আশির দশকের একবারে শেষ পাতে বাড়িতে ঢুকল চৌকোনা রঙিন টিভি। বোকা না চালাক জানি না, তবে দেখতে ভারিক্কি। দূরদর্শনের অনুষ্ঠানসূচিও পাল্লা দিয়ে গম্ভীর। সংগীত বা নৃত্য মানেই ধ্রুপদী, আলোচনা মানেই অন্তহীন ফুটেজ-ভক্ষণ আর সংবাদ পরিবেশন মানেই পরিপাটি আড়ষ্টতায় টেলিপ্রম্পটার-পাঠ। বাচ্চাদের ভ্যাকসিনের মতো বিনোদনের নিয়মিত ডোজ— সাপ্তাহিক রদ্দি ফিল্ম আর মেলোড্রামা-জর্জরিত প্রাগৈতিহাসিক ‘সিরিয়াল’ (‘সোপ’ শব্দটা তখনও তেমন চালু হয়নি)। এই বৌদ্ধিক আদিমতার মধ্যে একটা অনুষ্ঠান হঠাৎই তার ভাবনা, বিষয় ও উপস্থাপনার জোরে ভারতীয় টেলিভিশনকে এগিয়ে দিল অন্তত এক দশক। তবলার তালে বেগুনি ভূ-গোলক এসে সটান সেঁটে যেত হলুদ বর্ণের ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ শব্দবন্ধের ‘ও’ অক্ষরে। ক্লাস সেভেনের এক কিশোরের কাছে উত্তর কলকাতার এঁদো গলির আকাশটা ওই একটা ঘণ্টার জন্য রাতারাতি আন্তর্জাতিক! সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের ‘আফটার-শক’ থেকে বার্লিনের দেওয়াল-পতন, চিনের প্রথম ম্যাকডোনাল্ড-বিপণি থেকে নেলসন ম্যান্ডেলার জেলমুক্তি— শোওয়ার ঘরে খাটের পাশে যত্নে রাখা চৌকো বাক্সটার দু’পাশে শুক্রবার রাতে যেন জুড়ে যেত পক্ষীরাজের দুটো ডানা। রূপকথার মতো ওই এক ঘণ্টায় পৃথিবীর নতুন এক দিগন্তে পৌঁছে দিত সপ্তাহান্তের সেই সঞ্জীবনী, নিয়মিত। আর রূপকথার তো নায়কও থাকে। আমার গল্পেও ছিল। সুবিন্যস্ত দাড়ি (তখনও পাক ধরেনি), শান্ত চোখ, বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি ও ধীর বাক্যবিন্যাসের এক অতীব সুবেশ-সুপুরুষ (ভাগ্যিস কৈশোরের সেই আইকনের ‘যৌন আবেদন’ নিয়ে তখনও শোভা দে কাটাছেঁড়া শুরু করেননি)।
ভারতীয় টেলিভিশনের অন্য রকম সে রাজপুত্রের নাম প্রণয় রায়। রাজপুত্র, না কি রোল মডেল? ভোটের দিন রাজ্যের চায়ের ঠেকে যিনি জোগান দেন ‘সেফোলজি’, ‘সু্ইং’-এর মতো শিক্ষিত শব্দবন্ধ, ইভিএম-পূর্ব ব্যালট বাক্সের যুগে গোটা ভারতবর্ষকে চেনান এগজিট পোল-এর মাহাত্ম্য— একটা প্রজন্মের কাছে তিনি তো সংশয়াতীত আইকন। হেইলিবেরি, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স-এ পড়া ও পড়ানোর কৃতিত্ব ভারতের আমজনতার সঙ্গে তাঁর কোনও উন্নাসিক আভিজাত্যের দূরত্ব তৈরি করেনি, বরং তিনিই নরসিংহ-মনমোহনের মুক্ত অর্থনীতির অঙ্কুরোদ্গমের বেশ কয়েক বছর আগেই ভারতীয় টেলিভিশনকে কূপমণ্ডূকতা-মুক্ত করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন পেশাদারিত্বের আন্তর্জাতিক আঙিনায়। কতটা? মনে আছে, পরের দিন ক্লাস টেন-এর অংক পরীক্ষার উদ্বেগ ভুলিয়ে দিয়েছিল গর্ব, ভারতবাসী হিসেবে গর্ব, যখন ১৯৯২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর উচ্ছ্বসিত বিল ক্লিনটনের সামনে ক্যামেরা-ফ্রেমের ডান দিক থেকে বুম বাড়িয়ে দিলেন দাড়িতে সদ্য পাক-ধরা এক ভারতীয়, প্রশ্ন সমেত— ‘হোয়াট রোল এশিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়া উইল প্লে ইন ইয়োর ভিশন অফ আমেরিকা?’ সেই সময় গোটা পৃথিবীর সামনে ভারতীয় টিভি সাংবাদিকতার এর থেকে বড় বিজ্ঞাপন আর দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না।
আর প্রভাব? একটা আস্ত প্রজন্ম কী ভাবে প্রণয় রায়ের ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ গিলত এবং অজান্তেই প্রভাবিত হত— লালবাজারের পুলিশ ফাইল থেকেই একটা উদাহরণ দিই। ১৯৯৩-এর নভেম্বরে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ডে শিউরে উঠেছিল গোটা রাজ্য, সেই বারুই পরিবারের হত্যাকাণ্ডের মূল চক্রী কিশোর সজল বারুই স্বীকার করেছিল, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’-এর শেষাংশ ‘নিউজমেকার’-এ একটি ফিল্ম ক্লিপিংয়ে তারা দেখেছিল, খুন করার পর খুনিরা ঠান্ডা পানীয়র দাম রেখে যায় টেবিলের ওপর। তাই নিজের পরিবারের তিন-তিন জনকে ঠান্ডা মাথায় খুন করে সজল ও তার সঙ্গীরা মিষ্টি আর বিস্কুট খেয়ে তার দাম সাজিয়ে রেখে দিয়েছিল টেবিলের ওপর, যা পুলিশকে প্রাথমিক ভাবে যথেষ্ট বিভ্রান্ত করে। স্বয়ং প্রণয় রায়ও নিঃসন্দেহে কোনও দিন ভাবেননি যে, ‘নিউজমেকার’ সে যুগে ছিল ভারতবাসীর সঙ্গে হালের হলিউড ফিল্ম ও পশ্চিমি গসিপের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য যোগসূত্র, তা অপরাধী-মনেও এতটা গভীর ছাপ ফেলবে!
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গে সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম, তাদের সামনে সম্ভাবনার উজ্জ্বল ছবিটা কিন্তু ছিল প্রিন্ট সাংবাদিকতারই। কাজেই ওই দশকের শেষে আমরা যখন টেলিভিশন মাধ্যমকে বেছে নিয়েছিলাম, তখনও আমাদের যাবতীয় আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল ফিল্ড রিপোর্টিং, সঞ্চালনার ইচ্ছে ভবিষ্যতের দূর দিগন্তেও কোনও দিন ঠাঁই নেয়নি, অন্তত আমার ক্ষেত্রে। এখন মনে হয়, সচেতন অনুকরণ বা অনুসরণ না হোক, নেহাত ঘটনাচক্রে উপস্থাপনার জগতে আসতে হবে জানলে, কৈশোরের একমাত্র টিভি-আইকনের সঞ্চালনা নিয়ে আরও একটু নিবিড় চর্চা করা যেত।
আপশোসটা প্রথম হয়েছিল এই শতাব্দীর প্রথম বছরে, এক দুর্যোগ-কবলিত দিনে অনিবার্য কারণে আমার তখনকার সংস্থার তিন-তিন জন সঞ্চালক যখন একসঙ্গে অনুপস্থিত। দফতরে হাজির শুধু সদ্য ঝড়জলে রিপোর্টিং করে ফেরা আমি! মনে আছে, দাপুটে ‘অ্যাংকর কো-অর্ডিনেটর’ ভদ্রমহিলা প্রায় ধাক্কা মেরে আমায় স্টুডিয়োয় ঢুকিয়েছিলেন এই বলে, ‘এক দিনের ব্যাপার, চেষ্টা করে দেখ, ঠিক পারবি।’ ঘেমো শার্টের ওপর কোট চাপিয়ে সেই প্রথম এক রিপোর্টার কোনও ক্রমে ‘লাইভ’ বুলেটিনটা উগরে দিয়ে বেরোতেই সেই মেয়েটির ধমক— ‘অপ্রসন্ন মুখে ভুরু কুঁচকে মুষ্টিযুদ্ধ হতে পারে, কিন্তু টেলিভিশন অ্যাংকরিং-টা স্রেফ হয় না! প্রণয় রায়কে দেখে শিখতে পারিস না?’ শেলের মতো বিঁধলেও সে সমালোচনা সে দিন কাবু করতে পারেনি, কারণ নিশ্চিত জানতাম, উপস্থাপকের চরিত্রে আমার গেস্ট-অ্যাপিয়ারেন্স সেই প্রথম, সেই শেষ।
গত পনেরো বছর আমার সঞ্চালনা সহ্য করা অতীব সহ্যশক্তির দর্শককুল জানেন, আমার সে প্রত্যয় মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। গত দেড় দশকে আমার কৈশোরের সেই আইকনের শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডলও শুভ্রতার ছোঁয়ায় অভিজাততর। দেশে চব্বিশ ঘণ্টার খবরের চ্যানেলের সংখ্যাও এক থেকে প্রায় দুশো ছুঁয়েছে। প্রণয় রায়ের সংস্থার তথাকথিত ‘রেটিং’ বা বাণিজ্য নিয়ে যাঁরা ইদানীং প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা হয়তো ভাবেন না যে পথপ্রদর্শকদের কৃতিত্ব-বিচার প্রতি দিনের প্রতিযোগিতার হার-জিতে হয় না, হয় দিকচিহ্ন নির্দেশে। আমার মতো গোটা দেশের অসংখ্য অনুরাগী-হৃদয়ের ‘বার্ক’ বা ‘ট্যাম’ রেটিং-এ প্রণয় রায়ই ভারতীয় টেলিভিশন সাংবাদিকতার যুগপুরুষ।
শেষে একটা তথ্য গোপন করা অনুচিত হবে। আমার প্রথম লাইভ টিভি উপস্থাপনা শেষ হওয়ামাত্র সরোষে প্রণয় রায়ের কাছ থেকে সঞ্চালনা শেখার পরামর্শ দেওয়া সেই পেশাদার মহিলা ঘটনাচক্রে আজ আমার স্ত্রী, কাজেই আমার জীবনে সেই গঠনমূলক গঞ্জনা চিরস্থায়ী চেহারা নিয়েছে!
sumand@abpnews.in
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy