঙ্গে তাঁর তফাত। জৈনরা তুমুল অহিংস, পোকামাকড়েরও যাতে অনিষ্ট না হয়, মুখে কাপড় বেঁধে রাখেন। শস্য কাটতে গেলেও জীবের মৃত্যু হয় দেখে কৃষিকাজেও উৎসাহ দেন না। গোতম বাড়াবাড়িটা করেন না, তিনি সবেতেই ‘মজ্ঝিম পন্থা’য় বিশ্বাসী। সমসাময়িক জৈন ধর্মের বদলে গোতম বুদ্ধের ধর্ম কেন ভারত ছাড়িয়ে মায়ানমার, চিন, ভিয়েতনাম থেকে আফগানিস্তান অবধি ছড়িয়ে পড়ে, তার অন্যতম হেতু এটিই। স্থানীয় খাদ্যাভ্যাসে, আচারবিচারে সে বাধা দেয় না।
শেষ রাতে, পরিব্রাজক শ্রমণ ও গৃহী উপাসকেরা বুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কোথায় যাওয়া উচিত। তিনি বলেছিলেন, তথাগতের জন্মস্থান লুম্বিনী, বোধিস্থান বুদ্ধগয়া ও পরিনির্বাণের এই কুশীনগর। ব্রাহ্মণ্য ধর্মে এর আগে ছিল অন্য আইডিয়া। গৃহস্থকে ফি সন্ধ্যায় ঘরে অগ্নিপুজো করতে হবে। অঋণী, অপ্রবাসী ব্যক্তিই তাই সুখী। সুগত তাঁর স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলি যে ভাবে দেখতে বললেন, হিন্দুধর্ম পেল নতুন ভাবনা— তীর্থদর্শন।
বুদ্ধ শায়িত, কিছু ক্ষণ পরেই তাঁর এই জন্মের শেষ হবে, বাইরে উচ্চস্বরে কথাবার্তা। আনন্দের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছেন তিনি, ‘ওঁকে আজ আর বিরক্ত করবেন না।’ সুভদ্র এসে গিয়েছে? তথাগত জানেন, পরিব্রাজক সুভদ্র আজই আসবেন। তিনি বৌদ্ধ নন, কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা রয়েছে। ‘আনন্দ, ওঁকে আসতে দাও,’ বললেন তিনি।
সুভদ্র এলেন, তাঁর জিজ্ঞাসা, ‘আপনার সমসাময়িক কিন্তু বৌদ্ধ মত স্বীকার করেন না— এ রকম দার্শনিকেরা কি জানতে পেরেছেন সত্যকে?’
পরচর্চার অবকাশ প্রথমেই থামিয়ে দিলেন গোতম, ‘স্বীয় মত অনুযায়ী তাঁরা কেউ হয়তো জেনেছেন, কেউ বা জানেননি। সুভদ্র, তোমাকে ধর্মদেশনা করি। মানুষের দুঃখ দূর করার জন্য চারটে আর্যসত্য, আর সম্যক দৃষ্টি, সঠিক সংকল্প, সঠিক বচন, সঠিক কর্ম, সঠিক সমাধি, সঠিক স্মৃতি ইত্যাদি অষ্টাঙ্গিক মার্গের বাইরে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির কোনও শ্রমণ নেই।’
অশ্বমেধের ঘোড়া না ছুটিয়েও তাঁর চিন্তাভাবনার দিগ্বিজয় নিয়ে শেষ মুহূর্ত অবধি আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ছিলেন শাক্য রাজকুমার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy