গুরু: চেয়ারে বসে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। (দাঁড়িয়ে) বাঁ দিকে গোপাল হালদার ও বিভূতিভূষণ
আপনি বলছেন হালদার আপনার কাছে গবেষণায় নিযুক্ত, আমাদের রেকর্ড বলে, সে অন্য রকম কাজেই ছিল ব্যস্ত।’’ জেলে বন্দি ছাত্রের সঙ্গে সাক্ষাতের আবেদন করতে গিয়ে ইংরেজ গোয়েন্দা দফতরের কর্তাদের কাছে এমন কথা শুনতে হল মাস্টারমশাইকে।
মেনে নিতে পারলেন না ছাত্রটি। মাস্টারমশাইকে বললেন, ‘‘আপনাকে ওরূপ কথা ওরা শোনায়, এ আমার ভালো লাগে না।’’ শুনে অল্প হাসলেন মাস্টারমশাই। বললেন, ‘সে আমি বুঝব। আপনাকে ভাবতে হবে না।’’ আসলে ছাত্রের সঙ্গে দেখা করাটা তাঁর অত্যন্ত দরকার। তাঁরই অধীনে ছাত্রটি গবেষণা করছে যে! বিষয় ‘বিক্রমপুরের উপভাষা’।
সময়টা ১৯৩০-এর কাছাকাছি। উত্তাল জনজীবন। এক দিকে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ডাক দিয়েছেন আইন অমান্য আন্দোলনের। উলটো দিকে দানা বাঁধছে বিপ্লবী ও বামপন্থী আন্দোলন। এমন অস্থির সময়ের ছোঁয়া লেগেছে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের কৃতী ছাত্রটিও জড়িয়ে পড়লেন আন্দোলনে। গবেষণার বদলে ছাত্রের মন তখন মাঠে-ময়দানে, বিপ্লবে।
তত দিনে ছাত্রটি ‘বোমার আসামী’ হিসেবেও ‘নাম’ কুড়িয়েছে গোয়েন্দা দফতরে। লক-আপ বাসের অভিজ্ঞতাও হয়েছে।
১৯৩২, প্রায় ছ’বছরের জন্য ছাত্রটিকে কারাবাসে পাঠাল ইংরেজ সরকার। অসহনীয় অবস্থায় দিন কাটে শিক্ষিত তরুণটির। দু’চারটে খবরের কাগজ ছাড়া আর কিছুই প্রেসিডেন্সি জেলের লৌহকপাট ভেদ করে আসে না। এলেও বিস্তর কাটছাঁটের পর। জেল কর্তৃপক্ষের কড়া নিয়ম, আত্মীয় ছাড়া কেউ দেখা করতে পারবেন না। কিন্তু মাস্টারমশাই সে নিয়ম মানেন না। সরকার বাহাদুর এবং জেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিলেন, ‘‘ও আমার ছাত্র। গবেষণার প্রয়োজনেই আমার সঙ্গে দেখা করা দরকার।’’
অনুমতি মিলল। চিঠি চালাচালি ও প্রয়োজনীয় রাশি রাশি বই আসতে লাগল জেলখানায়। কিন্তু বন্দি ছাত্রটি ব্রিটিশের সরকারি খাতায় ‘সুবিধার’ লোক নন, তাই তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল আলিপুরদুয়ার, বক্সা জেলে। সঙ্গী হল মাস্টারমশাইয়ের পাঠানো বই, চিঠিপত্রগুলি। ইলিয়ড, ওডিসি, রামায়ণ থেকে আরব্য উপন্যাস, কী নেই বইয়ের তালিকায়! এমনকী ও’ হেনরির গল্পও।
ছাত্রটি গোপাল হালদার। শিক্ষক, আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
সুনীতিবাবুর পাঠানো চিঠিগুলিই মুক্ত-জীবনের আস্বাদ এনে দিল ছাত্রের কাছে। কারণ, সুকিয়াস রো-র বাড়ি থেকে পাঠানো স্যরের চিঠিগুলি যে শুধু নীরস গবেষণা সংক্রান্ত নয়। সেখানে লেখা গোপালবাবুর পরিবারের খুঁটিনাটি কথাও, যাতে তিনি দুশ্চিন্তা না করেন। সুনীতিবাবু এটা করেছিলেন নিজে থেকেই। চিঠি আর বইপত্রের সঙ্গে তিনি গুঁজে দিতে থাকলেন নিজের লেখা গবেষণা প্রবন্ধগুলির ‘অফ-প্রিন্ট’ও।
তবে শুধু অক্ষর-শৃঙ্খলে কী আর মন ভরে! সুনীতিবাবু ঠিক করলেন, ছাত্রের সঙ্গে দেখা করতে হবে। সুযোগ মিলেছিল, সম্ভবত তিন বার। বক্সায় থাকাকালীন দু’বার অসুস্থ হয়ে পড়েন গোপাল। চিকিৎসার প্রয়োজনে আনা হল প্রেসিডেন্সি জেলে। দু’বারই ইংরেজ গোয়েন্দাদের উপস্থিতিতে আধ ঘণ্টা ছাত্রের সঙ্গে আড্ডা দিলেন সুনীতিবাবু। দু’বারই ভাষাতত্ত্বের বদলে আলোচনা হল সংস্কৃতির নানা গল্প। সে আড্ডায় থাকত চিনা দেবতার প্রসঙ্গ থেকে ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’, সব কিছুই। ছাত্রের প্রতি এমনই টান শিক্ষকের, বন্দিদশাতেই ছাত্রকে বালিগঞ্জে নিজের নতুন বাড়ি ‘সুধর্মা’ দেখাবেন বলে ঠিক করলেন। অনুমতি আদায়ের পরে পুলিশি পাহারায় ছাত্র গেলেন মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক যে কোনও রাজনৈতিক দর্শনের উপরে ভিত্তি করে তৈরি হয় না, এই দু’জনের জীবন সে কথাই শিখিয়ে গিয়েছে। কারণ, গোপাল হালদার যে রাজনৈতিক দর্শনকে লালন করেছেন, সুনীতিবাবুর হয়তো তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছিল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy