Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস: পর্ব ১৭

স্বাধীনতা তুমি...

এদিকে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের দায়িত্বটা শ্যামলের হাতে দিয়ে কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছেন না অলকেশ। শ্যামল যে ডেকরেটরের সঙ্গে কথা বলছে, তারাই যাচ্ছেতাই রকমের দর হাঁকছে।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সঞ্জয় দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

এদিকে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের দায়িত্বটা শ্যামলের হাতে দিয়ে কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছেন না অলকেশ। শ্যামল যে ডেকরেটরের সঙ্গে কথা বলছে, তারাই যাচ্ছেতাই রকমের দর হাঁকছে। শ্যামলকে জিজ্ঞেস করলে বাঁধা উত্তর, ‘এ বার তো স্বাধীনতার ষাট বছর লাহিড়ীদা, ডেকরেটরের হেব্বি ডিমান্ড বাজারে। সবাই রেট বাড়িয়ে দিয়েছে।’

ব্যাপারটা খুব সন্দেহজনক লাগছে অলকেশের। স্বাধীনতার ষাট বছর বলে খরচের ব্যাপারে রাজ্য সরকার আর কেন্দ্রীয় সরকার বেশ উদার। রেল এবং রাজ্য পুলিশ, দু’তরফ থেকেই অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে অনুষ্ঠানের জন্য। তাই বাড়তি হ্যাপা সত্ত্বেও এই দায়িত্বটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেননি অলকেশ। মোটা টাকার বাজেট হলে তার থেকে কিছুটা সরিয়ে ফেলা যাবে সহজেই। এ বছরের মধ্যেই সূচনার বিয়েটা লাগিয়ে দিতে চান তিনি। তার তো একটা খরচ আছে! অনেক আশা নিয়ে জ্যেষ্ঠ সন্তানের নাম দিয়েছিলেন সূচনা। তার পর আর সন্তানই দিলেন না ভগবান! সূচনার বিয়ের খরচ তো এ ভাবেই তুলতে হবে, যতটা সম্ভব!

কিন্তু শ্যামল কি পুরোটা নিজেই খাওয়ার পরিকল্পনা করছে? ডেকরেটরদের সঙ্গে কথা বলে রাখছে তলে তলে! প্রচুর দাম হাঁকো, তার পর তোমার মুনাফার ফাইভ পার্সেন্ট আমার। এতটা কাঁচা কাজ করবে শ্যামল? সে তো জানে, মিলেমিশে কাজ করলে একটা নায্য বখরা থেকেও সে বঞ্চিত হবে না। কিন্তু পুরোটা যদি সে একাই খাওয়ার প্ল্যান করে থাকে, সেটা যে তিনি বানচাল করে দেবেন, এটুকু বুঝবে না শ্যামল? আর শুধু কি তিনি একা? স্টেশনমাস্টার ধীরেশবাবু, আরপিএফ-এর কম্যান্ডান্ট সুখদেব বর্মা, এরা কি বসে বসে অঙ্গুলিলেহন করবে?

‘লাহিড়ীদা জানেন তো, সে দিন যে লোকটি মারা গেল, ওই যে, আপনারা যাকে বললেন হিজড়ে...’

সুলেখা মিত্রর কথায় চিন্তায় ছেদ পড়ল অলকেশের।

‘আমরা মানে কারা, সুলেখা? আমরা বলব কেন? মেডিক্যাল রিপোর্ট বলছে। ফাইল করা হয়েছে রিপোর্ট, তুমি চাইলে দেখে নিতে পারো।’

‘আরে ওই হল। আমি তো আপনাদের কাছেই শুনলাম। তা শুনুন না, সেই হিজড়ের বডি খোঁজ করতে দু’এক জন এসেছিল কাল, জানেন তো?’

‘তাই নাকি? কই, আমাকে তো বলেনি কেউ! কখন এসেছিল?’

‘এই তো কাল বিকেলের দিকে। তিনটে নাগাদ। আপনি ছিলেন না তখন। কোথায় যেন গিয়েছিলেন।’

‘হ্যাঁ, আমার একটু টাউনে কাজ ছিল। তা যে এসেছিল সেও কি হিজড়ে?’

‘এক জনকে দেখে তো হিজড়ে মনে হল না। বেশ তো লম্বাচওড়া ছেলেটি! সঙ্গে আর এক জন ছিল, সেও ছেলে, তবে একটু মেয়েলি।’

‘শালা, একে মরছি নিজের জ্বালায়, তার উপর আবার হিজড়েদের উৎপাত আরম্ভ হল। কার কাছে এসেছিল, কী চায়?’

‘এসেছিল তো বোধহয় আপনার কাছেই। শ্যামল তো পত্রপাঠ হাঁকিয়ে দিল।’

‘তা হাঁকিয়ে দেবে না তো কি জামাই আদর করবে? কোথায় গেল ওরা?’

‘বোধহয় কে জি হসপিটালে গেল খোঁজ করতে।’

‘অ্যাঁ? হাসপাতালে গেল? ওরা আবার বডি রিলিজ করে দেয়নি তো? এই কেসটা নিয়ে জল ঘোলা হতে পারে।’

‘তা তো জানি লাহিড়ীদা। তবে বডি রিলিজ করলে তো ওরা এ দিক দিয়েই যেত, তাই না? স্টেশন দিয়েই তো যেত। কেউ কি দেখেছে?’

‘আরে এত বড় স্টেশনে কে আসছে কে যাচ্ছে, সবাই কি গুনে গুনে দেখছে নাকি? দেখি এক বার খোঁজ নিয়ে।’

কে জি হসপিটালের নম্বরটা সামনেই ছিল। টেলিফোনের ইয়ারপিসটা ডান কাঁধ দিয়ে কানের সঙ্গে আটকে রেখে, ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে নম্বর টিপতে শুরু করলেন অলকেশ। ভ্রু কুঞ্চিত, চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি। হিজড়েটা মরার আর জায়গা পেল না! এমনিতেই এত ঝামেলা, তার মধ্যে আর একটা উটকো ঝঞ্ঝাট ঘাড়ে এসে পড়ল।

ভর দুপুরে এখন সরকারি হাসপাতালে কাউকে পাওয়া মুশকিল। একটু আগেই রঞ্জন সিনেমাহলের দিকটায় গিয়েছিলেন তিনি। জানলে এক বার নিজেই ঘুরে আসতেন কে জি হসপিটালে। পোস্ট অফিসেও তো কাজ ছিল তাঁর। পোস্ট অফিস থেকে কে জি হসপিটাল বেশি দূরে নয়। দুটো কাজই একসঙ্গে সেরে আসা যেত।

কিন্তু এখন আর এ সব ভেবে লাভ কী? সকালে তো তিনি জানতেন না যে হিজড়ের ডেডবডি নিয়ে যেতে লোক এসেছিল। এ কথাটাও তাঁকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি শ্যামল। ছেলেটা পেয়েছে কী? আজই কথা বলতে হবে ওর সঙ্গে। একটা সোজাসুজি আলোচনা দরকার। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজন করার দায়িত্বটা ওকে দিয়েছেন বলে যেটুকু যা মালকড়ি সরানো যায় পুরোটাই সে একা ভোগ করবে, ওর এই ধারণাটা যে ভুল, সেটা ও যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারে ততই মঙ্গল!

এই সব ভাবতে ভাবতেই হাসপাতালের নম্বরটা ডায়াল করে যাচ্ছিলেন। বার তিনেকের চেষ্টায় লেগেও গেল নম্বর। যাকে চাইছিলেন, সুনীত রাহা নামে সেই তরুণ ডাক্তারটি নেই, কিন্তু মর্গে ডিউটিতে ছিল যে লোকটি, তার সঙ্গে কথা বলা গেল। সে খবর নিয়ে জানাল, হিমঘরের ২৩৭ নম্বর ড্রয়ার থেকে কোনও মৃতদেহ কারও হাতে তুলে দেওয়া হয়নি গত কাল। শুনে একটু নিশ্চিন্ত হলেন অলকেশ।

তার মানে গত কাল যে বা যারাই এসে থাকুক, তাদের বিফলমনোরথ হয়ে ফিরতে হয়েছে। মৃতদেহ তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি! কোনও একটা অজুহাতে হাঁকিয়ে দেওয়া হয়েছে ভাগ্যিস!

এই কেসটা নিয়ে উপরমহলে যদি কারও টনক নড়ে, তা হলে যে কোনও সময় যে কোনও রকম নির্দেশ আসতে পারে। মৃতদেহের আর এক বার ময়না তদন্ত হতে পারে, বা কোনও উচ্চপদস্থ অফিসার নিজে আসতে পারেন বডিটা দেখতে। যে বুলেটটা পাওয়া গিয়েছে, সেটা দেহের কোন অংশে কী ভাবে আটকে ছিল, এত সব বিষয়েও তাঁকে ‘ব্রিফ’ করতে হতে পারে। এই সময় ডেডবডি কোনও মতেই হাতছাড়া করা যাবে না। সুনীত রাহাকে আজই আর এক বার ফোন করবেন অলকেশ। ছোঁড়া যেন হুট করে কোনও রিলিজ ফর্মে সই না করে দেয়।

যারা এসেছিল, তারা যদি সত্যিই মৃত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ পরিজন হয়, তা হলে তারা আবারও আসবে। কয়েকটা দিন যাক, পরিস্থিতি যদি একটু থিতিয়ে পড়ে, তা হলে দেখা যাবে। তবে একটা হিজড়ের মৃতদেহ নিয়ে সাংঘাতিক ছুটোছুটি খুব একটা কেউ করবে বলে মনে হয় না অলকেশের। কোনও হিজড়ে পল্লি থেকেই কেউ এসেছিল বোধহয়! এতটা যে খুঁজে খুঁজে এসেছিল, এতেই একটু অবাক হয়েছেন অলকেশ।

যাকগে, আপদ বিদেয় হয়েছে। গত কাল দুপুরে এসেছিল জিআরপি’র এই অফিসে। এত ক্ষণে বিদায় হয়েছে নিশ্চয়ই।

জিআরপি অফিসের জানলা দিয়ে স্টেশনের একাংশ দেখা যায়। চোখ তুলে তাকালেন অলকেশ। দুপুর মরে আসছে। চিত্তরঞ্জন বড় স্টেশন। গভীর রাত্রেও স্টেশন চত্বর পুরো ফাঁকা হয় না। দিনের বেলা তো কথাই নেই। পড়ন্ত দুপুরেও জনাকীর্ণ প্ল্যাটফর্ম। নানা কণ্ঠের বিচিত্র কোলাহল। কারও উন্মুখ অপেক্ষা, কারও ক্লান্তিহীন অধৈর্য পদচারণা।

স্টেশনের অন্য প্রান্তে, একটা সিমেন্টের বেদির উপর পা ঝুলিয়ে বসে, দুটি যুবক তখন অলকেশের মতোই প্রবহমান জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে ছিল। দুজনেই ক্লান্ত। গত কাল দুপুর থেকে এই অফিস সেই অফিস ঘুরে বেড়িয়েছে পল্টন আর সিলেট। চিত্তরঞ্জন স্টেশনে নেমেই প্রথমে যে পুলিশ থানাটি চোখে পড়েছিল, সেখানে বুলাকিলালের খবর নেওয়ার চেষ্টা করে তারা।

ঢোকার মুখেই আটকায় বিশাল গোঁফের প্রহরীটি। ‘ক্যা চাহিয়ে?’

‘আচ্ছা, এখানে পূর্বা এক্সপ্রেসের এক জন প্যাসেঞ্জার মারা গিয়েছিলেন কয়েক দিন আগে...’

তাদের কথা শেষ করতে দেয়নি দ্বাররক্ষী, ‘ইধার নেহি...’

‘না, এখানেই নামানো হয়েছে। আসলে আমাদের রিলেটিভ। আমরা খবর পেয়ে...’

পল্টনের কথার মাঝেই ধমকে উঠেছিল লোকটি। ‘আরে ইখানে কী? ইধার নেহি, বোলা না? ইয়ে আরপিএফ হ্যায়। আপলোগ জিআরপি’কে পাস যাইয়ে। ও দিকে আছে।’

দু’দলকেই দেখতে পুলিশের মতো। আরপিএফ আর জিআরপি যে আলাদা, তা জানবে কী করে পল্টন? অবশ্য ব্যবহার সবার প্রায় একই রকম। জিআরপি অফিসে ঢোকামাত্রই দরজার কাছের একটা টেবিলে বসা এক জন মুখ তুলে তাকালেন।

‘কী চাই ভাই?’

এ বার প্রশ্নটা বাংলায়। তাই একটু ভরসা পেয়েছিল পল্টন।

‘আমরা কলকাতা থেকে আসছি। এখানে আমাদের এক জন আত্মীয় মারা গেছেন, খবর পেয়েছি আমরা। পূর্বা এক্সপ্রেসে আসছিলেন।’

কথাটা শুনেই ভদ্রলোক সরু চোখে ভাল করে এক বার মেপে নিলেন পল্টনকে। তার পর তাকালেন সিলেটের দিকে।

‘এখানে তো খোঁজ পাবেন না! বডি তো যত দূর জানি কে জি হসপিটালের মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সব কেসে তো পোস্টমর্টেম করতে হবে। আপনারা হসপিটালে খোঁজ করুন।’

কথাটা শুনে সেখানে আর দাঁড়ায়নি পল্টনরা। বিশেষ করে ভদ্রলোক যে ভাবে সিলেটকে লক্ষ করছিলেন, সেটা ভাল লাগেনি পল্টনের।

কে জি হাসপাতালে গিয়ে যখন পৌঁছেছিল তারা, তখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। কারও সঙ্গেই কথা বলা যায়নি সেখানে। মর্গ অবধি গিয়েছিল তারা, কিন্তু সেখানকার দারোয়ানরা কোনও ডাক্তারের সার্টিফিকেট বা পুলিশের অনুমতিপত্র ছাড়া কথা বলতেই রাজি হয়নি।

রাতটা স্টেশনেই কাটিয়েছিল পল্টন আর সিলেট। সকালে আবার হাসপাতালে ফিরে গিয়েছিল। অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করার পর এক জন জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিল তারা। ডাক্তারটি অমায়িক। কিন্তু তিনি কোনও রকম সাহায্য করতে পারেননি।

পল্টনও সহজে খালি হাতে ফিরতে রাজি না। ‘তা হলে কী করব আমরা ডাক্তারবাবু?’

‘শুনুন, কোনও ডকুমেন্ট ছাড়া কেউই আপনার সঙ্গে কোনও কথা বলবে না। আপনারা বরং কলকাতায় ফিরে যান। সেখানে আপনাদের লোকাল থানায় একটা মিসিং পার্সন রিপোর্ট করুন। সেই কাগজটা নিয়ে এসে দেখা করুন চিত্তরঞ্জন জিআরপি’র যিনি ওসি, তাঁর সঙ্গে। বুঝিয়ে বলুন ব্যাপারটা। তাতে যদি কাজ হয়।’

সকালের ব্যস্ততার মাঝে তাদের সঙ্গে আর বেশি সময় ব্যয় করতে পারেননি ডাক্তারটি।

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Mystery Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE