Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১৪
Bengali Novel

মায়াডোর

ডাম্বো ভেবেছিল টুটুল স্যর হাঁ হাঁ করে উঠবেন, কেন ডাম্বো এত পাকামি করছে তাই নিয়ে ধমক লাগাবেন, কিন্তু টুটুল স্যর সে সব কিছুই করলেন না।

ছবি: বৈশালী সরকার

ছবি: বৈশালী সরকার

অভিনন্দন সরকার
শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৭:৫২
Share: Save:

সবচেয়ে বড় কথা হল, এত দিন ধরে মাঝে মাঝেই ব্যাটিংয়ের সময় যে কালো ছায়াটা তাকে ঘিরে ধরত, ডাম্বো বোঝে সেই ছায়ার প্রকোপ যেন আজকাল অনেকটা কম। তার চোখের সামনে হলুদ ট্যাক্সিটা আর বাঁক নেয় না বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে বাঁ দিকে। ডাম্বো ব্যাটিংয়ের সময় বুঝতে পারে ব্যাটসম্যান সত্যিই এক নিঃসঙ্গ যোদ্ধা। হয়তো গোটা পরিবার তার সমর্থনে আছে, একটা আস্ত দেশ হয়তো তার মঙ্গল কামনা করছে, কিন্তু দুশমন যখন শুটিং রেঞ্জের মধ্যে তাকে পেয়ে যাবে তখন আশপাশে কেউ থাকবে না। কিছু লড়াই যে শুধু একা লড়তে হয় তাই নয়, এই লড়াইয়ের পাশ-ফেলের হিসেবও খুব নিভৃত প্রক্রিয়া, জিতে গেলে নিজের জিত, হারলেও তা একান্ত নিজস্ব।

ডাম্বো নিজেকে নিংড়ে দিলেও যেন এক-এক দিন কিছুতেই মন ভরত না টুটুল স্যরের। আরও একটু পাওয়ার ট্রেনিং, আরও একটু ফিটনেস এক্সারসাইজ়... কষ্টে, পরিশ্রমে ডাম্বোর চোখ ফেটে জল আসত। টুটুল স্যর দেখেও দেখতেন না। এগিয়ে আসতেন না। বলতেন না একটাও নরম কথা, শুধু দৈববাণীর মতো তাঁর স্বর শুনত ডাম্বো, “স্পোর্টসম্যানের চোখে জল মানায় না দর্পণ, স্পোর্টসম্যানদের কাঁদতে নেই।”

এই মুহূর্তে টুটুল স্যর দেখলেন এক জন লেগ স্পিনারের বলে স্টেপ আউট করেও ঠিক পায়ের কাছে, সামনেই পিচের ওপর আস্তে করে ঠুকে দিল ডাম্বো। টুটুল স্যর অখুশি হলেন না। ডাম্বো আজকাল অকুতোভয় হয়ে বেরিয়ে আসছে ক্রিজ় ছেড়ে। স্টেপ আউটের একটা মানসিক অ্যাডভান্টেজ আছে, বোলারের কাছে এই নীরব মেসেজ পৌঁছে যায় যে, এ বার হয়তো এই ব্যাটসম্যান ছয় মারল না, কিন্তু চাইলেই যে কোনও সময় সে আমাকে মাঠের বাইরে পাঠানোর জন্য তৈরি।

টুটুল স্যর ডাম্বোর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন। তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে আজ থেকে তিন মাস আগের সেই সন্ধেটার কথা।

যে সন্ধে খুব স্বাভাবিক ভাবে এসে একটা রাতে মিশে গিয়েছিল। ডিনারের পর শহরের অভিজাত বহুতলের একটা ফ্ল্যাটের আলো নেভেনি আর বাংলা রঞ্জি টিমের প্রাক্তন অলরাউন্ডার অভিরাজ সেন তাকে কাছে ডেকে নিয়েছিল, “এই দর্পণ গাঙ্গুলি যে আমার ক্যাম্পে ট্রেনিং করে তার সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশনের চান্স আছে তোর, সেইটা কাজে লাগা। হি ইজ় এ ব্রাইট ইয়ংস্টার।”

পাঁচ, ছ’পেগ হুইস্কির জড়ানো গলায় সে বলেছিল, “ধুস, ও সব আমার কিচ্ছু মনে নেই।”

“এ সব কেউ ভোলে না কি? কত ছেলে আমার কাছে ট্রেনারের চাকরি করবে বলে আসে। আমি তো অনেককেই নিয়ে নিই, সবার কি তোর মতো ডিস্ট্রিক্ট লেভেল খেলার এক্সপিরিয়েন্স আছে না কি?”

সে অসহায় বোধ করেছিল, বলেছিল, “কিন্তু... আমি কি পারব?”

আড়মোড়া ভেঙেছিল অভিরাজ, “সাইকেল, সাঁতারের মতো জিনিস তো নয়। আর তা ছাড়া তোকে তো আর নিজে মাঠে নেমে পড়তে হচ্ছে না। এক দল আট-দশ বছরের ছেলেকে শেখাবি, পারবি না ম্যানেজ করতে?”

সে চিন্তায় পড়েছিল। গুম হয়ে বসে ছিল অনেক ক্ষণ। ডাম্বোর কাছে যাওয়া তার প্রয়োজন। এই কথাই এত ক্ষণ হচ্ছিল অভিরাজের সঙ্গে, অথচ যখন অভিরাজ এমন এক উপায় বাতলে দিয়েছে তখনই সংশয়ে ভুগছে সে।

অভিরাজ হাই তুলেছিল, “ধুস, বাদ দে, তোকে দিয়ে হবে না। তোর নামটাতেই সমস্যা। একটা ব্যর্থ প্রেমিকমার্কা নাম নিয়ে ঘুরছিস, এই নামের ছেলের কাছে মেয়েরা আসে কখনও? ভুলে যাস না মেয়েদের কাছে আজকাল প্রচুর অপশন, অলিতে গলিতে কত বজ্রসেন ওত পেতে বসে রয়েছে। কিন্তু তোর তাতে কী? জীবনপাত্র বিরহরসে উছলে পড়বে, তবেই না মজা!”

সে চিন্তিত স্বরে বলেছিল, “শুধু বিকেলের সেশনটা করাব, ওকে? মাইনে দিতে হবে না, শনিবার করে সিঙ্গল মল্ট খাইয়ে দিস, কিন্তু...” আরও চিন্তিত হয়ে সে বলেছিল, “মায়ের কাছে গিয়ে ডাম্বো
আমার নাম বললেই তো হয়ে গেল। খেলাটা প্রথমেই ঝুলে যাবে।”

ঘরের পাশের নিমগাছে একটা দোয়েল পাখি ডাকছে, ডেকেই চলেছে একঘেয়ে স্বরে, অভিরাজের ঘুমচোখ জ্বলজ্বল করে উঠল, “ধুস! এটা একটা সমস্যা হল? তোর আসল নামটা রাখব না কি? তোর মামার বাড়ির দিকে তোকে কী যেন একটা নামে ডাকে বলেছিলি না?”

“টুটুল।”

“ব্যস। তা হলে তো মিটেই গেল। ওয়েলকাম টু অভিরাজ সেন ক্রিকেট অ্যাকাডেমি, টুটুল স্যর।”

তরফদার অ্যান্ড তরফদার কাপের ফাইনালের আর দেরি নেই। তাই প্রথম একাদশে খেলা ছেলেদের ছুটি নেই আজ, সারা দিন প্র্যাকটিস।

সেই সকালে ট্রেনিং-এ এসেছে ডাম্বো। আজ আর সন্ধে অবধি ট্রেনিং হবে না, বেলাবেলি ছেড়ে দেবেন বলেছেন টুটুল স্যর।

ডাম্বো রেস্ট রুমে একটু আলাদা হয়েই বসল। এই সময়টা বাকিদের সঙ্গে গজল্লা করে মনঃসংযোগ নষ্ট করতে চাইছে না। মাকে বলে আজ স্কুল থেকে ছুটির ব্যবস্থা করেছে সে। আজ শুক্রবার, প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়ে মাকে রাজি করিয়েছে ডাম্বো।

রেস্টরুমের দরজা ঠেলে ঢুকলেন টুটুল স্যর। ডাম্বো এই অপেক্ষাতেই ছিল। সে দেখল লম্বা লম্বা পা ফেলে টুটুল স্যর তার দিকেই এগিয়ে আসছেন।

ডাম্বো নিজেকে গুছিয়ে নিল, স্যর এসে বসতেই সে বলল, “স্যর, আপনাকে আমার একটা কথা বলার ছিল।”

টুটুল স্যর জামার হাতায় মুখ মুছে বললেন, “কী বলবে দর্পণ, বলো?”

ডাম্বো মাথা নিচু করে লাজুক স্বরে বলল, “স্যর, আপনাকে অনেক অনেক থ্যাঙ্কস। জানি না ম্যাচের দিন ভুলভাল কিছু করে আপনার বকুনি খাব কি না, কিন্তু আজ আপনাকে কিছু দিতে চাই স্যর।”

টুটুল স্যর ডাম্বোর পিঠ চাপড়ে দিলেন, “আরে, নো নেগেটিভ থটস, ম্যান। ইয়ং বেঙ্গলের একটা বোলারও যদি তোর হাতে ওভারবাউন্ডারি খাওয়া থেকে বেঁচে যায় তা হলে কিন্তু আমি খুব রেগে...”

টুটুল স্যরকে কথা থামাতে হয়েছে। কারণ স্যরের হাতের মুঠোয় একটা গণেশমূর্তি তুলে দিয়েছে ডাম্বো। দু’হাতে স্যরের মুঠো বন্ধ করে দিয়ে ডাম্বো বলল, “আপনি না বলবেন না স্যর। একটা ছোট্ট অ্যান্টিক। আপনাকে দেওয়ার জন্য আমার কাছে আর কিছুই নেই স্যর।”

ডাম্বো ভেবেছিল টুটুল স্যর হাঁ হাঁ করে উঠবেন, কেন ডাম্বো এত পাকামি করছে তাই নিয়ে ধমক লাগাবেন, কিন্তু টুটুল স্যর সে সব কিছুই করলেন না। একমনে তিনি তাকিয়ে আছেন, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছেন তিব্বতি কিউরিয়ো গণেশমূর্তিটাকে।

বিস্ময়ে সম্ভবত তিনি বাধা দেওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেন।

ডাম্বোও স্যরের দিকে তাকাল, স্যারের গালের হাড় প্রকট হয়ে আছে, মুখটা খুব শুকনো লাগছে, তার মনে হল স্যর সারা দিন কিচ্ছুটি খাননি।

ডাম্বো টিফিনবক্স খুলে ধরেছে স্যরের সামনে, “খেয়ে নিন স্যর। আমার থেকে শেয়ার করুন। মা খিচুড়ি করে দিয়েছে। আমার মায়ের হাতের খিচুড়ি স্যর, এক বার খেলে...”

ডাম্বো অপেক্ষা করল না, নিজেই বড় চামচে করে তুলে দিয়েছে স্যরের মুখে। ডাম্বো ভেবেছিল এক বার অন্তত মায়ের রান্নার প্রশংসা করবেন টুটুল স্যর। কিন্তু এ বারেও স্যর তাকে অবাক করলেন। তিনি জানলা দিয়ে মাঠের শেষ প্রান্তে গ্যালারির ও পারে মস্ত বড় জলের ট্যাঙ্কের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছেন।

ডাম্বো স্পষ্ট দেখল স্যরের গলার হাড়টা ঘন ঘন ওঠানামা করছে, চোখ যেন জলভরা টলটলে দিঘি। দম বন্ধ করে তার থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন স্যর।

ডাম্বো চোখ সরিয়ে নিল না। সে অপেক্ষা করছে। সে চাইছে স্যরের চোখের ওই টলটলে দিঘিটা উপচে জল নেমে আসুক গাল বেয়ে।

ডাম্বো নিজের হাতে সেই জল মুছে দেবে, আদর ভরা স্বরে স্যরকে মনে করিয়ে দেবে, “আপনি কাঁদছেন স্যর! কেন? স্পোর্টসম্যানরা কি কখনও কাঁদে? স্পোর্টসম্যানদের কাঁদতে নেই, স্যর।”

বাস থেকে নেমে প্রায় ছুটছিল মিহিকা।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। কাগজে কলমে শরৎকাল। তবে শহরের আবহাওয়া কবেই বা ক্যালেন্ডার মেনে চলে? তার ওপর আজকাল
বিশ্ব জুড়ে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নাকি দ্রুত পালটে যাচ্ছে, বরফ গলে যাচ্ছে পৃথিবীর উত্তরতম প্রান্তের, জলস্তর বাড়ছে সাগরে। বনাঞ্চল নাকি ধ্বংসের মুখে, তীব্র জলাভাবের আতঙ্কে এখন থেকেই থরোথরো কাঁপছে পৃথিবীর একটা বড় অংশের মানুষ।

এই শহরই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? দু'দিন পর পর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হচ্ছে এক-একটা নিম্নচাপ, ফলে প্রায় দিনই আকাশের মুখ গোমড়া আর তারই সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া আর হঠাৎ হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি।

পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। মিহিকার মনে হয় সেই দিন আর দূরে নেই যখন বর্ষাকাল বলে কিছু থাকবে না, নিম্নচাপ ছাড়া বৃষ্টিই নামবে না শহরে।

কতটাই বা পথ? খুব বেশি হলে দু’শো আড়াইশো মিটার। তবু এটুকু পথ হাঁটা শুরু করতেই বিশ্রী আর্দ্র হাওয়ায় তার কপালে ঘামের রেখা ফুটে উঠেছে। ফর্সা টকটকে গালে রক্তিম আভা।

মিহিকা আজ শাড়ি পরেছে, ময়ূরকণ্ঠী রঙের ব্যাঙ্গালোর সিল্ক। সঙ্গে মানানসই মেকআপ, কাজল, মাসকারা, আই লাইনার, ম্যাট ফিনিশ লিপস্টিক। এত সেজে সে অন্য দিন বাড়ির বাইরে বেরোয় না। আজ এত সাজগোজের কারণ আছে। আজ মিহিকার কাফের উদ্বোধন।

এমন দিনে কাফের মালকিন নিজে যে ধোপদুরস্ত হয়ে আসবে সে আর নতুন কথা কী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই যে, মিহিকার মুখে যেন আঁধার ঘনিয়েছে, সারা শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। যেন এই মুহূর্তেই তাকে কাফেতে ঢুকতে হবে, এতটুকু সময়ের এ দিক-ও দিক হলে যেন ঘটে যাবে ভয়ানক বিপর্যয়।

হাতঘড়ি দেখল মিহিকা, বারোটা চল্লিশ। তার মানে এতক্ষণে ফুলের লোকগুলো এসে গেছে। সাজানোর কাজে হাতও দিয়ে ফেলেছে তারা। কাফের ভেতরের সঙ্গে সঙ্গে বাইরেও, ঠিক ঢোকার মুখে একটা ফুলের তোরণ বানানোর ইচ্ছে ছিল মিহিকার। প্রথমে গাঁইগুঁই করলেও পরে ফ্লোরিস্ট রাজি হয়েছে, বলা ভাল উত্তীয় রাজি করিয়েছে। এত ক্ষণে কি সেই তোরণও বানানোর কাজ শেষ? না কি তারা অপেক্ষা করছে মিহিকার আসার?

জীয়নের সঙ্গে আজ সকালেই কথা হয়েছে। গত মাসখানেকে তাদের দু’জনের সম্পর্কের পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। জীয়ন এখন মিহিকার মস্ত অবলম্বন। আজকাল মাঝে মাঝে বাইকের পিছনে বসে জীয়নের কোমরে হাত রাখে মিহিকা। জীয়নের চোখ সামনে রাস্তায় স্থির থাকে। বাইক-চলতি উতলা হাওয়া জীয়নের জামা আর টি-শার্টের ভাঁজে ফুলে ফেঁপে ওঠে, জীয়নকে দেখায় এক বলশালী মানুষের মতো।

আজ প্রায় চার মাসের মাথায় তার কাফে খুলছে। অথচ মিহিকা কি ভাবতে পেরেছিল এই অল্প ক’দিনের মধ্যে সে নিজে আস্ত একটা কাফের মালকিন হয়ে বসবে!

তারই সঙ্গে একটা চিন্তা গ্রাস করছিল মিহিকাকে। যদি না পারে? যদি এই কাফে ফ্লপ করে? এত টাকার লোন শোধ হবে কী করে? সব থেকে খারাপ লাগবে উত্তীয়দার জন্য। অজানা অচেনা একটা লোক কী ভাবে লড়ে গেল মিহিকার জন্য। মানুষ মানুষের জন্য এতটা করে?

এই নিয়েই ধন্দে ছিল মিহিকা। ছিল, এখন নেই।

আজ সকালের পর থেকে পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গেছে। আর সেই জন্যই তার এই মুহূর্তে এক বার উত্তীয়দার সঙ্গে দেখা হওয়া ভীষণ দরকার। আজ সন্ধেয় কাফের উদ্বোধন, একটা ছোটখাটো ফাংশন হবে।

বন্ধুরা তো থাকবেই। দিদি, ডাম্বো আর কয়েক জন আত্মীয়কেও আসতে বলেছে মিহিকা, আর এলাকার মুরুব্বি গোছের কিছু লোক।

তবে সে সবের আগে এক বার উত্তীয় মজুমদারের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া তাকে করে ফেলতেই হবে।

অথচ আজ সকাল অবধিও সব ঠিকঠাক ছিল। সুন্দর আলো-ঝলমলে দিন একটা। মনটা তার ছিল ভারী ফুরফুরে। আগের রাতে দিদিয়াকে নিজের কাফের ওপেনিং-এর খবর দিয়েছিল মিহিকা। খুব সাবধানে খবরটা দিতে হত। দিদিয়া যে খুব সহজে এই ঘটনা মেনে নেবে না সেটা জানত মিহিকা। জন্ম থেকে দিদিয়াকে দেখে আসছে সে। বরাবর লাজুক মুখচোরা মেয়ে। ফ্যামিলি ফাংশনে গান গাইতে বললেও গলা কেঁপে যেত দিদিয়ার। মিহিকা ছিল দিদির ঠিক বিপরীত। গান, নাচ, যে কোনও পারফর্মিং আর্টসে মিহিকা ছিল পারদর্শী। বিন্দুমাত্র জড়তা ছিল না তার।

সেই দিদিয়ার জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত তো কম এল না। জামাইবাবুটা ওই ভাবে বিট্রে করল, নতুন করে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াল, ডাম্বোটাকে দিব্যি মানুষ করছে, কিন্তু মিহিকা জানে দিদির ভিতর সেই ছোট ভিতু আর মুখচোরা মেয়েটা আজও বেঁচে আছে।

এ পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর থেকে দিদি হঠাৎ মিহিকার অভিভাবকের ভূমিকা নিয়েছিল। মিহিকা কী খাবে, কী পরবে, কোন দিকে পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাবে, সব বিষয়ে যেন একটু বাড়াবাড়ি নজর রাখতে শুরু করেছিল মঞ্জীরা।

মিহিকাই বা তা মেনে নেবে কেন, সে তো কচি খুকি নয়। ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তার জীবনটা একান্তই তার নিজের। মঞ্জীরা থমকেছিল, কিন্তু হাত গুটিয়ে নেয়নি পুরোপুরি। আড়াল থেকে নিয়মিত মিহিকার সমস্ত খোঁজখবর রেখে গিয়েছে সে।

তাই মিহিকা তাকে না জানিয়ে একেবারে নিজের প্রতিষ্ঠান খুলে ফেলেছে, বিন্দুমাত্র মানসিক বা আর্থিক সাহায্য ছাড়াই, এটা দিদিয়া কী করে মেনে নেবে, তা নিয়ে একটা মৃদু ধোঁয়াশা ছিল তার মনে। আর ছিল আশঙ্কা, দিদিয়া যদি জেদ দেখিয়ে কাফের উদ্বোধনে যেতে বেঁকে বসে, তা হলে একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে।

খুব সাবধানে প্রসঙ্গ তুলেছিল মিহিকা, বেশি খোলেনি। একটা চোরা অপরাধবোধ হচ্ছিল তার। এই কি সেই চিরন্তন মধ্যবিত্ত মানসিকতা, যা বাধা দেয় একটি মেয়েকে স্বনির্ভর হতে?

মঞ্জীরা অবাক করেছিল মিহিকাকে। খুব সহজে ঘটনাটা গ্রহণ করেছিল সে। যেন সে জানত মিহিকা এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে যে কোনও দিন, অথবা একুশ বছরের একটা মেয়ের আস্ত একটা কাফেটেরিয়া খুলে ফেলা এক অত্যন্ত মামুলি ঘটনা। দিদিয়া আলতো হাতে জড়িয়ে ধরেছিল তাকে, মৃদু স্বরে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল, আর বলেছিল, আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ডাম্বোকে নিয়ে পৌঁছে যাবে কাফের দরজা খোলার আগেই।

মিহিকা বোঝেনি, শত ব্যস্ততার মাঝেও দিদিয়া তার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল।

সকাল থেকে যেন হাওয়ায় ভাসছিল মিহিকা। ফোনে কথা আর শেষ হচ্ছে না তার। কথা বলার ধরনে অকৃত্রিম ঘনিষ্ঠতা। টিফিন বানাতে বানাতে, ডাম্বোকে স্কুলের জন্য রেডি করার ফাঁকেও বোনের দিকে খেয়াল করছিল মঞ্জীরা। কুড়ি বছরের একটা মেয়ে ফোন কানে নিয়ে একটা বড় সময় কলকল করবে এ তেমন আশ্চর্য ঘটনা নয়, তবু সেই নিকট আলাপচারিতা অস্বস্তিতে ফেলেছিল মঞ্জীরাকে।

মিহিকা সময় নিয়ে স্নান করেছে, আর তার পর ঢুকে গেছে নিজের ঘরে। তালের গান চালিয়েছে একটা। ঘরময় ছড়িয়ে যাচ্ছে বিদেশি সুর—

আই অ্যাম ইন দ্য স্টারস টুনাইট/ সো ওয়াচ মি ব্রিং দ্য ফায়ার/ অ্যান্ড সেট দ্য নাইট অ্যালাইট...

ডাম্বো স্কুলে বেরিয়ে গেলে পর্দা সরিয়ে বোনের ঘরে ঢুকল মঞ্জীরা।

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Novel rabibasariyo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy