ছবি: তারকনাথ মুখোপাধ্যায়
এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফিরতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। বাড়ি যখন পৌঁছলাম, তখন বিকেল। মা উদ্বিগ্ন মুখে বলল, “এত দেরি? সেই কখন প্লেন থেকে নেমে ফোন করলি!” হেসে বললাম, “তোমাদের শহরের যা যানজট...”
বাবা বলল, “যা বলেছিস! কিন্তু বাবাই, এটা তো তোরও শহর... যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে।”
ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করতে করতে ভাবলাম, ‘সত্যি! এটা তো আমারও শহর!’ এই শহরেই আমার বড় হওয়া, লেখাপড়া, কৈশোর, যৌবন... বছর দেড়েক মোটে চাকরিসূত্রে বেঙ্গালুরুতে আছি। সেখানকার জীবন দ্রুত, ঝাঁ চকচকে।
মা-র ডাকে চমক ভাঙল, “বাবাই, জলখাবার খেয়ে নে।”
আমি এলেই মা ব্যস্ত হয়ে ওঠে, বাবাও বাজার করে বেশি বেশি। বারণ করলেই বলে, “এত বড় বাড়িতে আমরা দু’জনে হাঁপিয়ে উঠি, তুই এলে তবু সময়টা কাটে।” বাবাকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি, তোমাদের বয়স হচ্ছে, এত বড় বাড়িতে না থেকে বরং একটা কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাটে শিফ্ট করো। ও সব ফ্ল্যাটে নিরাপত্তা থেকে ‘ডাক্তার অন কল’— সব সুবিধে আছে। আমিও অত দূরে বসে একটু নিশ্চিন্ত হতে পারি। এই নিয়ে আগেও যত বার বলেছি মনোমালিন্য হয়েছে। মা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে আর বাবা গম্ভীর। আসলে বাবা অনেক কষ্ট করে বাড়িটা করেছে। গাছপালা ভালবাসে বলে শহুরে কোলাহল থেকে দূরে। বয়সের ভারে আর যত্ন করতে পারে না, তবু স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে থাকা। বাড়ির আনাচে-কানাচে আমার বেড়ে ওঠার স্মৃতি মা নাকি দেখতে পায়।
জলখাবার দিতে দিতে মা বলল, “তুই একেবারে রেডি হয়ে এলি? কোথাও বেরোবি না কি?”
“হ্যাঁ মা, একটু শুভর বাড়ি যাব।”
মা জিজ্ঞেস করল, “কে শুভ?”
মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম, “শুভ, শুভজিৎ, যাদের শোভাবাজারে পুরনো বাড়ি। বড় উঠোন, ঠাকুরদালান আর বড় বড় থামওয়ালা বাড়িটা। স্কুলের পর মাসিমা মাঝে মাঝে আমাদের জোর করেই ওঁদের বাড়ি নিয়ে যেতেন।”
আচমকা লোডশেডিং থেকে লাইট আসার মতো মা মুখটা আলো করে বলল, “মনে পড়েছে! দিদি খুব ভালবাসতেন তোদের। ওই পরিবারের প্রত্যেকের খুব আন্তরিকতা ছিল।”
স্মৃতির গভীর জলে হাতড়াতে হাতড়াতে কত কথা মনে পড়ে... কত আনন্দ, কত ভাল লাগা মুক্তোর মতো সঞ্চিত হয়ে আছে। বিস্মৃতির খোলস সরালে তার ঝিলিক দেখা যায়।
বাবা বলল, “তা এত দিন বাদে যোগাযোগ হল কী করে?”
“বাবা, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আজকাল সবার সঙ্গেই যোগাযোগ থাকে। স্কুলের অনেক বন্ধুর সঙ্গেই আছে। শুভ বার বার বলেছে কলকাতায় এলে যেন ওর সঙ্গে দেখা করি। সে জন্য যাচ্ছি। কিন্তু ওকে বলিনি, চমকে দেব গিয়ে।”
বাবা বলল, “তা বেশ। স্কুটিতে যাচ্ছ, সাবধানে যাবে। আর আমার বাহনটাকে অক্ষত রেখো।”
যেতে যেতে মনে করার চেষ্টা করলাম শুভদের বাড়ি যাওয়ার ল্যান্ডমার্কটা। আমার মনে ছবির মতো আঁকা হয়ে আছে। রাস্তার উপর গোল বারান্দাওয়ালা সাদা একটা বাড়ির রাজকীয় উপস্থিতি। বাড়ির বারান্দায় রংবেরঙের কাচের জানলা বিকেলের পড়ন্ত আলোয় বর্ণময়তা ছড়িয়ে দিত। স্কুলের পর শুভদের বাড়ি যাওয়ার পথে আমি সেই রঙের মোহময়তা উপভোগ করতাম। বাড়ির বাহারি গেটের উপর ঝুঁকে পড়া বাগানবিলাস যেন মাথা ঝুঁকিয়ে কাছে ডাকত। খুব ভাল লাগছিল স্মৃতির সরণি বেয়ে গাড়ি চালাতে, স্কুটিটা যেন একটা টাইম মেশিন। উত্তর কলকাতার এই দিকটায় অনেক নতুন ফ্ল্যাট হয়েছে, তবু কিছু স্মৃতি এখনও অটুট। পুরনো বইয়ের দোকানটা, সেই মিষ্টির দোকানটা একই রকম আছে।
হঠাৎ ব্রেক চেপে দাঁড়িয়ে বাস্তবের মাটিতে পা রাখলাম। আর তো চিনতে পারছি না! সেই ল্যান্ডমার্ক রাজকীয় বাড়িটা তো নেই। তা হলে কি রাস্তা ভুল করলাম! বইয়ের দোকান, মিষ্টির দোকানটা তো আছে। আর একটু এগিয়ে দেখি, সামনে একটা মাঠ। ঠিক মাঠ নয়, বাড়ি ভেঙে ফেললে তার ভিতরের মেঝের মানচিত্রটা আর তার উপর ভাঙা দেওয়ালের কিছুটা রেশ যেমন দেখা যায়, তেমনই। বাড়িটা কি এখানেই ছিল! বাধ্য হয়েই চমকে দেওয়ার আশা ছেড়ে শুভকে ফোন করলাম। রিং হয়ে গেল।
সামনে চোখ যেতেই দেখলাম, এক জন বয়স্কা মহিলা বাড়িটার ভাঙা মেঝের দিকে আনমনে তাকিয়ে আছেন। টুকটুকে গায়ের রং, টিকোলো নাক-চোখ, অভিজাত চেহারা, পরনে পাটভাঙা সাদা শাড়ি। এক বার এঁকেই না-হয় জিজ্ঞেস করি, ‘মাসিমা’ বলে ডাকতেই একটু চমকে উঠলেন। তাঁকে আমার স্মৃতির ছবির বর্ণনা দিলাম। সব শুনে মলিন হাসি হেসে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ বাবা, এখানেই ছিল সেই বাড়িটা, মাসছয়েক আগে ভাঙা পড়েছে ফ্ল্যাট হবে বলে।”
উনি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এই সময় শুভর ফোনটা এল, “কী রে, ফোন করলি?”
আসার উদ্দেশ্য আর অসহায়তার কথা শুনে যেন ফোনেই লাফিয়ে উঠে বলল, “তুই আসছিস!”
শুভ নিজে গুগল ম্যাপ হয়ে ওঠার আগেই বললাম, “তুই বাড়ির সামনে দাঁড়া।” আমি স্কুটিতে স্টার্ট দিয়ে মাসিমাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে হেসে শুভকে বললাম “এ বার ঠিক চিনে গেছি।”
যথাস্থানে পৌঁছতেই শুভ যেন ট্র্যাফিক পুলিশের কেস দেওয়ার মতো রাস্তা আগলে দাঁড়াল। নির্ভেজাল আন্তরিকতা আর হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা করল, “আয়, আমার ফ্ল্যাটের তলায় পার্কিং আছে। ওখানে স্কুটিটা রাখ।”
আকাশ থেকে পড়লাম, “ ফ্ল্যাট! তোদের বাড়ি কী হল?”
শুভ তাড়া লাগাল, “আর বাড়ি! চল ওপরে চল, এখানেই সব কথা শুনবি না কি!”
শুভর বাবা গত হয়েছেন বছর দুয়েক, আর মাসিমা চিনতে সময় নিলেন। তার পর স্মৃতির ঝাঁপি খুলে আমাদের ছোটবেলায় ফিরে গেলেন। বুঝতে পারলাম মায়েরাও উপভোগ করতেন আমাদের বন্ধুত্ব। চা খাওয়ার পর শুভ নিচু স্বরে সাবধান করল, “আমাদের পুরনো বাড়িটার কথা বেশি তুলিস না, মা অভিমান করে।”
“তোর বাড়িটা বরাবরই আমার খুব ভাল লাগত। লুকোচুরি খেলার জন্য সেই থামগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকার রোমাঞ্চই আলাদা ছিল। আর বাড়ির খোলা বারান্দায় সবাই মিলে বসে টিফিন খাওয়া আর গল্প। সত্যি, কী সব দিন ছিল!”
শুভ ম্লান হেসে বলল, “না রে! এই ভাল। তিন কামরার ফ্ল্যাট। অনেক ঝামেলা কম। আর পারা যাচ্ছিল না। পরিবারের সম্পর্কগুলোও পলেস্তারা খসে যাওয়ার মতো আলগা হয়ে আসছিল। প্রোমোটিংয়ের মতো সামাজিক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ল বাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেই নিয়ে রোজ অশান্তি। তাই এই ফ্ল্যাটের ডিসিশন।”
কখন শুভ’র মা ঘরে এসেছেন খেয়ালই করিনি। ফ্ল্যাটে রান্নাঘর থেকে বসার ঘরের দূরত্ব কয়েক পা মাত্র। মাসিমা ভার ভার গলায় বলে উঠলেন, “কত বার করে বললাম, থাক না এই সব। অন্তত যত দিন বেঁচে আছি! শ্বশুরমশাই বাড়িটা করেছিলেন। শুভর বাবা-কাকারা সেটাকে পরিপূর্ণ রূপ দিয়েছিল, সবাই এক সঙ্গে থাকবে বলে। ওর বাবা খালি বলত, আমাকে তোরা খাঁচায় পুরিস না। সেকালের মানুষ, হাত পা ছড়িয়ে থাকতে ভালবাসতেন।”
শুভ একটু যেন চেঁচিয়ে উঠল, “মা, আবার তুমি শুরু করলে!”
আকস্মিক ছন্দপতন। আমি শুভর হাতটা চেপে ধরলাম।
নিঃশব্দে মাসিমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শুভ বলল, “বাবা মারা যাওয়ার পর, মা’র কেন যেন মনে হয়েছে আগের বাড়িতে থাকলে বাবা আরও বেশি দিন বাঁচতেন।”
ছন্দে ফেরার জন্য কথা ঘোরালাম, “আবার কবে দেখা হবে? রিইউনিয়নের প্ল্যান কর একটা।”
আরও নানা কথায় ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে শুভকে বিদায় জানালাম। রওনা দিলাম স্মৃতির সরণি দিয়ে নয়, রূঢ় বাস্তবের রাস্তা দিয়ে। পথে পড়ল সেই ল্যান্ডমার্ক বাড়িটার ভগ্নাবশেষ, যেখানে সেই বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে ছিলেন। বোঝার চেষ্টা করলাম, এই ভাঙা বাড়িটার মেঝের মানচিত্রে উনি কি কিছু খুঁজছিলেন? কী মনে হতে স্কুটি থেকে নেমে আর একটু ভাল করে দেখার পর বুঝতে পারলাম, মেঝের উপর পুরনো কিছু অস্পষ্ট দাগ যেন অ্যালবামের পাতা থেকে ছবি খুলে যাওয়ার মতো স্মৃতিছাপ রেখে গেছে। দেওয়ালে মাঙ্গলিক চিহ্নের অন্তিম রেশ, আলমারি থাকার দাগ, কিংবা অনেক দিনের খাট না সরানোর জন্য মেঝের সাদা হয়ে থাকার প্রমাণ। দূরে দেওয়ালের তাকের ভেঙে যাওয়ার অংশ যেন বলছে, ‘আমরা এখানেই ছিলাম।’ সব কিছু ছবির মতো জোড়া লাগতে লাগল। এই ঘরটায় হয়তো সবাই বসে গল্প করত। ওই ঘরটা ছিল শোবার ঘর। রান্নাঘরটাও বেশ বুঝতে পারলাম কোণের দিকে হলদেটে তেল-কালির চিহ্ন দেখে। ওই বয়স্কা মহিলা হয়তো এই বাড়িরই কেউ, খোঁজার চেষ্টা করছিলেন ফেলে আসা দিনের ভালবাসা, অভিমান, সুখ-দুঃখের অনুভূতি। সারা জীবনের পরিচিত ঘেরাটোপ হঠাৎ বদলে গেলে সব মানুষই হয়তো ওই মাসিমা বা শুভর মায়ের মতো অভিমানী আর অন্যমনস্ক হয়ে যান!
রাত্তিরে খাওয়ার টেবিলে বাবা বলল, “ভেবে দেখলাম, তুই ঠিকই বলেছিস। আমাদের এই বাড়ি বেচে ফ্ল্যাটে চলে যাওয়াই ভাল। তোকেও আর আমাদের সিকিয়োরিটি, অসুখবিসুখ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি কাগজে টু-থ্রি বিএইচকে কয়েকটা ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপনে দাগ দিয়ে রেখেছি। সময় করে দেখিস।”
মনটা আনমনা হয়ে ছিল, তাই সাড়া দিলাম না। মা বলে উঠল, “কী রে! কী হল তোর?”
মুখের দিকে না তাকিয়ে থালায় আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বললাম, “থাক না বাবা বাড়িটা। এখানে আমাদের কত স্মৃতি, রবিবারে ছাদে খেলা, মা’র যত্নের বাগানে ফুল, বাড়ির খুঁটিনাটি নিয়ে তোমাদের ঝগড়া সবই যেন দেখতে পাই...”
দু’জোড়া চোখে খুশির ঝিলিক আমি স্পষ্ট দেখলাম চোখ না তুলেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy