অনুকৃতি: সেন্ট অ্যালবান্স ক্যাথিড্রালে সংরক্ষিত শিল্পী লরোনা মে ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর চিত্রশিল্প। (শিল্পীর ফেসবুক পেজ থেকে)
এক চিলতে খবর, চেনা-জানা ফর্সা জিশুখ্রিস্ট হয়ে গেছেন কালো। জুলাই মাসে ইংল্যান্ডের হার্টফোর্ডশায়ারের গির্জায় লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চির ‘দ্য লাস্ট সাপার’-এর অনুকৃতিতে আঁকা ‘আ লাস্ট সাপার’ বলে একটা ছবি টাঙানো হয়েছে। পটবিন্যাসে বড় রদবদল নেই, কেবল অন্তিম ভোজে হাজির জিশু ও তাঁর শরিকরা কৃষ্ণাঙ্গ। অভিনবত্বের রাজনৈতিক বার্তাটুকু স্পষ্ট।
আমরা বঙ্গবাসী। আমাদের আরাধ্য দেবদেবীর অনেকেরই রং কালো, শ্যাম কিংবা শ্যামা। কালো তো জগতের আলো। কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলোর নাচন দেখে অনেকেরই মন ভোলে। তবু কালো জিশুর ছবি দেখলে আমাদেরও চোখ কচলাতে হয়, অভ্যস্ত ভাবনা টাল খায়।
উনিশ শতক থেকেই বাংলার গঞ্জে মেলায় বা পরবের জমায়েতে হুতোমি লব্জের ‘ক্যাটিকৃষ্ট ভায়ারা’ বা ক্যাটেকিস্টরা খ্রিস্ট-মাহাত্ম্য প্রচার করার জন্য প্রভু জিশুর পট নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। অনেক সময়ই তাঁদের প্রচারের বাংলাটা হত বিদঘুটে, কিন্তু পটটায় থাকত এক সুদর্শন পুরুষের ছবি— নীলাভ চোখ, মাথা থেকে ঘাড়ে ছড়িয়ে পড়া গুচ্ছ-গুচ্ছ সোনালি চুল, গায়ের রং সাদা। প্রভু জিশুর এই চেহারাটাই আম বাঙালির চোখসওয়া। শরীরী বিভঙ্গের রকমফের আছে। বৈঠকখানার দেওয়ালে, গির্জার গায়ে বা বইয়ের পাতায় সুদর্শন পুরুষটি কখনও ক্রুশবিদ্ধ, কখনও বা পাপীদের বরাভয় প্রদানে তদ্গতচিত্ত। কিন্তু সব প্রতিকৃতির বর্ণে বা শরীরী সংস্থানে মনে হয় যে, পরমকারুণিক মানবপুত্রের রূপটি সাগরপারের শ্বেতদ্বীপের কোনও এক মহাত্মা সাহেবের আদলে তৈরি। হারলেমের কবি ল্যাংস্টন হিউজ-এর শব্দবন্ধে, ‘দ্য হোয়াইট লর্ড জিসাস’।
বাঙালির মনের কাছে সাহেবি জিসাসই যথেষ্ট, ওই দীর্ঘদেহ শান্তিনয়ন মূর্তিটিই দেওয়ানপুর স্কুলের মফস্সলি ছাত্র অপূর্বর মনে বুদ্ধ, চৈতন্য আর বিশালাক্ষীর পাশে সহজে জায়গা করে নেয়। খেয়ালে আসে যে, সেই ১৯০৮ সনে বরিশালের পাড়াগাঁ ইলুহার হিন্দু কবি মধুসূদন সরকার ভবকর্ণধার জিশুর উপর বাইবেলের গসপেলমাফিক একাধিক খ্রিস্টপুরাণ ছন্দে লিখেছিলেন, নিজেই প্রকাশক ছিলেন, তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে সরাসরি খ্রিস্টপুরাণগুলি কিনলে বেশি ছাড় পাওয়া যেত। বরিশালি বাঙাল-মনে মর্ত্যের জীবনসঞ্চারিণী সুধায় পূর্ণ খ্রিস্টবার্তার কথা ভক্তিরসের জোয়ার আনত, কেষ্ট ও খ্রিস্ট তো ধ্বনিসাযুজ্যে একে অন্যের দোসর।
‘জিসাস ক্রাইস্ট’ নামটি গ্রিক, তবে অনূদিত। একটি ব্যক্তিনাম, অন্যটি উপাধি। জিশুর জন্ম, বড় হয়ে ওঠা, কর্মজীবন সব কিছুই পশ্চিম এশিয়ার এককোণে। তাঁর খাস জবানও অ্যারামাইক, হিব্রুর স্বগোত্রীয়। একজাতীয় সেমিটিক কথ্যভাষা, ইরাক ও সিরিয়ার দু’-একটি জনগোষ্ঠীর মুখে আজও টিকে আছে। ভূমধ্যসাগরের পূর্ব পারে ও সিরিয়ার বিখ্যাত জরদন (এখনকার জর্ডন) নদীর পশ্চিম তীরে মধ্যবর্তী লম্বাটে ভূখণ্ডটির নাম প্যালেস্টাইন, প্রাচীন জুদাইয়া (জুদিয়া)। জুদাইয়ার মধ্যে উঁচুনিচু পাহাড়ে সমাকীর্ণ অঞ্চল গালিলি, গালিলি-র এক গণ্ডগ্রাম নাজ়ারেথ। রোমসম্রাট অগাস্টাসের আমলে ওই গ্রামের এক ছুতোর পরিবারে জন্মানো প্রথম সন্তানের নাম রাখা হয় জোশুয়া। দেশজ নাম, অর্থ ‘জিহোভা [পরমেশ্বর] মোক্ষদাতা’। জোশুয়ার গ্রিক রূপ ‘জিসাস’। সে কালের ইহুদি সমাজে ওই রকম নাম রাখাটা বেশ প্রচলিত ছিল। তবে ওই নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘খ্রিস্ট’ কথাটি, বহুলালিত একটি কৌমী স্বপ্ন বা প্রত্যাশার খেতাব। গ্রিক ক্রিয়াপদ ‘খ্রিএইন’ থেকে তৈরি, অর্থ অভিষিক্ত, হিব্রু ‘মসিয়া’ বা ‘মসিহা’ শব্দের অনুরূপ। ইহুদি ধর্মসংস্কৃতির পরম্পরায় ঈশ্বরপ্রেরিত এক ত্রাণকর্তার অনুষঙ্গে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। নাম যা-ই হোক না কেন, ইতিহাসের রক্তমাংসের জিশু প্রাচ্যের বাসিন্দা, গালিলির ইহুদি। রোমান ইতিহাসবিদ তাসিতুস বা স্বজাতীয় জোসেফাস তাঁকে ইহুদি সমাজে জাত, স্বতন্ত্র ধর্মগোষ্ঠীর জনক বলেই চিহ্নিত করেছেন। ওই ধর্মের ভক্তমণ্ডলীই তাঁকে ‘খ্রিস্ট’ বলত। সন্ত জোহনের বক্তব্য অনুযায়ী, জুদাইয়ার রোমান দণ্ডনায়ক পন্তিস পিলাতের নির্দেশে ক্রুশবিদ্ধ জিশুর উপরে সাঁটা ফলকনামায় তিনটি ভাষায় লেখা ছিল, ‘নাজ়ারেথের জিশু—ইহুদিদের রাজা’। সোনালি চুল বা ফর্সা রং, নজরকাড়া পোশাক বা ভঙ্গি, ইতিহাসের ফেরফারে মানবপুত্রের উপরে চেপে বসেছে, প্রাচ্যজাত এক ঐতিহাসিক পুরুষের প্রতীচ্যায়িত আইকনিক রূপ।
সেকালের পৃথিবীতে ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিতসাগরের মধ্যে প্রধান বাণিজ্যপথের কেন্দ্রে জুদাইয়া, ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে সাংস্কৃতিক সংযোগসেতুও বটে। জিশুর আমলে রোমান সাম্রাজ্যের সুবা সিরিয়ার প্রদেশপাল ও তাঁর আজ্ঞাবহ রোমান দণ্ডনায়কের শাসনাধীন ছিল অঞ্চলটি, সেই শাসনকাজে সাহায্য করত করদস্থ হেরোদ বংশের সামন্তরাজরা। জুদাইয়া, বিশেষত গালিলি এলাকার প্রজারা বেয়াড়া ছিল, বিদেশি শাসক ও দেশি বশংবদদের জবরদস্তির বিরুদ্ধে তারা সব সময় খড়্গহস্ত। ‘জ়িলট’ বলে খ্যাত এই ধরনের গালিলিবাসী জঙ্গি প্রজাগোষ্ঠীর এক জন, সিমোন-ও তো জিশুর বারো জন প্রধান পরিকরের মধ্যে স্থান পেয়েছিলেন। জুদাইয়ার একেশ্বরবাদী ইহুদিরা স্বাতন্ত্র্যগর্বী, কুলিশকঠোর একলষেঁড়ে এক নামহীন আরাধ্য তথা ‘জিহোভা’-র তারা অনুগামী। তাদের চোখে অন্য সব পৌত্তলিক প্রতিবেশীরা তুচ্ছ, তারাই কেবল বিশ্বনিয়ন্তার নির্বাচিত জাতি। ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে লিপ্ত ইহুদিদের সঙ্গে জিহোভা-র সম্বন্ধের বিবরণই তো ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ বা ‘পুরনো সন্ধি’-তে, বাইবেল বা পবিত্র গ্রন্থ-এর প্রথম খণ্ডটিতে। ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ ইতিকথা ও ক্রিয়াকর্মের সংহিতাবিশেষ, ইহুদি কৌম জীবনচর্চার দিগ্দর্শন, ঐশী গ্রন্থের মান্যতায় স্বীকৃত। এহেন সংহিতা গ্রন্থের সিংহভাগ জুড়ে আছে মোজেস, জেরমিয়া বা দানিয়েলের মতো জিহোভা-আদিষ্ট প্রবক্তাদের কর্মকথা, তাঁদের নির্দেশিত বিধান ও জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁদের মুখনিঃসৃত নানা প্রত্যাদেশ। ইহুদি ভক্তদের কাছে এই সব প্রত্যাদেশ দুঃসহ বর্তমান থেকে উত্তরণের আশ্বাস বহন করত, এই সব আদেশের মধ্যেই আছে অতীতের কল্পস্মৃতি রাঙানো আগামী কোনও এক প্রলয়োত্তর স্বপ্নসম্ভব স্বর্ণকালের হাতছানি।
এহেন দলিত, অথচ আত্মগর্বী সমাজে জিশুর কর্মজীবন বিবৃত হয়েছে বাইবেলের দ্বিতীয় খণ্ডে, ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ বা ‘নতুন সন্ধি’ নামেই পরিচিত, মার্ক, মথি, লুক ও জোহন নামে চার জনের লেখা গসপেল পর্বে। গসপেল দিয়েই ‘নিউ টেস্টামেন্ট’-এর শুরু। জিশু নিজে কিছু লিখে যাননি। তাঁর মৃত্যুর আনুমানিক ৩৫ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে খ্রিস্ট-ভক্তদের লেখা চারটি গসপেল বা সুসমাচার বা মঙ্গলবার্তাই জিশুর চরিতকথা। সাক্ষাৎ শিষ্যদের স্মৃতিতে ধৃত টুকরো ঘটনা ও মুখফেরতা বাণীগুলোকেই আখ্যানের আকারে গসপেল-লেখকরা সাজিয়ে ফেলেছিলেন। লেখকদের ঝোঁক অনুযায়ী অবশ্যই তথ্য পরিবেশন ও কথার স্বাদে পার্থক্য ঘটেছে। কারও লেখা সুসমাচারে মানবপুত্র জিশু প্রাধান্য পেয়েছেন, প্রকৃত মানুষরূপেই নাজ়ারেথের জিশু রেগে যান, হতাশ হন, দুঃখে ভেঙে পড়েন, আবার শান্ত হয়ে সাহসভরে ভবিতব্যের মোকাবিলা করেন। আবার কারুর লেখা সুসমাচারে জিশু সরাসরি ঈশ্বরপ্রেরিত মহান প্রবক্তারূপে চিহ্নিত হয়েছেন, ঈশ্বর নির্দেশিত পথের পথিক তিনি, সেই অনুযায়ীই তাঁর জীবনপর্ব বিন্যস্ত। একটি রূপ আর একটি রূপকে নাকচ করে না, কেবল রূপপ্রাধান্য অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন গসপেলের ঘটনা উপস্থাপনায় ও ভাষাভঙ্গিতে ইতরবিশেষ ঘটেছে, কিছু কথা বাদ গিয়েছে আর কিছু যোগ হয়েছে। প্রতিসরণ, স্পর্শক ও প্রতিচ্ছদের সমবায়ে গঠিত ভিন্ন ভিন্ন গসপেলে অন্বিত জিশুচরিত বহুকৌণিকতার আকারে ধরা পড়ে। এই গসপেলগুলি নিউ টেস্টামেন্ট-এর প্রাথমিক পর্ব, তবে রচনার ভাষা আদৌ অ্যারামাইক বা হিব্রু নয়, বরং ‘কয়নি’ বা কথ্য গ্রিক, তৎকালীন পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকাকূল বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সর্বজনবোধ্য ভাষা। ভক্ত লেখকরা নিছক জুদাইয়াতে জিশুর জীবনমাহাত্ম্যকে ধরে রাখতে নারাজ ছিলেন।
গসপেল অনুযায়ী, সাবেক আমলের মোজেস বা দানিয়েলের মতো জিশুর মানবজীবন চমকপ্রদ ঘটনায় পূর্ণ নয়। তিরিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি পারিবারিক পেশাতেই নিয়োজিত ছিলেন। প্রবক্তারূপে তাঁর জীবন মাত্র তিন বা সাড়ে তিন বছরের। গ্রামে, ছোট শহরে, হ্রদ ও পাহাড়ের সংলগ্ন ছোট জনবসতিতে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। গালিলির জেলে, রাখাল ও কৃষকদের মধ্যেই প্রধানত তাঁর প্রচারকাজ চলত, সমাজের কয়েক জন ঘরছাড়া, প্রান্তিক মহিলাও তাঁর অনুগামী হন। তবে জিশু ব্যাধি ও বিকার সারাতে ওস্তাদ ছিলেন, লাগসই গল্প বলাতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাঁর বলা প্যারাবল বা উপমাকথা তো বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ।
মথির গসপেলে সঙ্কলিত জিশুর পর্বতে উপদেশাবলি পরস্পরনির্ভর সদাচারী মানুষের গার্হস্থ্য তথা সমাজজীবন গড়ে তোলার ব্যবহারবিধি। ওই উপদেশগুলো পড়লেই বোঝা যায় যে, ঈশ্বরভীরু ছাপোষা গৃহস্থ পরিবারই ছিল তাঁর প্রচারের উদ্দিষ্ট। অন্তরের শুদ্ধতাতেই জিশুর আস্থা, লোকদেখানো ক্রিয়াকর্মের প্রতি তাঁর ঘৃণা আত্যন্তিক। মার্ক-এর লেখা প্রথম গসপেলে জিশু নিজেকে বার বার মানবপুত্র বলেছেন। সর্বময় শাস্তা হবার বড় একটা ইচ্ছে তাঁর ছিল বলে মনে হয় না, অবশ্যই তাঁর শিষ্য ও আশপাশের জনমণ্ডলীর প্রত্যাশা ছিল অন্য। ভারতীয় হিসেবে চকিতে খেয়াল আসে যে, নিজের প্রার্থনাসভায় গাঁধীজি মাঝে মাঝেই এই উপদেশমালা পড়তেন, জিশুর বাণীতে স্বরাজি মানুষ তৈরি করার নৈতিক প্রেরণা খুঁজে পেতেন।
তবে জিশু নিছক ধর্মসংস্কারক নন, বরং জাতির ধর্মভাবনায় রূপান্তর ঘটাতে চেয়েছিলেন। পুরনো সন্ধি সম্মাননীয়, কিন্তু অপূর্ণ। তাঁর নতুন সন্ধির বার্তা অভিনব ও পূর্ণ। পরম্পরার শেকল ভাঙতে জিশু আগ্রহী, মথির সুসমাচারে জিশু মনে করিয়ে দেন যে, টাটকা মদ কেউ পুরনো চামড়ার ভিস্তিতে রাখলে ভিস্তির গায়ে ফাট ধরে মদ পড়ে যায়, ভিস্তিও নষ্ট হয়। নতুন চামড়ার ভিস্তিতে নতুন মদ রাখতে হয়, তবেই মদ টাটকা থাকে। জিশুর মতে অহিংসা দিয়েই হিংসা জয় সম্ভব, তাই কেউ তোমার ডান গালে চড় মারলে মুখ ঘুরিয়ে অন্য গালটিও তার দিকে পেতে দাও। এই রকম কথা জিহোভাপ্রেরিত মোজেস ও এলাইজার মুখে উচ্চারিত হওয়া অসম্ভব ছিল। মৌলিক রূপান্তর ঘটেছে ঈশ্বরচেতনায়। জিশুর কল্পিত স্বর্গরাজ্যে পাপীর অন্যায়কে সাত বার নয়, বরং সত্তর গুণ সাত বার ক্ষমা করা বিধেয়। এ ভাবে ওল্ড টেস্টামেন্টের ইহুদিদের আরাধ্য নিষ্করুণ দণ্ডদাতা জিহোভা হয়ে উঠেছেন পরমকারুণিক বিশ্বপিতা, মমতাময় সর্বজনীন দেবতা। ইহুদি-অনিহুদির কাছে সমভাবে ঈপ্সিত পাপী জনশরণপ্রভু জিশুর আনা সুসমাচারের সুষমার সারকথা এটাই।
চারটি গসপেলই একমত যে, তাঁর শেষ পরিণতিটা জিশু ভালমতো আন্দাজ করেছিলেন। তাঁর সহজ সরল বাণীর আবেদন ও পাপীতাপী নির্বিশেষে সর্বজনের ত্রাণকর্তা পরমেশ্বরের জন্য প্রার্থনা জিহোভা মন্দিরের রক্ষক ধর্মব্যবসায়ী সাদুকি পুরোহিতকুল ও ইহুদি সমাজগৃহের বিধানবাদী গোঁড়া ফরিসিদের কায়েমি স্বার্থকে ধাক্কা দিয়েছিল। দণ্ডনায়ক পিলাত চরম দাম্ভিক, শাসিতের প্রতি উদাসীন। জিশুর আপন পরিকরদের মধ্যে কেউ বা বিশ্বাসঘাতক, কারও বা বিশ্বাসের ভিত নড়বড়ে।
জিশুর স্থৈর্য ও শান্ত সাহস এই সব মুহূর্তে ধরা পড়েছে। জোহনের গসপেল অনুযায়ী, মহাযাজক দোর্দণ্ডপ্রতাপ আন্নার প্রশ্নের মুখে বন্দি জিশু সাফসুতরো জানান যে, তিনি তাঁর বক্তব্য জনসমক্ষে বারংবার বলেছেন, কোনও লুকোছাপা করেননি, অতএব সাধারণ লোকদের জিজ্ঞাসা করলেই তাঁর প্রচারের সত্য-মিথ্যা জানা যাবে। জিশুর উক্তিতে সেপাই তাঁকে চড় মারে। মার খাওয়ার পর অকুতোভয় জিশুর জবাব বরিশালবাসী কবি-অনুবাদকের ভাষায় শোনা যাক, ‘‘বলিলেন যীশু যদি বলিনু অন্যায়/ কি অন্যায় তাহা কেন বল না আমায়/ আমি যদি ন্যায্য কথা বলে থাকি আর/ কি জন্য আমাকে তবে করিলে প্রহার।’’ জেরুসালেমের মন্দিরে সব নিপীড়নের সামনে শুদ্ধ ও আত্মশীল, কমবেশি তিরিশ বছরের যুবা, নাজ়ারেথের জিশু নিজের বাক্স্বাধীনতায় অনড়। তাই জিশুর মৃত্যুবরণ সব মানুষের হয়ে এক পরমশুদ্ধ সত্তার আত্মত্যাগ, সেটাই তো পুনরুজ্জীবনের শর্ত। জোহনের মতে, ক্রুশবিদ্ধ জিশুর অন্তিম কথা ছিল, ‘তেতেলেসতাই’। অর্থাৎ ‘সমস্তই শেষ হল’।
‘কালান্তর’-এ সঙ্কলিত ‘শক্তিপূজা’ নামে এক সংবেদী প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন যে, ইতিহাসের আবর্তনে খ্রিস্টধর্মে ও তত্ত্বে ‘দুই বিরুদ্ধভাব’-এর টানাপড়েন চলেছে। দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই দুর্দমনীয় খ্রিস্টধর্ম প্রচারকরা ‘নতুন সন্ধি’-র বার্তা নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়। সন্ত পল ও সন্ত পিতরের মত শিরোধার্য করে জেরুসালেমের ছোট নাজ়ারীয় সম্প্রদায় থেকে সিরিয়া, গ্রিস ও এশিয়া মাইনরের একাধিক খ্রিস্টানমণ্ডলী থেকে রোমান ক্যাথলিক চার্চের আওতায় পোপ-শাসিত খ্রিস্টীয় জগৎ বা ‘Christendom’-এর রূপান্তরের ইতিহাস বহুকথিত ও বহুবিতর্কিত। তবে চার্চেরই প্রাতিষ্ঠানিক আইকন রাজসিক খ্রিস্ট, পবিত্র পিতা-পবিত্র সন্তান-পবিত্র আত্মার এক অন্বয় মূর্তি। রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে বলতে পারি, নাজ়ারেথের জিশুর পরিবর্তে পশ্চিমের চার্চের রাজসিক খ্রিস্ট ও তাঁর ঈশ্বর ‘যুদ্ধের দেবতা, ভাগাভাগির দেবতা, সাম্প্রদায়িক দেবতা’। অনেক নজির আছে, তিনটি মাত্র পেশ করছি।
১০৯৬ খ্রিস্টাব্দ। মিশরের ফতিমাইদ খলিফার শাসন থেকে পবিত্র শহর জেরুসালেমকে মুক্ত করার জন্য পোপ দ্বিতীয় আরবান ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন, তাঁর নিজের ঘর সামলাতে হবে। ক্রুসেডারদের জন্য ইহলৌকিক পাপাচার থেকে রেহাইনামা বিলি করার ঢালাও বন্দোবস্ত ছিল। এক স্তরে আমন্ত্রিত সামন্তযোদ্ধারা তৈরি করেছিল ‘নাইটস অব সেন্ট জন’ আর ‘নাইট টেম্পলার’-এর মতো জঙ্গি সংগঠন, কোনও কোনও নাইটের আবার যুদ্ধের ফাঁকে ব্যবসা ও সুদের কারবারেও আগ্রহ ছিল। অন্য স্তরে সাড়া দিয়েছিল অসংখ্য গরিবগুরবো কৃষক, খ্রিস্টের শেষ যাত্রার জিগিরে প্রাণিত তীর্থযাত্রীর দল। এদের ছেঁড়াখোঁড়া জোব্বায় একটা করে ক্রুশচিহ্ন বোনা থাকত। যুদ্ধকালে খ্রিস্ট ও তাঁর পরিকররা প্রদর্শক হবেন, এই স্বপ্ন ও প্রত্যাশাতেই তারা বিভোর। অশ্বারোহী শ্বেতকায় জিশু বাইবেল হাতে ক্রুসেডারদের পথ দেখাচ্ছেন, এই রকম সমসাময়িক চিত্র দুর্লভ নয়।
ষোড়শ শতকে ইউরোপে পোপ ও ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে ধর্মবিপ্লবের নেতা মার্টিন লুথার, নিউ টেস্টামেন্টের জিশু ও তাঁর সন্তদের বাণীই তাঁর আদর্শ। তবে লুথার জিশুর পাশাপাশি সন্ত পলকেও শ্রদ্ধা করতেন। পলের রোমীয় ধর্মপত্রানুসারে রাজশাসকদের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য প্রকাশই তো খ্রিস্টানদের কর্তব্য। ওই আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে লুথার নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, যে কোনও কৃষক বিদ্রোহীকে খেপা কুকুরের মতো মেরে ফেলাই খ্রিস্টবিশ্বাসীর দায়িত্ব। আবার গসপেলের খ্রিস্টহত্যার বিবরণের জিগির তুলেই এই বরেণ্য ঐতিহাসিক পুরুষ ইহুদিবিদ্বেষী প্রচারপুস্তিকা লেখেন। পরবর্তী কালে নাৎসিরা জাতিবিদ্বেষের তত্ত্বে খ্রিস্টান ধর্মগুরু লুথারের বক্তব্য ব্যবহার করতে দ্বিধা করেননি।
১৯৩৮-৪০ সালে প্যালেস্টাইনে ইংরেজ সরকারের পোষকতায় খ্রিস্টভক্ত, আরবি ভাষায় দুরুস্ত, অর্দে উইনগেট এক হাতে বাইবেল আর অন্য হাতে রাইফেল নিয়ে ঘুরে বেড়াত। বাইবেল থেকে পছন্দসই এলাকা বাছা আর এক দল ঠ্যাঙাড়ে নিয়ে সেই এলাকার আরব-বাসিন্দাদের ঝাড়ে-বংশে নিকেশ করাই ছিল এই খ্রিস্টভক্তের কাজ। বিশ্বযুদ্ধের বাজারে মিত্রশক্তি মহলে বীর সেনানী হিসেবে তার নামও হয়েছিল। ‘হোয়াইট লর্ড জেসাস’ নিছক কবিকল্পনা নয়।
অথচ পাশ্চাত্যে আরাধ্য জিশুর প্রভুমন্য লড়াকু অবয়বই সর্বজনমান্য নয়। তিনি প্রাচ্যের সাধকও বটে। ধলা, কালো, হলদে বা বাদামি বর্ণবিশিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভাব নানা রূপ ও প্রতীকের অনুষঙ্গে তিনি বন্দিত হন। ইথিয়োপিয়ার চার্চে ক্রুশচিহ্নিত নূহ-র নৌকোর প্রতীকই তাঁর আরাধ্য রূপ। ভক্তরা জিশুকে ‘তওয়াহেদো’ বা ঐশ্বরিক ও মানবিকের পূর্ণ বিধায়ক বলে মনে করে। ‘তৌহিদ’ বা স্রষ্টা ও সৃষ্টের অভেদ কল্পনা তো ইসলামি সুফি চিন্তার একটি কেন্দ্রীয় তত্ত্ব।
১৯৯৪ সালে ‘ফ্রম দ্য হোলি মাউন্টেন’ নামে একটি মনোজ্ঞ ভ্রমণকাহিনিতে অজস্র উদাহরণ দিয়ে উইলিয়াম ডালরিম্পল দেখিয়েছেন, পশ্চিম এশিয়ায় জিশু চরিত্র ও তার সাধনচর্চা পরিকর সাহায্যে নিজস্ব অক্ষে আবর্তিত হয়েছে। যেমন আনাতোলিয়ায় চতুর্থ শতকে স্থাপিত সন্ত স্যর গেব্রিয়েলের মঠটি বিশ শতকের শেষেও সজীব, কাকভোরেই উপাসকরা সারি বেঁধে প্রার্থনা শুরু করেন। স্তোত্র আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে উপাসকরা এক সঙ্গে দাঁড়ান, আবার নতজানু হন, মাথা দিয়ে ভূমি স্পর্শ করেন, আবার সমবেত ভাবে উঠে পড়েন। এই ওঠা ও বসার মধ্যে তাঁরা দেহে ক্রুশচিহ্ন আঁকতে থাকেন। এক লহমার জন্য ডালরিম্পলের মনে হয়েছিল, যেন মসজিদে মোমিনদের নমাজ চলছে, শুধু ক্রুশচিহ্ন আঁকার আচরণটি আলাদা। গত দেড় হাজার বছর ধরে প্রাচ্যবাসী খ্রিস্টভক্তরা এই রীতিতে প্রার্থনা করে চলেছেন। রীতিটি ইসলামি উপাসনার ঐতিহ্যে বাহিত হয়েছে, পাশ্চাত্যে কোনও গির্জার অঙ্গনে এহেন খ্রিস্ট-উপাসনার স্থান নেই।
জাতিবিদ্বেষে দীর্ণ আজকের ইজরায়েলের ছোট জনপদ বেইত-জালা, জেরুসালেম থেকে অল্প দূরে। খ্রিস্টবিশ্বাসীদের কাছে ওই জনপদটিই সেন্ট জর্জের জন্মস্থান। সেন্ট জর্জ তো শ্বেত অশ্বারোহী বল্লমধারী বর্মাবৃত নাইট, ব্রিটেনের পেট্রন-সেন্ট, আরাধ্য রক্ষক, তাঁর প্রসাদেই তো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না। আল্লার মোমিনদের মতে, ওই থানটি মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত পীর খাজা খিজিরের আস্তানা। সবুজ জোব্বা গায়ে অশ্বারোহী পীর পথ-হারানো পথিকদের পথ চেনান, তাঁরই বরকতে খরা কেটে যায়, বন্ধ্যা নারী সন্তানবতী হয়। সাদা সেন্ট জর্জ আর সবুজ খাজা খিজিরের কৃপায় আজকাল লোকে চাকরিও পায়। পীঠস্থানে খ্রিস্টান ও মুসলিম ভক্তদের ভিড় লেগেই আছে। ভক্তদের পছন্দ অনুযায়ী, সেন্ট বা পীর, যে যার রূপে বা বর্ণে দেখা দেন, সহজেই এক জন আর এক জনের পরিবর্ত হন।
জিশু স্বপ্ন দেখতেন আর দেখাতেন, তাঁর কাছে অনেকের অনেক প্রত্যাশা ছিল, অনেকের শঙ্কাও ছিল। খোদ নিউ টেস্টামেন্ট শেষ হয়েছে কোনও এক সন্ত জোহনের প্রত্যাদেশে, যুগান্তের ডাকে, ঐশ রাজ্য শুরু হওয়ার প্রকল্পে। নানা চিত্রকল্প, উপমা ও রহস্যে পূর্ণ প্রত্যাদেশটি। যেমন, সাত-সাতটি সিলমোহর ভেঙে কোনও এক রহস্যপুঁথি খুলতে হয়, যুগান্তের ক্ষণ ঘোষণা করে বার বার তূর্যধ্বনি ধ্বনিত হয়, শুভ ও অশুভের চরম লড়াইয়ের প্রস্তুতি চলে। এশিয়া ও আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই সব রূপকল্প ও ইঙ্গিতকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল রকমারি গসপেল, সন্ত টমাস, সন্ত ফিলিপ আর মাগদালা মেরির সুসমাচার, এমনকি বিশ্বাসঘাতক জুদা ইসকারিয়তের নামেও মঙ্গলবার্তা পাওয়া গিয়েছে। গসপেলগুলিতে জিশুর বাণী বদলায়, স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক সন্তরা ধিকৃত হন, লিঙ্গ, ধর্ম বা গোত্রভেদ বার বার লঙ্ঘিত হয়। দেশকালভেদে জিশু নামে এক ক্রান্তিপুরুষের কল্পস্বপ্নের ডাকে বিভোর হয়ে সাড়া দেন জলজঙ্গলের নানা মানুষ। যুগাবসানের আশায় কখনও বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, কখনও বা ছোটনাগপুরের বীরসা ভগবানের উলগুলানের গানে ওই কল্পান্তেরই অনুরণনই শুনতে পাওয়া যায়। অন্য প্রেক্ষিতে কালান্তরের পুরুষের প্রত্যাদেশ প্রাণিত করে ব্লেকের কবিতা বা বার্গম্যানের ছবি। মানবসংস্কৃতির নানা পরতে হাজির মানবপুত্র জিশুকে কোনও গসপেলের দাগানো অভিজ্ঞতায় বাঁধা যায় না, তিনি চিররূপান্তরী চরিতের অধিকারী।
জিশু শ্বেতাঙ্গ না কৃষ্ণাঙ্গ, এই তর্ক সংস্কৃতির রাজনীতি, ক্ষমতার সাম্প্রতিকতা ও ঐতিহাসিকতার টানাপড়েনে সিদ্ধ। রাজনীতি ছাপিয়ে জিশুর জীবনী মানবপুত্র থেকে ঈশ্বরপুত্ররূপে প্রকাশ হবার আখ্যান, আখ্যানটি একটি জিজ্ঞাসায় দীর্ণ। জিজ্ঞাসাটি চরিত্রে হয়তো বা একটু অ্যানথ্রোপসিন—
‘নিদারুণ দুঃখরাতে/ মৃত্যুঘাতে/ মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্ত্যসীমা/ তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy