ছবি: কুনাল বর্মণ
স
ত্তর-আশির দশকের কলকাতা। বিজয়া সম্মিলনীতে ভোর রাতে শেষ শিল্পী মীরা আর বুবাই বিশ্বাস। অবধারিত প্রথম গান ‘জাগো মোহন প্রীতম’। গানের সুরে জেগে উঠেছে পক্ষিকুল। পুরসভার কর্মীদের রাস্তা ধোয়া স্থগিত। শ্রোতাদের মানসপটে ক্ষীণতনু মরাঠি কন্যার অবয়ব, ঠিক যেমন চণ্ডালিকার প্রকৃতি। কোমলে কঠোরে গড়া বিদ্যুল্লতা। মন তখন বম্বে মেল। এসি থেকে সাধারণ ক্লাস, সব আসনেই আসীন সুরের চিরকালীন সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। দাদু থেকে নাতি— তিন প্রজন্মের স্বপ্নের সুরকন্যা তিনি। না, কণ্ঠের বয়স বাড়েনি ওঁর।
শখের নয়, বেশ জোরদার ভ্রাম্যমাণ থিয়েটারের দল ছিল বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের। যত দিন বেঁচে ছিলেন, ছেলেমেয়েদের মঞ্চে উঠতে দেননি। কিন্তু নাটকীয়তার বীজ নিশ্চিত বুনে দিয়েছিলেন সন্তানদের মধ্যে। তাই লতা, আশার নিবেদনের নৈপুণ্য ছাপিয়ে যা ঠিকরে বেরোয়, তা হলো নিখাদ অভিব্যক্তি, নাটকীয়তা।
সেই অভিব্যক্তি যুগ থেকে যুগান্তরে বিভিন্ন অভিনেত্রীর গলায় বাসা বেঁধেছে। সুরকারেরা থেকেছেন নিশ্চিন্ত। তাঁরা জানতেন, পরিবেশনে খুঁতহীন নিশ্চয়তা না এলে লতা নিজেই ফ্লোর ছেড়ে নড়বেন না। সময়ের অকুলান, যত দিন কাজ করেছেন, তত দিনই ছিল। তার সঙ্গে ছিল কোয়ালিটি কন্ট্রোল। বহু সহস্র গান তার সাক্ষ্য বহন করছে। ওঁর প্রথম দিকের বাংলা গানের একটি ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে’ এক টেক-এই ওকে হয়ে গেলেও সুরকার সতীনাথ মুখোপাধ্যায়কে অপরটির জন্য বেশ ক’টি দিন মুম্বইয়ে থেকে যেতে হয়েছিল। গান আত্মস্থ করতে সময় চাইলেন লতা, মনের মতো স্টুডিয়ো পেতেও অনেক তদবির তদারক করতে হয়েছে। অপেক্ষার ফল পাওয়া গেল হাতেনাতে। সারেঙ্গির গভীর মূর্ছনায় অমর হল সে রেকর্ডিং ‘কত নিশি গেছে নিদহারা ওগো’। ভাল কাজের জন্য সময় যে দিতেই হয়।
ছবিতে চরিত্র আর নায়িকা ভেদে গায়কির পরিবর্তন করেছেন লতা মঙ্গেশকর, খুব সচেতন ভাবেই। অনেকেই পারেননি, মুকেশ যেমন পারেননি রাজ কপূরের ছায়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে। লতা কিন্তু অভিনেত্রীর নিজস্বতাকে ছাপিয়ে যাননি তাঁর গানে। পঞ্চাশের দশক থেকে একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত তেমনই কয়েকটি নাম— মীনাকুমারী, মধুবালা, বৈজয়ন্তীমালা, নার্গিস, সুচিত্রা সেন, ওয়াহিদা, আশা পারেখ, শর্মিলা ঠাকুর, মালা সিন্হা, সায়রা বানু, রাখি, জয়া, জিনাত হয়ে হেমা মালিনী, রেখা, শ্রীদেবী, জয়াপ্রদা, ডিম্পল, পদ্মিনী কোলাপুরি, মাধুরী, জুহি, কাজল, ঐশ্বর্য, রানি, করিনা। সবার কণ্ঠেই লতার গান। এমনটি পৃথিবীর গানবাজনার ইতিহাসে ঘটেনি, ঘটবেও না সম্ভবত। চালচিত্রে এই একটি কারুকৃতি অক্ষয়। তাকে সরানোর উপায় নেই। তাই দ্বৈত গান গাওয়ার সময় কুমার শানু নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখছেন, এ স্বপ্ন না সত্যি! কারণ, তাঁর জন্মের আগেই যে এই শিল্পী সর্বভারতীয় গানে প্রতিষ্ঠিত মুখ। কুমার শানুর উত্থানের ঢের আগে সত্যজিৎ রায় ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ লিখে ফেলেছেন, সেই কাহিনিতে তোপসে বারাণসীর গলিতে সন্ধ্যা নেমে আসার বর্ণনা দেয়, “কীর্তিমান ছোটুরামের পানের দোকানে এইমাত্র ট্রানজিস্টর খোলাতে লতা মঙ্গেশকর সাইকেল রিকশার প্যাঁকপ্যাঁকানির সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করেছে।” এখানেই লতা-মহিমা। কলকাতা থেকে বারাণসী, ঝুমরিতলাইয়া সর্বত্র জনসংস্কৃতিতে তিনি!
সে প্রতিষ্ঠা পেতে বিস্তর আত্মদমন ছিল ওঁর নিত্য অভ্যাস। রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমির উষাপর্বে এক সেমিনারে সলিল চৌধুরীকে বলতে শুনেছিলাম সে কথা। রেকর্ডিংয়ের আগে বিশেষ কিছু খেতেন না লতা। দুঃখের গানের আগে তো প্রায় উপবাস। নিজেকে প্রশমিত রেখে যজ্ঞে পদার্পণ যেন। আশা ভোঁসলের সঙ্গে মন কষাকষির টকঝাল যখন গসিপ আকারে তুবড়ির মতো জ্বলছে, তখন সকলের অগোচরে অফার পেয়েও ও পি নাইয়ারের কোনও ছবিতে গাইতে সম্মত হননি লতা। এই কালজয়ী সুরকারের তুরুপের তাস ছিলেন আশা। সেখানে প্রবেশ মানে সাংসারিক অসন্তোষকে বাড়ি বয়ে ডেকে আনা। তাই ও পথই মাড়াননি। এতটাই বুঝদার তিনি। অন্য ছবিও আছে। যশ চোপড়ার ‘বীর জ়ারা’ ছবিতে অবসর ভেঙে ফের গাইতে এসেছেন। যশ চোপড়ার নানা সময়ের ছবিতে গান গেয়ে যে যশ পেয়েছেন লতা, অবসর ভেঙে ফের গাওয়া সেই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনেরই সুরেলা রূপ। নিজের কাছে পরিষ্কার থাকতে গিয়ে কখনও আবার কিছু অপ্রিয় আলোচনার তিরেও বিদ্ধ হয়েছেন। মধুবালা ভাবতেন, তাঁর অভিনয়ে লতার কণ্ঠটি ভাল যায়। লতা ভেবেছেন অন্য রকম। তিনি গাইতে চাইতেন সায়রা বানুর লিপে। এমনকি যে মহম্মদ রফির সঙ্গে দ্বৈত গানে খ্যাতির আকাশ ছুঁলেন লতা, রয়্যালটি সংক্রান্ত বিবাদে মতান্তর হওয়ায় তাঁর সঙ্গে টানা তিন বছর কোনও রেকর্ডই করেননি। যে মেয়ে বাবার অকাল প্রয়াণে চোদ্দো বছর বয়সে সংসারের হাল ধরে, তাঁকে এ ধরনের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে দেখাটাই স্বাভাবিক। অবশ্য বিতর্কও তাঁকে ছাড়েনি। নানা সময়ে বাণী জয়রাম, অনুরাধা পড়োয়ালের অনুরাগী মহল থেকে অভিযোগ এসেছে, লতা মেনে নিতে পারেন না অপর মহিলা গাইয়ের গৌরবকীর্তন। কেন বেবাক মূক বনে গেলেন সুমন কল্যাণপুরের মতো প্রতিভাময়ী, সে বিষয়েও আঙুল উঠেছে লতার দিকে। কেন আরতি মুখোপাধ্যায়ের কাজের সংখ্যা গানের গুণপনার সঙ্গে মিলল না, এ প্রশ্নও ওঠে। এমনকি পছন্দের কোনও গান নজরে এলে সে গান অপরের মুখ থেকে তুলে আনতে বাধ্য করেছেন লতা, এমন কানাঘুষোও শুনেছি। এ সবের পাল্টা জবাবও আছে। আছে অন্য ছবি, যেখানে দেশভক্তির গানে লতা কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই উদ্বুদ্ধ চিত্তে কাজ করেছেন সকলের সঙ্গে।
তাই ২০১৯-এ নিজের প্রতিষ্ঠিত এল এম মিউজ়িক যখন প্রকাশ্যে আনল সেনাবাহিনীর প্রতি উৎসর্গীকৃত ওঁর নতুন গান ‘সৌগন্ধ মুঝে ইস মিট্টি কি’, কেউই কিন্তু অবাক হননি, বিশেষ করে লতার দেশভক্তি বিষয়ে যাঁরা অল্পবিস্তর খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা। গান ছাড়া শুধুমাত্র ভোকাল রিফ্রেনের কাজেও লতা একশো শতাংশ পেশাদার এবং নিবেদিতপ্রাণ। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় শুনিয়েছিলেন সে কাহিনি। ১৯৬১ সাল। মুম্বইয়ে ‘মায়া’ ছবিতে দেব আনন্দের লিপ-এ গাইতে গিয়ে ফাঁপরে পড়লেন দ্বিজেনবাবু। স্বয়ং লতা মঙ্গেশকর এসেছেন স্টুডিয়োতে সলিল চৌধুরীর ডাকে। ‘অ্যায় দিল কঁহা তেরি মঞ্জিল’ গাইছেন দ্বিজেন, আর সমান্তরাল মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে লতা কণ্ঠের স্বরমালিকায় অবিশ্বাস্য আবহ গড়ছেন। সে গানের এই অংশ যত বার শুনি, তত বারই মনে হয় সঙ্গীতশিক্ষার আসর বসেছে যেন। নব্বই শতাংশ সময় আশা ভোঁসলের গান নিয়ে থাকলেও, রাহুল দেব বর্মণের জীবনের প্রথম এবং শেষ সুরারোপ লতা মঙ্গেশকরের গানেই। ১৯৬১-তে ‘ছোটে নবাব’, ১৯৯৪ সালে ‘১৯৪২ আ লাভ স্টোরি’ তে ‘কুছ না কহো’-য় শেষ। যত বার এ গানের কথা উঠেছে, রাহুলের প্রয়াণের প্রসঙ্গে প্রায় পুত্রশোকে নত হতে দেখা গেছে ওঁকে। দীর্ঘ জীবন অনাকাঙ্ক্ষিত শোকতাপও দেয় যে!
রাহুল দেব বর্মণের বাবা লতার কাছে ‘বর্মণ দাদা’। শচীনকত্তা ওঁকে ডাকতেন ‘লোতা’ বলে, তাঁর পূর্ববঙ্গীয় অতি নিজস্ব উচ্চারণে। দানে গ্রহণে সে এক অপূর্ব উন্মোচন। নিজের চল্লিশ থেকে ষাটের দশকের লোকগীতি-ভাঙা অতুলন সম্ভার লতা-কণ্ঠে ভিন্ন গায়কিতে ছবির গানে সেঁটে দিলেন শচীন দেব বর্মণ। ভাবনার গৌরব আর গায়নের দ্যুতিতে তা অচিরেই লতার খ্যাতির মুকুটে নতুন পালক। ৩১ বছরের এই সঙ্গীতসখ্য এক বার চিড়ও খায়। বছর চারেক কাজ করা তো দূরস্থান, বাক্যালাপও বন্ধ ছিল দু’জনের। শেষে রাহুলের মধ্যস্থতায় বরফ গলে। ‘বন্দিনী’-তে ফের শোনা গেল এস ডি-লতা জুটির গান ‘মোরা গোরা অঙ্গ লাই লে’। বাংলা গানে কিন্তু এ জুটির কাজ নেই। সেখানে একশো ভাগ সফল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
লতার বাংলা উচ্চারণে অসঙ্গতি কানে বাজতেই অগ্রজের স্নেহে তা ধরিয়ে দেন হেমন্তবাবু। এতে বিন্দুমাত্র না চটে বাসু ভট্টাচার্যকে লতা অনুরোধ করেন বাংলা শেখাতে। দস্তুরমতো, নিয়ম করে শেখেনও। হেমন্ত-লতা সম্পর্কে কখনও মন্দ বাতাস আসেনি। কলকাতায় এলে বরাবরই লতার প্রথম ঠিকানা হেমন্তবাবুর বাড়ি। ছবির গানে মেলোডির হাজার বর্ণছটায় লতাকে বাঙালিয়ানার মোড়কে উপস্থাপিত করেন হেমন্ত। ১৯৫৬-য় ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’ তার প্রথম এবং সিগনেচার গান। এখানে লতা যেন বাঙালির গৃহকোণের তুলসীমঞ্জরি। এ কৃতিত্ব হেমন্তবাবুরই। অপর বিষয়টি হল দ্বৈত গায়ন। হেমন্ত-সন্ধ্যা, মান্না-সন্ধ্যা, আরতি-মান্না জুটির গানের মাঝে অন্যতর স্বাদ হেমন্ত-লতা জুড়ি, ফিল্মের গান হয়ে বেসিক রবীন্দ্রসঙ্গীতেও তা সুপারহিট।
সলিল চৌধুরীর গানে তাঁর দক্ষতা নিয়ে নিজেই নিঃসংশয় ছিলেন লতা। প্রকাশ্যেই বলেছেন, সলিলবাবুর গানে রপ্ত হতে গেলে নানা ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। হিন্দি ফিল্মে অসংখ্য আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় গানে সলিল এবং লতা যেন একে অপরের পরিপূরক। স্রষ্টা আর শিল্পীকে আলাদা করা যায় না। ব্যাপারটা সহজ ছিল না। গণনাট্যের আদর্শে স্ফুরিত সলিল মুম্বইয়ে ছবির গানে তাঁর স্লোগানকে দিলেন প্রেমের পাঠ ও সংলাপ। নিখাদ সাঙ্গীতিক প্রজ্ঞায় গানের আবহে আনলেন নতুন তারার আলো। সে আলোয় নয়া রূপ নিল লতা-কণ্ঠ। শাস্ত্রীয় ঘরানাদার মদনমোহন, লতার ৭০০ গানের সুরকার লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলালকে পাশ কাটিয়ে মোক্ষে পৌঁছনো অতি কঠিন বিষয়। সলিল পারলেন। বাংলায় লতা-সলিল জুটি বেশি কাজ করেননি। ৩৫টির মতো গান, যার অধিকাংশগুলিই মিউজ়িক অ্যারেঞ্জমেন্ট-সহ শ্রোতার মুখে মুখে ফেরে। এখানে মুখ্য ভূমিকায় লতাকণ্ঠের ‘পারফেকশন’।
‘পিচ পারফেক্ট’ লতা মঙ্গেশকরকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন গীতিকার জাভেদ আখতার তনয় ফারহান। খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ এই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। হালের প্রায় সব হিট গানেই বড় ভূমিকা পালন করে পিচ কারেকশন। বেসুরোকে সুরে আনার এই যান্ত্রিক উপায় থেকে শতহস্ত দূরে থেকেছেন লতা এবং তাঁর আগে পরের সমসাময়িকেরা। এ আর রহমান বলেছেন, মঞ্চে গায়নের টিপস তিনি পেয়েছেন লতা মঙ্গেশকরের কাছ থেকেই। আর লতাও রহমান সাহেবের ‘জিয়া জ্বলে’-তে প্রমাণ দিতে পেরেছেন, প্রয়োজনে সব খোলস ত্যাগ করে নতুন রূপ নিতে পারেন তিনি। বেহালা আর গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে লতার পাঁচ দশকের সঙ্গী উত্তম সিংহ স্মরণ করেছেন ১৯৯৭-র ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ গায়নের সেই উত্তাল সময়কে। গলি থেকে রাজপথে মুখে মুখে ফিরেছে তখন এ গান।
গলি থেকে রাজপথে তাঁর কোন গান না গুনগুন করেছে মানুষ? তিনি কখনও ‘শোর’ ছবিতে জয়া ভাদুড়ির লিপে গাইছেন ‘এক পেয়ার কা নাগমা হ্যায়’। ছবি ফ্লপ, কিন্তু গান? রাহুল দেব বর্মণের সুরে ‘আঁধি’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের ঠোঁটেও তিনি... ‘তেরে বিনা জিন্দগি সে কোই’। বাংলার মহানায়িকাকে যে তামিল বা গুজরাতি দর্শক চেনেন না, তাঁর স্মৃতিতেও তো রয়ে গিয়েছে সেই গান। রাহুলের বাবা, শচীন দেব বর্মণের সুরে ‘গাইড’ ছবিতে ওয়াহিদা রহমানের পর্দা-উপস্থিতিতে ‘আজ ফির জিনে কি তমন্না হ্যায়’, সেখানেও তো লতা মঙ্গেশকর। প্রেমিকার আহ্বান যে কোন শিখরে পৌঁছাতে পারে, তার উদাহরণ
আজও ‘শঙ্খবেলা’ ছবিতে মাধবীর ঠোঁটে ‘আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব’।
আসলে, বাংলা, হিন্দি এ সব ভাষার মাপে তাঁকে কোনও দিনই বাঁধা যায়নি। গায়কিটাও তো রহস্য। যাঁরা ভাবেন, লতার গলায় ক্যাবারে গান খোলে না, তাঁরা ভুলে যান ‘ঝিল কে উস পার’ ছবিতে তার গাওয়া ‘দো ঘুঁট মুঝে ভি পিলা দে শরাবি’। জয়াপ্রদা বহু বছর সিনেমা ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর অভিনয়েই তো মূর্ত হয়েছে লতার গাওয়া ‘ডফলিওয়ালে ডফলি বাজা’। ছবিটা সে সময় হিট হয়েছিল, নাম ছিল ‘সরগম’।
আবার ‘দিল অপনা প্রীত পরাই’ ছবিটা লোকে এখন ভুলে গিয়েছে। কিন্তু সে ছবিতে লতার গাওয়া ‘আজীব দস্তাঁ হ্যায় ইয়ে’ এখনও বহু মানুষের ফোনে কলার টিউন। এই প্রজন্মের চলচ্চিত্র পরিচালক ফারহান আখতারের ছবি ‘রক অন’-এ এই গান আবার ব্যবহৃত হয় প্রাচী দেশাইয়ের কণ্ঠে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে লতা মঙ্গেশকর এই রকমই। একক ও অনন্য। ছবির ব্যবসা হিট, ফ্লপ অনেক কিছুই হতে পারে। কিন্তু তাঁর গাওয়া গান অবশ্যই জনপ্রিয়তার ঘোড়া ছোটাবে, নিশ্চিত।
এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ রাজ কপূর-নার্গিসের ‘আওয়ারা’ ছবির সেই দৃশ্য। নার্গিস স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছেন। ঠোঁটে গান ‘ঘর আয়া মেরা পরদেসি’। ছবির গল্পে আইনজীবী পৃথ্বীরাজ কপূরের জন্মপরিচয়হীন পুত্র রাজ কপূর তাঁর প্রেমিক। লতার কণ্ঠে নার্গিস তাঁকেই ডাকছেন। রাজ-নার্গিসের কয়েক প্রজন্ম পরে ‘মিস্টার নটবরলাল’। সেখানে অমিতাভ বচ্চনকে উদ্দেশ্য করে রেখা বান্ধবীদের সঙ্গে গাইছেন ‘ও পরদেসিয়া ইয়ে সচ হ্যায় পিয়া’। দুই যুগের তফাত অনেক। নার্গিসের প্রেমের বার্তা ছিল অন্যদের অগোচরে, অবচেতনে। রেখার ক্ষেত্রে প্রকাশ্য বাস্তবে, সখীদের সমক্ষে। ছবির ভাষা ও সমাজে অনেক বদল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দুই যুগকেই অবিচ্ছেদ্য স্পর্শকের মতো ছুঁয়ে আছে লতার কণ্ঠ।
এই সব গান এবং স্মৃতিচারণে লতা মঙ্গেশকরের অনেকটাই এখন জানা। কিন্তু জানা যায় না কেন তিনি শিক্ষকতায় আসেননি। সে কি নিছক রেকর্ডিংয়ের ব্যস্ততা, না শৈলী হস্তান্তরের ভয়? এমন গায়কির নিজের হাতে গড়ে নেওয়া উত্তরসাধনা থাকবে না?
আর বাঙালি হিসেবে খেদ তো থেকেই যায়। কেন তাঁর গলায় থাকল মাত্র দুশোটির মতো বাংলা গান? এ সংখ্যা কি বাড়ানো যেত না? তাঁর গলায় রবীন্দ্রনাথের গানের একটি গোটা এল পি থাকা কি একান্তই অসম্ভব ছিল? রবীন্দ্রমুখী হয়েছিলেন হেমন্তবাবুর আগ্রহে। বাংলা জানতেন জোরদার। ভাবেও ছিলেন তদ্গত, নইলে ‘মধুগন্ধেভরা’ বা ‘শাওন গগনে ঘোর ঘোনঘটা’ এত ভাল বললেন কী ভাবে? ‘ভানুসিংহের পদাবলী’র গানগুলি নিয়েই তো হতে পারত একটি লং প্লেয়িং। ওঁর ঠাকুরঘরে শ্রীরামকৃষ্ণ-স্বামী বিবেকানন্দের পাশাপাশি শোভা পেত রবীন্দ্রনাথের ফোটোগ্রাফ।
এই প্রেমভক্তিকে আরও কিছু গানে নিয়ে আসা যেত বলেই মনে হয়। আসলে সর্বভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক নানাবিধ সুরেলা আমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে প্রায় পঁচাত্তর বছরের কর্মময় জীবনও ছোট ঠেকে। এই সময়ের সঙ্গীতের শ্রোতারা ভাগ্যবান, একটি সাঙ্গীতিক মহাজীবনের ক্রমারোহণের সাক্ষী থাকলেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy