Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প
Short story

এক লক্ষ তেইশ হাজার চারশো ছাপান্ন

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২২ ০৯:৪৫
Share: Save:

এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়— পর পর বসালে কত হয়? এক লক্ষ তেইশ হাজার চারশো ছাপ্পান্ন। এই বার ধরো, এইটে হচ্ছে তোমার জীবনের ধার, মহাকালের কাছে। শোধ না করে মরলে, মরার পরে শোধ করতে হবে। তার চাইতে বেঁচে থাকতে শোধ করে দেওয়া কি ভাল নয়? কিন্তু কী ভাবে শোধ করবে? ‘কাম’ ইজ় ইকুয়াল টু এক; ‘ক্রোধ’ আর দুই সমান সমান; ‘লোভ’ ইকুয়ালস টু থ্রি; ‘মোহ’ ধরো চার, ‘মদ’ মানে পাঁচ আর মাৎসর্য ছয়। এ বার তুমি ঈর্ষা কমিয়ে ফেললে মানে এক লক্ষ তেইশ হাজার চারশো ছাপান্ন টাকা থেকে ছ’টাকা শোধ হল তোমার। অহঙ্কার ধ্বংস করে ফেলো যদি, আরও পঞ্চাশ টাকা কমল। একই ভাবে মোহ না থাকলে চারশো টাকা আর লোভ না থাকলে তিন হাজার টাকা শোধ। কিন্তু ক্রোধ? ক্রোধ যত ক্ষণ না বিসর্জন দিচ্ছ তত ক্ষণ কুড়ি হাজার টাকা বাকি থাকছেই। আর ক্রোধ চলে গেলেও তোমার মুক্তি নেই কারণ ওই, ‘এক’ অর্থাৎ এক লক্ষ টাকা ধার রইল। এ বার, কামনা আর বাসনা সবটাই কিন্তু কামের মধ্যে পড়ছে। এই একটু আগে লিফটে এখানে আসার সময় তোমার সঙ্গে একটি মেয়ের ধাক্কা লেগেছে, তুমি নিজেই এসে বললে। আচ্ছা, তুমি কি চাইছিলে যে ধাক্কাটা লাগুক? আচমকা লেগে গেলে তো অতটা মনে থাকার কথা নয়! আসলে কী জানো, ওই রূপ, ওই শরীর, ওই যে সামনের দোকানের খাদ্যাখাদ্য কিংবা ইলেকট্রনিক গ্যাজেটগুলো সব এমনিই তোমায় ছুঁচ্ছে। তুমি যদি ওদের না দেখে, পাত্তা না দিয়ে চলে যাও, তাই ওরা তোমার ইন্দ্রিয়গুলিকে স্পর্শ করে জানান দিতে চাইছে নিজেদের অস্তিত্ব! যে কোনও দোকানের সামনে ধ্যানে বসা বুদ্ধ বা ক্রুশবিদ্ধ জিশুর ছবি কেন থাকে না? কেন, শরীরের অনেকটা খুলে রাখা কোনও মডেলের ছবি থাকে?”

কথাগুলো শোনার থেকে বেশি করে বক্তাকে দেখছিল শতদ্রু। এই উইকেন্ডে ওর স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে একটা গেট-টুগেদারে যাওয়ার কথা ছিল। দীর্ঘ দিন আমেরিকায় থাকা দুই ক্লাসমেটের সৌজন্যে রায়চকে একটা রিসর্ট ভাড়া নেওয়াও হয়ে গিয়েছিল। অথচ ঘটনাটা ঘটানোর পিছনে যার অনেকটা শ্রম এবং পরিকল্পনা ছিল সেই শতদ্রু রায় এই মুহূর্তে দিল্লির একটা অডিটোরিয়ামের দর্শকাসনের সামনের সারিতে বসে আচার্য প্রহ্লাদের বক্তৃতা শুনছে।

“সাংবাদিকের জীবন এ রকমই বাবু!” শতদ্রুর ছুটির অ্যাপ্লিকেশন বাতিল করে উদাস ভঙ্গিতে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে রাজাদা বলেছিল।

“কিন্তু কে এই আচার্য প্রহ্লাদ, যার জন্য একেবারে হিল্লি-দিল্লি ছুটতে হবে?” শতদ্রু, রাজাদার চেম্বারে বসে লোকটার অনেক ছবি দেখতে দেখতে বলেছিল।

“তুই কোন জগতে থাকিস যে, এখনও আচার্য প্রহ্লাদের নাম শুনিসনি? ফেসবুকে একচল্লিশ লক্ষ ফলোয়ার লোকটার। বলতে পারিস, ইন্ডিয়ার স্পিরিচুয়াল মানচিত্রে, হি ইজ় দ্য নিউ সেনসেশন। ওর এক-একটা বাণী, এক-একটি কাজ, আলোড়ন ফেলে দেয়। আমাদের কোম্পানির বিগেস্ট শেয়ারহোল্ডার চৌহানদের বাড়ির যজ্ঞ করতে গিয়ে লোকটা কী করেছিল বল তো?”

“কী করে জানব?”

“বড় চৌহানের বৌকে বলেছিল, গলার পাঁচ ভরি সোনার হারটা আগুনে ফেলে দিতে।”

“মানে?”

“মানে এই যে, আগুনে ফল-টল আহুতি তো সবাই দেয়, তুমি তোমার গলার হারটা ফেলে দিয়ে দেখাও যে আগুনকে কতটা ভালবাসো।”

“দিয়েছিল ফেলে? অবশ্য ওদের কোটি-কোটি টাকা…”

“টাকার ব্যাপার নয় শুধু। এই যে ছকের বাইরে গিয়ে ভাবতে পারা…”

“এতটা সোনা নষ্ট করাটা বুঝি…”

রাজাদা থামিয়ে দিয়েছিল শতদ্রুকে, “নষ্ট কোথায় হল? আগুনে অলঙ্কার গলে যায়, সোনা তো সোনাই থাকে।”

“তুমি কি চাইছ আমার থেকে?”

“চাইছি যে তুইও অলঙ্কার গলিয়ে ফেলে, খাদ ফেলে দিয়ে, সোনাটাকে বার করে নিয়ে আয়। আচার্য প্রহ্লাদকে নিয়ে এমন একটা স্টোরি কর, যেখানে ওর ভিতরের মানুষটা জ্বলজ্বল করবে, বাইরের আবরণ নয়।”

এ-এগারো সিটে বসে অবশ্য প্রহ্লাদের বাইরের চেহারাটাই চোখে পড়ছিল শতদ্রুর। রবীন্দ্রনাথের আলখাল্লার ঢঙে একটা ঘিয়ে আলখাল্লা গায়ে, গালে কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা। পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের ভিতরে বলেই মনে হয় বয়স, আর ওঁর সামনে যে লোকটা ভ্যাবলা মুখে দাঁড়িয়ে আছে, যার লিফটের ভিতরের অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প ফেঁদেছেন আচার্য প্রহ্লাদ, সে তিরিশের আশেপাশে।

শতদ্রুর এক বার ইচ্ছে হল মঞ্চে উঠে গিয়ে, ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে বলে আসে যে, আদম ভাগ্যবান বলেই ইভের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গিয়েছিল তার। কিন্তু আচার্য প্রহ্লাদ ঠিক বিরিঞ্চিবাবা নন। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে উনি ফের বলতে থাকলেন, “অর্ধনগ্ন কোনও মেয়ের ছবি দেখলেই একটি পুরুষের ভিতর পৌরুষ জেগে ওঠে। সেই পৌরুষ তাকে নিজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে আর নিজের কাছে জরুরি হয়ে উঠলেই না মানুষ নিজের জন্য খরচ করবে? গায়ে-হাতে-পায়ে পেরেক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জিশু কিংবা গাছের নীচে বসে থাকা উপবাসে শীর্ণ বুদ্ধের ছবি তো তাকে, নিজেকে তুচ্ছ ভাবাবে। যে তুচ্ছতার বোধে আক্রান্ত সে খরচ করতে যাবে কেন?”

সেকেন্ড রো-র এক জন ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এখন কিন্তু কেবল অর্ধনগ্ন নারীর ছবি থাকে না ঝাঁ-চকচকে দোকানে, সেমি-ন্যুড পুরুষের ছবিও থাকে। নারীর কাছে কিছু বেচার জন্য আজ পুরুষকেও পণ্য বনতে হচ্ছে। অর্থাৎ আপনার থিয়োরি অনুযায়ী দেখলেও, মেয়েদের নিজেদের জায়গা বুঝে নেওয়ার ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।”

প্রহ্লাদ হেসে উঠলেন, “আমার কোনও থিয়োরি নেই, আমার একটা অনুভব রয়েছে। আর সেই অনুভব বলে, গরুর পিঠের ঘা দেখিয়ে যদি কেউ মাছিকে শোনায় যে ওটাই তার জায়গা, ওখানে গিয়ে তাকে বসতে হবে, সে কি মাছিকে সম্মান দেয়? মেয়েদেরও যদি, ছেলেদের মতোই, বিপরীত লিঙ্গের উত্তেজক ছবি দেখিয়ে প্রলুব্ধ করা যায়, তবে ব্যবহৃত হওয়ার বিরুদ্ধে লড়াইটার কী দাম থাকল? মূল বিষয়টা বোধহয় একটু অন্য। উত্তেজিত না হলে, মেয়ে হোক বা ছেলে, বই কিনবে, সাহিত্য বা বিজ্ঞানের পত্রিকা কিনবে; লঁজারি কিংবা জুতোই যে ব্যক্তিত্বের মাপকাঠি— এই ভ্রান্তি তার মাথায় আসবে কী করে?”

শুনতে শুনতে স্মৃতির ভুলভুলাইয়ায় ঢুকে পড়ল শতদ্রু। সম্পর্কটা থাকাকালীন, তমশ্রীর সঙ্গে একটা থ্রি-ডি সিনেমা দেখতে গিয়েছিল ও, যেখানে হলের ভিতর ঢোকার আগে চশমা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল হাতে। চশমাটা চোখে দিতেই বনের আগুন যেন সামনের সিটে এসে লাগল। আশপাশ থেকে হাওয়া এসে ফুলকিদের ঠেলে দিল গাছগুলোর মগডালে। তমশ্রী আর শতদ্রুও হয়ে উঠল আগুন লাগা এক-একটা পাতা, যাদের ভিতরকার রাসায়নিক দ্রব্যসমূহ ফেটে পড়ছিল চুম্বনে-চুম্বনে, চারিয়ে যাচ্ছিল পোশাক থেকে পোশাকে। জোরে হাওয়া বইছিল, পর্দায় আর ওদের দু’জনের মধ্যেও। নীচের আগুন যত উঁচুতে উঠছিল, তলার আগুন নিভে যাচ্ছিল তত, কারণ নীচের বাতাসকে গিলে ফেলছিল উপরের হাওয়া। ওদের দু’জনের ঠোঁটও দু’জনকার ফুসফুসের সব বাতাসকে টেনে নিচ্ছিল আর অসহ্য আনন্দের মধ্যেও দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি করছিল।

প্যাঁক প্যাঁক করে তিনটে মেসেজ ইনবক্সে ঢুকতেই ঘোরটা কেটে গেল শতদ্রুর। সাংবাদিককে রিসার্চ করেই নিজের সাবজেক্টের কাছে যেতে হবে সেই বিশ্বাসে ও বন্ধু শ্রীবিলাসের কাছে জানতে চেয়েছিল আচার্য প্রহ্লাদের ব্যাপারে। পেশায় বিজ্ঞানী হলেও ইদানীং বৌয়ের পাল্লায় পড়ে খুব ধম্মেকম্মে মন গেছে ছেলেটার। আমেরিকা থেকে ও আসছে আর শতদ্রু চলে যাচ্ছে দিল্লিতে, তাই নিয়ে বাকিরা চোটপাট করলেও শ্রীবিলাস দার্শনিকের মতো বলেছিল, “ঈপ্সিত বস্তু না পাওয়াই হয়তো ইচ্ছেকে বাঁচিয়ে রাখে।”

“পরের সপ্তাহেই দেখা হচ্ছে” প্রতিশ্রুতি দিয়ে শতদ্রু দিল্লিতে ল্যান্ড করেছিল।

শ্রীবিলাস কেবল কথাই লেখেনি, ছবিও ফরোয়ার্ড করেছে। সেই সব কথা আর ছবির ভিতর আধ্যাত্মিকতা নেই, একদম পিয়োর বিজ্ঞান।

“...যে-কোনও পূর্ণতাই একটা ভ্যাকুয়ামের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বলে; মধ্যরাতের সূর্য যেখানে জ্বলজ্বল করে, মধ্যাহ্নের গুরুত্ব সেখানে থাকে না। তাই তো বলি, যত কারও আপন হওয়ার চেষ্টা করবে, তত ডুবে যাবে পাতালে। তোমার আকাশে ওড়ার কথা, মাটির গভীরে তলিয়ে যাচ্ছ কেন? মায়া কাটাও, আপনাপন ভুল যাও। পরায়াপন সিখো...” আচার্য প্রহ্লাদের গলাটা এক ডেসিবেল বেশি ঠেকল কানে।

আপন-পর, পর-আপন, উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল শতদ্রু। পিছন থেকে আওয়াজ আসতেই, বসে পড়ল ফের।

*****

প্রত্যেক সাংবাদিকের জন্য বরাদ্দ সময় দু’মিনিট, হয়তো ওর সংস্থার নামের কারণেই তিন মিনিট অবধি সময় পেতে পারে বলে জানানো হয়েছিল শতদ্রুকে। কিন্তু নিজের কাজটা তিরিশ সেকেন্ডের ভিতর করে নেওয়ার হোমওয়ার্ক সেরে রেখেছিল শতদ্রু। আট জনের পরে যখন ওর ডাক এল তখন ভিতরে গিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাল ও আচার্য প্রহ্লাদকে।

“লেখার মতো কিছু পেলেন?”

“মেঘনা সান্যালের প্রেমিক হিসেবে যে লোকটার পরিচিতি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি জুড়ে, তার সম্বন্ধে লেখার মতো কিছু আপনার এই ওয়ার্কশপে ছিল কি?”

“শুধু মেঘনার প্রেমিক হিসেবেই পরিচিত? রঞ্জিত ভদ্রাচলমের আত্মহত্যার কারণ হিসেবেও কুখ্যাত নয় লোকটা?” আচার্য প্রহ্লাদের চোখ দুটো কী রকম জ্বলে উঠল।

“বলতে পারব না। প্রিন্সটনে যাইনি তো কখনও,” শতদ্রু ইচ্ছে করেই সেফ খেলল।

শতদ্রুর কথার উত্তরে কিছু না বলে, ইশারায় ওকে নিজের ঘরের লাগোয়া অ্যান্টিচেম্বারে অপেক্ষা করতে বললেন আচার্য প্রহ্লাদ।

সব সাংবাদিকের সঙ্গে কথা সেরে, প্রায় দু’ঘণ্টা পর শতদ্রুকে ফের ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে যেতেই বা হবে কেন কাউকে? ওটাই দুনিয়া নাকি?”

“দুনিয়ার বাইরেও নয়,” নিচু কিন্তু স্পষ্ট গলায় জবাব দিল শতদ্রু।

“শিবের তৃতীয় চোখ খুলে গেলে ভস্ম হয়ে যেতে পারে সব পাপ, কিন্তু সেই চোখ যদি সারা ক্ষণ বন্ধই থাকে, তবে পুণ্য নিজেকে বাঁচাবে কী করে?”

“স্যরি, কিছু বুঝতে পারলাম না।”

“বুঝতে পারার আগে আপনাকে জানতে হবে, যে রিসার্চের জন্য ভদ্রাচলমের নাম ছড়াল, তাতে ওর পঞ্চাশ ভাগ অবদান থাকলে আমারও পঞ্চাশ ভাগ ছিল। ইন ফ্যাক্ট, প্রথম যে সমীকরণটা এই গবেষণার দরজা খুলে দেয়, তা আমারমাথাতেই এসেছিল।”

“ভদ্রাচলম জানল কী করে?”

“মেঘনার প্রতি আমার আকর্ষণ এমন দুর্নিবার ছিল যে, একটি চুমুর বিনিময়ে ও আমাকে দিয়ে সব বলিয়ে নিতে পারত। আলাস্কা থেকে ফেরার রাতেও বলিয়ে নিয়েছিল। আর তার পর সেটা বলে দিয়েছিল ভদ্রাচলমকে। আমি হয়ে গিয়েছিলাম একটা কুকুর, যে বরফের উপর দিয়ে সেই স্লেজটা টেনে আনে যার ভিতরে প্রেমিক আর প্রেমিকা পরস্পরকে জড়িয়ে নিশ্চিন্ত আরামে বসে থাকে।”

“তাই প্রতিশোধ নিয়েছিলেন?”

প্রহ্লাদ হেসে উঠলেন, “প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করেছি ল্যাবরেটরিতে, প্রতিশোধে বিশ্বাস রাখি না। রঞ্জিতের এই চিঠিটার ভিতর সবটাই আছে, পড়ে দেখতে পারেন।”

“চিঠিটা প্রকাশ্যে আনেননি কেন এত দিন?” আচার্য প্রহ্লাদের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে দ্রুত চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল শতদ্রু।

“এখনও আনব না। রঞ্জিত আমার বন্ধু ছিল।”

“কিন্তু আনলে তো বিদেশে আপনার বদনাম ঘোচার একটা…”

“নামটাই তো পূর্বাশ্রমে ফেলে এসেছি, আমার আবার বদনাম! তা ছাড়া আমার ফুলগুলো দিয়ে যদি ও মালা গেঁথে থাকে, যদিও ওর নিজের কন্ট্রিবিউশনও ছিল অনেক, তাতে কী ক্ষতি? আবিষ্কারের সঙ্গে আবিষ্কারকের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকতেই হবে, এমনটা তো নয়।”

“তবে আবার শেষ মুহূর্তে ভদ্রাচলমের পেটেন্ট নেওয়া কেঁচিয়ে দিলেন কেন?”

“আমার মস্তিষ্কের কোষে যার শুরু, সেই আবিষ্কারকে রঞ্জিতের বলে মেনে নিতে সামান্যই অসুবিধে হয়েছিল আমার, কিন্তু মেঘনার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা এক পলকের জন্যেও মেনে নিতে পারেনি রঞ্জিত। তবে আত্মহত্যা কিন্তু ও সেই কারণে করেনি।”

“একটু খোলসা করবেন?”

“পেটেন্টটা পেলেই রঞ্জিত একটা মাল্টিন্যাশনালের কাছে সেটা বিক্রি করে দিত। খুব সম্ভব অ্যাডভান্সও নিয়ে রেখেছিল। এমনিতে কম কথা বললেও, জল আর অক্সিজেনের সংস্পর্শে ধাতুর বদল আটকে দেওয়ার রাস্তা খুঁজে পেয়ে মেঘনাকে জাপ্টে ধরে ও বলে উঠেছিল যে, এ বার কোটি-কোটি ডলার হাতে পাওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। ওকে দোষ দিতে পারি না, কিং-সাইজ বাঁচতে চাওয়ার ইচ্ছে অনেকেরই থাকে।”

“উনি সে ভাবে বাঁচলেও আপনার কী সমস্যা হত?”

“আমার হলে কিছু আসত-যেত না, সমস্যা ছিল মেঘনার। রঞ্জিতের জীবনের শরিক হলেও ভাবনার শরিক ছিল না মেঘনা। পরদিন সন্ধ্যায় তাই ছুটে এসেছিল আমার কাছে। আসলে আমার মতোই মেঘনার বিজ্ঞান-সাধনাও মানব-প্রেমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল, স্বয়ম্ভু ছিল না। আমরা দু’জনেই বিশ্বাস করতাম যে, এই পৃথিবীতে অসুখের মালিক থাকলেও থাকতে পারে, ওষুধের মালিক থাকতে পারে না। কেমোথেরাপির পর শরীরের অস্থিমজ্জা থেকে নতুন শ্বেতকণিকা সংশ্লেষ করায় পেগফিলগ্র্যাস্টিম। ক্যানসার-আক্রান্ত রোগীদের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই ওষুধ। পেগফিলগ্র্যাস্টিম-এর উন্নততর রূপ ভদ্রাচলমের হাত দিয়েই আসত পৃথিবীতে, কিন্তু তার মালিকানা কোনও একটি মাল্টিন্যাশনালের কাছে কুক্ষিগত থাকলে গরিব ক্যানসার পেশেন্টরা যেত কোথায়? ”

“পেগফিলগ্র্যাস্টিমের কথা বললেন আপনি?”

“হ্যাঁ। তার কারণ ওটা নিয়েই তো গোটা ঘটনা।”

“পেগফিলগ্র্যাস্টিম নিয়ে আমার জীবনেও একটা ঘটনা আছে। মায়ের ক্যানসার থার্ড স্টেজে চারিয়ে যেতে ডাক্তার খুব করে বলেছিলেন ওটার কথা। কিন্তু পারিনি, সামর্থ্যে কুলোয়নি আমাদের। পার ডোজ়, দশ থেকে এগারো লাখ টাকা খরচ, অ্যাফোর্ড করা সম্ভব? চোখের সামনে মাকে চলে যেতে দেখলাম, কিছু করতে পারলাম না!” শতদ্রুর গলা চোক করে গেল।

“সেই রাতে আমি আর মেঘনা যা করেছিলাম তাতে কোনও ভুল ছিল না তবে। হ্যাঁ, ওষুধের কমপোনেন্ট ফাঁস করার কারণ হিসেবে মেঘনা আমায় ব্যবহার করেছিল, কারণ ও তো আমায় নয়, রঞ্জিতকেই ভালবাসত। ভালবাসত বলেই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল…”

“আপনাকে ব্যবহার করে?”

“ব্যবহার করা আর ব্যবহৃত হওয়া আসলে একই কয়েনের এ-পিঠ আর ও-পিঠ, বিশ্বাসভঙ্গ আর বিশ্বাস-নির্মাণও তাই, যদি বৃহত্তর পটভূমি থেকে থাকে। আমাদের ছিল। রঞ্জিত যখন আবিষ্কার বিক্রি করতে চাইছে, আমরা তখন বিজ্ঞানকে বিক্রি হতে দিইনি। আমাদের সেই সিদ্ধান্ত মানতে পারেনি বলেই রঞ্জিতের কোটি কোটি ডলারের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে সে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিয়েছে নিজেকে। কিন্তু ওই ডিসিশনের জন্যই, আপনার মায়ের মতো অনেক মা বেঁচেযাবেন ভবিষ্যতে।”

“একটা ডোজ়ের দাম যদি…”

শতদ্রুকে থামিয়ে দিলেন প্রহ্লাদ, “দামটা আর ওই স্তরে থাকবে না তো। পৃথিবী জুড়ে তিনটে কোম্পানি এখন ওই আবিষ্কারকে ওষুধের রূপ দিয়েছে। আমি সব ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে এসেছি, কারণ রঞ্জিত চলে যাওয়ার পরও মেঘনা আমায় ভালবাসতে পারবে না, তা বুঝে গিয়েছিলাম। কিন্তু তা বলে আমরা যোগাযোগে থাকতে পারব না, তা তো নয়।”

“কী করছেন এখন মেঘনা সান্যাল?” প্রশ্ন করে শতদ্রু।

“রঞ্জিতের নামে তৈরি ট্রাস্টের মাথায় আছে, আর যে তিনটে কোম্পানি ওষুধটা বানাচ্ছে তারা বাজারে কম্পিটিটিভ প্রাইস রাখার পাশাপাশি ট্রাস্টকে অর্ধেক দামে ওষুধ বিক্রি করতে বাধ্য। ওই ট্রাস্টের মাধ্যমেই ভারতে ওষুধটা আনাচ্ছি আমরা। বলতে পারেন, মেঘনাই পাঠাচ্ছে। আর এখন, প্রতিটি ডোজ় কত করে পড়বে আন্দাজ করুন তো?”

শতদ্রু উত্তর খুঁজে না পেয়ে মাথা নাড়ল।

আচার্য প্রহ্লাদ ডান হাত বাড়িয়ে শতদ্রুর গালটা ছুঁয়ে বললেন, “ওই সকালের সেশনে আমি যে সংখ্যাটার কথা বলছিলাম। মানে, এক লক্ষ তেইশ হাজার চারশো ছাপ্পান্ন টাকা।”

অন্য বিষয়গুলি:

Short story Binayak Bandyopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy