Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Short story

short story: থিম

নদীর তীরে খালি গায়ে পড়ে আছে ভ্যাবলা। তার স্বপ্নে এখন লক্ষ তারার ঝলকানি। পথে মৃত অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক আজ প্রাণ খুলে হাসছে যে…

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।

চিরঞ্জিত সাহা
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৭:৪৯
Share: Save:

অষ্টমীর রাতেই ঘটল বিপর্যয়টা। সবে আটটা বেজেছে। বাইরে লাখো মানুষের ঢল। হঠাৎই জ্বলে উঠল মূল মণ্ডপের সামনের বৈদ্যুতিক তার। কয়েক সেকেন্ড আলোর দপদপানি। পরমুহূর্তেই সব অন্ধকার। ছিটকে আসা আগুনে ঝলসে উঠল মাতৃমূর্তির একাংশ। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল লাইনসমেত রেলগাড়ি।

তার পর কেটে গেছে তিনটে ঘণ্টা। প্রাথমিক ভাবে দর্শনার্থীদের বিশৃঙ্খলা সামাল দিয়েছে ‘মুক্তিদূত’-এর স্বেচ্ছাসেবকরা। পুড়ে যাওয়া থিমের ঠাকুর সরিয়ে নিয়ে সেখানে এখন ফুট তিনেকের সাবেকি দুর্গাপ্রতিমা। শাস্ত্রীয় পুজোর জন্য সেটি রাখা ছিল এক পাশে। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই-ছুঁই। সামনে বিশাল জনসমুদ্র। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে দর্শনার্থীদের। উদ্যোক্তাদের তরফে মাইকে বার বার আশ্বস্ত করা হলেও পরিস্থিতি বিশ বাঁও জলে।

জনপ্রিয় সংবাদপত্র থেকে লিডিং নিউজ় চ্যানেল, প্রখ্যাত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে ক্ষমতাসীন রাজ্য সরকার— পুরস্কারের বন্যা এ বার মুক্তিদূত-এ। মিডিয়ার ফোকাস জুড়ে শুধুই মুক্তিদূত। উদ্যোক্তাদের প্রচারকৌশলে অভূতপূর্ব থিমের খবর ছড়িয়ে পড়েছে শহরের সর্বত্র।

হঠাৎ এমন বিপর্যয়ে মাথায় হাত পুজো কমিটির। অনেকে চেষ্টা করেও কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না অভিজ্ঞ থিম মেকার সৌমিক সিংহ। বছরের পর বছর ধরে অভিনব সব মণ্ডপ সে উপহার দিয়ে এসেছে। সৌমিক সিংহ পুজোর স্টার আর্টিস্ট। চমকপ্রদ পরিকল্পনা আর ফিনিশিংয়ে তার জুড়ি মেলা ভার।

এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা তার কেরিয়ারে এই প্রথম। দ্রুত ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে গিয়ে বাদ সাধল রেললাইন। ভাঙা অংশগুলো জোড়ার কোনও কৌশল মাথায় আসছে না। তার ওপর টানা তিন ঘণ্টা গোটা মণ্ডপ অন্ধকারে। যথাসাধ্য চেষ্টার পর রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হল সৌমিকের ইলেকট্রিশিয়ানরা। কপালে চিন্তার ভাঁজ শহরের সেরা থিমমেকারের। পুজো কমিটির সদস্যরাও গলদঘর্ম। লোডশেডিং, মণ্ডপ ভেঙে পড়া... মুক্তিদূতের পুজোর লাইসেন্স বাতিল হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।

এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ে সৌমিকের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করল— যদি এ সময় ভ্যবলা খেপা থাকত!

থিম-পুজোর সার্কিটে সৌমিকের আকাশছোঁয়া সাফল্যের পিছনে ভ্যাবলা খেপার অবদান অসীম। সৌমিকের শৈল্পিক চিন্তাভাবনা বাস্তবে রূপ দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ওই আধপাগলা ছেলেটার। নিখুঁত স্কেচে গোটা প্ল্যানটা ভ্যাবলাকে বুঝিয়ে দেয় সৌমিক। তার পর ভ্যাবলা ছেনি, হাতুড়ি নিয়ে নেমে পড়ে কাজে। পেন্টিং কিংবা মাটির কাজ সৌমিক নিজে করলেও থার্মোকল আর লোহালক্কড়ের দায়িত্ব থাকে ভ্যাবলার বিশ্বস্ত হাতে। ইলেকট্রিকের কাজেও ওর তুলনা নেই। প্রায় শ’পাঁচেক লেবার সৌমিকের আন্ডারে থাকলেও ভ্যাবলার মতো দক্ষ নয় কেউ।

এ বার মোট সতেরোটা প্যান্ডেলের কাজ ছিল সৌমিক সিংহর হাতে। গত বছর দশমী পেরোতেই টাকার থলি নিয়ে ওর জন্য ঝাঁপিয়েছিলেন মুক্তিদূত-এর সহসভাপতি। কন্ট্রাক্টে সই করতে দেরি করেনি ধুরন্ধর শিল্পী নিজেও। তার পর গোটা বিশ্ব জুড়ে করোনার থাবা। দুর্গাপুজোর সম্ভাবনা কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু জুনের শুরুতেই কমিটির তরফে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, পুজো হচ্ছে। কাজ শুরু করার অনুরোধ জানানো হয় সৌমিককে।

তার পর টানা সাড়ে চার মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম আজ ধ্বংসের মুখে। মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে দীর্ঘ ক্ষণ মানুষকে আটকে রাখার পর অপারগতা স্বীকার করে দর্শনার্থীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন মুক্তিদূত-এর সভাপতি। সীমাহীন অপেক্ষায় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে জনতার। ব্যারিকেড টপকে তারা ভিতরে ঢুকে ভাঙতে শুরু করেছে মণ্ডপের অক্ষত অংশ। প্যান্ডেল তখন প্যান্ডেমোনিয়াম।

রাগে দিশেহারা হয়ে সৌমিকের কলার চেপে ধরলেন মুক্তিদূতের সম্পাদক, “এত ক্ষণ ধরে এ সব ছেনালি না করে তোমার হেডমিস্ত্রিকে তো ডাকতে পারতে! তুমি তো শালা স্পটেই আসো না। সব নষ্টামি ওই পাগলাই করেছে। পুরস্কার আর ফুটেজ মারাবে বলে তুমি গতকাল থেকে ঘুরঘুর করা শুরু করেছ!”

“ফালতু কথা বলবেন না!” তেতে ওঠে সৌমিকও, “শহর জুড়ে আরও ষোলোটা প্যান্ডেল আমার। পুরস্কার ওরাও পেয়েছে। আর আমি থিম মেকার, মিস্ত্রি নই। সব প্যান্ডেলেই সমান সময় দিয়েছি আমি। বাকিটা আমার লেবাররা করেছে। ভ্যাবলা আমার টিমের সবচেয়ে দক্ষ লেবার। এখানে পুরো দায়িত্বটা ও নিয়েছিল বলেই আমায় আসতে হয়নি, কিন্তু প্ল্যান তো আমারই।”

“আচ্ছা! তা এই লোডশেডিং, মণ্ডপ ভাঙার প্ল্যানও কি তোমার, খোকা? কত মাল্লু খেয়েছ অপোনেন্ট ক্লাবগুলোর কাছ থেকে?”

“মুখ সামলে মুরারিদা! হাতে-কলমে কাজটা কিন্তু ভ্যাবলা করেছে, আমি না। আজ ও থাকলে হয়তো…”

“তা কোথায় সে শালা! ফোন করো না ওই ঢ্যামনাকে!”

“ওর ফোন নেই।”

“তা হলে হারামির বাচ্চা এখানে দাঁত না কেলিয়ে আমার গাড়িটা নিয়ে ওর বাড়ি যাও! মাঝপথে এ ভাবে পুজো বন্ধ হলে আমাদের রেপুটেশন কোথায় নামবে, ভাবতে পারছ? ও দিকে পাবলিক তো প্যান্ডেল ভেঙে পুলওয়ামা করে দিচ্ছে।”

“ওর ঠিকানা জানি না, স্যর...” সৌমিকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

ছাপার অযোগ্য কিছু বাছাই গালিগালাজ স্টক থেকে বার করে দাঁত খিঁচিয়ে মুরারিদা বললেন, “তোমার লেবার আর তুমি জানো না বাড়ি কোথায়?”

“আপনি কিন্তু সীমা ছাড়াচ্ছেন মুরারিদা! আপনাকে মিথ্যে বলে লাভটা কী আমার?”

“ও মা গো! টুরু ন্যাকা! যাই হোক, পুলিশ হয়তো আমার পুজো বছর তিনেকের জন্য ব্যান করবে। কিন্তু তোমার কেরিয়ার কী করে পুরোপুরি খতম করতে হয়, আমি দেখে নেব। মণ্ডপ কিন্তু তোমারই আইডিয়া।”

“সে কথা তো আমি অস্বীকার করিনি, দাদা। প্রথম থেকে আমি বার বার বলেছিলাম স্পেসের ওপর রেললাইন দাঁড় করানো ভীষণ মুশকিল। আপনি তো পাত্তাই দিলেন না, উল্টে চটে গিয়ে বললেন, আপনাদের কোন কর্তা নাকি পিডব্লুডি-এর বড় ইঞ্জিনিয়ার! বছরে দুটো করে বড় বড় ব্রিজ তোলে। এ সব মামুলি কাজ নাকি সে কড়ে আঙুলে সামলে নেবে।”

“তোমার ওই হারামজাদা মিস্ত্রি তো সদানন্দকে হাতই দিতে দেয়নি কাজে! সারাদিন শালা মালের বোতল নিয়ে পড়ে থাকত মাঠে। কী যে করেছে, তা তো দেখতেই পাচ্ছি।”

এবার গলা চড়ায় সৌমিক, “ফাইনাল টেস্টিংয়ের দিন তো আপনার ক্লাবের লোকেরাও পরখ করে নিয়েছিল পুরোটা। তখন কিছু বলেননি কেন? আজও তো দেখলাম তিন ঘণ্টার ওপর চেষ্টা করলেন ওঁরা! সব নাকি রাজ্য সরকারের কারিগরি বিভাগের বড় বড় অফিসার! অথচ একটা খেলনা রেললাইন জুড়তে গিয়েই হাওয়া ফুস! আর ওই বিদ্যুৎসচিব, বোসবাবু না কী যেন নাম— শালা একটা কানেকশন ঠিকঠাক লাগাতে পারে না, সরকারের লাখ লাখ টাকা লুটছে প্রতি বার। ইঞ্জিনিয়ার শালা!”

“ওরা পারছে না বলেই তো ভ্যাবলাকে ঢাকতে বলছি সৌমিক। কিন্তু তোমার তো দেখছি ধনুকভাঙা পণ। আমাদের পোঙায় হাতা দেওয়ার জন্য অন্য ক্লাবগুলোর থেকে যা খেয়েছ, তার দশগুণ বেশি দেব ভাই। প্লিজ়, ওকে ফোন করো একটা। সম্মান যে পুরো স্যাকারিন হয়ে গেল!”

“আমি ওর ঠিকানা বা ফোন নম্বর কিছুই জানি না মুরারিদা। মোবাইল ও ইউজ়ও করে না।”

“চোপরাও শালা...”

মিথ্যে বলেনি সৌমিক। ভ্যাবলার ফোন নম্বর ও জানে না। বাড়ির ঠিকানাও গত দশ বছরে ভ্যাবলা বলেনি কখনও। প্রবল জোরাজুরির পরও প্রতি বারই ওর পাথুরে নীরবতার কাছে শেষমেশ হার মানতে বাধ্য হয়েছে সৌমিকের প্রয়াস। বছর দশেক আগে মৌলালির অফিসে সৌমিকের সঙ্গে প্রথম দেখা করতে আসে ভ্যাবলা। বছর চল্লিশেক বয়স। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। রোদে পোড়া রং। পাকানো চেহারা। মুখ দিয়ে সে দিনও বাংলা মদের গন্ধ বেরোচ্ছিল ম-ম করে। থিম মেকার হিসেবে তখন এক রকম অখ্যাতই সৌমিক। কাজও পেত হাতে গোনা দু-চারটে। নেশার ঘোরে ভ্যাবলা যেটুকু বলেছিল তার সারমর্ম— কলকাতার এক বিখ্যাত ডেকরেটরের কাছে লেবারের কাজ করত ও। পর পর লসের ধাক্কায় হঠাৎই ব্যবসা গোটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিক। কর্মহারা ভ্যাবলা তাই দিশাহীন। বাইরে পোস্টারে নাম দেখে পেট চালানোর দায়ে যোগাযোগ করতে বাধ্য হয়েছে সৌমিকের সঙ্গে। একটা কাজ পেলে খুব ভাল হয়।

সৌমিক তখন একেবারেই নতুন। পুজোর বায়না এলেও যথেষ্ট লেবার হাতে নেই। ভ্যাবলাকে টিমে নিতে তাই ভাবতে হয়নি এক মুহূর্তও। মাতাল ভ্যাবলাও নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে যায় দৈনিক দুশো টাকার প্রস্তাবেই। সঙ্গে সারা দিনের মদ। হাতে মদের বোতল নিয়ে ভ্যাবলা নেমে পড়ল কাজে। প্রতিদিনই তার দক্ষতায় মুগ্ধ হতে থাকল সৌমিক। ক্রমে ভ্যাবলা হয়ে উঠল সৌমিক ক্রিয়েশনের বেস্ট লেবার। প্রতি বছর পুজোর তিন মাস আগে সে হাজির হয় সৌমিকের অফিসে। কাজ শেষ করে গ্রামের বাড়ি ফেরে ষষ্ঠীর রাতে।

সৌমিকের খ্যাতি আজ আকাশ ছুঁয়েছে। মাইনে বেড়েছে ভ্যাবলারও। তিন মাস কাজের বদলে ষাট হাজার টাকা এখন সৌমিক তুলে দেয় ওর হাতে। সঙ্গে ঢালাও মদের খরচ তো আছেই। বহু বার জিজ্ঞেস করার পরও ওর বাড়ির ঠিকানাটা কিছুতেই বলেনি ভ্যাবলা। ‘সুন্দরবনের কাছে’, তার বেশি একটা শব্দও বার করতে পারেনি ওর মুখ থেকে। ঘাঁটায়নি সৌমিকও। কত লেবারই তো আসে প্রতিবার। ক’জনের ঠিকানাই বা ঠিক মতো জানে ও। তবে ভ্যাবলার মতো শিল্পী সৌমিকের টিমে আর নেই, ভ্যাবলার রোয়াবও তাই বেশি।

মুঠোফোন এখনও অচেনা ভ্যাবলার কাছে, আর তাতে এক পক্ষে শাপে বরই হয়েছে সৌমিকের। মোবাইল থাকলে এত দিনে বড় অঙ্কের টোপ দিয়ে ঠিক ওকে দলে ভিড়িয়ে নিত অন্য থিম মেকার। ভরপেট মদ আর পুরোপুরি স্বাধীনতা পেলেই পাগলটা খুশি। সৌমিকও ওর কাজে হস্তক্ষেপ করে না কখনও। স্কেচের পর একটা গোটা মণ্ডপ প্রতি বছর ছেড়ে দেয় ভ্যাবলার হাতে। মাটির কিংবা ছবির ব্যাপারটা নিজের হাতে করে এলেও ভ্যাবলার প্যান্ডেলের ইলেক্ট্রিক বা শোলার কাজে নাক গলায় না। মহালয়ার দিন গোটা কাজ পার্টিকে দেখিয়ে দেয় ভ্যাবলা। কিছু চেঞ্জের প্রস্তাব এলে সেরে ফেলে পরের দিনগুলোয়, কিন্তু তার আগে কেউ নাক গলালেই ওর মটকা যায় গরম হয়ে। বোতল ভেঙে তাড়া করতেও ভাবে না। এ ভাবেই চলে আসছে দশটা বছর। বড় বাজেটের পুজোও নির্ভয়ে সৌমিক এখন ছেড়ে দেয় ভ্যাবলার ওপর। প্রাইজ়ও মিস হয় না।

এ বছর ভ্যাবলার আসা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল সৌমিক। একেই লকডাউনে ট্রেন-বাস সব বন্ধ। তার ওপর অতিমারিতে বেঁচে আছে কি না কে জানে! উপায় ছিল না যোগাযোগের। সতেরোটা পুজো হাতে থাকলেও কাজ তোলা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছিল সৌমিক। যদিও তত দিনে স্কেচ কমপ্লিট হয়ে গেছে প্রায় সব ক’টারই।

রথের দিন সকালে সাইকেল নিয়ে হঠাৎই সৌমিকের অফিসে এসে হাজির ভ্যাবলা। দেখামাত্রই যেন হাতে চাঁদ পেল সৌমিক। অতিমারির মাঝেও সাইকেল চেপে সুদূর সুন্দরবন থেকে যে উদয় হবে ভ্যাবলা, ভাবতে পারেনি সৌমিক। ভ্যাবলাকে নিয়ে সটান সে হাজির হল মুক্তিদূত-এর অফিসে। সৌমিকের প্ল্যান শুনেই উল্লাসে ফেটে পড়লেন ক্লাবকর্তারা, কিন্তু মিইয়ে গেল ভ্যাবলা। থিমটা শুনেই ইতস্তত ভাবে বলে উঠল— “এটাকে কি কিছুতেই পাল্টানো যাবে না সৌমিকবাবু?”

রে রে করে উঠলেন সম্পাদক, “আরে এই থিমের জন্যই তো কর্পোরেট টাকা দেবে আমাদের। পাগলা না কি আপনি? সৌমিকভাই, তুমি তো পুরো লেজেন্ড আছ, দেখছি! মাশাল্লাহ প্ল্যানিং ভাই!”

ভ্যাবলার বিরোধিতার কারণে তাকে প্যান্ডেলের কাজে রাখার ব্যাপারে সম্পাদকমশাই আপত্তি জানালেও বুঝিয়েসুজিয়ে ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা সামলে নিল সৌমিক। মিষ্টিমুখ দিয়ে শেষ হল আলোচনা পর্ব।

গোটা প্ল্যান সৌমিক ভ্যাবলাকে ব্যাখ্যা করে দিল নিখুঁত ভাবে। পরদিন থেকেই যন্ত্রপাতি আর বোতল হাতে শিল্পী লেগে পড়ল কাজে। নির্ধারিত দিনের আগেই শেষ করল কাজ। মাঝে সৌমিকও গিয়ে ঢুঁ মেরে এসেছে কয়েক বার। ভ্যাবলার কাজে স্তম্ভিত মুক্তিদূতের কর্তারাও। মণ্ডপ পরীক্ষার জন্য নিয়ে আসা ইঞ্জিনিয়ার থেকে ইলেকট্রিশিয়ান— সকলেই প্রশংসায় ভরিয়ে দিল ভ্যাবলাকে। কিন্তু সে বরাবরের মতোই নির্বিকার। বোতল হাতে বিস্ফারিত চোখে শুনে চলে সব। তার পর কাউকে কিছু না জানিয়ে পঞ্চমীর রাতে হঠাৎই সে উধাও হয়ে যায় সৌমিকের অফিসের লেবার রুম থেকে। পড়ে থাকে বিছানা, ব্যাগ আর পারিশ্রমিকের টাকা। দেয়ালে মদের বোতলের ভাঙা কাচ দিয়ে লিখে দিয়ে যায়— “পার্ক সার্কাসের বস্তিতে শালা ছড়িয়ে দিস এই টাকা। মরণ নিয়ে খেলছে শুয়োরের বাচ্চা!”

এর মধ্যেই মুক্তিদূত-এর মণ্ডপে হাজির পুলিশ বাহিনী। দর্শক হাঙ্গামায় ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে সব। পুলিশের গাড়ি তুলে নিয়ে গেছে মুক্তিদূত-এর তিন কর্তা এবং সৌমিক সিংহকে।

সেখান থেকে বহু দূরে, গভীর অন্ধকারে কুলতলির এক নদীর তীরে মদের বোতল হাতে পড়ে আছে ভ্যাবলা। বাড়ি তার ভেসে গেছে বছর বারো আগে আয়লায়। তার পর থেকে ভাড়া থাকা এর-ওর কুঁড়েঘরে। গত বছর ফণী এসে খেল বৌটাকে। চাষের জমি গেল আম্পানের পেটে আর ছেলেটা রেলে কাটা পড়ল লকডাউনে মহারাষ্ট্র থেকে ফেরার পথে। হতাশ ভ্যাবলা ঠিক করে আর কোনও দিন পা রাখবে না কলকাতায়। করবে না আর থিমের কাজ। যে মায়ের পুজোর আয়োজনে প্রাণপাত করে চলেছে দশ বছর ধরে, সেই মা-ই তো ওকে সুখ দিল না। বরং এক এক করে কেড়ে নিল সব। প্রখর রোদে সারাটা দিন সাইকেল চালিয়ে সৌমিকবাবুকে কাজ ছাড়ার কথা জানাতে গেছিল এ বার। বদলে সৌমিকবাবু দিল নতুন কাজের প্রস্তাব।

থিমের প্ল্যানটা শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে যায় ওর— “হাঁটল ওরা হাজার মাইল, ফিরবে বাড়ি বলে / ক্লান্ত হয়ে লাইনে শুল, কাটল গলা রেলে।” কিন্তু নিজেকে সামলে নেয় কোনও ক্রমে। মণ্ডপ নির্মাণে রেখে দেয় মোক্ষম কিছু খুঁত, যা সাধারণের চোখে পড়া অসম্ভব। অষ্টমীর রাতে ভোল্টেজ বাড়তেই ফেল করে সার্কিট। চাপ পড়তেই ভেঙে পড়ে থিমের রেললাইন। সবই ভ্যাবলার নিখুঁত কৌশলের ফল। এ ভাবেই নিঃস্ব এক জাতশিল্পী, এক সন্তানহারা বাপ নিজের মতো করে প্রতিবাদ করে। গরিবের মৃত্যুকে হাতিয়ার করে কর্পোরেটের পুরস্কার জয়ের পরিকল্পনায় বিছিয়ে দিয়ে যায় মানবিক কাঁটা।

ঘড়িতে রাত তিনটে। পুলিশ সিল করে দিয়েছে মুক্তিদূত-এর মণ্ডপ। নদীর তীরে খালি গায়ে পড়ে আছে ভ্যাবলা। তার স্বপ্নে এখন লক্ষ তারার ঝলকানি। পথে মৃত অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক আজ প্রাণ খুলে হাসছে যে…

ষ্টমীর রাতেই ঘটল বিপর্যয়টা। সবে আটটা বেজেছে। বাইরে লাখো মানুষের ঢল। হঠাৎই জ্বলে উঠল মূল মণ্ডপের সামনের বৈদ্যুতিক তার। কয়েক সেকেন্ড আলোর দপদপানি। পরমুহূর্তেই সব অন্ধকার। ছিটকে আসা আগুনে ঝলসে উঠল মাতৃমূর্তির একাংশ। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল লাইনসমেত রেলগাড়ি।

তার পর কেটে গেছে তিনটে ঘণ্টা। প্রাথমিক ভাবে দর্শনার্থীদের বিশৃঙ্খলা সামাল দিয়েছে ‘মুক্তিদূত’-এর স্বেচ্ছাসেবকরা। পুড়ে যাওয়া থিমের ঠাকুর সরিয়ে নিয়ে সেখানে এখন ফুট তিনেকের সাবেকি দুর্গাপ্রতিমা। শাস্ত্রীয় পুজোর জন্য সেটি রাখা ছিল এক পাশে। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই-ছুঁই। সামনে বিশাল জনসমুদ্র। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে দর্শনার্থীদের। উদ্যোক্তাদের তরফে মাইকে বার বার আশ্বস্ত করা হলেও পরিস্থিতি বিশ বাঁও জলে।

জনপ্রিয় সংবাদপত্র থেকে লিডিং নিউজ় চ্যানেল, প্রখ্যাত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে ক্ষমতাসীন রাজ্য সরকার— পুরস্কারের বন্যা এ বার মুক্তিদূত-এ। মিডিয়ার ফোকাস জুড়ে শুধুই মুক্তিদূত। উদ্যোক্তাদের প্রচারকৌশলে অভূতপূর্ব থিমের খবর ছড়িয়ে পড়েছে শহরের সর্বত্র।

হঠাৎ এমন বিপর্যয়ে মাথায় হাত পুজো কমিটির। অনেকে চেষ্টা করেও কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না অভিজ্ঞ থিম মেকার সৌমিক সিংহ। বছরের পর বছর ধরে অভিনব সব মণ্ডপ সে উপহার দিয়ে এসেছে। সৌমিক সিংহ পুজোর স্টার আর্টিস্ট। চমকপ্রদ পরিকল্পনা আর ফিনিশিংয়ে তার জুড়ি মেলা ভার।

এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা তার কেরিয়ারে এই প্রথম। দ্রুত ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে গিয়ে বাদ সাধল রেললাইন। ভাঙা অংশগুলো জোড়ার কোনও কৌশল মাথায় আসছে না। তার ওপর টানা তিন ঘণ্টা গোটা মণ্ডপ অন্ধকারে। যথাসাধ্য চেষ্টার পর রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হল সৌমিকের ইলেকট্রিশিয়ানরা। কপালে চিন্তার ভাঁজ শহরের সেরা থিমমেকারের। পুজো কমিটির সদস্যরাও গলদঘর্ম। লোডশেডিং, মণ্ডপ ভেঙে পড়া... মুক্তিদূতের পুজোর লাইসেন্স বাতিল হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।

এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ে সৌমিকের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করল— যদি এ সময় ভ্যবলা খেপা থাকত!

থিম-পুজোর সার্কিটে সৌমিকের আকাশছোঁয়া সাফল্যের পিছনে ভ্যাবলা খেপার অবদান অসীম। সৌমিকের শৈল্পিক চিন্তাভাবনা বাস্তবে রূপ দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ওই আধপাগলা ছেলেটার। নিখুঁত স্কেচে গোটা প্ল্যানটা ভ্যাবলাকে বুঝিয়ে দেয় সৌমিক। তার পর ভ্যাবলা ছেনি, হাতুড়ি নিয়ে নেমে পড়ে কাজে। পেন্টিং কিংবা মাটির কাজ সৌমিক নিজে করলেও থার্মোকল আর লোহালক্কড়ের দায়িত্ব থাকে ভ্যাবলার বিশ্বস্ত হাতে। ইলেকট্রিকের কাজেও ওর তুলনা নেই। প্রায় শ’পাঁচেক লেবার সৌমিকের আন্ডারে থাকলেও ভ্যাবলার মতো দক্ষ নয় কেউ।

এ বার মোট সতেরোটা প্যান্ডেলের কাজ ছিল সৌমিক সিংহর হাতে। গত বছর দশমী পেরোতেই টাকার থলি নিয়ে ওর জন্য ঝাঁপিয়েছিলেন মুক্তিদূত-এর সহসভাপতি। কন্ট্রাক্টে সই করতে দেরি করেনি ধুরন্ধর শিল্পী নিজেও। তার পর গোটা বিশ্ব জুড়ে করোনার থাবা। দুর্গাপুজোর সম্ভাবনা কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু জুনের শুরুতেই কমিটির তরফে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, পুজো হচ্ছে। কাজ শুরু করার অনুরোধ জানানো হয় সৌমিককে।

তার পর টানা সাড়ে চার মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম আজ ধ্বংসের মুখে। মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে দীর্ঘ ক্ষণ মানুষকে আটকে রাখার পর অপারগতা স্বীকার করে দর্শনার্থীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন মুক্তিদূত-এর সভাপতি। সীমাহীন অপেক্ষায় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে জনতার। ব্যারিকেড টপকে তারা ভিতরে ঢুকে ভাঙতে শুরু করেছে মণ্ডপের অক্ষত অংশ। প্যান্ডেল তখন প্যান্ডেমোনিয়াম।

রাগে দিশেহারা হয়ে সৌমিকের কলার চেপে ধরলেন মুক্তিদূতের সম্পাদক, “এত ক্ষণ ধরে এ সব ছেনালি না করে তোমার হেডমিস্ত্রিকে তো ডাকতে পারতে! তুমি তো শালা স্পটেই আসো না। সব নষ্টামি ওই পাগলাই করেছে। পুরস্কার আর ফুটেজ মারাবে বলে তুমি গতকাল থেকে ঘুরঘুর করা শুরু করেছ!”

“ফালতু কথা বলবেন না!” তেতে ওঠে সৌমিকও, “শহর জুড়ে আরও ষোলোটা প্যান্ডেল আমার। পুরস্কার ওরাও পেয়েছে। আর আমি থিম মেকার, মিস্ত্রি নই। সব প্যান্ডেলেই সমান সময় দিয়েছি আমি। বাকিটা আমার লেবাররা করেছে। ভ্যাবলা আমার টিমের সবচেয়ে দক্ষ লেবার। এখানে পুরো দায়িত্বটা ও নিয়েছিল বলেই আমায় আসতে হয়নি, কিন্তু প্ল্যান তো আমারই।”

“আচ্ছা! তা এই লোডশেডিং, মণ্ডপ ভাঙার প্ল্যানও কি তোমার, খোকা? কত মাল্লু খেয়েছ অপোনেন্ট ক্লাবগুলোর কাছ থেকে?”

“মুখ সামলে মুরারিদা! হাতে-কলমে কাজটা কিন্তু ভ্যাবলা করেছে, আমি না। আজ ও থাকলে হয়তো…”

“তা কোথায় সে শালা! ফোন করো না ওই ঢ্যামনাকে!”

“ওর ফোন নেই।”

“তা হলে হারামির বাচ্চা এখানে দাঁত না কেলিয়ে আমার গাড়িটা নিয়ে ওর বাড়ি যাও! মাঝপথে এ ভাবে পুজো বন্ধ হলে আমাদের রেপুটেশন কোথায় নামবে, ভাবতে পারছ? ও দিকে পাবলিক তো প্যান্ডেল ভেঙে পুলওয়ামা করে দিচ্ছে।”

“ওর ঠিকানা জানি না, স্যর...” সৌমিকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

ছাপার অযোগ্য কিছু বাছাই গালিগালাজ স্টক থেকে বার করে দাঁত খিঁচিয়ে মুরারিদা বললেন, “তোমার লেবার আর তুমি জানো না বাড়ি কোথায়?”

“আপনি কিন্তু সীমা ছাড়াচ্ছেন মুরারিদা! আপনাকে মিথ্যে বলে লাভটা কী আমার?”

“ও মা গো! টুরু ন্যাকা! যাই হোক, পুলিশ হয়তো আমার পুজো বছর তিনেকের জন্য ব্যান করবে। কিন্তু তোমার কেরিয়ার কী করে পুরোপুরি খতম করতে হয়, আমি দেখে নেব। মণ্ডপ কিন্তু তোমারই আইডিয়া।”

“সে কথা তো আমি অস্বীকার করিনি, দাদা। প্রথম থেকে আমি বার বার বলেছিলাম স্পেসের ওপর রেললাইন দাঁড় করানো ভীষণ মুশকিল। আপনি তো পাত্তাই দিলেন না, উল্টে চটে গিয়ে বললেন, আপনাদের কোন কর্তা নাকি পিডব্লুডি-এর বড় ইঞ্জিনিয়ার! বছরে দুটো করে বড় বড় ব্রিজ তোলে। এ সব মামুলি কাজ নাকি সে কড়ে আঙুলে সামলে নেবে।”

“তোমার ওই হারামজাদা মিস্ত্রি তো সদানন্দকে হাতই দিতে দেয়নি কাজে! সারাদিন শালা মালের বোতল নিয়ে পড়ে থাকত মাঠে। কী যে করেছে, তা তো দেখতেই পাচ্ছি।”

এবার গলা চড়ায় সৌমিক, “ফাইনাল টেস্টিংয়ের দিন তো আপনার ক্লাবের লোকেরাও পরখ করে নিয়েছিল পুরোটা। তখন কিছু বলেননি কেন? আজও তো দেখলাম তিন ঘণ্টার ওপর চেষ্টা করলেন ওঁরা! সব নাকি রাজ্য সরকারের কারিগরি বিভাগের বড় বড় অফিসার! অথচ একটা খেলনা রেললাইন জুড়তে গিয়েই হাওয়া ফুস! আর ওই বিদ্যুৎসচিব, বোসবাবু না কী যেন নাম— শালা একটা কানেকশন ঠিকঠাক লাগাতে পারে না, সরকারের লাখ লাখ টাকা লুটছে প্রতি বার। ইঞ্জিনিয়ার শালা!”

“ওরা পারছে না বলেই তো ভ্যাবলাকে ঢাকতে বলছি সৌমিক। কিন্তু তোমার তো দেখছি ধনুকভাঙা পণ। আমাদের পোঙায় হাতা দেওয়ার জন্য অন্য ক্লাবগুলোর থেকে যা খেয়েছ, তার দশগুণ বেশি দেব ভাই। প্লিজ়, ওকে ফোন করো একটা। সম্মান যে পুরো স্যাকারিন হয়ে গেল!”

“আমি ওর ঠিকানা বা ফোন নম্বর কিছুই জানি না মুরারিদা। মোবাইল ও ইউজ়ও করে না।”

“চোপরাও শালা...”

মিথ্যে বলেনি সৌমিক। ভ্যাবলার ফোন নম্বর ও জানে না। বাড়ির ঠিকানাও গত দশ বছরে ভ্যাবলা বলেনি কখনও। প্রবল জোরাজুরির পরও প্রতি বারই ওর পাথুরে নীরবতার কাছে শেষমেশ হার মানতে বাধ্য হয়েছে সৌমিকের প্রয়াস। বছর দশেক আগে মৌলালির অফিসে সৌমিকের সঙ্গে প্রথম দেখা করতে আসে ভ্যাবলা। বছর চল্লিশেক বয়স। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। রোদে পোড়া রং। পাকানো চেহারা। মুখ দিয়ে সে দিনও বাংলা মদের গন্ধ বেরোচ্ছিল ম-ম করে। থিম মেকার হিসেবে তখন এক রকম অখ্যাতই সৌমিক। কাজও পেত হাতে গোনা দু-চারটে। নেশার ঘোরে ভ্যাবলা যেটুকু বলেছিল তার সারমর্ম— কলকাতার এক বিখ্যাত ডেকরেটরের কাছে লেবারের কাজ করত ও। পর পর লসের ধাক্কায় হঠাৎই ব্যবসা গোটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিক। কর্মহারা ভ্যাবলা তাই দিশাহীন। বাইরে পোস্টারে নাম দেখে পেট চালানোর দায়ে যোগাযোগ করতে বাধ্য হয়েছে সৌমিকের সঙ্গে। একটা কাজ পেলে খুব ভাল হয়।

সৌমিক তখন একেবারেই নতুন। পুজোর বায়না এলেও যথেষ্ট লেবার হাতে নেই। ভ্যাবলাকে টিমে নিতে তাই ভাবতে হয়নি এক মুহূর্তও। মাতাল ভ্যাবলাও নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে যায় দৈনিক দুশো টাকার প্রস্তাবেই। সঙ্গে সারা দিনের মদ। হাতে মদের বোতল নিয়ে ভ্যাবলা নেমে পড়ল কাজে। প্রতিদিনই তার দক্ষতায় মুগ্ধ হতে থাকল সৌমিক। ক্রমে ভ্যাবলা হয়ে উঠল সৌমিক ক্রিয়েশনের বেস্ট লেবার। প্রতি বছর পুজোর তিন মাস আগে সে হাজির হয় সৌমিকের অফিসে। কাজ শেষ করে গ্রামের বাড়ি ফেরে ষষ্ঠীর রাতে।

সৌমিকের খ্যাতি আজ আকাশ ছুঁয়েছে। মাইনে বেড়েছে ভ্যাবলারও। তিন মাস কাজের বদলে ষাট হাজার টাকা এখন সৌমিক তুলে দেয় ওর হাতে। সঙ্গে ঢালাও মদের খরচ তো আছেই। বহু বার জিজ্ঞেস করার পরও ওর বাড়ির ঠিকানাটা কিছুতেই বলেনি ভ্যাবলা। ‘সুন্দরবনের কাছে’, তার বেশি একটা শব্দও বার করতে পারেনি ওর মুখ থেকে। ঘাঁটায়নি সৌমিকও। কত লেবারই তো আসে প্রতিবার। ক’জনের ঠিকানাই বা ঠিক মতো জানে ও। তবে ভ্যাবলার মতো শিল্পী সৌমিকের টিমে আর নেই, ভ্যাবলার রোয়াবও তাই বেশি।

মুঠোফোন এখনও অচেনা ভ্যাবলার কাছে, আর তাতে এক পক্ষে শাপে বরই হয়েছে সৌমিকের। মোবাইল থাকলে এত দিনে বড় অঙ্কের টোপ দিয়ে ঠিক ওকে দলে ভিড়িয়ে নিত অন্য থিম মেকার। ভরপেট মদ আর পুরোপুরি স্বাধীনতা পেলেই পাগলটা খুশি। সৌমিকও ওর কাজে হস্তক্ষেপ করে না কখনও। স্কেচের পর একটা গোটা মণ্ডপ প্রতি বছর ছেড়ে দেয় ভ্যাবলার হাতে। মাটির কিংবা ছবির ব্যাপারটা নিজের হাতে করে এলেও ভ্যাবলার প্যান্ডেলের ইলেক্ট্রিক বা শোলার কাজে নাক গলায় না। মহালয়ার দিন গোটা কাজ পার্টিকে দেখিয়ে দেয় ভ্যাবলা। কিছু চেঞ্জের প্রস্তাব এলে সেরে ফেলে পরের দিনগুলোয়, কিন্তু তার আগে কেউ নাক গলালেই ওর মটকা যায় গরম হয়ে। বোতল ভেঙে তাড়া করতেও ভাবে না। এ ভাবেই চলে আসছে দশটা বছর। বড় বাজেটের পুজোও নির্ভয়ে সৌমিক এখন ছেড়ে দেয় ভ্যাবলার ওপর। প্রাইজ়ও মিস হয় না।

এ বছর ভ্যাবলার আসা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল সৌমিক। একেই লকডাউনে ট্রেন-বাস সব বন্ধ। তার ওপর অতিমারিতে বেঁচে আছে কি না কে জানে! উপায় ছিল না যোগাযোগের। সতেরোটা পুজো হাতে থাকলেও কাজ তোলা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছিল সৌমিক। যদিও তত দিনে স্কেচ কমপ্লিট হয়ে গেছে প্রায় সব ক’টারই।

রথের দিন সকালে সাইকেল নিয়ে হঠাৎই সৌমিকের অফিসে এসে হাজির ভ্যাবলা। দেখামাত্রই যেন হাতে চাঁদ পেল সৌমিক। অতিমারির মাঝেও সাইকেল চেপে সুদূর সুন্দরবন থেকে যে উদয় হবে ভ্যাবলা, ভাবতে পারেনি সৌমিক। ভ্যাবলাকে নিয়ে সটান সে হাজির হল মুক্তিদূত-এর অফিসে। সৌমিকের প্ল্যান শুনেই উল্লাসে ফেটে পড়লেন ক্লাবকর্তারা, কিন্তু মিইয়ে গেল ভ্যাবলা। থিমটা শুনেই ইতস্তত ভাবে বলে উঠল— “এটাকে কি কিছুতেই পাল্টানো যাবে না সৌমিকবাবু?”

রে রে করে উঠলেন সম্পাদক, “আরে এই থিমের জন্যই তো কর্পোরেট টাকা দেবে আমাদের। পাগলা না কি আপনি? সৌমিকভাই, তুমি তো পুরো লেজেন্ড আছ, দেখছি! মাশাল্লাহ প্ল্যানিং ভাই!”

ভ্যাবলার বিরোধিতার কারণে তাকে প্যান্ডেলের কাজে রাখার ব্যাপারে সম্পাদকমশাই আপত্তি জানালেও বুঝিয়েসুজিয়ে ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা সামলে নিল সৌমিক। মিষ্টিমুখ দিয়ে শেষ হল আলোচনা পর্ব।

গোটা প্ল্যান সৌমিক ভ্যাবলাকে ব্যাখ্যা করে দিল নিখুঁত ভাবে। পরদিন থেকেই যন্ত্রপাতি আর বোতল হাতে শিল্পী লেগে পড়ল কাজে। নির্ধারিত দিনের আগেই শেষ করল কাজ। মাঝে সৌমিকও গিয়ে ঢুঁ মেরে এসেছে কয়েক বার। ভ্যাবলার কাজে স্তম্ভিত মুক্তিদূতের কর্তারাও। মণ্ডপ পরীক্ষার জন্য নিয়ে আসা ইঞ্জিনিয়ার থেকে ইলেকট্রিশিয়ান— সকলেই প্রশংসায় ভরিয়ে দিল ভ্যাবলাকে। কিন্তু সে বরাবরের মতোই নির্বিকার। বোতল হাতে বিস্ফারিত চোখে শুনে চলে সব। তার পর কাউকে কিছু না জানিয়ে পঞ্চমীর রাতে হঠাৎই সে উধাও হয়ে যায় সৌমিকের অফিসের লেবার রুম থেকে। পড়ে থাকে বিছানা, ব্যাগ আর পারিশ্রমিকের টাকা। দেয়ালে মদের বোতলের ভাঙা কাচ দিয়ে লিখে দিয়ে যায়— “পার্ক সার্কাসের বস্তিতে শালা ছড়িয়ে দিস এই টাকা। মরণ নিয়ে খেলছে শুয়োরের বাচ্চা!”

এর মধ্যেই মুক্তিদূত-এর মণ্ডপে হাজির পুলিশ বাহিনী। দর্শক হাঙ্গামায় ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে সব। পুলিশের গাড়ি তুলে নিয়ে গেছে মুক্তিদূত-এর তিন কর্তা এবং সৌমিক সিংহকে।

সেখান থেকে বহু দূরে, গভীর অন্ধকারে কুলতলির এক নদীর তীরে মদের বোতল হাতে পড়ে আছে ভ্যাবলা। বাড়ি তার ভেসে গেছে বছর বারো আগে আয়লায়। তার পর থেকে ভাড়া থাকা এর-ওর কুঁড়েঘরে। গত বছর ফণী এসে খেল বৌটাকে। চাষের জমি গেল আম্পানের পেটে আর ছেলেটা রেলে কাটা পড়ল লকডাউনে মহারাষ্ট্র থেকে ফেরার পথে। হতাশ ভ্যাবলা ঠিক করে আর কোনও দিন পা রাখবে না কলকাতায়। করবে না আর থিমের কাজ। যে মায়ের পুজোর আয়োজনে প্রাণপাত করে চলেছে দশ বছর ধরে, সেই মা-ই তো ওকে সুখ দিল না। বরং এক এক করে কেড়ে নিল সব। প্রখর রোদে সারাটা দিন সাইকেল চালিয়ে সৌমিকবাবুকে কাজ ছাড়ার কথা জানাতে গেছিল এ বার। বদলে সৌমিকবাবু দিল নতুন কাজের প্রস্তাব।

থিমের প্ল্যানটা শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে যায় ওর— “হাঁটল ওরা হাজার মাইল, ফিরবে বাড়ি বলে / ক্লান্ত হয়ে লাইনে শুল, কাটল গলা রেলে।” কিন্তু নিজেকে সামলে নেয় কোনও ক্রমে। মণ্ডপ নির্মাণে রেখে দেয় মোক্ষম কিছু খুঁত, যা সাধারণের চোখে পড়া অসম্ভব। অষ্টমীর রাতে ভোল্টেজ বাড়তেই ফেল করে সার্কিট। চাপ পড়তেই ভেঙে পড়ে থিমের রেললাইন। সবই ভ্যাবলার নিখুঁত কৌশলের ফল। এ ভাবেই নিঃস্ব এক জাতশিল্পী, এক সন্তানহারা বাপ নিজের মতো করে প্রতিবাদ করে। গরিবের মৃত্যুকে হাতিয়ার করে কর্পোরেটের পুরস্কার জয়ের পরিকল্পনায় বিছিয়ে দিয়ে যায় মানবিক কাঁটা।

ঘড়িতে রাত তিনটে। পুলিশ সিল করে দিয়েছে মুক্তিদূত-এর মণ্ডপ। নদীর তীরে খালি গায়ে পড়ে আছে ভ্যাবলা। তার স্বপ্নে এখন লক্ষ তারার ঝলকানি। পথে মৃত অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক আজ প্রাণ খুলে হাসছে যে…

অন্য বিষয়গুলি:

Short story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy