ওয়াচ টাওয়ারে উঠে সার্চলাইটের তীব্র আলো জঙ্গলের রাস্তায় ফেলতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। রাস্তার পাশেই তিনটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার একটা গন্ডারের বাচ্চাকে ধরার জন্য ওত পেতেছে। নেতৃত্বে মা বাঘিনি। বাকি দুটো সাব-অ্যাডাল্ট সন্তান। প্রথম বাঘের তিরিশ মিটারের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছেন জিপসি-চালক। তিনি অবশ্য বিপদ বুঝতে পারেননি তখনও। এসিএফ (অ্যাসিস্ট্যান্ট কনজ়ারভেটর অব ফরেস্ট) ম্যাডাম চাপা গলায় যতটা পারলেন চেঁচিয়ে চালককে ডেকে বললেন, “জলদি গাড়িতে উঠুন।”
বনের মানুষদের জন্য ইঙ্গিতই যথেষ্ট। তড়িৎবেগে ঝাঁপিয়ে গাড়িতে উঠেই দরজা-জানলা বন্ধ করে রিভার্স গিয়ারে গাড়ি চালালেন চালক। পিছনে থাকা এসিএফ-ও দৌড়ে এসে লাফিয়ে সামনের আসনে বসলেন। গাড়ি ফের ছুটল পিছনে। তত ক্ষণে একটা বাঘ তাড়া করেছে জিপসিকে। হেডলাইটের আলো ফালা ফালা করে ডোরাকাটা দেহটা তীব্র রাগে ঝাঁপ দিল জিপসি লক্ষ্য করে। ভাগ্যিস থাবা দুটো পৌঁছল বনেট পর্যন্তই! রাস্তায় দাঁড়িয়ে গর্জাতে লাগল সে। অনেকটা গাড়ি পিছিয়ে হেডলাইট বন্ধ করে বসে থাকলেন দু’জন। বন্ধ হওয়ার উপক্রম দমও। হার্ডটপ বোলেরো তো নয়, সাধারণ ক্যানভাসের ছাউনি দেওয়া জিপসি। পিছনটা খোলা। বাঘের পক্ষে গাড়িতে ঢোকা তো ছেলেখেলাই। বেশ কিছু ক্ষণ আলো নিভিয়ে থাকার পরে মনে হল, সামনের বাঘটা নিশ্চয়ই এত ক্ষণে চলে গিয়েছে। কিন্তু আলো জ্বালতেই ধাক্কা! গাড়ির সামনে তত ক্ষণে একটি নয়, দু’টি বাঘ দাঁড়িয়ে। শিকার ফস্কে যাওয়ার রাগে তখনও ক্ষমাহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে গাড়ি আর আরোহীদের দিকে। আর আলো নেভানোর সাহস হয়নি। প্রায় ২০ মিনিট পরে মা বাঘিনিও হাজির। পায়ে পায়ে গাড়ির দিকে এগোল সে। চাপা গরগর শব্দটা গাড়ির চার পাশে ঘুরতে থাকে। ভিতরে তখন তামিল ও অসমিয়ায় ইষ্টনাম জপ চলছে। সামনে দুই সন্তান দাঁড়িয়ে মায়ের নির্দেশের অপেক্ষায়। শেষ পর্যন্ত অঘটন ঘটেনি। অনুপ্রবেশকারীদের ক্ষমা করে দুই সন্তানকে নিয়ে বাঘিনি চলে গেল জঙ্গলের ভিতরে।
কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানের কোহরা রেঞ্জে, আড়িমোড়া ওয়াচ টাওয়ারের কাছে ওই দিনের ঘটনাটা ভাবলে এক দিকে যেমন এখনও গায়ে কাঁটা দেয় তাঁর, তেমনই কাশীপালায়াম মহেশ্বরী অভর্ণা মনে করেন, ওই দিন কাজিরাঙায় বাঘিনি আর দুই সন্তানের মুখোমুখি পড়াটাই তাঁর মনের মধ্যেও বাঘিনির তেজ আর ডোরাকাটাদের প্রতি অপত্যস্নেহ ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। সেই শুরু। এর পর ওই মা আর বাচ্চাদের সঙ্গে অনেক বার জঙ্গলের পথে মোলাকাত হয়েছে। ভয় করেনি আর।
মেঘলা চিতাবাঘ (ক্লাউডেড লেপার্ড) শিকারের খবর পেয়ে প্রবেশনারি মহিলা রেঞ্জ অফিসার পৌঁছে গেলেন ঘটনাস্থলে। অসমের গোলাঘাট জেলা। মেরাপানি এলাকা। মহিলা অফিসার এসেছে দেখে গ্রামের মানুষ তেমন পাত্তাই দেননি। কিন্তু সেই মহিলাই ছ’জনকে একেবারে কোমরে দড়ি পরিয়ে গ্রেফতার করে রওনা দেওয়ায় বিস্ময়ের ঘোর কেটে বিদ্রোহের চেহারা নেয়। শতাধিক মানুষ ঘেরাও করে বনকর্মীদের। দাবি, কোনও ভাবেই গ্রামের কাউকে গ্রেফতার করা চলবে না। কিন্তু দমবার পাত্র নন সেই তরুণী অফিসারও। রাত পর্যন্ত চলে সেই বিক্ষোভ আর ঘেরাও। কিন্তু তার মধ্যেই অকুতোভয় রেঞ্জার ছ’জনকেই ধরে রেখে পর দিন আদালতে তোলেন।
সাধারণত গন্ডার আছে এমন জঙ্গলের কর্তা ও কর্মীরা দিন শেষে এক বার জঙ্গল টহল দিয়ে দেখেন কোথাও গন্ডারের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে কি না, কোনও গন্ডারের খড়্গ পড়ে রয়েছে কি না। তেমনই এক টহলদারি বিকেল। গন্ডারের খড়্গ কুড়িয়ে ক্যাম্পে ফিরছিলেন অভর্ণারা। তাঁর রাইফেল রয়েছে চালকের হাতে। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রক্ষীরা। মানুষের মাথা ছাড়ানো হাতিঘাসের জঙ্গল চার দিকে। হঠাৎই ঘাসবন তছনছ করে ভারী কিছু দৌড়নোর শব্দ। অভর্ণা দেখেন, রক্ষীরা মুহূর্তের মধ্যে দৌড়ে হাওয়া! কিন্তু তখনও জঙ্গল-জীবনে নবিশ এসিএফ বিপদ আঁচ করতে পারেননি। তিনি অবাক হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। আচমকা দেখেন, কালো বিরাট একটা দেহ তাঁর দিকে ধেয়ে আসছে— “আমার থেকে মাত্র দশ মিটার দূরে গন্ডারটার চোখের মণি দুটো দেখতে পেয়েছিলাম মনে আছে। তার পরই ভয়ে চোখ বুজে ফেলি। ভেবেই নিয়েছিলাম আর ফেরা হবে না। কিন্তু পাশ থেকে কান ফাটানো গুলির আওয়াজ। চোখ খুলে দেখি নাকের সামনে গন্ডারের লেজটা। দুটো পা বাতাসে তুলে ছিটকে পড়ছে সে। চালকের হাতে থাকা রাইফেলের নল থেকে তখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে।”
রাতের অন্ধকারে বাঘের মোকাবিলা যদি বন্য জীবনের চ্যালেঞ্জ নেওয়া শিখিয়ে থাকে, ফুঁসতে থাকা মারমুখী জনতার ব্যূহ ভেদ করে অপরাধীদের আদালতে পৌঁছে দেওয়ার কয়েকটা ঘণ্টা তাঁকে শিখিয়েছে জনরোষ সামলানোর ধৈর্য। আর গন্ডারের মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তটা অভর্ণার ভিতর থেকে মৃত্যুভয় মুছে দিয়ে ভরসা জুগিয়েছে, কঠিনতম বিপদেও কাউকে পাশে পেয়েই যাবেন।
“এর পর হাতির মুখে পড়া, বাঘের মুখে পড়া, বুনো মোষের সামনে পড়া, চোরাশিকারির বুলেটের সামনে পড়া, গাড়ি দুর্ঘটনার মতো কত ঘটনাই ঘটেছে কাজিরাঙায়। কিন্তু ভয় নয়, ততই আমার মনে বন্যপ্রাণের জন্য প্রাণ সঁপে দেওয়ার জেদ বেড়ে চলেছে। আর ঠিক সেই কারণেই আমি আমার জঙ্গল-জীবন আর কেরিয়ারের জন্য বরাবর কাজিরাঙার কাছে ঋণী,” বলছিলেন কে এম অভর্ণা।
আসলে সাহস পেশিতে নয়, থাকে কলজেতে। আর সেই কলজের জোরেই অনায়াসে পুরুষশাসিত বনমহলে বহু অফিসারকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন সদ্য কাজে যোগ দেওয়া মেয়েটা। পয়েন্ট ৩১৫ বোরের ভারী রাইফেলটা যেমন ছিল জঙ্গলচারণার নিত্যসঙ্গী, তেমনই একগুঁয়ে জেদ আর সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল তার সহজাত। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বিদ্যা বালন অভিনীত ‘শেরনি’ ২০২১ সালে মুক্তি পেয়েই আলোচনার কেন্দ্রে। আর বাস্তবের শেরনি পাঁচ বছর আগে কাজিরাঙার জঙ্গল দাপিয়ে বেড়িয়েছেন।
২০১৭-১৮ সালে মহারাষ্ট্রের জঙ্গলের বাঘিনি অবনী, আর তাঁকে ধাওয়া করে চলা তদনীন্তন ডেপুটি কনজ়ারভেটর অব ফরেস্ট অভর্ণাকে নিয়েই তৈরি হয়েছে সিনেমা। যা বিভিন্ন মহল থেকেই বন ও বনকর্তাদের জীবন নিয়ে তৈরি বলিউডের প্রথম প্রামাণ্য ছবির স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই সূত্র ধরেই আনন্দবাজার উল্টেপাল্টে দেখল অকুতোভয় অভর্ণার ডায়েরির পাতা।
বাঙালি আইএফএস শুভাশিস দাস কট্টর, রাগী, ঠোঁটকাটা অফিসার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কাজিরাঙার ডিএফও (ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার) হিসেবে থাকার সময়ই অসম-মেঘালয় ক্যাডারের ২০১৩ ব্যাচের আইএফএস কে এম অভর্ণার পোস্টিং হয় তাঁর অধীনে। কাজিরাঙার কেন্দ্রীয় রেঞ্জ কোহরায়। অভর্ণাকে দেখেই ‘বস’ শুভাশিস বুঝেছিলেন, নিছকই এক কুর্সি গরম করা অফিসার নয়, জঙ্গলে বাঘিনির পা পড়েছে বটে।
তার আগে, গোলাঘাট ফরেস্ট ডিভিশনে থাকাকালীন অভর্ণা দেরগাঁও রেঞ্জের প্রায় ৪০টি গ্রামে বাঁদর-মানুষ সংঘাত সামলে এসেছেন। কাজিরাঙায় অভর্ণা যখন কাজে যোগ দেন তখন চোরাশিকার তুঙ্গে। শুভাশিস বলছিলেন, “আমি কখনও অভর্ণাকে রাইফেল ছাড়া দেখিনি। সাধারণত মহিলা ক্যাডার প্রবেশন পিরিয়ডে এলে হালকা কাজ, ক্যামেরা তদারক করা, গবেষণার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু অভর্ণা ছিলেন ডাকাবুকো। শিকার ঠেকাতে রাতের পর রাত বনরক্ষীদের সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলে ওত পেতে থাকতেন তিনি। প্রথমে সকলে ভেবেছিল, মহিলার এই দাপট নেহাতই সাময়িক। কিন্তু সকলকে ভুল প্রমাণ করে আদর্শ ফিল্ড অফিসার হয়ে উঠেছিলেন অভর্ণা।”
মনিটরে চোখ আর কি-বোর্ডে আঙুল নয়, দূরবিনে দৃষ্টি আর রাইফেলের ট্রিগারে আঙুল চেপে কেটেছিল তাঁর কাজিরাঙার দিন-রাত। তিনি যে ক’মাস কোহরায় ছিলেন, শিকারের একটিও ঘটনা ঘটেনি। শুধু গন্ডার শিকারই নয়, কোহরা রেঞ্জে গ্রামবাসীদের অবৈধ ভাবে মাছ শিকার বন্ধ করতেও সফল হয়েছিলেন অভর্ণা। লেডি এসিএফ-এর উদ্যোগে জঙ্গল ও তার আশপাশে নিষিদ্ধ হয়েছিল প্লাস্টিকের ব্যবহার।
মহারাষ্ট্র ক্যাডারের আইএফএস অফিসারের সঙ্গে প্রণয় ও বিয়ের পরে ক্যাডার বদল করে অভর্ণা মহারাষ্ট্রে চলে যান। শুভাশিসবাবুর মতে, পরবর্তী কালে জঙ্গল ও আশপাশের গ্রামবাসীদের সামলানোর কাজে অভর্ণার দক্ষতার বীজ লুকিয়ে আছে কাজিরাঙাতেই। মহিলা অফিসার হিসেবে শুধু নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করাই নয়, মহিলা বনকর্মীদেরও উৎসাহ দিয়ে তিনি রাইফেল হাতে বনটহলে নিযুক্ত করেছিলেন।
কাজিরাঙা পশু উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের অধিকর্তা রথীন বর্মণও বলেন, মহিলা অফিসারদের হালকা ভাবে নেওয়াটা অলিখিত দস্তুর। কারণ বনের জীবন অনেকাংশেই পুরুষপ্রধান। কিন্তু জঙ্গল-জীবনে অতিসক্রিয় থেকে ও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে অভর্ণা সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছিলেন।
অভর্ণা যখন কাজিরাঙা দাপাচ্ছেন, তখনই মহারাষ্ট্রের ইয়াভাতমালের জঙ্গল-গ্রামে আতঙ্ক ছড়ানো শুরু করেছে অবনী ওরফে টি-১। অসম থেকে মহারাষ্ট্রে বদলি হওয়ার পরে সেই বাঘিনিকে ধরার ভার পড়ে অভর্ণার ওপরে, তখন তিনি ডেপুটি কনজ়ারভেটর অব ফরেস্ট। বন দফতর, আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক অসহযোগিতা, প্রতিকূলতার মধ্যেও বরাবরের নেত্রী অভর্ণা ২০১৭-র অগস্ট থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত টি-১ বাঘিনিকে রক্ষা করেছেন। পশু চিকিৎসক সামসুল আলিও অভর্ণার সঙ্গে গোলাঘাট ও কাজিরাঙায় কাজ করেছেন। গোলাঘাটে বেশ কিছু ক্ষেত্রে গ্রামে ঢোকা চিতাবাঘকে সফল ভাবে জঙ্গলে ফেরানোয় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অভর্ণা। অবনীকে ট্রাঙ্কুলাইজ় করতেও সামসুলকে ডেকেছিলেন তিনি। কিন্তু অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় যেতে পারেননি সামসুল। বদলে মধ্যপ্রদেশ থেকে যান তিন পশু চিকিৎসক।
২০১৮ সালের নভেম্বরে বন দফতরের নিযুক্ত শিকারি নবাব শতাফ আলি খানের ছেলে আসগর আলি খানের গুলিতে অবনী মারা যায়। অভর্ণারূপী বিদ্যা বালানের ‘শেরনি’ জঙ্গলের রাজনীতি আর রাজনীতির জঙ্গলকে ১৩০ মিনিটে বেঁধেছে বটে, কিন্তু টি-১ হত্যা নিয়ে মামলা, তদন্ত আড়াই বছরেও শেষ হয়নি। বন দফতরের বন্ধ ফাইল ২০১৯ সালের শেষে ফের খোলা হয়েছে। সম্প্রতি নতুন করে তৈরি তদন্ত কমিটিও।
পান্ধারকাওয়াড়ার জঙ্গলের তদানীন্তন ডেপুটি কনজ়ারভেটর অব ফরেস্ট অভর্ণা বলেন, টি-১ কে অনুসরণ করা, তাকে মানুষখেকো বলে দাগিয়ে দেওয়া, সংরক্ষণ বনাম উন্নয়নের বিতর্ক এবং শেষ পর্যন্ত টি-১ (পর্দার টি-১২) হত্যার ঘটনাক্রমকে হালকা ভাবে অনুসরণ করেছে পর্দার শেরনি। অনেক ক্ষেত্রেই চিত্রনাট্যের স্বাধীনতা নেওয়া হয়েছে। গল্প সরে গিয়েছে সত্য থেকে। বলেন, “আমি কাজে যোগ দেওয়ার আগেই কিন্তু অবনী পাঁচ জন মানুষ মেরেছিল। আমি যোগ দেওয়ার পরে সিস্টেম্যাটিক মনিটরিং শুরু হয়। ‘শেরনি’ ছবিতে গোটা ঘটনায় পুলিশের ইতিবাচক ভূমিকা এবং বন দফতরের নিয়োগ করা মধ্যপ্রদেশের পশুচিকিৎসক দলের ভূমিকাকে সেই ভাবে তুলে ধরা হয়নি। তা ছাড়া আসল ঘটনা মহারাষ্ট্রে হলেও শুটিং করা হয়েছে মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে। তাই দুই জঙ্গলের পরিবেশও ভিন্ন। মহারাষ্ট্রে জঙ্গলের প্রাণী ও জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের মানুষ কী ভাবে সহাবস্থান করে, কী ভাবে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত হ্যাবিট্যাটে মহারাষ্ট্রের বাঘিনিদের শাবকদের বড় করে তুলতে হয়, সেটাও বোঝা যায়নি।”
অবশ্য অভর্ণা মেনে নেন, সিনেমা কখনওই তথ্যচিত্র হতে পারে না। আর মূল ধারার বলিউড এই প্রথম এমন বিশদ ও বাস্তবনিষ্ঠ ভাবে সংরক্ষণ ও জঙ্গলের সমস্যা তুলে ধরায় পরিচালক অমিত মাসুরকরকে কুর্নিশ জানান অভর্ণা।
মুখ্য বনপালকে পাঠানো তাঁর রিপোর্টে অভর্ণা জানিয়েছিলেন, অবনীকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ঘুম পাড়ানো গুলিতে কাবু করার সোনালি সুযোগ দু’বার হাতছাড়া হয়েছে। অবশ্য গ্রামবাসীকে উস্কানি দেওয়া, রাজনৈতিক স্বার্থে অবনীকে মানুষখেকো হিসেবে তুলে ধরা ও বাঘ মারাকে ভোট-রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার পুরো অধ্যায়টাই এখন বিচারাধীন। তিনটি জনস্বার্থ মামলা চলছে হাইকোর্টে। সম্প্রতি অবনীহত্যা নিয়ে আরও একটি কমিটি গড়া হয়েছে, তাই মুখে কুলুপ আঁটতে বাধ্য হয়েছেন অভর্ণা। কিন্তু এটা বলে দিলেন, “আমার চার পাশে আসলে কী ঘটছিল তা বুঝতে ১৫ মাস সময় লেগেছিল।”
এক দিকে অবনীকে গুলি করে মারার অনুমতি দেওয়া নিয়ে দেশের বিভিন্ন অংশে তখন চলছিল বিক্ষোভ, অন্য দিকে, শিকারিদের সঙ্গে অভর্ণার রেষারেষি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। প্রধান মুখ্য বনপালের কাছে অভর্ণার অসহযোগিতা নিয়ে নাগাড়ে নালিশ ঠুকছিলেন প্রভাবশালী নবাব। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, এক দিন রাতে পিসিসিএফ (প্রিন্সিপাল চিফ কনজ়ারভেটর অব ফরেস্ট) সব মিটমাট করার জন্য অভর্ণাকে নবাবের হোটেলে যেতে বাধ্য করেন। যা নিয়ে বিভাগেই তীব্র সমালোচনা হয়। সে সব তিক্ততা নিয়ে আজ আর মুখ খুলতে চান না অভর্ণা। শুধু বলেন, “যে ভাবে নবাব ও তার ছেলে শেষ পর্যন্ত অবনীকে মেরেছে, বন দফতর কখনওই তা চায়নি। কিন্তু শিকার যাদের নেশা, তারা যে কোনও উপায়ে রক্তের স্বাদ চাইবেই। গ্রামবাসীদের একাংশও বাঘটিকে মেরে ফেলতে চাইছিলেন। কিন্তু বাঘ বাঁচাতেও গ্রামেরই অনেকে আমাদের সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে শিকারিদের হাত থেকে অবনীর দুই শাবককে বাঁচাতে গ্রামের মানুষের অবদান অনেক।” অবনীর শিকারিদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল বিধায়কের উদ্যোগে, উপহার দেওয়া হয় বাঘের মূর্তিও।
মায়ের মৃত্যুর পরে অসহায় দুই বাচ্চা শিকার ধরে খেতে পারত না। অবনীর মেয়েকে পরে ধরে এনে পেঞ্চ ব্যাঘ্র প্রকল্পের ঘেরাটোপে বড় করা হয়েছিল। তিন বছর দু’মাস বয়সে, চলতি বছর মার্চে তাকে নাগপুরের পেঞ্চ ব্যাঘ্র প্রকল্পের মূল অরণ্যে রেডিয়ো কলার পরিয়ে ছাড়া হয়েছে। অবনীর ছেলেকে অবশ্য কিছুতেই ধরা যায়নি। মা শিকার শিখিয়ে যেতে পারেনি, তাই অনেক দিন ধরে গ্রামের পোষা প্রাণী শিকার করছিল সে। কিন্তু পরে সে নিজেই শিকার ধরা শিখে গ্রামের কাছে আসা বন্ধ করে দেয়। পান্ধারকাওয়াড়ার জঙ্গলে এখন ভালই আছে অবনীপুত্র। সেটাই অভর্ণার সান্ত্বনা।
সিনেমায় বিজয় রাজ অভিনীত চরিত্রটি বাস্তবেও ছিলেন অধ্যাপক ও সাম্মানিক বনপাল। অভর্ণা বলেন, “মনে আছে আমি তখন দেহরাদূনে একটা কর্মশালায় ছিলাম। খবর আসে, টি-১ সপ্তম মানুষ মেরেছে। সবেমাত্র এক মাস হল কাজে যোগ দিয়েছিলাম। এ দিকে জনরোষে গ্রামে ঢোকা যাচ্ছিল না। সেই সময় ওই অধ্যাপক আমায় সাহায্য করেছিলেন। তখন থেকেই বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়।”
অভর্ণারই ব্যাচমেট এক আইএফএস-এর কথায়, “বন্যপ্রাণীর দিক থেকে আসা চ্যালেঞ্জে আমরা ভয় পাই না। কিন্তু আইএফএস অফিসারদের মূল লড়াই ফাইল আর রাজনীতির সঙ্গে। কোনও গ্রামে বা বসতি এলাকায় বাঘ বা চিতাবাঘ ঢুকলে কোন দফতর থেকে কোন পশু চিকিৎসক কোন রাইফেল নিয়ে কোন স্টক থেকে ঘুম পাড়ানো ওষুধ সংগ্রহ করে কার জিপে চড়ে বাঘ-চিতাবাঘকে ঘুম পাড়াতে যাবেন— সেই পুরো প্রক্রিয়াতেই জড়িয়ে থাকে প্রকট বা প্রচ্ছন্ন রাজনীতি। অসমের ক্ষেত্রে তা কম, কিন্তু অন্য রাজ্যে হয়তো আরও বেশি।”
‘শেরনি’ ছবিতে যে ভাবে বিদ্যার চরিত্রটির সঙ্গে অন্য বনকর্তাদের খারাপ ব্যবহার, দুর্নীতি, দুমুখো চরিত্র দেখানো হয়েছে, তার পরে দফতর থেকে কি কোনও ভাবে চাপ বাড়ছে তাঁর উপরে? চাপের কথা উড়িয়ে দেন অভর্ণা।
তামিলনাড়ুর ইরোডের গোবিচেট্টিপালায়ামের মেয়ে অভর্ণার পরিবারে তিনিই প্রথম আইএফএস। চেহারা দেখলে মনে হতেই পারে ভরতনাট্যম শিল্পী বা শিক্ষিকা। তেমন কিছুও হতেই পারতেন। কিন্তু ছোট থেকেই জঙ্গল আর প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যান। সেই টানেই পুরুষশাসিত সাম্রাজ্যে পা রাখা। অবশ্য ব্যক্তিগত জীবনে বাবা-মা, আইএফএস স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন পেয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে জানালেন, টি-১ পর্ব তাঁকে আরও অনেক নতুন পরিবার দিয়েছে।
প্রতিবেদকের কাছে অভর্ণা বার বার ঢেলে দেন নস্ট্যালজিয়ার উচ্ছ্বাস। জানান, পরবর্তী জীবনে রাজনীতি-আমলাতন্ত্রের সঙ্গে লড়তে হলেও অসমে কাটানো সময় তাঁর কাছে সেরা। অবনীকাণ্ডে বিধায়ক ও বিরোধী নেতার যন্ত্রণায় নাজেহাল অভর্ণার স্মৃতিচারণে উঠে আসেন তদনীন্তন বনমন্ত্রী প্রমীলা রানি ব্রহ্ম। বলেন, “কাজিরাঙায় এলেই বাইদেও (অসমিয়া ভাষায় দিদি) আমার সঙ্গে দেখা করতেন। তাঁর সঙ্গে খাওয়া ছিল বাঁধা। আমায় মেয়ের মতো দেখতেন তিনি। তাঁর সাহসেই মহিলা বনকর্মীদের হাতে রাইফেল ধরিয়ে বনটহলে বার করতে পেরেছিলাম। এমনকি মহিলা কর্মীদের রাতের অ্যামবুশেও নিয়ে যেতে পেরেছি। সেই সঙ্গে শুভাশিস স্যর, দীপিকা চৌধুরী ম্যাডাম, অমিত সহায় স্যর, অলকা ভার্গব ম্যাডাম, সত্যেন্দ্র সিং, অভয়কুমার জোহারি স্যরেদের মতো অনেকে আমায় যে প্রশিক্ষণ, সাহস ও প্রশ্রয় দিয়েছেন তা ভোলার নয়।”
অভর্ণা কোহরা রেঞ্জে মাছ ধরা বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। এ দিকে স্থানীয় মানুষ কোহরা নদীতে মাছ ধরবেই। তার উপরে অবৈধ মাছ ধরায় জঙ্গলের এক পুরনো বনকর্মীর মদত ছিল। তা জানতে পেরে তরুণী আইএফএস বিশ বছর কাজিরাঙায় কাজ করা ওই কর্মীর বদলির নির্দেশ দেন। প্রবল আপত্তি ওঠে কর্মী ও গ্রামবাসীদের মধ্যে থেকে। কিন্তু বক্তব্যে অনড় অভর্ণার মতকে সমর্থন করেন ডিএফও শুভাশিস। ওই বনকর্মী সম্প্রতি গন্ডারের খড়্গ ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। অভর্ণা বলেন, “এত দিনে খবরটা পেয়ে ফের নিশ্চিত হলাম, মন্দ লোক চিনতে আমার তা হলে ভুল হয়নি।”
বর্তমানে মহারাষ্ট্রের ‘ব্যাম্বু রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’-এর অধিকর্তা পদে নিযুক্ত অভর্ণা। আমলাতন্ত্রের কাছে পোষ না মানা বাঘিনি যাতে জঙ্গলে দাপাতে না পারে, সেই জন্যেই কি বাঁশের বেড়ায় আটকে রাখার বন্দোবস্ত? বিতর্কিত মন্তব্য করা বারণ, তাই দীর্ঘশ্বাসে জানিয়ে দেন, “জঙ্গলের পোস্টিং খুব মিস করি জানেন! কী আর করব, সবই জীবনের অঙ্গ।”
তাঁর পরিচিত মানুষজন কিন্তু তাঁকে নিয়ে আশাবাদী। বলছেন, খাঁচায় থাকলেও বাঘ বাঘই থাকে। গর্জন সময়ের অপেক্ষামাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy