গীতিময়: যূথিকা রায়।
সালটা ১৯৩৪। বছর চোদ্দোর মেয়েটি গ্রামাফোন কোম্পানিতে এসেছে গান রেকর্ড করতে। ঘরে রয়েছেন দু’জন, সুরকার কমল দাশগুপ্ত ও গীতিকার প্রণব রায়। কমলবাবু মেয়েটির খাতায় লিখে দিলেন দু’টি গান। এ বার শেখার পালা। শেখানোর আগে কমল দাশগুপ্ত মেয়েটিকে বললেন, ‘‘আমরা এমন গান তৈরি করতে চাইছি, যা হবে সহজ কথায় সুরে মেলডিতে ভরা রোম্যান্টিক বাংলা গান। এ জন্যে তোমার মতো কণ্ঠচলন আমার দরকার। যেখানে শাস্ত্রীয়-সঙ্গীতের শিক্ষার ছোঁয়া থাকবে, কিন্তু কখনও তা প্রকট হবে না। গান এমন হবে, যা শুধু সমঝদারদের মধ্যে নয়, ছড়িয়ে পড়বে আপামর বাঙালির মনে।’’ তার পর প্রণব রায়ের কথায় ও কমল দাশগুপ্তর সুরে রেকর্ড করা হল যূথিকা রায়ের গাওয়া সেই দুটি গান— ভৈরবীতে ‘আমি ভোরের যূথিকা’ আর ইমনকল্যাণে ‘সাঁঝের তারকা আমি’। ১৯৩৪-এর নভেম্বর মাসে প্রকাশ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে ৬০,০০০ কপি বিক্রি হল সেই রেকর্ড। রাতারাতি প্রতিষ্ঠা পেলেন কিশোরী শিল্পী। বাংলা গানের একটি ধারা হিসেবে যে ‘আধুনিক’ বাংলা গানের জন্ম হয়েছিল এই দশকে, সে ব্যাপারে অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল যূথিকা রায়ের গাওয়া গানদু’টির।
এর এক বছর আগেই গ্রামাফোন কোম্পানিতে গান রেকর্ড করেছিলেন যূথিকা রায়। কিন্তু তা বাজারে বেরোয়নি। তখন বরানগরের জ্ঞানরঞ্জন সেনগুপ্তর কাছে গান শেখেন যূথিকা। এক দিন সেখানেই যূথিকার গান শুনে মুগ্ধ কাজি নজরুল ইসলাম তাঁকে দিয়ে নিজের দু’টো গান গ্রামাফোন কোম্পানিতে রেকর্ড করালেন। যার মধ্যে একটি ছিল মল্লার রাগে ‘স্নিগ্ধ শ্যামবেণীবর্ণা’। কিন্তু রেকর্ডটা কোম্পানির বোর্ডে পাশ হল না। তখন বোর্ডে থাকতেন কোম্পানির ডিলাররা, তাঁরা রেকর্ডের বিক্রির ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করে তা বাতিল করলেন। এর এক বছর বাদে এইচএমভি-র ট্রেনার নিযুক্ত হলেন কমল দাশগুপ্ত। তিনি পুরনো বাতিল রেকর্ডের স্তূপ ঘেঁটে পেলেন তাঁর আকাঙ্ক্ষিত কণ্ঠ। রেকর্ড করালেন যূথিকাকে দিয়ে। এ বারেও কিন্তু ‘ভোরের যূথিকা’ রেকর্ডটি বোর্ডের ডিলাররা প্রথমে নিতে চাননি। গানদু’টিতে সুরকার কমল দাশগুপ্ত কোনও তালবাদ্য ব্যবহার করেননি— বেহালা, পিয়ানো, অর্গ্যান ও হারমোনিয়াম বেজেছিল। তাই হয়তো ডিলারদের কাছে তা নতুন ঠেকেছিল। সে দিন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন নজরুল। তখন তিনি কোম্পানির ‘রিটেনার’ পদে বহাল। বলেছিলেন, যে সব রেকর্ড বিক্রি হয় না, সেগুলো তো কোম্পানি ফেরত নিয়ে নেয়। তা হলে অসুবিধে কোথায়? যূথিকার রেকর্ডটা না নিলে ডিলারদের কোনও রেকর্ডই দেওয়া হবে না। অগত্যা নিতেই হল তাঁদের। পরবর্তী কালে যূথিকা রায় বার বার বলতেন, ‘‘সে দিন কাজিদা ওই ভাবে রুখে না দাঁড়ালে হয়তো আমার আর গান গাওয়াই হত না।’’
১৯২০ সালের ২০ এপ্রিল হাওড়ার আমতায় জন্ম। বাবা সত্যেন্দ্রনাথ রায়ের চাকরিতে বদলির কারণে, যূথিকাকে তিন-চার বছর বয়সেই চলে আসতে হয় খুলনার সেনহাটি গ্রামে। বাবা ভাল গান জানতেন, শেখাতেন মেয়ে রেণুকে। ওটাই যূথিকা রায়ের ডাকনাম। মা স্নেহলতা দেবী ছিলেন এক ব্যতিক্রমী নারী। নিজের মেয়েদের ইস্কুলে তো পড়িয়েছিলেনই, সেনহাটির বাড়ি বাড়ি ঘুরে মায়েদের বলতেন মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর কথা। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের সময়ে, কলকাতায় নিজের বাড়িতে প্রতিদিন বহু নিরন্ন মানুষকে খাওয়াতেন স্নেহলতা দেবী।
সেনহাটি গ্রামে আলাপ হল গায়িকা সুধীরা দাশগুপ্তর সঙ্গে, তাঁরই পরামর্শে সাত বছরের মেয়ে রেণুকে নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ গেলেন কলকাতায় সুধীরার বড়দা বিমল দাশগুপ্তর কাছে। ইচ্ছে, তাঁর কাছে মেয়েকে গান শেখানো। বিমলবাবু ছিলেন একাধারে মিউজিশিয়ান, ম্যাজিশিয়ান ও কমেডিয়ান, প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক কমল ও সুবল দাশগুপ্তর বড়দা তিনি। এইটুকু মেয়েকে সে দিন গান শেখাতে রাজি হননি বিমল দাশগুপ্ত। তবে সে বারই বাবার উদ্যোগে সদ্য জন্ম নেওয়া কলকাতা বেতারে অডিশন দিয়ে পাশ করে, রেডিয়োতে খালি গলায় যূথিকা গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আর রেখো না আঁধারে’। এর পর ১৯৩০ সালে পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় আসা, এবং চার বছরের মাথায় রেকর্ড জগতে প্রবেশ যূথিকার।
নিজের গানকে মেলে ধরার ইচ্ছে নিয়ে যাঁর পারিবারিক পরিমণ্ডলে ঘটনাচক্রে প্রথমেই গিয়ে পড়েছিলেন যূথিকা, সেই কমল দাশগুপ্তর সঙ্গীত-স্পর্শেই বিকশিত হয়ে পরে কিংবদন্তি শিল্পীতে পরিণত হলেন তিনি। যূথিকা রায় জীবনে যত গান রেকর্ডে গেয়েছেন, তার মধ্যে কয়েকটা বাদে সবগুলোর সঙ্গীত পরিচালক এক জনই— কমল দাশগুপ্ত। কমল-যূথিকা সংযোগে আধুনিক বাংলা গানের দুনিয়ায় ঝরে পড়েছে এক-একটি সঙ্গীত-রত্ন— ‘মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে’ (কথা: নজরুল), ‘ওরে নীল যমুনার জল’ (নজরুল), ‘এমনই বরষা ছিল সে দিন’ (প্রণব রায়), ‘শতেক বরষ পরে’ (মোহিনী চৌধুরী), আরও কত! কমল দাশগুপ্ত যূথিকাকে দিয়ে অজস্র ভজন গাইয়েও ভারত-বিখ্যাত করে দিয়েছেন। এমনকি তামিল ভাষায় বেশ কিছু গানও তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় গেয়েছেন যূথিকা রায়। মিষ্টি অথচ উঁচু পর্দায় বাঁধা, সাত সুরের জোয়াড়িসম্পন্ন কণ্ঠ এবং এর সঙ্গে কমল দাশগুপ্তর সুরমূর্ছনা— এ যেন ছিল রাজযোটক। শেষ জীবনে তাঁকে দেখে বোঝা যেত, কী ভাবে কমল দাশগুপ্তকে তিনি অন্তরে ধারণ করে রাখতেন। ভক্তি ও প্রেমে ভরা এ যেন অপূর্ব এক সুরময় সংযোগ! নয় বছর বয়স থেকে আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করেছিলেন যূথিকা রায়। বেলুড় মঠের দীক্ষিত ছিলেন। সাধারণ ধার্মিক বাঙালির মতো নিয়তিবাদী বা বিলাপধর্মী কথা বলতেন না কখনও। ভবিষ্যতের দিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল সতত
শুভ আশায় ভরা।
শিল্পীর গানের খাতায় কমল দাশগুপ্তর হস্তাক্ষর
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট সকালে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যখন লালকেল্লার সামনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করছিলেন, দিল্লি বেতার কেন্দ্র থেকে যূথিকা রায় তখন গাইছেন, ‘সোনেকা হিন্দুস্থান মেরা।’ সে বছরেই দাঙ্গার সময় কলকাতার বেলেঘাটায় মহাত্মা গাঁধীর অবস্থানকালে, তাঁকে গিয়ে ভজন শুনিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ধর্মতলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক বিরাট মিলনসভায় শান্তির বাণী প্রচার করেছিলেন গাঁধী। সেখানে তিনি নিয়ে যান যূথিকা রায়কে। সভা শেষ হয় তাঁর গাওয়া ‘ওরে নীল যমুনার জল’ গান দিয়ে। শান্তির বাতাবরণ যেন পরিপূর্ণতা পেয়েছিল সে দিন। অনেক পরে ১৯৭২ সালে পোরবন্দরে গাঁধীজির জন্মকক্ষে বসেও গান করেন যূথিকা রায়। সে বছরেই পেয়েছিলেন ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান।
সারা ভারতে আজও জনপ্রিয় তাঁর গাওয়া ভজন। যে তিনটি ছবিতে তিনি নেপথ্যে গেয়েছেন, তার সবগুলিই ভক্তিসঙ্গীত। যেমন রাজেন সরকারের সুরে সুচিত্রা সেনের লিপে ‘ঢুলী’ (১৯৫৪) ছবিতে ‘এই যমুনারি তীরে’ (প্রণব রায়) এবং ‘প্রভুজী জীবনজ্যোত জাগাও’ (পণ্ডিত ভূষণ)। এ ছাড়া, রবীন চট্টোপাধ্যায় ও সন্মুখবাবু উপাধ্যায়ের সুরে যথাক্রমে ‘রত্নদীপ’ (১৯৫২) এবং ‘লালক্যর’(১৯৫৬) নামে ছবি দু’টিতে যূথিকার ভজন শোনা গেছে। সিনেমায় বেশি গাইলেন না কেন জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলেন, ‘‘ওই রকম ধরাবাঁধা সিচুয়েশন অনুযায়ী গান গাইতে আমার ভাল লাগত না। কমলদা এটা ভাল বুঝতেন। তাই কোনও দিন আমায় ছবিতে গাইতে বলেননি।’’ শেষ দিকে কিছু অনুষ্ঠানে বা ঘরোয়া পরিবেশে অনেক সময় তাঁকে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে শোনা যেত। অথচ কোনও দিন এ গান তিনি রেকর্ডে গাইলেন না। বলতেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের গান আমার প্রাণে মিশে আছে। কিন্তু রেকর্ডে গাইতে সাহস পাইনি। ওখানে যে বড্ড নিয়মের কড়াকড়ি!’’ প্রসঙ্গত, ‘ভোরের যূথিকা’ রেকর্ডটি রবীন্দ্রনাথকে শোনানো হয়েছিল গ্রামাফোন কোম্পানির উদ্যোগে। শুনে মুগ্ধ হয়ে কবি বলেছিলেন, ‘‘এই মেয়েটির গানে যেন চিরকাল এই রকমই পরিমিত বাজনা ব্যবহার করা হয়।’’ শেষ দিকে নিজের সুরে কয়েকটা গান রেকর্ডে গেয়েছিলেন যূথিকা রায়। গেয়েছেন অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্তের গানও। যার মধ্যে ‘ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়’ শুনলে মনে হয়, কান্তকবি যেন যূথিকার জন্যেই গানটি রচনা করেছিলেন।
এক জন সাধিকা শিল্পী বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তা-ই। গান গাইতে সারা ভারত শুধু নয়, বিদেশেও গেছেন। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক সন্ধ্যায় চন্দননগর রবীন্দ্রভবনে ‘স্পন্দন সঙ্গীত শিক্ষালয়’ ও ‘অবশেষে’ সংস্থার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত বাংলা গানের এক অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত করা হয় এই কিংবদন্তি শিল্পীকে। তিনি সেখানে গান গেয়েছিলেন, কিছু কথাও বলেছিলেন। সেটাই ছিল তাঁর শেষ মঞ্চানুষ্ঠান।
নব্বই পেরনো বয়সেও অসীম জীবনীশক্তি ছিল তাঁর। নিজে নিয়মিত লেখালিখির মধ্যে থাকতেন। বহু বিখ্যাত মানুষ ও শিল্পীর আত্মকথা অনুলিখনের সহায়তায় তৈরি, কিন্তু যূথিকা রায়ের ‘আজও মনে পড়ে’ বইটির পুরোটাই তাঁর নিজের লেখা। গীতা চৌধুরীর অনুবাদে ইংরেজিতে ‘মাই ওয়র্ল্ড অব মিউজ়িক’ নামে যখন তাঁর আত্মজীবনী প্রকাশিত হয় মুম্বইতে, তখন তাঁর বয়স ৯৩ বছর। সেই বয়সেও সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। নিয়মিত গান শেখাতেন তখনও। এক বার বলেছিলেন, ‘‘যখন ভজন শেখাই, সুর-তাল-লয়টুকু ছাড়া আর কিছু শেখানো যায় না। ‘ভক্তি’-টা কী করে শেখাবো বলো? ওটা তো
নিজস্ব ব্যাপার।’’
ছ’বছর হল চলে গিয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি এই সুরসাধিকার প্রয়াণদিবস। আর এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। আজ এই সন্ত্রস্ত ও রোগপীড়িত সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, তাঁর মতো শিল্পীদের বড়ই প্রয়োজন, যাঁদের গান চরাচরকে স্বস্তি দেবে, শান্ত করবে।
কৃতজ্ঞতা: সঞ্জয় সেনগুপ্ত, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দীপা মুখোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy