Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Short story

আমি আছি

বর্ণদীপকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে শান্তিতে চোখ বুজল দিয়া। মধ্যরাতে নদী-জ্যোৎস্নায় তখন জোয়ার-ভাটা নেই। সব একাকার।

ছবি: শুভম দে সরকার।

ছবি: শুভম দে সরকার।

শুভমানস ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২১ ০৬:৫৭
Share: Save:

ুন্দরবনের বুড়ির ডাবরি অভয়ারণ্যে ক্যানোপি ওয়াকে যাওয়ার জন্য লঞ্চ জেটিতে ভিড়তেই পাশের লঞ্চ থেকে এক বৃদ্ধ উল্লসিত ভাবে বর্ণদীপের বাবা জয়মাল্যকে বললেন, “বাঘ দেখেছেন? আমরা দেখেছি!”

কাল বর্ণদীপ-দিয়ার প্রথম বিবাহবার্ষিকী ছিল। রাতে লঞ্চে কেক কেটে, বেলুন উড়িয়ে, মিউজ়িকের সঙ্গে হাত ধরে নেচে সবাই খুব এনজয় করেছে। আইডিয়াটা জয়মাল্যর। তিনি চেয়েছিলেন, ছেলে বন্ধুবান্ধবী নিয়ে বিয়ের বর্ষপূর্তি অন্য ভাবে সেলিব্রেট করে আসুক। তাঁর পরিচিত গোসাবার লঞ্চমালিক সঞ্জীবকে ফোন করে দু’রাত তিন দিনের জন্য লঞ্চও বুক করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু বর্ণদীপ-দিয়া রাজি হল না। উল্টে শর্ত দিল, বাবা-মাকে যেতে হবে। জেঠিমা মারা যেতে জেঠু প্রতাপরঞ্জন একা হয়ে গিয়েছেন। সাহিত্যচর্চা করেন। ইদানীং তাঁর গল্প ইউটিউবেও দিতে শুরু করেছেন। পঁয়ষট্টি বছর বয়সেও টগবগে। বন্ধুবান্ধব সঙ্গে না-ই গেল, জেঠু মাস্ট।

ভ্রমণের নামে প্রতাপরঞ্জন পাগল। সারা ভারতবর্ষ চষে ফেলেছেন। দু’বার বলতে হয়নি, আনন্দের সঙ্গে চলে এসেছেন। শুধু এসেছেন নয়, সকলকে হাসিয়ে-মাতিয়ে ট্যুর পুরো জমিয়ে দিয়েছেন। এই বয়সে কাল রাতে যা নেচেছেন, সকলে তাজ্জব। মাথায় পানামা হ্যাট। চোখে সানগ্লাস। পায়ে স্নিকার। সকলের আগে লঞ্চ থেকে নেমে গটগটিয়ে হাঁটছেন।

দিয়াকে হাত ধরে জেটিতে নামিয়ে বর্ণদীপ ঘুরতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল। লঞ্চের দিকে চেয়ে দেখল, পাঁচ জন বৃদ্ধ লঞ্চে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছেন।

“আপনারা দেখেছেন? যাহ্‌!” জয়মাল্যর গলায় আফসোস।

“আপনারা দেখেননি? আমাদের পেছনেই তো আপনাদের লঞ্চ ছিল!”

“একটুর জন্য মিস হয়েছে! নদী পেরিয়ে বাঘটা জঙ্গলে চলে যাওয়ার পরই আমরা পৌঁছই। গাইড তীরে পায়ের ছাপ দেখাল। আপনারা খুব লাকি দেখছি।”

“সাত-সাত বার সুন্দরবনে এসেছি। এই প্রথম বাঘ দেখলাম।”

জয়মাল্য হেসে ফেললেন, “কনগ্র্যাচুলেশন!”

“ঘাটের দিকে পা বাড়িয়ে আছি, কনগ্র্যাচুলেশন!”

“বালাই ষাট!”

“ষাট কী? আমার বাহাত্তর। ভীমরতি না হলে এই বয়সে বাঘ দেখে ধেইধেই করে নাচি?”

জয়মাল্য বললেন, “আমরা দেখলেও তা-ই করতাম। বাঘটা ধোঁকা দিল যে!”

“ধোঁকা কি শুধু বাঘেই দেয়!” বলতে-বলতে জীবনের সংজ্ঞাই নির্ণয় করে ফেললেন বৃদ্ধ, “পৃথিবীটাই ধোঁকার টাটি, মশাই! ছেলেরা সব বিদেশে। কারও বুড়ি আছে। কারও থেকেও নেই। পড়ে-পড়ে কাতরাচ্ছে। তাই আমরা দু’দিন অন্তর বেরিয়ে পড়ি। খাওয়া-দাওয়া ইয়ার্কি-ফুর্তি করি, আর বাঘের সন্ধানে ঘুরে বেড়াই। আপনার টিম তো দেখলাম বেশ ভারী! যান এনজয় করুন!”

বর্ণদীপ দিয়ার দিকে চেয়ে গলা চাপল, “শুনলে?”

শুনেছে। কিন্তু কালই বিয়ের মধুর দুইয়ে পা ফেলেছে। দিয়া হাত ধরে টানল বর্ণদীপের, “চলো! বড়দের কথা শুনতে হবে না।”

বর্ণদীপ হাঁটতে শুরু করল। জয়মাল্যও বৃদ্ধকে “আপনারাও করুন!” বলে পাল্টা শুভেচ্ছা জানিয়ে তাদের সঙ্গে জয়েন করলেন। বর্ণদীপ কাছে আছে ভেবে আনন্দ হচ্ছিল তাঁর, আবার বৃদ্ধদের জন্য দুঃখও হচ্ছিল। বাঘ-দেখা মিস হওয়ার আফসোস মিলিয়ে আসছিল মন থেকে।

*****

জয়মাল্যর মাথায় সব সময় অভিনব আইডিয়া খেলে। আজও খেলল।

আজ রাতে আর নাচগান নয়। ভূতের গল্পের আসর হবে। একটা করে ভূতের গল্প সবাইকে শোনাতেই হবে। দাদা প্রতাপরঞ্জন তো অনেক ভূতের গল্পও লিখেছেন।

সারা দিনের বনভ্রমণ সেরে লঞ্চ এখন মাঝনদীতে নোঙর করেছে। দিগন্ত-বিস্তৃত নদী দোলনার মতো দুলছে। লঞ্চও ভাসছে। নোঙরের টানে আবার ফিরে আসছে। দূরে ম্যানগ্রোভ অরণ্য হাতছানি দিচ্ছে। শব্দ করে বইছে ঝোড়ো হাওয়া।

লঞ্চের ডেকে সকলে কান-পেতে বসে আছে যদি বাঘের ডাক শোনা যায়। তার মধ্যে ভূতের অনুপ্রবেশ পছন্দ হল না বর্ণদীপের। জয়মাল্যকে বলল, “যেমন তুমি তেমনি জেঠু! এখন ভূত জমবে না।”

“খুব জমবে!” দিয়া উলটো বাজল, “ভূতের গল্প শুনতে আমার ভাল লাগে।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, দিয়া!” প্রতাপরঞ্জন বললেন, “কেন ভাল লাগে জানো? কারণ মৃত্যুর পরে কী হয় আমরা জানি না। খুব শিগগির জানতে পারব তারও আশা কম।”

বলতে-বলতেই গর্জন ছাড়লেন, “হয়ে যাক ভূত!”

দাদার কথায় জয়মাল্যও চটপট সারেংকে ডেকের টেবিল-চেয়ারগুলো সরিয়ে মাঝখানে শতরঞ্চি পেতে বসেই পড়লেন। নিভিয়ে দেওয়া হল ডেকের সব আলো।

“সেই ভূত!” বর্ণদীপ বেজার, “যত ছেলেমানুষি তোমাদের!”

প্রতাপরঞ্জন বললেন, “আচ্ছা, তা হলে ভূত থাক। অলৌকিক হোক!”

“বলো! বলো!” দিয়া সরে এল।

প্রতাপরঞ্জন শুরু করলেন। তাঁর ছায়া-ছায়া মুখচোখ। গলা গমগম করছে। ছেলেবেলার সাধারণ গল্প, কিন্তু তাঁর কাছে অনেক কিছু। এখনও বেশ মনে পড়ে, তখন তাঁরা অজ পাড়াগাঁয় থাকতেন। মা তাড়াতাড়ি খাইয়ে-দাইয়ে ঘুমোতে পাঠিয়ে দিতেন। একা ঘরে শিশু প্রতাপরঞ্জন চোখ বুজে শুয়ে থাকত। তার মনে হত কেউ নেই। কিছু নেই। গোটা পৃথিবীটাই যেন ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে। ভয়ে বুক গুড়গুড় করত।

ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটত। রোজই ঘটত। কানে আসত গ্রামের চৌকিদার গগনজ্যাঠার গম্ভীর গলা। রাতপাহারায় বেরিয়েছে। সুর করে, বাড়িয়ে-কমিয়ে হাঁক দিত, “কে জাগে-এ-এ? কে জাগে-এ-এ-এ?”

সঙ্গে-সঙ্গে ধড়মড়িয়ে পৃথিবীটা জেগে উঠত। দূর থেকে একটু-একটু করে স্পষ্ট হয়ে জানলার কাছে হুঙ্কারের মতো ফেটে পড়ে আবার আস্তে-আস্তে মিলিয়ে যেত গগনজ্যাঠার গলা। ভয় চলে যেত প্রতাপরঞ্জনের। কান-পেতে মিলিয়ে-আসা শব্দ শুনতে-শুনতে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ত।

প্রতাপরঞ্জন থামলেন। বর্ণদীপ সত্যিই হতাশ, “তাতে কী হল?”

“অলৌকিক! বাইরে পৃথিবী জাগল। ঘরে আমি পড়লাম ঘুমিয়ে। অলৌকিক নয়!”

“অলৌকিক!” দিয়া অবাক।

“আরে, দাদা শব্দের অলৌকিক শক্তির কথা বলতে চাইছে। শব্দ যেমন ঘুম ভাঙায়, তেমনই ঘুম পাড়িয়েও দেয়। শব্দের ক্ষমতা অসীম। শব্দই ব্রহ্ম,” জয়মাল্য ফিরলেন প্রতাপরঞ্জনের দিকে, “কী রে, তাই তো?”

“সেটাই তো বুঝতে পারি না! সে জন্যই তো আজও সেটা অলৌকিক,” সকলকে হতবাক করে প্রতাপরঞ্জন বললেন, “কেন গগনজ্যাঠার গলা মিলিয়ে যাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়তাম, বিশ্বাস কর, আজও জানি না। মনে হত এক অপার্থিব শব্দ যেন আমাকে পাহারা দিচ্ছে, এ বার আমি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারব। সেই গগনজ্যাঠা যে জীবন থেকে কখন হারিয়ে গেল, তা-ও জানি না! কত কী যে জানার রয়ে গেল! মাঝখান থেকে ফুরিয়ে এল জীবন!”

দিয়া বকুনি দিল প্রতাপরঞ্জনকে, “ফুরিয়ে গেল মানে? তুমি এখনও ইয়াং জেঠু! কাল যা নেচেছিলে, আমরা কেউ দাঁড়াতেই পারিনি। ভিডিয়ো করে রেখেছি। ফেবুতে ছাড়লেই ভাইরাল!”

“খবরদার না! ট্রোল করবে সবাই। দশ বছর বাঁচলেও তিনশো পঁয়ষট্টি ইনটু দশ, তিন হাজার ছ’শো পঞ্চাশ দিন আছি মেরেকেটে। এখনই মারতে চাও আমায়?”

“তোমার মুখে এ সব কথা মানায় না জেঠু!” বর্ণদীপ সিরিয়াস হল, “তুমি কত দেখেছ। কত লিখেছ। কত জায়গায় ঘুরেছ! আরও কত ঘুরবে। দেখবে। জানবে। এখন থেকে ‘যাই যাই’ করছ কেন?”

“ঘুরেছি?” প্রতাপরঞ্জন বিরক্ত হলেন, “আমি কি গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখেছি? মিশরের পিরামিড দেখেছি? নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখেছি? সুন্দরবনের বাঘ দেখতেই পেলাম না! কিচ্ছু দেখিনি দীপ! কিচ্ছু না! তাই তো লেখাটাও ভাল হল না।”

সকলে চুপ। প্রতাপরঞ্জন বলে চললেন, “পৃথিবীতে এত কিছু দেখার আছে— কত অজানা রহস্য, আকাশ-ভরা সূর্যতারা, সবাই নিজেদের কাজ করে যায়। এত দিন পৃথিবীতে আছি। কত স্মরণীয় ঘটনাই ঘটেছে। সে সব ছেড়ে ছোটবেলায় মাঠ থেকে খেলে ফেরার পথে দেখা একটা তুচ্ছ দৃশ্য— রাস্তার কল টিপে পা ধুচ্ছে গগনজ্যাঠা— কেন যে হঠাৎ-হঠাৎ চোখে ভেসে ওঠে কে জানে!”

সামান্য থেমে প্রতাপরঞ্জন হাহাকার করে উঠলেন, “আমার যে আরও, আরও অনেক দিন বাঁচতে ইচ্ছে করে দীপ। এত সুন্দর, এত রহস্যময় এই ভুবন চেয়ে-চেয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু উপায় নেই রে! পৃথিবীতে মানুষের আসা, ছোট-বড় মায়া নিয়ে বেঁচে থাকা, তার পর হঠাৎই এক দিন ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া! এর চেয়ে মর্মান্তিক অলৌকিক আর কী আছে?”

প্রতাপরঞ্জনের গলা ধরে এল। তাঁর মুখের দিকে চেয়ে বর্ণদীপের মনে পড়ল লঞ্চের বৃদ্ধের কথা। ভাঙাচোরা চোয়াল। নদীর নোনা বাতাসে ওড়া কয়েকগাছি বিষণ্ণ অসহায় চুল। কে বলে পৃথিবীতে কেউ নেই? কিছু নেই? নদীতীরের থকথকে কাদা ফুঁড়ে শ্বাসমূল এখনও গভীর ভালবাসা ও মমতায় জীবনকে শুষে নিচ্ছে!

এখন অনেক রাত। সকলে লঞ্চের খোলে শুতে চলে গিয়েছে। সারেংরাও তাদের কেবিনঘরের তলার কুঠুরিতে শুয়ে পড়েছে। জোয়ার লেগেছে। উল্টো দিকের সমুদ্রের উজানি জলের ঠেলায় গতি হারাচ্ছে নদী। বাঘের জঙ্গলের মাথার ওপর চাঁদ। দিয়ার হাত ধরে চেয়ারে বসে মুগ্ধ অপলক চোখে নদীর জলে জ্যোৎস্নার খেলা দেখছে বর্ণদীপ।

বর্ণদীপ দিয়াকে দেখাল, “দ্যাখো আস্তে আস্তে কেমন বড় হচ্ছে চাঁদ! জ্যোৎস্নাও উজ্জ্বল হচ্ছে। পৃথিবী সত্যিই সুন্দর দিয়া! আজ জেঠুর গল্প শুনে আরও বেশি করে মনে হচ্ছে, কী আশ্চর্য পৃথিবীতে জন্মেছি আমরা!”

বলতে-বলতেই জেঠুর গলা, “দীপ! দীপ! তোরা কোথায়?”

দিয়ার হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বর্ণদীপ, “জেঠু!”

চটির শব্দ করে সারেংয়ের ঘর পেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রতাপরঞ্জন। উত্তেজিত গলায় বললেন, “তোরা শুনলি? শুনেছিস?”

“কী?” বর্ণদীপ অবাক।

“চৌকিদারের গলার শব্দ। আমাদের সেই গগনজ্যাঠা রে!”

দিয়াও উঠে দাঁড়াল, “না তো!”

“কিন্তু আমি যে শুনলাম! শুয়েছিলাম, গগনজ্যাঠার গলায় ঘুমটা ভেঙে গেল। সেই আগের মতো সুর করে বলছে, ‘কে জাগে-এ-এ! কে জাগে-এ-এ-এ!’ স্পষ্ট শুনলাম রে!”

“ভুল শুনেছ!” বর্ণদীপ বলল।

“ভুল? অসম্ভব!” প্রতাপরঞ্জন সজোরে মাথা নাড়ালেন, “এক বার ভুল শুনেছিলাম। আবার ভুল?”

“ভুল শুনেছিলে? কবে?” অবাক হয় বর্ণদীপ।

“হ্যাঁ... গগনজ্যাঠা সে দিনও আমায় ঘুম পাড়িয়ে চলে যাওয়ার পরের দিন খবর পেয়েছিলাম, গগনজ্যাঠা আর নেই। আগের দিন সন্ধেবেলাতেই গলায় দড়ি দিয়েছিল। তার পরেও ভালবেসে আমায় ঘুম পাড়াতে চলে এসেছিল। বড্ড অল্প মাইনে ছিল তো! সংসার টানতে পারছিল না। সেটা জানার পর, তার পর থেকেই সব ভয় চলে গিয়েছিল আমার। তবু রোজ রাতে গগনজ্যাঠার গলার জন্য অপেক্ষা করতাম। মনে হত, মৃত্যুর রাতের মতো আবারও সে আসবে। অলৌকিক শব্দে আমায় ঘিরে, ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যাবে। অপেক্ষা করতে-করতে বড়ই হয়ে গেলাম। গগনজ্যাঠা সেই যে গেল, আর এল না। আজ এত দিন পর আবার শুনলাম! এক জীবনে দু’-দুটো ভুল? হতে পারে না!”

ডেকের উপর তখন চাঁদের আলোয় আশ্চর্য মায়া। প্রতাপরঞ্জনের বিস্মিত চোখদুটো চিকচিক করে উঠছে। যেন কোন বহুদূর অতীত থেকে ভেসে আসছে তাঁর কণ্ঠস্বর!

বর্ণদীপ আর দিয়া স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইল। প্রতাপরঞ্জন বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলেন। বর্ণদীপ আর দিয়া ধীরে ধীরে চেয়ারে এসে বসল। কথা নেই দুজনের কারও মুখে।
চেয়ে আছে।

“অদ্ভুত!” নীরবতা ভেঙে বর্ণদীপ বলল, “এ কাহিনি কোথাও লেখেননি জেঠু! মন খারাপ করে দেয়।”

“আসলে জেঠিমা চলে যেতে বড্ড ধাক্কা খেয়েছে জেঠু!” বলতে বলতে দিয়া খুব আস্তে আস্তে বলল, “আমি যখন বুড়ি হয়ে যাব, বিছানায় পড়ে যাব, তুমিও আমাকে ফেলে বাঘ দেখতে চলে যাবে দীপ?”

চমকে পাশ ফিরল বর্ণদীপ। দিয়ার গলায় কান্নার ছোঁয়া। মাঝরাত, মাঝনদী আর মাঝ-আকাশে এমন শান্ত চাঁদের মায়া বড় অদ্ভুত। সমস্ত আনন্দ মন্থন করে তুলে আনে কষ্টের অমৃত। চোখ জ্বালা করে ওঠে বর্ণদীপের। জোর করে নিজেকে সামলায় সে। পরিবেশটা হালকা করতে বলে, “বাঘ দেখতে থোড়ি যাব? বাঘিনি দেখতে যাব! দরকার পড়লে একটা লঞ্চই কিনে ফেলব!”

দিয়া সিরিয়াস হয়ে কান্না সামলায়, “অ্যাই, মজা কোরো না! ঠিক করে বলো!”

“কী রকম ঠিক করে বলব দেখবে?” বর্ণদীপের গলায় দুষ্টুমি।

চাঁদনি রাতের অন্য নেশাও আছে। বর্ণদীপ দিয়াকে জড়িয়ে ধরতে যাবে, হঠাৎ তার চোখ গেল জলে। নদী একদম স্থির। বাতাসও স্তব্ধ।

“দিয়া, নদীর জলে চাঁদটাকে দ্যাখো!” বর্ণদীপ চঞ্চল, “এত ক্ষণ কাঁপছিল না ছায়াটা?”

“তাই তো! নদী যে পুকুরের মতো শান্ত হয়ে গিয়েছে!” দিয়া সোজা হয়ে বসল, “এই সময় বাঘ নদী পেরোয়। আমার ভয় করছে! চলো, নীচে যাই!”

“ধ্যাত! এমন ফাটাফাটি চাঁদনি রাত ছেড়ে কেউ যায়?”

“চাঁদনি রাত না ছাই! তুমি আসলে বাঘ দেখতে এসেছ!” গলা বুজে এল দিয়ার।

“কিসের বাঘ? পৃথিবীতে এখন কিছু নেই। কেউ নেই। শুধু তুমি আছ আর আমি আছি।”

মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল বর্ণদীপের, অরণ্যের গভীর থেকে ভেসে এল বাঘের গম্ভীর গর্জন। থেমে থেমে, স্বর বাড়িয়ে-কমিয়ে ডাকছে। যেন বলছে, ‘সুখী জীবনের অদূরে অসুখী মৃত্যুর মতো আমিও আছি! উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায়...’

“মা গো!” দিয়া কাঁপছে।

বর্ণদীপের রক্ত টগবগিয়ে উঠল, “কোথাও যাবে না তুমি! আমায় ছেড়ে যাবে না তুমি!”

“মাথাখারাপ হয়ে গেল না কি তোমার? বাঘটা জলে নেমে সাঁতরে চলে আসবে এখনই।”

“কিচ্ছু হবে না!” বর্ণদীপ অভয় দিল, “আরে আমি তো আছি।”

দিয়া স্তব্ধ হয়ে গেল। কোথা থেকে এসে আবার কোথায় চলে যায় মানুষ! সে জানে, সে আজ আছে, কাল নেই। তাও বলে ‘আমি আছি?’ যে কোনও মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে যে কোনও কিছু, তবু সে প্রিয়জনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে ‘কিচ্ছু হবে না!’ গভীর বিস্ময়ে মন ভরে গেল তার। চেনা জীবনের পরতে পরতে মিশে থাকা এই অচেনা বৈচিত্র কি কম অলৌকিক!

বর্ণদীপকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে শান্তিতে চোখ বুজল দিয়া।

মধ্যরাতে নদী-জ্যোৎস্নায় তখন জোয়ার-ভাটা নেই। সব একাকার।

অন্য বিষয়গুলি:

Short story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy