ঐতিহ্য: ন'গাজী মাজারে হিন্দু খাদিম গুড্ডু। ছবি: গৌতম চক্রবর্তী।
গত মঙ্গলবার লোকসভা ভোটের ফল বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল তাঁকে। অযোধ্যার অন্ধকার মাঠে শুয়ে-থাকা বড়ি বুয়াকে। তার আগের সপ্তাহেই শ্রীরামজন্মভূমি মন্দির দেখতে অযোধ্যা গিয়েছিলাম যে! জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম মঙ্গলবার সেখানে ‘বড়া মঙ্গল’ উৎসব। স্থানীয় লোকবিশ্বাস, সে দিনই হনুমান প্রথম শ্রীরামচন্দ্রের দর্শন পেয়েছিলেন। লোকবিশ্বাস কি আর একটা? তার আগে, সোমবার সন্ধ্যায় বড়ি বুয়ার দরগা আরও বেশি চমকে দিল আমাকে।
বড়ি বুয়া আসলে মধ্যযুগের এক জন সুফি সাধিকা। অসামান্যা সুন্দরী, আসল নাম ছিল রহমতুল্লা বিবি। তাঁর দাদা শেখ নাসিরুদ্দিন, ‘চিরাগ-ই-দিল্লি’ খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার অন্যতম শিষ্য। ভাই, বোন দু’জনের জন্মই অযোধ্যায়।
দাদা দিল্লির সুফি দরবারে চলে গেলেন, মাঝে মাঝে বাড়ি আসতেন। বোন পড়ে রইলেন অযোধ্যায়। তিনিও সুফি সাধিকা। ইসলামিক সুফি ধর্মে হিন্দু-মুসলমান বিবাদ নেই। তাঁরা ভক্তির আবেশে বিহ্বল হয়ে গান করেন, কবিতা লেখেন। গোঁড়া শরিয়তি মুসলমানরা তাঁদের তাই পছন্দ করেন না।
কিন্ত সুন্দরী মহিলার প্রেমিক থাকবে না, তা কি হয়? একাধিক পুরুষ রহমতুল্লা বিবির কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল। তিনি সবাইকে ফিরিয়ে দিলেন। বিয়ে নয়, সাধনাতেই জীবন কাটাবেন তিনি। শেষ অবধি প্রস্তাব পাঠালেন অযোধ্যার কোতোয়াল স্বয়ং।
সবাইকে ফেরত পাঠানো যায়, কিন্তু কোতোয়াল বা শহরের পুলিশ সুপার? তাঁকে কী ভাবে ফেরাবেন বিবি? রমণী জানালেন, কোনও বার্তাবাহক নয়, তিনি সরাসরি কোতোয়ালের সঙ্গে কথা বলতে চান।
কোতোয়াল পরদিনই হাজির, বিবি প্রশ্ন করলেন, ‘আমাকে কেন বিয়ে করতে চান?’ কোতোয়াল জানালেন, তিনি বুয়ার দুই ডাগর চোখের প্রেমে পাগল। সাধিকা অন্দরে চলে গেলেন, ছুরি দিয়ে নিজের দুই চোখ উপড়ে কোতোয়ালের হাতে এনে দিলেন। কোতোয়াল বুঝলেন, ইনি কোনও সামান্যা নারী নন। বুয়ার পায়ে লুটিয়ে ক্ষমা চাইলেন। বুয়া সটান বলে দিলেন, ‘ইহাঁ না রহেগা আলিম, না রহেগা জালিম।’ মানে, এই শহরে কোনও বিদ্বান থাকবে না, অত্যাচারীও থাকবে না।
টোটোওয়ালা জানাল, অযোধ্যা থেকে ফৈজাবাদ যাওয়ার পথে বেণীগঞ্জে সেই দরগা। যেতে যেতে বড় রাস্তার পাশেই তাজিয়া বিসর্জনের কারবালা বা শহিদ-প্রান্তর। অন্ধকারে নিঃসঙ্গ কবরখানা। লাগোয়া রাস্তাটি আলো ও পথচারীদের হাঁকডাকে উজ্জ্বল। ‘আলো-অন্ধকারে যাই— মাথার ভিতরে/ স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে’— লিখেছিলেন না জীবনানন্দ!
সেই শুনশান কারবালা থেকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। কার্তিক মাসে অযোধ্যা-ফৈজাবাদে হিন্দুরা যে রাস্তায় পঞ্চকোশী পরিক্রমা করেন, সেখানেই অন্ধকার মাঠ। অদূরে ছোট্ট এক মাজার, আলো জ্বলছে সেখানে। বড়ি বুয়ার কবর ঘিরে বসে আছেন মহিলারা। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে! শিশুর গোঙানি। অসুস্থ শিশুকে কোলে শুইয়ে, মাথায় ঘোমটা টেনে দোয়া মাগছেন পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের গোন্ড শহর থেকে আসা নীতা মৌর্য ও তাঁর সঙ্গিনীরা। মৌর্য মানে এখানকার জাতপাতের সিঁড়িভাঙা অঙ্কে অন্ত্যজ হিন্দু। সেরে উঠবে তো? জানতে চাইতেই এক দেহাতি মহিলা নীরবতার ইশারা করলেন। ছবি তুলতেও বারণ করলেন। রাম-সীতার দরবার নয়, এই দরগাই বিপদে-আপদে অযোধ্যার দেহাতি মহিলাদের আশ্রয়।
মাজারের সামনের মাঠে তিনটি বড় কবর। জানা গেল, তিনটিই চিস্তি সিলসিলার সাধকদের। শেখ জইনুদ্দিন আলি আওধি, শেখ ফতেউল্লা আলি আওধি ও আল্লাম্মা কামালউদ্দিন আওধি। আওধ বা অযোধ্যা যে কত সুফি সাধকের জন্ম দিয়েছে, এই নামগুলিই তার প্রমাণ।
আর মাজার? নতুন চকচকে মার্বেল, দরজায় সবুজ গ্রিল। জানা গেল, বড়ি বুয়ার কবরের ঘরে সমস্ত মার্বেল লাগিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় ই-রিকশার ডিলার সতীশ সিংহ ঠাকুর। বারান্দার টাইলস দিয়েছেন সুলতানপুরের ডাক্তার পটেল।
গল্প এখানেই শেষ নয়। আগে এই দরগা ছিল বেশ ক্ষতিগ্রস্ত ও লজঝড়ে। ১৯৭৩ সালে দরগা মেরামত করে এই শক্তপোক্ত কাঠামো তৈরি করে দিয়েছিলেন বৈষ্ণব গোকুল ভবন মঠের পীঠাধীশ্বর রামমঙ্গল দাস। ‘শুধু ওখানে কেন? আমরা মহারাজজির সঙ্গে অন্য দরগাও পরিষ্কারে হাত লাগাতাম,’ জানালেন রামমঙ্গলের শিষ্য, বর্তমান পীঠাধীশ্বর পরশুরাম দাস। অযোধ্যা মানে শুধু রাম জন্মভূমি বনাম বাবরি মসজিদ নয়। তার বাইরেও অনেক কিছু। আমাদের ক্ষীণদৃষ্টি দেখতে পায় না।
হিন্দু সন্ন্যাসী মুসলিম মাজারে সাহায্য করতে গেলেন কেন? স্বর্ণেন্দু দত্ত তাঁর ‘অযোধ্যার বিনির্মাণ’ বইয়ে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত, রামমঙ্গল দাসের লেখা হিন্দি বই থেকে জানিয়েছেন, পার্থিব সময়ের সীমারেখা ভেঙে মধ্যযুগের ওই সন্ন্যাসিনী এবং অনেক সুফি পীরের সঙ্গে তাঁর ধ্যানে কথা হত। মরমি আধ্যাত্মিকতাও অনেক সময় সম্প্রীতির সন্ধান দেয়, হিংসার রাজনীতি পারে না।
সম্প্রীতির আর এক নাম কি গুড্ডু? অযোধ্যার প্রশস্ত রামপথে কোতোয়ালি থানার পাশের গলি দিয়ে এগোলেই ন’গজী মাজার। সকালবেলায় যাওয়া গেল সেখানে। সবুজ চাদরে ঢাকা নয় গজ লম্বা বিশাল এক কবর। মানুষ এত লম্বা হয়? কেউ বলেন, হজরত নু আসলে নোয়া। বিশাল চেহারায় প্রলয়পয়োধিজলে নৌকো ভাসিয়ে জীবজগৎকে বাঁচিয়েছিলেন। হাজার বছরের বেশি সময় জীবিত ছিলেন। সে অবশ্য রামচন্দ্রও নাকি রাবণ বধের পর কয়েক হাজার বছর অযোধ্যায় রাজত্ব করেছিলেন!
মাজারের খাদিম সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারীদের মতো সাদা ধুতি, কুর্তা, উড়নিশোভিত। জানালেন, তাঁর নাম গুড্ডু। বললেন, ‘আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু হিন্দু।’ আমি হতবাক, আপনার গুরু? ‘মহম্মদ আক্রম। উনিই এখানকার খাদিম ছিলেন। মৃত্যুর আগে আমাকে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন।’ আপনি না হিন্দু? ‘তাতে কী? মাজারের সেবা করার ভাগ্য ক’ জন পায় বলুন?’ গুড্ডু হাসলেন। জানালেন, ১৮ বছর ধরে এখানে আছেন। রোজ দুপুরে প্রায় এক-দেড়শো লোককে নিখরচায় খাওয়ানো হয়। পুরি-সব্জি, চাল-ডাল বা বাটিচোখা। সবই নিরামিষ। রান্না করেন হিন্দুসন্তান ললিত, সন্তোষরা। সন্তানের অসুখ থেকে গৃহপ্রবেশ, নতুন বিয়ের পর আশীর্বাদ নিতে অনেক হিন্দুসন্তানই জনপ্রিয় এই মাজারে আসেন।
শেষ অবধি মুসলমানের মাজার? সন্তোষের জবাব, ‘এই যে এখানকার মন্দিরে মন্দিরে এত ফুল, বেলপাতা, তুলসীপাতা— সে সব মুসলমানদের বাগান থেকেই আসে। কেউ বলে না তো, মুসলমানের ফুল নেব না। কোরান সব পয়গম্বরকে শ্রদ্ধা করতে বলেছে। রামচন্দ্রও তো পয়গম্বর।’ শুনলাম, রোজকার লোক খাওয়ানোটাও ভক্তদের দানে। সরকারি সাহায্য মেলে না।
ভোরের শেষ চমকটা ছিল সরযূর ধারে নাগেশ্বরনাথ মন্দিরের কাছে। লোকবিশ্বাস, এটি রামচন্দ্রের ছেলে কুশের তৈরি মন্দির। অনেকটা মহাভারতের অর্জুন-উলুপীর মতো গল্প। কুশ নদীতে স্নানে নেমেছেন, পরমাসুন্দরী এক নাগকন্যা তাঁকে টেনে পাতালে নিয়ে গেল। কুশ মহাদেবের নাম জপতে জপতে ছাড়া পেলেন, তার পর মর্ত্যধামে ফিরে সরযূর ধারে এই মন্দির বানালেন।
মন্দিরের পিছল সিঁড়িতে ভিড়ের ধাক্কাধাক্কি। আকন্দর মালা, অপরাজিতা ফুল, ছোট দুধের পাত্র, জল নিয়ে শিবের মাথায় ঢালতে চলেছে ভক্তরা। মন্দির থেকে বেরিয়ে পাশের গলিতে একটু এগোলেই আড়গড়া মাজার। তাসখন্দ থেকে প্রায় সাড়ে সাতশো বছর আগে আসা হজরত সৈয়দ শাহ মহম্মদ ইব্রাহিমের সমাধি। আল্লার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মাঝে মাঝেই কোনও গুহায় চলে যেতেন, পনেরো দিন পর ফিরতেন। এক বার আর ফিরলেন না। অনেকের বিশ্বাস, আজও তিনি ধ্যানস্থ ‘জিন্দা ফকির’।
মসজিদের খাদিম ইব্রাহিম শাহ রহমতুল্লাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখনও চাবি রাখেন?’ তিনি হাসলেন, ‘হ্যাঁ, চাবি নিজের কাছেই রাখি। কাউকে দিই না।’
‘সবাই রাখে?’
‘যারা দেয়, তাদেরটাই রাখি।’ ঘটনা, সরযূতীরের এই অঞ্চলেই বাজারহাট। সাতসকালে দোকান খোলার পর হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে অনেকেই এখানে চাবি রেখে যান। তাঁদের বিশ্বাস, বিকিকিনিতে তা হলে লাভ হবেই!
বত্রিশ বছর ধরে রাজনীতির কারবারি, মিডিয়া কেউ খেয়াল রাখেনি, মন্দির-মসজিদ বিতর্ক নয়, মানুষে-মানুষে অন্তঃসলিলা এই সংহতিই অযোধ্যার সিংহদ্বারের আসল চাবি। দুনিয়ার প্রথম মানবসন্তানকেও এখানে খুঁজে পাওয়া যায়। হনুমান গন্ধমাদন পর্বত মাথায় নিয়ে লঙ্কায় আহত লক্ষ্মণের কাছে ফেরার পথে মৃতসঞ্জীবনীসহ সেই পাহাড়ের কিছু অংশ ভেঙে পড়ে। সেটাই নাকি আজকের মণিপর্বত। এই পাহাড়ের নীচেই হজরত শিস পয়গম্বরের সমাধি। শিস দুনিয়ায় জন্মানো প্রথম মানুষ, আদম ও হবার পুত্র। বহুকাল আগের সমাধি, আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরিতেও উল্লেখ আছে। মাঝে হিন্দুত্ববাদীরা এটিকে শেষনাগের উপাসনাস্থল বলছিল, আপাতত সব শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে।
ক’টা শেষনাগ থাকবে? কাশ্মীরে অমরনাথের পথে, আবার অযোধ্যাতেও? হিন্দুত্ববাদ দেশটাকে চেনে না, অযোধ্যাকেও না। আগেই তো বড়ি বুয়া বলে গিয়েছেন, ওখানে আলিম, জালিম, কেউ থাকবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy